প্রাচীন জাপানি লৌহশিল্পের কৌশল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রাচীন জাপানি লৌহ শিল্পের কৌশলগুলি প্রাথমিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যা আসুকা সময়কালের (৫৩৮-৭১০ খ্রিষ্টাব্দ) বলে মনে করা হয়। জাপানে লোহা প্রথম আনা হয়েছিল পূর্ববর্তী ইয়ায়োই যুগে (৯০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ২৪৮ খ্রিষ্টাব্দ)। সেই সময়ে প্রাপ্ত লোহার নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে খামারের সরঞ্জাম, তীরের মাথা এবং কিছু ছুরির ফলক। জাপানে লৌহ শিল্প সম্ভবত বিকশিত হয়েছিল ইয়ায়োই যুগের শেষের দিকে বা কোফুন যুগে, যখন লোহার অস্ত্র এবং বর্মের ব্যবহার ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। জাপানে প্রথম দিকে লোহার কাজের কৌশলগুলির সর্বোত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় আসুকা সময়কালে। সেই সময় ইয়ামাতো রাজ্যের রাজদরবারে বৌদ্ধধর্মের প্রচলন হয়।

জাপানি লোহা শিল্পের বিকাশ[সম্পাদনা]

ঐতিহ্যবাহী জাপানি লোহা গলানোর চুল্লি সাধারণত তাতারা নামে পরিচিত। এটি একটি হাইব্রিড ধরনের চুল্লি ছিল। চুল্লির হাপরগুলি ছিল ইউরোপীয় মারুত চুল্লি মতো দেখতে। তবে চুল্লিগুলি মাটি দিয়ে নির্মাণ করা হতো। চুল্লিগুলি লোহা গলানোর পরে ভেঙ্গে ফেলা হতো।[১] প্রত্নতাত্ত্বিক নথি অনুসারে দেখা যায়, প্রথম জাপানি চুল্লি তাতারা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর[২] সময়ে নির্মিত হয়েছিল। ইউরোপীয়, ভারতীয় এবং চীনাদের লোহা গলানোর চুল্লির তুলনায় জাপানি লোহা গলানোর চুল্লি তাতারা আকারে ছিল বেশ বড়। সেইকারণে চুল্লির তাপমাত্রা চুল্লির উচ্চতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতো। তাই চুল্লির অভ্যন্তরে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন ধরনের লোহা পাওয়া যেতো। সাধারণত তাতারা চুল্লির শীর্ষে পেটা লোহা (তাপ থেকে সবচেয়ে দূরে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা), মাঝখানে লোহা ঢালাই এবং অবশেষে নীচের দিকে ইস্পাত (কার্বন সামগ্রীর বিভিন্ন মাত্রাসহ।) পাওয়া যেত।[৩] এই জাপানি চুল্লি তাতারার তাপমাত্রা ১৫০০ সেন্টিগ্রেডের বেশি ছিল না, তাই এতে লোহা সম্পূর্ণরূপে গলতে পারত না।

ধাতু-শ্রমিকরা তাতারা চুল্লির মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন ধরণের লোহার মধ্যে পার্থক্যগুলি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারতো। সেই অনুযায়ী তারা বিভিন্ন বিভিন্ন ধরণের লোহা আলাদা করতো।[৪] উদাহরণস্বরূপ কাতানা ঢালাই প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র বেশি- এবং কম-কার্বনযুক্ত লোহা ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করা হতো। জাপানি তরবারি বানানোর লৌহ কারিগরেরা প্রথমে এই দু ধরণের কার্বনযুক্ত লোহা নিয়ে পিটিয়ে আরও বড় লোহার চাদর তৈরি করত। লোহার চাদরটিকে প্রয়োজন মতো ভাঁজ করে আবার পেটানো হতো। তারা এই প্রক্রিয়াটি কমপক্ষে ১০ বার পুনরাবৃত্তি করতো।[৪] এইভাবে তৈরি হতো জাপানি তরবারি। যদিও রাসায়নিক প্রক্রিয়াটি তাদের কাছে অজানা ছিল, তবুও তারা কার্যকরভাবে ইস্পাতে থাকা কার্বনের মাত্রাকে লোহা সামগ্রীর সমগ্র পণ্য জুড়ে সমানভাবে বিতরণ করতে জানতো। শুধু তাই নয় অবিশুদ্ধগুলিকে আরও সমানভাবে বিতরণ করার কৌশলও জানা ছিল।[৩] এর ফলে উৎকৃষ্ট মানের লোহা সামগ্রী তৈরি হতো, যার মধ্যে কার্বনের পরিমাণ সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পকর্মের তুলনায় বেশি ছিল তবে ভারতীয় শিল্পকর্মে পাওয়া কার্বনের পরিমাণ থেকে বেশি ছিল না।[৫]

প্রযুক্তি স্থানান্তর[সম্পাদনা]

তাতারা লৌহ শিল্পের পদ্ধতিটিকে ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনন্য বলে মনে করেন। আরও বিশেষভাবে বলা যায় মূলধারার ধাতুবিদ্যার বিকাশের একটি প্রাচীন পদ্ধতি।[৬] গবেষকেরা মনে করেন এই প্রযুক্তিটি প্রাথমিকভাবে কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছিল।[২] যাইহোক, আমরা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে জাপানি লৌহ শিল্পের পদ্ধতির রৈখিক (বৃত্তাকার ইউরোপীয় ব্লাস্ট ফার্নেসের বিপরীতে) নকশার সাথে অবশ্যই অনেক সমসাময়িক দক্ষিণ এশীয় নকশার সাথে মিল রয়েছে।[২] "তাতারা" এর বুৎপত্তি তার উৎপত্তিতে জাপানি নয়, যা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে যে এই প্রযুক্তি স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়নি।[৪]

যাইহোক, এই প্রযুক্তিটি গ্রহণের পরে প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় ব্যবহারের জন্য এটি নানাভাবে পরিবর্তিত বা অভিযোজিত হয়েছিল বলা যায়। শ্রীলঙ্কা এবং কম্বোডিয়া সহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ফার্নেস ডিজাইনের সাথে তাতারার মিল থাকলেও মারুৎ চুল্লিতে ব্যবহারের জন্য স্থানীয় কাঁচামালগুলি আলাদা ছিল।[৭] জাপানি ইস্পাত তৈরির জন্য আকরিকের প্রধান উৎস ছিল লোহামিশ্রিত বালি। এটিএকটি বালির মতো পদার্থ যা জাপানের পার্বত্য অঞ্চলে গ্রানাইট এবং অ্যান্ডিসাইটের ক্ষয়ের পর বালির আকারে জমা হতো।[৭] গুরুত্বপূর্ণভাবে, বালি থেকে আকরিক আহরণ করা কঠিন শিলা থেকে কম শ্রমসাধ্য ছিল। তাছাড়া শ্রমসাধ্য খনির প্রক্রিয়ার পরিবর্তেএই বালি ভূপৃষ্ঠের পাওয়া করা যেতো। তবে সাধারণত শিলা আকরিকগুলির থেকেএই বালিতে লোহার পরিমাণ অনেক কম ছিল। যেমন কিছু শ্রীলঙ্কার লোহার আকরিকের মধ্যে থাকা ৭৯-৮৭% ফেরাস অক্সাইডের তুলনায় লৌহঘটিত বালিতে শুধুমাত্র ২-৫% ফেরাস অক্সাইড পাওয়া যেত।[৮] যেহেতু লৌহঘটিত বালিতে কম মাত্রার ফেরাস অক্সাইড থাকত সেজন্য উৎপাদনও কম হতো। তাই জাপানি ধাতু শ্রমিকরা নির্দিষ্ট প্রকারের লোহাকে একত্রিত করার প্রক্রিয়ার সাথে খুব পরিচিত ছিল। এই পরিবেশগত সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে, সবচেয়ে কার্যকর সমাধান ছিল নির্দিষ্ট ধরণের লোহা একত্রিত করা। বিভিন্ন প্রচেষ্টা এবং ত্রুটি সমস্যা সমাধানের মৌলিক পদ্ধতির মাধ্যমে ধাতু-শ্রমিকরা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল যে তলোয়ারের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপাদানগুলি তাতারা চুল্লির নীচের অংশে জমা হয়।[৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Technology and the culture of progress in meiji japan. P.25
  2. Technology and evolution: a root and branch view of asian iron from first-millennium bc sri lanka to japanese steel. P.573
  3. Ancient and historic steel in japan, india and europe, a non-invasive comparative study using thermal neutron diffraction. Analytical and Bioanalytical Chemistry. P.1494
  4. Tatara and the japanese sword: the science and technology. P.19
  5. Ancient and historic steel in japan, india and europe, a non-invasive comparative study using thermal neutron diffraction. Analytical and Bioanalytical Chemistry. P.1497
  6. Technology and evolution: a root and branch view of asian iron from first-millennium bc sri lanka to japanese steel. P.574
  7. Technology and the culture of progress in meiji japan. P.24
  8. Technology and evolution: a root and branch view of asian iron from first-millennium bc sri lanka to japanese steel. P.561