বৈশাখী মেলা
বৈশাখী মেলা | |
---|---|
পালনকারী | বাঙালি এবং (বাংলাদেশি প্রবাসী) |
ধরন | বাঙালি এবং বাংলাদেশি প্রবাসীদের উদযাপিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | বাংলা নববর্ষ |
বৈশাখী মেলা বা বৈশাখের মেলা হচ্ছে একটি বাঙালি উৎসব মেলা, যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে আয়োজিত হয়। এটি একটি সার্বজনীন উৎসব, যা বর্তমানে বাংলাদেশের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্তৃক প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের সাথে আয়োজন করা হয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]পন্ডিতেরা মনে করেন মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে হিজরি, চন্দ্রাসন ও ইংরেজি সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় বলে জানা যায়। নতুন এ সনটি প্রথমে 'ফসলি সন' নামে পরিচিত থাকলেও বঙ্গাব্দ হিসেবেই তা পরিচিতি পায়। বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবরের সময় থেকে পালন করা হত। ঐ সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো এ উপলক্ষে। পরবর্তী সময়ে বৈশাখ উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন করা হতো, সে মেলাকে ‘বৈশাখী মেলা’ নামে নামকরণ করা হয়।[১]
লন্ডনে বৈশাখী মেলার ইতিহাস
[সম্পাদনা]বৈশাখী মেলা লন্ডনের ব্রিক লেন এ আয়োজিত করার মাধ্যমে, যা বাংলাদেশের বাহিরে সবচেয়ে বেশি বাঙালি জনতাপূর্ণ স্থান। এটি বাংলা নববর্ষ পালনের একটি উৎসব এবং ১৯৯৭ সাল থেকে ব্রিটিশ বাংলাদেশ সম্পদায় কর্তৃক পালিত হয়ে আসছে। বাংলায় এই অনুষ্ঠানের মূল ভিত্তি পহেলা বৈশাখ। লন্ডনে এই উৎনবটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আয়োজন করা হয়। আগে এটি প্রবাসী বাংলাদেশিরা আয়োজন করত, তবে বর্তমানে তা বৈশাখী মেলা ট্রাস্ট লিমিটেড, একটি অলাভজনক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়।
বৈশাখী মেলা একটি বিরল উৎসব, যা প্রজন্মব্যাপী বাংলাদেশি মানুষেরা বাঙালি নববর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্যে তৈরি করে। বৈশাখী মেলার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মঞ্চ পরিকল্পণা, গান এবং নাচ প্রদর্শনসহ বিভিন্ন বৃত্তিমূলক এবং উদ্ভাবনশীল ভাব আবিস্কার এবং উপস্থাপনের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের সময় এটি বাংলাদেশি প্রবাশিদের আরও সৃষ্টিশীল হতে সহায়তা করে। এটি পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসকারী বাঙালিদের নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি উপস্থাপন করে ও তাদের অংশগ্রহণে উৎসাহ দিয়ে এবং সেখানে বিদ্যমান বাঙালির উপস্থিতির পরিচয় দিয়ে এটি সম্প্রদায়ের বিনোদন ছাড়াও তাদের স্বীকৃতি পেতে উদ্যাপন করা হয়। এটি তরুণদের আগ্রহ এবং পেশাদার শিল্পীদের গান এবং নাচ উপস্থাপনের দক্ষতা এবং সুযোগ প্রদান করে।
পূর্বে বাংলা টিভি ছিল এই উৎসবের প্রধান সম্প্রচারক। ২০০৫ সাল থেকে চ্যানেল এস এই অধিকার তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রতিজ্ঞার কারণে (তাদের স্লোগান সম্প্রদায়ের কাছে কার্যকরী) অর্জন করে। তারা সম্প্রদায়ের প্রধান স্পন্সরদের কাছে সমর্থন লাভ করছে।
প্যারেডের পর একটি গানের উৎসব শুরু হয়, যেখানে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট শিল্পীরা নাচ প্রদর্শনকারী এবং অভিনয় শিল্পীদের সাথে মঞ্চ প্রদর্শনী করেন। চারটি পর্যায়ে গান, নাট্যমঞ্চ (যার মধ্যে সিলেটি নাটক) এবং সারা দিন ধরে নাচ প্রদর্শনী চলতে থাকে। গানের মধ্যে থাকে বাংলা গান যেমন, ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান বা লোকসঙ্গিত[২], আধূনিক সঙ্গিত, সমসাময়িক সংগীত এবং বাংলা এবং সিলেটি ভাষার রেপ সঙ্গিত।
বিবরণ
[সম্পাদনা]এটি খুবই আনন্দমুখর উৎসব। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত ইত্যাদি পণ্য এই মেলায় পাওয়া যায়। শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রীসহ এই মেলায় তাদের জন্য আরো অনেক বিশেষ সামগ্রী পাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য ও মিষ্টান্ন যেমন: চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ইত্যাদি এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ।
এ মেলায় বিনোদনের কোনো অভাব থাকে না। বিনোদনের ক্ষেত্রে এ মেলায় বাঙালি সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এখানে বাঙালি লোকশিল্পীরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি লোকগান এবং লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ ইত্যাদি আখ্যান পরিবেশন করেন। এছাড়া থাকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া থাকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, বায়োস্কোপ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বৈশাখী মেলা উদ্যাপন
[সম্পাদনা]বাংলাদেশে বৈশাখী মেলা আয়োজনের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হচ্ছে: নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়ি ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া ও মুজিবনগর এলাকা।
ঢাকার নিকটবর্তী শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা এবং রাজনগর মেলা উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরের ফুলতলী, রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী মেলাও এখন ব্যাপক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে আয়োজন
[সম্পাদনা]বৈশাখী মেলা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেট্স এর ব্রিক লেন -এর এলাকা জুড়ে আয়োজিত হয়। এই মেলাটি ব্রিক লেন থেকে বেথন্যাল গ্রিন এর ওয়েভেন ফিল্ডস এবং এলেন গার্ডেনস এর এলাকা জুড়ে আয়োজিত হয়। এই আয়োজনটিবিাংলা নববর্ষের একটি অনুষ্ঠান হিসেবে সাঙ্গিতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচির সাথে পালিত হয়। এটি ইরোপের সবচেয়ে লম্বা সময় চলা এশীয় আয়োজন এবং বাংলাদেশের বাহিরে সবচেয়ে বড় বাঙালি উৎসব। নটিং হিল কার্নিভাল এর পর এটি যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ পথ উৎসব যেখানে সারা দেশ থেকে ৮০,০০০ মানুষের বেশি অংশগ্রহণ করে। যদিও বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাংলা নববর্ষ এপ্রিল মাসের ১৪/১৫ তারিখে (বঙ্গাব্দ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে পহেলা বৈশাখ) হয়ে থাকে কিন্তু এপ্রিল মাসের বৃষ্টির উচ্চ আশঙ্কার কারণে এই মেলা মে মাসের দ্বিতীয় সাপ্তাহিক ছুটিতে কোনো রবিবার আয়োজিত হয়।
লন্ডনে অনুষ্ঠানসুচি
[সম্পাদনা]সকাল ১২ টায় ব্রিক লেন থেকে শুরু হয়ে ওয়েভেন ফিল্ডস পর্যন্ত পদযাত্রা চলে। একে বলা হয় গ্রান্ড প্যারেড এবং এতে নারী এবং শিশুরা তাদের রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং মুখোশ পরিধান করে থাকে। সেখানে গায়ক, ঢাকি,নাচ প্রদর্শনকারী এবং সম্প্রদায়ের নেতাগণ উপস্থিত থাকেন। ২০০৮ সালের মেলায় একজন মহান সম্রাট, ভারত উপ-মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী জমিদার, একটি বাঘ, চাকার উপর একটি হাতি এবং একটি রিকশা আরও অনেক প্রতীকের সাথে প্যারেডটি অগ্রসর হয়।[৩] ব্রিক লেন, যেখানে বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রচুন ভারতীয় রেস্টুরেন্ট রয়েছে তাদের কর্তৃক রাস্তায় উপস্থিত হওয়া মানুষদের বাংলাদের ঐতিহ্যবকাহী খাদ্যের সাথে কারি খেতে দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাধুনিগণ রান্না করে।[৪]
২০০৯: টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিল
[সম্পাদনা]২০০৯ সাল থেকে এই মেলার ব্যবস্থাপনা পরিকল্পণার দীর্ঘ মেয়াদী উদ্যোগ নেয় টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিল। তারা এই মেলাকে "বাংলাটাউন ব্রিক লেন এ অনুষ্ঠিত একটি বৈশাখী মেলা (a Boishakhi Mela in Banglatown Brick Lane)" বলে অভিহিত করে।[৫] ২০০৯ সালে মেলাটি মে মাসের ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে প্রায় ৯৫,০০০ পর্যন্ত মানুষ উপস্থিত। সেটি ছিল বড় একটি সফলতা। সেখানে ২৫০ জন বিদ্যালয় ছাত্র, নৃত্যশীল্পী গায়ক এবং বিভিন্ন সমপ্রদায় একটি বাঙালি বাঘ এবং বাঙালি রানির (একটি ময়ূর আকৃতির মূর্তি) সাথে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। মেলাটিতে প্রায় ২০০ টি বাঙালি মশলা, খাদ্য এবং পানীয় এর দোকান ছিল। এখানে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পী যেমন, মমতাজ, কাজল দেওয়ান, নুকলি কুমার উপস্থিত ছিলেন।[৬] নবীন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন মামজি স্ট্রেঞ্জার, যিনি লন্ডনের পূর্বাঞ্চলের একজন বিশিষ্ট এমসি এবং ডিজি ছিলেন। অন্যান্য সঙ্গিতশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন লুসি রহমান এবং অন্যরা। মঞ্চ পরিচালনা করেছিলেন আদিল রায়, সওকত হাশমি, কেন্ডি ম্যান এবং আরও অনেকে। অনুষ্ঠানটির প্রধান স্পন্সর ছিল বিবিসি এশিয়ান নেটওয়ার্ক এবং চ্যানেল এস।[৭]
চিত্রশালা
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ সিকদার মনজিলুর রহমান (৩১ মার্চ ২০১৮)। "বাঙালির বৈশাখী মেলা"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০২০।
- ↑ "London Events: Boishakhi Mela"। LondonTown.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-১০।
- ↑ "Boishakhi Mela"। Your London। মে ২০০৮। ২০১২-১২-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-১০।
- ↑ "Banglatown spices it up for New Year at the Boishakhi Mela"। The Londoner। মে ২০০৮। ২০০৭-০৯-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-১০।
- ↑ May 2009 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে Londontown.com. Retrieved on 2009-04-29.
- ↑ Tower Hamlets Council proudly presents a Boishakhi Mela in Banglatown Brick Lane ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ মে ২০০৯ তারিখে Tower Hamlets. Retrieved on 2009-04-29.
- ↑ BBC – Asian Network – Events – Boishakhi Mela ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে BBC Asian Network (BBC). Retrieved on 2011-05-07.
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- Baishakhi
- The Baishakhi Mela ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৭ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে. BBC. 2005-06-06.
- Banglatown spices it up for New Year at the Baishakhi Mela. The Londoner. May 2006.
- Baishakhi Mela. Your London. May 2007.
- Baishakhi Mela: Bengali New Year. The London Paper. 2007-05-10.
- Magic in the rain. Tower Hamlets. 2007-05-21.