বিষয়বস্তুতে চলুন

বর্জন (আখ্যানকৌশল)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বর্জন (Ellipsis) বলতে একটি আখ্যান কৌশলকে বোঝায়, যেখানে কাহিনীর ঘটনাক্রম থেকে অংশবিশেষ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পাঠক নিজেই কাহিনী বা আখ্যানের ফাঁকফোকর ভরাট করে নিতে পারে। সাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও এই কৌশলের ব্যবহার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোনও ঘটনার আগে ও পরে কী ঘটেছে, তা প্রদর্শন করার মাধ্যমে ঐ ঘটনাটির প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়। সিংহভাগ চলচ্চিত্রেই আখ্যান বা কাহিনীর জন্য অপ্রয়োজনীয় ঘটনাবলীকে বর্জন করা হয়; এগুলিকে সুবিধাজনক বর্জন বলে। তবে এর বাইরেও কাহিনীকে এগিয়ে নেবার জন্যও কৌশলগতভাবে বর্জন প্রয়োগ করা হতে পারে।

বর্ণনা[সম্পাদনা]

একটি আখ্যান বা কাহিনীতে বর্জন গল্পের একাংশ বাদ দিয়ে দেয়। এর দ্বারা সময় বাঁচানো হতে পারে, কিংবা পাঠককে নিজেই কল্পনার সাহায্যে গল্পের ফাঁকফোকর ভরাট করার সামর্থ্য প্রদানকারী এক ধরনের শৈলীগত পদ্ধতি হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতে পারে। [১] ইংরেজি সাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-র আধুনিকতাবাদী সাহিত্যকর্মগুলিতে বর্জনের ব্যবহার দেখা যায়, যার পদ্ধতিটিকে হিমশৈল তত্ত্ব নাম দেওয়া হয়েছে।

আরেক ইংরেজ ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলফের টু দ্য লাইটহাউজ উপন্যাসটিতে সাহিত্যিক বর্জনের একাধিক বিখ্যাত উদাহরণ আছে। উপন্যাসের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মাঝখানে বহু বছর অতিবাহিত হয় এবং সে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে যায়। পাঠককে উপন্যাসের চরিত্রগুলির মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে ঐ সময়ে কী ঘটেছে, তা অনুমান করে নিতে হয়। আরেকটি দৃষ্টান্ত হল এডিথ হোয়ার্টন রচিত দি এজ অভ ইনোসেন্স[২]

বর্জন চলচ্চিত্রের কাহিনীতে ব্যবহৃত একটি অতিসাধারণ পদ্ধতি, যেখানে গল্পকথনে অপ্রয়োজনীয় নড়নচড়ন ও ঘটনাকে সম্পাদনার সময় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যেমন কোনও চরিত্রের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গোটা কক্ষ হেঁটে অতিক্রম করে দরজা খোলার ঘটনাটি দেখানোর কোনও প্রয়োজন নেই। এর পরিবর্তে চরিত্রটিকে প্রথম উঠে দাঁড়াতে দেখানো হয়, এরপর তার কক্ষ অতিক্রম করা না দেখিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখানো হয়, সাধারণত অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে। কাহিনীর যুক্তিসঙ্গতি দর্শককে এই বর্জনটিকে অগ্রাহ্য করতে সাহায্য করে। স্ট্যানলি কুবরিকের চলচ্চিত্র ২০০১: আ স্পেস অডিসি-র (১৯৬৮) শুরুতে এক বিশাল বর্জন প্রয়োগ করা হয়, যেখানে মানুষের তৈরি প্রথম প্রযুক্তি (একট হাড়ের তৈরি গদা) থেকে শুরু করে ২০০১ সালে মহাকাশে উড়ন্ত একটি নভোযানকে দেখানো হয়; মাঝখানের কোনও প্রযুক্তি আর দেখানো হয় না।[৩] তবে এই দৃষ্টান্তটিতে বর্জনের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের পরিভাষায় মিলকারক কর্তন (match cut) কৌশলটিকেও ব্যবহার করা হয়, কেননা হাড়ের গদা ও মহাকাশযান দুইটিই আকৃতিতে একই রকম এবং দুইটির সাথেই মানুষের গভীর নৃতাত্ত্বিক সংযোগ আছে। দ্য মেসেজ চলচ্চিত্রটিতে ইসলাম ধর্মের শুরুর দিকের বছরগুলিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ইসলামের নবী মুহাম্মাদের চিত্রায়নের ব্যাপারে কিছু মুসলমানদের স্পর্শকাতরতাকে সম্মান দেখিয়ে নবী ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে চলচ্চিত্রে দেখানো হয়নি। মুহাম্মাদের উপস্থিতিকে অন্য চরিত্রগুলির মুখ দিয়ে তাঁর কথা পুনরাবৃত্ত করিয়ে দেখানো হয়, কিংবা তাঁর কৃত কাজগুলিকে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়।

জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক ইয়াসুজিরো ওজু-ও বর্জনের ব্যবহারের জন্য সুপরিচিত। তাঁর কাহিনী থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ঘটনাবলী বর্জন করে দেওয়া হয়, এবং পরবর্তী কথোপকথন থেকে দর্শক-শ্রোতাকে বের করে নিতে হয় কী হয়েছে। যেমন ১৯৪৯ সালে বসন্তের শেষভাগ চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয় যে নোরিকো নামক চরিত্রটি কিমোনো পড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, আর ঠিক তার পরের দৃশ্যেই দেখানো হয় যে সোমিয়া সাহেব বিয়ের পরে পানশালাতে বসে আছে। অর্থাৎ বিয়ের ঘটনাটিকে বর্জন করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Australian National University। "A Basic Glossary of Film Terms"। Springhurst.org। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০১৩ 
  2. Tomsyek, Sarah। "Narrative Gaps in Edith Wharton's The Age of Innocence"। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০১৩ 
  3. See Alexander Walker's book Stanley Kubrick, Director, pp. 181–182. This is the 2000 edition. The 1971 edition is titled Stanley Kubrick Directs.