বিষয়বস্তুতে চলুন

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী ও তাদের সংরক্ষণ

(Important Wild life and their Conservation)

বহুযুগ আগে মানুষ যখন সভ্যতার আলো দেখেনি সে সময় অরণ্যের জীবজন্তুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে মানুষও বাস করতো বনে জঙ্গলে, গাছের ডালে বা কোটরে অথবা পর্বত গুহায়। তারপর যতো দিন যেতে থাকে, মানুষ বিভিন্ন প্রাণীকে আপন বশে আনার কাজে ততো বেশী সচেষ্ট হর এবং সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পশু জগতের উপর মানুষের কর্তৃত্বও ক্রমাগত বেড়ে চলে। একদিকে বন্যপশুকে বশ মানানো অপরদিকে নির্বিচারে পোষ-না-মানা পশু শিকার এই দুইয়ের প্রভাবে বন্ধু- প্রাণীর সংখ্যা কমতে থাকে। এর উপর আবার যখন আধুনিক সহর সভ্যতার পত্তন হ'ল তখন থেকে সহর বা শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্যে এবং কাঠ সংগ্রহের কারণে ক্রমাগত বনভূমির সংকোচন শুরু হয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসেবে বাস্তুচ্যুত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী কয়েকটি হয় পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে অথবা অবলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। সু-উচ্চ হিমালয়ের কোলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে আছে বিশাল গভীর অরণ্য। এছাড়া আসাম উপত্যকার, পশ্চিম বাংলার সুন্দরবনে, বিহারের সাঁওতাল পরগণা জেলায়, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে এবং দাক্ষিণাতোর মালভূমি অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কতো না ছোট- বড়ো অরণ্য। এই সব অরণ্য চিরকাল বিভিন্ন রকম বন্যজন্তুকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। কোথাও আছে হাতী, গণ্ডার, বাঘ, সিংহ বাইসন প্রভৃতি বিশালদেহী জন্তু আবার কোথাও বা হরিণ, ভালুক, শূকর, বানর প্রভৃতির প্রাধান্য। শুধু স্তন্যপায়ীই নয় পাইথন, গোসাপ, কুমীর, প্রভৃতি সরীসৃপ আর অসংখ্য বিভিন্ন জাতের বন্য পাখিও ভারতের প্রাণী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

গত শতকের গোড়ার দিকে এইসব বন্যপ্রাণীর যেমন প্রাচুর্য ছিল এখন আর তেমনটি নেই। একদিকে অরণ্যের সংকোচন অন্যদিকে বন্যজন্তু শিকারের আগ্রহই আছে বন্যজন্তুর সংখ্যা হ্রাসের মূলে। জমিদার, নবাব বা ঐ জাতীয় উচ্চকূলের মানুষের কাছে বন্যপ্রাণী শিকারের ব্যাপারটি ছিল অবসর বিনোদন বা আমোদ প্রমোদের অঙ্গ। আবার মাংস, চামড়া, পালক, প্রভৃতির লোভে সাধারণ মানুষও পশুপাখী শিকারে অংশ নিয়েছে। গণ্ডারের খড়্গ বা শৃঙ্গ থেকে ওষুধ তৈরী হয় বলে ঐ খড়্গ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নির্বিচারে গণ্ডার হত্যা করা হয়েছে এবং মূল্যবান ব্যাঘ্রচর্ম সংগ্রহ ছিল বাঘ শিকারের উদ্দেশ্য। এরই ফলে আজ অনেক বন্যজন্তুর মতো গণ্ডার বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বা অরণ্যের গৌরব ব্যাঘ্ররাজের মোট সংখ্যাও আশঙ্কাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এই অবস্থায় বন্ধু প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে দেখা দিচ্ছে ব'লেই বিভিন্ন ভাবে এই বিষয়ে উয়োগ আয়োজন শুরু হ'য়েছে। আশার কথা দেশের সরকার এদিকে নজর দিয়েছেন ও প্রয়োজনীয় বাবস্থা অবলম্বনে তৎপর হয়েছেন।[১]

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন[সম্পাদনা]

বন্যপ্রাণী অধিকাংশই হিংস্র ও মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এদের ধ্বংস সাধনই তো আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে ব্যাপারটি তা নয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে বিভিন্ন দিক দিয়ে আমাদের আপন স্বার্থও জড়িত, যেমন-

(১) রয়াল বেঙ্গল টাইগার, এক শৃঙ্গী কালো গণ্ডার, লালমুখো হনুমান প্রভৃতি যে সব প্রাণী ভারতের বাইরে কোথাও পাওয়া যায় না, বিদেশে সেগুলির চাহিদা থাকায় রপ্তানীর মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আছে।

(২) বনের মাংসাশী প্রাণীরা শাকাশী প্রাণীদের শিকার করে উদরপূর্তি করে, ফলে শাকাশী প্রাণীরা বিপুল হারে বাড়তে পায় না। অরণ্যের বৃদ্ধি বা বিস্তারের জন্য এটি প্রয়োজন কেননা শাকাশী প্রাণীরা কচি চারাগাছ খেয়ে শেষ করে এবং এইভাবে বনভূমির বিস্তার ব্যাহত হয়। বনভূমি শুধু বৃক্ষ- সম্পদের জন্য মূল্যবান নয়, মেঘ আকর্ষণ করে এবং আবহাওয়া শীতল রেখে তা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজেও সহায়তা করে।

(৩) বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক 'ইকোসিস্টেম' (Eco-System) এর অংশ বিশেষ, অর্থাৎ জীবজগতের পারস্পরিক লেনদেন বা দেনা পাওনার স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে এদেরও ভূমিকা আছে। বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তিতে এই সম্পর্কের হানি ঘটে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য (Nature's balance) নষ্ট হয়। ব্যাপারটি মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

প্রাকৃতিক কারণে বা স্বাভাবিক পথে যখন বিশেষ বিশেষ প্রাণী-প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় থাকে না। কিন্তু সভ্যমানুষের হস্তক্ষেপে যখন এই রকম বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেয় তখন তা ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতে পাবে। অবন্ত সবক্ষেত্রেই সরকারী সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার উপর এর সাফল্য নির্ভরশীল। ব্যবস্থাগুলি এই-

(১) আইনের সাহায্যে বন্যপ্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

(২) বড় প্রাণীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণের জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা অভয়ারণ্য নির্মাণ করা।

(৩) কোনো বিশেষ প্রজাতিভুক্ত প্রাণীগুলি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে সেগুলিকে একত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

(৪) কারখানা বা নগরী স্থাপনের প্রয়োজনে বনভূমি উচ্ছেদের পূর্বে সেই বনভূমির বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষিত অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা।

(৫) সরকারী প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে বহুপ্রাণীর প্রতি মানুষের মনকে সহানুভূতিশীল করে তোলা। অর্থাৎ বন্দুকের পরিবর্তে ক্যামেরা দিয়ে বন্ধু পশু পাখীকে 'শিকার' করায় উৎসাহ প্রদান করা।[২]

ভারতে ব্যাঘ্র ও গণ্ডার সংরক্ষণ ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশালদেহী একশৃঙ্গী গণ্ডার (Great Indian Rhinoceros) আর প্রখ্যাত রয়াল বেঙ্গল টাইগার (Royal Bengal Tiger) নামে দুর্ধর্ষ বাঘ ভারতের গর্ব। পৃথিবীর অন্যত্র এই দুটির কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। ১৯৭২ সালে বাঘকে ভারতের জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

দুঃখের বিষয় দীর্ঘ সময় যাবৎ এই রকম মূল্যবান প্রাণীর সংরক্ষণের প্রতি নজর দেওয়া হয়নি। বন্যপ্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করে আইন চালু হয় বটে, তবে সেই আইন ঠিকমতো মেনে চলা হচ্ছে কিনা সেদিকে কঠোর লক্ষ্য না থাকায় ক্রমাগত আইন ভাঙ্গা হতে থাকে। বাঘের চামড়া এবং গণ্ডারের চামড়া, মাংস ও খড়্গের লোভেই সাধারণত এদের শিকার করা হতো। আবার শুধু শিকারের উদ্দেশ্যেই নয়, মধু সংগ্রহ, কাঠ সংগ্রহ প্রভৃতি অন্যান্য প্রয়োজনে মানুষ ক্রমাগত বনভূমিতে প্রবেশ করায় তাতেও এদের শান্তি ও স্বস্তি বিঘ্নিত হয়। বিশেষত বাঘ স্বভাবে এমনই লাজুক যে ত্রিসীমানায় মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র এরা প্রজনন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকে (যে কারণে চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘকে দিয়ে শাবক উৎপাদন এক দুরূহ কাজ)। এইসব কারণে ভারতে গণ্ডার আর বাঘের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম সরকারীভাবে বাঘের সংখ্যা গণনার প্রচেষ্টা হয় এবং তাতেই এদের সংখ্যা হ্রাসের শোচনীয় চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভের জন্যে ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার 'ব্যাঘ্র প্রকল্প' (Project Tiger) প্রবর্তন করেন, যাতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল সমূহে বাঘের রক্ষণাবেক্ষণ ও বংশ বৃদ্ধির জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অবশ্য শুধু বাঘই নয়, বিলুপ্তির-মুখে-দাঁড়ানো গণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণের জন্যেও সরকার যত্নবান হন। বিশ্ব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার ভহবিল (World Wild Life Fund) থেকেও এই কাজের জন্যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়।

বর্তমানে ভারতের যে সব অঞ্চলে অভয়ারণ্য বা সংরক্ষিত বনাঞ্চল (Reserve Forest) সৃষ্টি করা হয়েছে তার মধ্যে আছে-

(১) উত্তর প্রদেশের নৈনিতাল জেলার করবেট ন্যাশনাল পার্ক।

(২) মধ্যপ্রদেশের কানহা ন্যাশনাল পার্ক।

(৩) রাজস্থানের রনথভোর পার্ক।

(৪) মহারাষ্ট্রের মেলঘাট অরণ্য।

(৫) কর্ণাটকের বন্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক।

(৬) বিহারের পালামৌ অভয়ারণ্য।

(৭) উড়িষ্যার সিমলিপাল পার্ক।

(৮) আসামের মানস এবং কাজিরাঙ্গার অভয়ারণ্য।

(১) পশ্চিম বাংলার সুন্দরবন ও জলপাইগুড়ি জেলার জলদাপাড়া অভয়ারণ্য।

এগুলির মধ্যে মাত্র আসামের কাজিরাঙ্গা ও মানস এবং জলপাইগুড়ির জলদা-পাড়া অভয়ারণ্যে গণ্ডার প্রতিপালনের ব্যবস্থা হয়েছে ও বাকীগুলির মূল লক্ষ্য বাঘ সংরক্ষণ। অতি সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে হিমালয়ের পাদদেশে চিতাবান ও রান্থি- উপত্যকায় গণ্ডার সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। গণ্ডার ও বাঘ শিকার এখন দণ্ডনীয় অপরাধ এবং সরকার এই অপরাধ দমনে বিশেষ তৎপর হয়েছেন। জনসাধারণের মনেও পরিবর্তন ঘটেছে এবং বন্যপ্রাণীকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখায় ক্রমশ তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

এইসব ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে বর্তমানে বাঘ ও গণ্ডারের দ্রুত সংখ্যা হ্রাস ব্যাহত হয়েছে বলা চলে। এমন কি আগের তুলনায় যে এগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে তেমন প্রমাণও পাওয়া গেছে।[৩]

তথ্য সূত্র[সম্পাদনা]

  1. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি=উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান
  2. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি=উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান
  3. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি= উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান