বিষয়বস্তুতে চলুন

বনু নাদির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বনু নাদির
بني النضير
আরবীকৃত ইস্রায়েলীয়রা
নৃগোষ্ঠীইহুদি, আরবীয়
নিসবাআল-নাদিরি
অবস্থানখায়বার, আরব
এর বংশআল-নাদির
ধর্মইহুদিবাদ
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে আরব উপদ্বীপের মানচিত্র, যেখানে বিভিন্ন আরব গোত্র এবং তাদের বসতির স্থান দেখানো হয়েছে। লাখ্‌মিদরা (হলুদ) সাসানীয় সাম্রাজ্যের অনুগত আরব রাজতন্ত্র গঠন করে এবং ঘাসানিদরা (লাল) রোমান সাম্রাজ্যের অনুগত আরব রাজতন্ত্র ছিল। এটি ব্রিটিশ পণ্ডিত হ্যারল্ড ডিকসনের তৈরি একটি মানচিত্র, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রকাশিত হয়, এবং এতে পশ্চিম এশিয়ার আরব গোত্রগুলোর অবস্থান দেখানো হয়েছে।

বনু নাদির (আরবি: بَنُو ٱلنَّضِير, হিব্রু ভাষায়: בני נדיר‎) ছিল একটি ইহুদি আরব গোত্র, যারা উত্তর আরবের মদিনার ওয়াহিতে (oasis) ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বসবাস করত। ধারণা করা হয়, তারা মুহাম্মদের হিজরতের পর গঠিত মদিনার সনদের অংশ ছিল।[] উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর বনু নাদিরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়, যা পরবর্তীতে দ্বন্দ্বে রূপ নেয় এবং গোত্রটির বহিষ্কারের মাধ্যমে তা শেষ হয়।

পরবর্তীতে, বনু নাদির কুরাইশদের সঙ্গে মিলে খন্দকের যুদ্ধ সংগঠনের পরিকল্পনা করে এবং পরে খায়বারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।[]

বংশধারা

[সম্পাদনা]

আরব ঐতিহাসিক আল-সামআনী-এর মতে, বনু নাদির গোত্রের সদস্যরা ছিলেন এক ইহুদি ব্যক্তি আল-নাদিরের বংশধর, যিনি জুডিয়া থেকে আরবে হিজরত করেন।[] ধারণা করা হয়, "আল-নাদির" নামটি হিব্রু "হা-নাজির" নাম থেকে উদ্ভূত। অন্যদিকে আরেক আরব ঐতিহাসিক ইবন হাজম দাবি করেন, বনু নাদির গোত্র সরাসরি বাইবেলীয় হারুন নবীর পিতৃতান্ত্রিক বংশধর।[]

প্রারম্ভিক ইতিহাস

[সম্পাদনা]

মদিনায় গোত্র হিসেবে বনু নাদির ছাড়াও ছিল দুটি বড় আরব গোত্র: বনু আওসবনু খাযরাজ। এছাড়া সেখানে আরও দুটি ইহুদি আরব গোত্র ছিল: বনু কুরাইযাবনু কাইনুকা

মদিনার অন্যান্য ইহুদিদের মতো বনু নাদিরও আরবি নাম ব্যবহার করত, তবে তারা একটি স্বতন্ত্র ইহুদি আরবি উপভাষায় কথা বলত। তাদের জীবিকা ছিল কৃষি, সুদখোরি, এবং অস্ত্র ও গহনার বাণিজ্য। তারা মক্কার আরব বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করত। তাদের দুর্গগুলো মদিনা শহরের দক্ষিণে আধা দিনের দূরত্বে অবস্থিত ছিল।[] বনু নাদির একটি ধনী গোত্র ছিল এবং তারা মদিনার সবচেয়ে উর্বর জমিতে বসবাস করত।[]

গোত্রীয় যুদ্ধ

[সম্পাদনা]

৬১৭ সালে বু'আথের যুদ্ধে, যখন বনু আওসবনু খাযরাজ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তখন তিনটি ইহুদি গোত্র দুইপক্ষের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং উভয় পক্ষকেই অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে। কাব ইবন আল-আশরাফহুয়াইয়্য ইবন আখতাব-এর নেতৃত্বে বনু নাদির ও বনু কুরাইযা আওসদের পক্ষে যুদ্ধ করে,[] আর বনু কাইনুকা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। দীর্ঘ ও কঠিন লড়াইয়ের পর খাযরাজরা পরাজিত হয়।[]

মুহাম্মদের আগমন

[সম্পাদনা]

মুহাম্মদ ৬২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) হিজরত করেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার সহচরগণ, যাদের স্থানীয় অধিবাসীরা আশ্রয় দেন। এদেরই বলা হয় আনসার। আগমনের পর মুহাম্মদ প্রথমে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং আবু আইয়ুব আল-আনসারীর বাড়িতে অবস্থান নেন।[] এরপর তিনি মুসলিম, আনসার ও মদিনার বিভিন্ন ইহুদি গোত্রের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন, যেটি মদিনার সনদ নামে পরিচিত।[] এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল নগরের প্রশাসনিক ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ। এর শর্তগুলির মধ্যে ছিল কুরাইশদের বর্জন, তাদের কোনরূপ সহায়তা না করা, তৃতীয় পক্ষ আক্রমণ করলে একে অপরকে সাহায্য করা, এবং মদিনায় বহিরাগত আক্রমণ হলে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা।[১০][১১][১২]

বনু কাইনুকার বহিষ্কারে প্রতিক্রিয়া

[সম্পাদনা]

মুহাম্মদ ও বনু কাইনুকার মধ্যে সংঘাতের পর, গোত্রটি অবরুদ্ধ হয় ও মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়।[১৩][১৪] বনু নাদির এতে জড়িত হয়নি এবং এই ঘটনাকে ইহুদি গোত্রগুলোর আরেকটি অভ্যন্তরীণ বিরোধ হিসেবে বিবেচনা করে।[১৫]

কাব ইবন আল-আশরাফের হত্যাকাণ্ড

[সম্পাদনা]

বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের পর, বনু নাদিরের নেতাদের একজন কাব ইবন আল-আশরাফ কুরাইশদের কাছে যান, বদরে নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করতে এবং কুরাইশদেরকে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উস্কে দিতে। মুহাম্মদ এ সম্পর্কে বলেছিলেন: “সে (কাব) প্রকাশ্যে আমাদের প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে, এবং মুশরিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাদের একত্রিত করেছে।”[১৬]

এটি মদিনার সনদের পরিপন্থী ছিল, যেখানে কাবের নেতৃত্বাধীন বনু নাদির ছিল স্বাক্ষরকারী। সনদ অনুযায়ী, কুরাইশদের মতো মক্কার গোত্রের প্রতি কোনো সহায়তা দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিছু সূত্র মতে, মক্কা সফরের সময় কাব ইবন আল-আশরাফ আবু সুফিয়ানের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, যাতে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কুরাইশ ও ইহুদিদের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১৭]

অন্য ইতিহাসবিদদের মতে, কাব ইবন আল-আশরাফ একজন প্রতিভাবান কবিও ছিলেন। তিনি বদরে নিহত কুরাইশ নেতাদের জন্য শোকসন্তপ্ত কবিতা রচনা করেন। পরবর্তীতে তিনি মুসলিম নারীদের নিয়ে অশ্লীল কবিতাও লিখেছিলেন, যা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ছিল।[১৮]

তার এই কবিতা বহু মানুষকে প্রভাবিত করে।[১৯] এই কাজও মদিনার সনদের পরিপন্থী ছিল, যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্যতা বিশ্বাসঘাতকতা থেকে রক্ষা করে এবং এই দলিল কোনো অপরাধী বা অন্যায়কারীর পক্ষে ব্যবহৃত হবে না।

মুহাম্মদ কাব ইবন আল-আশরাফকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। মুহাম্মদ ইবন মাসলামা স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আরও চারজনকে সঙ্গে নেন। মুহাম্মদ ইবন মাসলামা ও তার দল মুহাম্মদের বিরোধিতাকারী সেজে কাবের কাছে যান এবং এক চাঁদনি রাতে তাকে তার দুর্গ থেকে বাইরে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।[১৮] কাব প্রবল প্রতিরোধ করলেও তারা তাকে হত্যা করতে সক্ষম হন।[২০]

কিছু বিশ্লেষকের মতে, এই কাজটি আরব সমাজে সম্মান রক্ষার ঐতিহ্যগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে।[২১]

এই হত্যাকাণ্ডে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ইবন ইসহাক লিখেছেন: “এমন কোনো ইহুদি ছিল না যে তার প্রাণ নিয়ে আশঙ্কিত ছিল না।”[২২]

মদিনা থেকে বহিষ্কার

[সম্পাদনা]
বনু নাদিরের আত্মসমর্পণ (চিত্র, ১৪শ শতক)

৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদের হাতে মুসলিমদের পরাজয়ের পর, বনু নাদির মুহাম্মদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়।[২৩]

ঐ বছরের জুলাই মাসে, একজন মুসলিম আমর ইবন উমাইয়া আদ-দামরী দ্বারা দুই ব্যক্তি নিহত হলে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বনু আমির গোত্রের সঙ্গে পূর্বের একটি চুক্তি অনুযায়ী বনু নাদির ও মুসলিমদের রক্তপণ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। এই চুক্তির আলোকে মুহাম্মদ বনু নাদিরের নিকট তাদের অংশের রক্তপণের জন্য আবেদন জানান। শুরুতে হুয়াইয়্য ইবন আখতাব ছাড়া অধিকাংশ বনু নাদির সদস্য এই অনুরোধে সম্মত হন। কিন্তু ইবন উবাই হুয়াইয়্যকে গোপনে বার্তা পাঠান যে তিনি কিছু মিত্র বেদুইনের সহায়তায় মুহাম্মদের ওপর হামলা চালাবেন। এর ফলে বনু নাদিররা রক্তপণ প্রদানের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে।[২৪]

এরপর মুহাম্মদ দ্রুত অঞ্চলটি ত্যাগ করেন এবং বনু নাদিরের বিরুদ্ধে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনেন। তিনি জানান যে এই তথ্য তিনি হয় ওহীর মাধ্যমে[২৩] অথবা মুহাম্মদ ইবন মাসলামার মাধ্যমে পেয়েছেন।[২৫]

অন্য সূত্র মতে, বনু নাদির মুহাম্মদকে ধর্মীয় বিতর্কের জন্য তাদের এলাকায় আমন্ত্রণ জানায় এবং তিনি শর্তসাপেক্ষে (তিনজন মাত্র সঙ্গী নিয়ে) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। পথে এক মুসলিম ধর্মান্তরিত বনু নাদির সদস্য মুহাম্মদকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন।[২৫]

মুহাম্মদ এরপর বনু নাদিরকে অবরোধ করেন এবং আদেশ দেন যে তারা ১০ দিনের মধ্যে মদিনা ত্যাগ করে তাদের সম্পদ হস্তান্তর করবে। গোত্রটি প্রথমে এই শর্তে সম্মত হয়। কিন্তু তখন মদিনার কিছু অবিশ্বাসী ব্যক্তি বনু নাদিরকে গোপনে বার্তা পাঠিয়ে জানায়, ‘‘টিকে থাকো, নিজেদের রক্ষা করো; আমরা তোমাদের মুহাম্মদের কাছে সোপর্দ করব না। যদি তোমাদের ওপর আক্রমণ হয়, আমরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, আর যদি তোমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়, আমরা তোমাদের সঙ্গে যাব।”[২৬]

হুয়াইয়্য ইবন আখতাব তখন প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও গোত্রের ভেতরেই মতবিরোধ ছিল। তিনি বনু কুরাইযার সহায়তার আশায় ছিলেন।[] ১৪ দিন অবরোধ চলার পর, যখন প্রতিশ্রুত সহায়তা আসে না এবং মুহাম্মদ তাদের খেজুর গাছ কাটার ও আগুন দেওয়ার নির্দেশ দেন, তখন বনু নাদির আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণের শর্ত অনুযায়ী, তারা কেবল উটের পিঠে বহনযোগ্য জিনিস নিয়ে মদিনা ত্যাগ করতে পারবে, অস্ত্র বাদে।[]

বনু নাদির ৬০০ উটে চড়ে মদিনা ছাড়ে। তারা বাঁশি ও ডফ বাজিয়ে শহর ছাড়ে।[২৩] আল-ওয়াকিদি তাদের বিদায় দৃশ্য বর্ণনা করেন: ‘‘তাদের নারীরা পালকিতে রেশম, মখমল, সূক্ষ্ম লাল ও সবুজ কাপড় পরে ছিল। মানুষ সারি বেঁধে তাদের দেখতে দাঁড়িয়েছিল।”[২৭]

বেশিরভাগ বনু নাদির খায়বারের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্রয় নেয়, এবং কিছু লোক সিরিয়ায় চলে যায়।[] ইবন ইসহাকের মতে, খায়বারে যাওয়া নেতারা ছিলেন সাল্লাম ইবন আবু আল-হুকায়ক, কেনানা ইবন আল-রাবি এবং হুয়াইয়্য ইবন আখতাব। খায়বারে পৌঁছালে স্থানীয় ইহুদিরা তাদের নেতৃত্ব মেনে নেয়।[২৮]

মুহাম্মদ এই অভিযানে লব্ধ জমি তার মুহাজির সঙ্গীদের মধ্যে বণ্টন করেন, যারা তখন পর্যন্ত আনসারদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জমির একটি অংশ নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখেন, যা তাকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলে।[২৩]

বনু নাদিরের বহিষ্কারের পর মুহাম্মদের কাছে সূরা আল-হাশর অবতীর্ণ হয় বলেও বলা হয়।[]

খন্দকের যুদ্ধ: ৬২৭

[সম্পাদনা]

মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ইহুদিদের একটি দল, যাদের মধ্যে ছিলেন বনু নাদিরের খায়বারে আশ্রয় নেওয়া নেতারা—সাল্লাম ইবন আবু আল-হুকায়ক, কেনানা ইবন আল-রাবি এবং হুয়াইয়্য ইবন আখতাব—তারা বনু ওয়াইলি গোত্রের দুই নেতার সঙ্গে কুরাইশদের কাছে যান এবং মুহাম্মদের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনের আহ্বান জানান, যাতে তাকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায়। এরপর তারা গাতফান গোত্রকেও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে।[২৯]

বনু নাদির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি বেদুইন গোত্রগুলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়, তবে তারা খায়বারের খেজুর ফসলের অর্ধেক তাদেরকে দেবে।[৩০][৩১]

কুরাইশদের সেনাপতি আবু সুফিয়ান বনু নাদিরের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ১০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী গঠন করেন। অপরদিকে মুহাম্মদ প্রস্তুত করতে পারেন মাত্র ৩,০০০ জনের বাহিনী। তবে তিনি প্রতিরক্ষার এক নতুন কৌশল গ্রহণ করেন, যা তৎকালীন আরবে অপরিচিত ছিল—যেখানে মদিনা অশ্বারোহী আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত ছিল, সেখানে একটি প্রশস্ত খন্দক খনন করা হয়। এই ধারণার কৃতিত্ব একজন পারস্য থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী মুসলিম সালমান ফারসিকে দেওয়া হয়।

মদিনার অবরোধ শুরু হয় ৬২৭ সালের ৩১ মার্চ এবং তা প্রায় দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়।[৩২] আবু সুফিয়ানের বাহিনী মদিনার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না। অব্যর্থ কোনো ফলাফল না পেয়ে এবং দীর্ঘ অবরোধে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে এই জোট সেনারা পিছু হটে।[৩৩]

এই যুদ্ধের প্রসঙ্গ কুরআনে উল্লেখ আছে, সূরা আহজাব, আয়াত ৩৩:৯–৩৩:২৭ এ।[৩৪]

খায়বারের যুদ্ধ: ৬২৮

[সম্পাদনা]

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ খায়বার আক্রমণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বনু নাদিরের আরেক নেতা উসাইর (ইউসাইর) ইবন জারিম-কে মদিনায় আমন্ত্রণ জানান, যাতে নাদির নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা যায়। এই উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। প্রতিনিধি দলে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন উনাইসও, যিনি বনু সালিমার মিত্র ছিলেন—এই গোত্রটি ইহুদিদের প্রতি বৈরী ছিল।

তারা উসাইর ইবন জারিমের কাছে গেলে তাকে বুঝাতে থাকে যে তিনি মুহাম্মদের কাছে গেলে তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হবে এবং তাঁর সঙ্গে চুক্তি করা হবে। বারংবার আহ্বানে সাড়া দিয়ে উসাইর কিছু ইহুদি অনুসারীসহ তাদের সঙ্গে রওনা দেন। আবদুল্লাহ ইবন উনাইস তাকে নিজের বাহনে বসান। যখন তারা আল-কারকারা নামক স্থানে পৌঁছান, যা খায়বার থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে, তখন উসাইর মনে মনে পরিকল্পনা বদলান এবং মুহাম্মদের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আবদুল্লাহ তার অভিপ্রায় বুঝতে পারেন, কারণ উসাইর তরবারি ধরার চেষ্টা করছিলেন। তা দেখে আবদুল্লাহ তাকে প্রথমে আক্রমণ করে তরবারির এক কোপে তার পা কেটে দেন। উসাইর প্রতিরোধ করেন এবং হাতে থাকা কাঠের লাঠি (শাহত নামক গাছের) দিয়ে আঘাত করে আবদুল্লাহর মাথায় জখম করেন। মুহাম্মদের প্রেরিত দূতেরা এরপর উসাইরের সঙ্গে আসা ত্রিশ জন ইহুদির ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে। শুধু একজন ব্যক্তি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।[৩৫]

এর আগে আবদুল্লাহ ইবন উনাইস রাতের অন্ধকারে খায়বারে গিয়ে বনু নাদিরের নেতা সাল্লাম ইবন আবু আল-হুকায়ককে হত্যার জন্য স্বেচ্ছায় অনুমতি নিয়ে অভিযান চালিয়েছিলেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মে/জুন ৬২৮ সালে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীরা খায়বার আক্রমণ করেন। যদিও ইহুদিরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব এবং দীর্ঘ অবরোধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধের পরিণাম মুসলিমদের পক্ষে যায়।

প্রায় সব দুর্গ দখল হয়ে গেলে—দু’টি ছাড়া—ইহুদিরা আত্মসমর্পণের জন্য আলোচনায় বসে। চুক্তি অনুযায়ী, খায়বারের বার্ষিক ফসলের অর্ধেক মুসলিমদের দিতে হবে, যদিও জমির মালিকানা ইসলামি রাষ্ট্রের সম্মিলিত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।[৩৬]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Buhl; Welch, Alfred। Encyclopaedia of Islam7 (2nd সংস্করণ)। পৃষ্ঠা 366। 
  2. Watt, William Montgomery (১৯৫৬)। Muhammad at Medina। Oxford At The Clarendon Press। পৃষ্ঠা 211-212; 217-219। 
  3. Abdulkarim al-Sam'ani. Al-Ansab. Jinan Publish House. Beirut. 1988. v4 p475 & v5 p503
  4. Ibn Hazm. Jawame Al-Syira Al-Nabawyia. Dar Al-Kotob Al-ilmiyah. Beirut. 2009. p26
  5. Vacca, V.। "Nadir, Banu 'l"। P.J. Bearman; Th. Bianquis; C.E. Bosworth; E. van Donzel; W.P. Heinrichs। Encyclopaedia of Islam Online। Brill Academic Publishers। আইএসএসএন 1573-3912 
  6. Stillman, Norman (১৯৭৯)। The Jews of Arab Lands: A History and Source Bookবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Philadelphia: Jewish Publication Society of America। আইএসবিএন 0-8276-0198-0 , পৃ. ১৩–১৪।
  7. jewishencyclopedia.com [১]
  8. Ibn Kathir, al-Bidaayah wa al-Nihaayah, Vol II, p. 279
  9. Ibn Hisham, Vol. I, p. 501.
  10. Saif-ur-Rahman Mubarakfuri, ar-Raheeq al-Makhtoom - "The Sealed Nectar"
  11. Ibn Hisham, as-Seerat an-Nabaweeyat, Vol. II, p. 147–150.
  12. Ibn Ishaq, p. 231–235.
  13. Ibn Ishaq। The Life Of Muhammad। পৃষ্ঠা 362–364। 
  14. al-Tabari। The History of Al-Tabari Volume 7: The Foundation of the Community (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা 85–87। 
  15. Stillman, Norman (১৯৭৯)। The Jews of Arab Lands: A History and Source Bookবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Philadelphia: Jewish Publication Society of America। পৃষ্ঠা 13। আইএসবিএন 0-8276-0198-0 
  16. আল-জুরকানি, শারহ আল-মাওয়াহিব, খণ্ড ২, পৃ. ১০–১২
  17. Rubin, Uri. The Assassination of Kaʿb b. al-Ashraf. Oriens, Vol. 32. (1990), pp. 65–71.
  18. William Montgomery Watt। "Ka'b ibn al-Ashraf"। P.J. Bearman; Th. Bianquis; C.E. Bosworth; E. van Donzel; W.P. Heinrichs। Encyclopaedia of Islam Online। Brill Academic Publishers। আইএসএসএন 1573-3912 
  19. Philip K. Hitti, History of the Arabs, 10th edition (Macmillan Press, 1970), p. 90.
  20. Ibn Hisham (১৯৫৫)। Al-Sira al-Nabawiyya2। Cairo। পৃষ্ঠা 51–57।  ইংরেজি অনুবাদ: Stillman (1979), পৃ. 125–126।
  21. Stillman (1979) পৃ. 13
  22. Ibn Hisham (1955). ইংরেজি অনুবাদ: Stillman (1979), পৃ. 127।
  23. Stillman (1979), পৃ. ১৪।
  24. Watt (1956), পৃ. ২১১–২১২।
  25. al-Halabi, Nur al-Din। Sirat-i-Halbiyyah। 2, part 10। Uttar Pradesh: Idarah Qasmiyyah Deoband। পৃষ্ঠা 34।  অনুবাদ: মুহাম্মদ আসলাম কাসেমী।
  26. "'Biography of Muhammad' by Ibn Ishaq"। জুন ২৫, ২০০৪। ২০০৪-০৬-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  27. Al-Waqidi (১৯৬৬)। Marsden Jones, সম্পাদক। Kitab al-Maghazi। London। পৃষ্ঠা 363–375।  ইংরেজি অনুবাদ: Stillman (1979), পৃ. 136।
  28. A. Guillaume, The Life of Muhammad, Oxford University Press, পৃ. 438
  29. A. Guillaume, The Life of Muhammad, Oxford University Press, পৃ. 450
  30. The Encyclopaedia of Islam. New Edition. Vol. 4, পৃ. 1137 ও পরবর্তী
  31. Watt (1956), পৃ. ৩৬–৩৭
  32. দেখুন:
    • রদিনসন (২০০২), পৃ. ২০৯–২১১;
    • Watt (1964), পৃ. ১৬৯
  33. Uri Rubin, Quraysh, Encyclopaedia of the Qur'an
  34. Ibn Ishaq, A. Guillaume, পৃ. ৬৬৫–৬৬৬
  35. Veccia Vaglieri, L.। "Khaybar"। P.J. Bearman; Th. Bianquis; C.E. Bosworth; E. van Donzel; W.P. Heinrichs। Encyclopaedia of Islam Online। Brill Academic Publishers। আইএসএসএন 1573-3912 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]