পুঞ্জাক্ষি

যৌগিক চোখ বা পুঞ্জাক্ষি হলো ক্রাস্টাসীয় ও পতঙ্গ প্রভৃতি সন্ধিপদী প্রাণীদের দর্শনেন্দ্রিয়। পুঞ্জাক্ষি অনেকগুলো ওমাটিডিয়ার (একবচনে ওমাটিডিয়াম) সমষ্টি।[১] ওমাটিডিয়াম হলো কর্নিয়া, লেন্স ও আলোকসংবেদী কোষ দ্বারা নির্মিত ক্ষুদ্র সংবেদী একক, যা আলোর উজ্জ্বলতা ও রং শনাক্ত করতে সক্ষম। সন্ধিপদীদের যৌগিক চোখ বা পুঞ্জাক্ষি দ্বারা গৃহীত আলোক উপলব্ধি হলো মূলত পাশাপাশি কিন্তু ঈষৎ ভিন্ন দিকে সজ্জিত অসংখ্য ওমাটিডিয়া থেকে আগত আলোক সংকেতের সমষ্টি। একক চক্ষুর তুলনায় পুঞ্জাক্ষির দর্শন সক্ষমতা কম। তবুও পুঞ্জাক্ষির দর্শন কোণ অত্যন্ত বিস্তৃত। পুঞ্জাক্ষির মাধ্যমে সন্ধিপদীরা দ্রুতগতির বস্তু এবং ক্ষেত্রবিশেষে আলোর পোলারায়ন শনাক্ত করতে সক্ষম।[২]
প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]
পুঞ্জাক্ষিকে সৃষ্ট প্রতিবিম্বের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়; যথাক্রমে- অ্যাপোজিশন বা মোজাইক পুঞ্জাক্ষি, যা অসংখ্য স্পষ্ট উল্টানো প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে ও সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি, যা একটিমাত্র অস্পষ্ট খাড়া প্রতিবিম্ব গঠন করে।[৩]
অ্যাপোজিশন পুঞ্জাক্ষি
[সম্পাদনা]অ্যাপোজিশন পুঞ্জাক্ষিকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি সাধারণ অ্যাপোজিশন পুঞ্জাক্ষিতে র্যাবডোমের একদিক থেকে আসা আলোকে আরেক দিকে সঞ্চালিত করার জন্য লেন্স থাকে এবং একই সাথে অপর দিক থেকে আসা আলো ওমাটিডিয়ামের কৃষ্ণ প্রাচীর দ্বারা শোষিত হয়। ম্যান্টিস চিংড়ি বা চিংড়িবাহারের দর্শনেন্দ্রিয় এ ধরনের পুঞ্জাক্ষির একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। অন্য ধরনের অ্যাপোজিশন পুঞ্জাক্ষি স্ট্রেপসিপটেরা বর্গের প্রাণীতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটি লেন্স একটি করে প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, যা মস্তিষ্কে একীভূত হয়ে একটি পূর্ণ প্রতিবিম্ব তৈরি করে। এই ধরনের পুঞ্জাক্ষিকে শাইজোক্রোল চক্ষু বা স্নায়বিক সুপারপজিশন চক্ষু (সুপারপজিশন নাম হওয়া সত্ত্বেও এটি অ্যাপোজিশন চক্ষু) বলা হয়।
সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি
[সম্পাদনা]পুঞ্জাক্ষির দ্বিতীয় প্রকারকে বলা হয় সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি। সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষিকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়: প্রতিসারক, প্রতিফলক ও অধিবৃত্ত সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি। প্রতিসারক সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষিতে লেন্স ও র্যাবডোমের মাঝে কোনো ফাঁকা স্থান ও পার্শ্বপ্রাচীর থাকে না। প্রতিটি লেন্সের অক্ষে একটি নির্দিষ্ট কোণে আলো প্রবেশ করে এবং ঐ অন্য পাশে একই কোণে প্রতিফলিত হয়। ফলে র্যাবডোমের অগ্রভাগে চোখের ব্যাসার্ধের অর্ধেক পরিমাণ প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। সাধারণত নিশাচর পতঙ্গে এ ধরনের পুঞ্জাক্ষি দেখা যায়। মেফ্লাই বা মাছমাছিতে অধিবৃত্তাকার সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি দেখা যায়। অধিবৃত্তাকার পুঞ্জাক্ষিতে ফ্যাসেটের অভ্যন্তরের অধিবৃত্তাকার তল প্রতিফলক থেকে আলোকরশ্মিকে সজ্জিত সংবেদী স্নায়ুতে কেন্দ্রীভূত করে। লম্বা শরীরবিশিষ্ট দশপদী ক্রাস্টাসীয়, যেমন চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, ক্রেফিশ, গলদা চিংড়ি ইত্যাদিতেই শুধুমাত্র প্রতিফলক সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি থাকে। এ ধরনের সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষিতে স্বচ্ছ ফাঁকা স্থান থাকলেও লেন্সের পরিবর্তে কোনায় অবস্থিত দর্পন ব্যবহার করে।
অন্যান্য
[সম্পাদনা]মাছি, মৌমাছি প্রভৃতি উড়ুক্কু পতঙ্গ, ম্যান্টিস, ফড়িং প্রভৃতি শিকারী পতঙ্গের ওমাটিডিয়ায় ফোভিয়া অঞ্চল নামে একটি বিশেষায়িত সুবিন্যস্ত অঞ্চল থাকে, যা এদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তি দান করে। এই সূক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন অঞ্চলে চোখ কিছুটা প্রশস্ত এবং চোখের গর্ত অপেক্ষাকৃত বড়। এইরূপ প্রশস্ততার জন্য কোনো একটি উৎস থেকে আগত আলোকরশ্মিকে বেশি পরিমাণ ওমাটিডিয়ায় গ্রহণ করতে পারে এবং এর ফলে উচ্চ রেজোল্যুশনের প্রতিবিম্ব গঠিত হয়।

উপরে বর্ণিত চোখের আবার কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কিছু পতঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে একটিমাত্র লেন্সবিশিষ্ট পুঞ্জাক্ষি থাকে। এটি মূলত সরল চোখবিশিষ্ট প্রাণীদের একক লেন্সের চোখ ও বহু-লেন্স বিশিষ্ট যৌগিক চোখের মধ্যবর্তী অবস্থান্তর দশা। মাইসিড চিংড়িতে (Dioptromysis paucispinosa) প্রতিসারক সুপারপজিশন পুঞ্জাক্ষি থাকে, যার পেছনে প্রায় তিনগুণ বড় গর্ত থাকে এবং এর পেছনে একটিমাত্র বৃহৎ ক্রিস্টালাইন কোণ কোষ থাকে। ফলে বিশেষায়িত রেটিনায় সোজা প্রতিবিম্ব গঠিত হয়।
স্কুটিগেরায় আরেক ধরনের ছদ্ম-ফ্যাসেটবিশিষ্ট চোখ দেখা যায়। এতে প্রকৃত পুঞ্জাক্ষির মতোই মাথার দুই পাশে অসংখ্য ওসেলি বা সরলাক্ষির একেকটি গুচ্ছ অবস্থান করে।
এক ধরনের ব্রিটল তারার (Ophiocoma wendtii) সম্পূর্ণ বহিঃত্বক ওমাটিডিয়ায় পূর্ণ হয়ে সম্মিলিতভাবে একটি যৌগিক চোখ গঠন করে বলে আগে ধারণা করা হতো।
পুঞ্জাক্ষির অপ্রতিসমতা খুব সম্ভবত প্রাণীর আচরণগত অপ্রতিসমতার সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, টেমনোথোরাক্স আলবিপেনিস (Temnothorax albipennis) প্রজাতির পিঁপড়া নতুন বাসস্থানের খোঁজ করতে সব সময় বাম দিক বরাবর গমন করে। সাধারণত পপুলেশন পর্যায়ে এই আচরণ প্রকাশিত হয়। এরকম আচরণের একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো এই যে, এ প্রজাতির পিঁপড়ার চারপাশের পরিবেশ কিছুটা গোলকধাঁধার মতো এবং ধারাবাহিকভাবে একই দিক নির্বাচন করা গোলকধাঁধা রাস্তা না হারিয়ে থেকে বের হওয়ার একটি উত্তম পন্থা।[৪] এরূপ ক্রমাগত একই দিকে বাঁক নেওয়ার পক্ষপাতমূলক আচরণ এই পিঁপড়াদের পুঞ্জাক্ষির সামান্য অপ্রতিসমতার (ওমাটিডিয়ার সংখ্যার পার্থক্য) সাথে সম্পর্কিত।[৫]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Senses. Insect eyes"। Insects and Spiders of the World. বালাম ৮: Scorpion fly - Stinkbug। নিউ ইয়র্ক: মার্শাল ক্যাভেন্ডিশ। ২০০৩। পৃ. ৪৫৯। আইএসবিএন ৯৭৮-০৭৬১৪৭৩৪২৮।
- ↑ Völkel, R.; Eisner, M.; Weible, K.J. (জুন ২০০৩)। "Miniaturized imaging systems" (পিডিএফ)। Microelectronic Engineering। ৬৭–৬৮ (8): ৪৬১–৪৭২। ডিওআই:10.1016/S0167-9317(03)00102-3। ১ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে (পিডিএফ) আর্কাইভকৃত।
- ↑ গ্যাটেন, অ্যাডওয়ার্ড (১৯৯৮)। "Optics and phylogeny: is there an insight? The evolution of superposition eyes in the Decapoda (Crustacea)" (ইংরেজি ভাষায়)। ৬৭ (৪): ২২৩–২৩৬। ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০২০।
{{সাময়িকী উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি journal এর জন্য|journal=প্রয়োজন (সাহায্য) - ↑ হান্ট ইআর, এবং অন্যান্য (২০১৪)। "Ants show a leftward turning bias when exploring unknown nest sites"। বায়োলজি লেটার্স। ১০ (১২): ২০১৪০৯৪৫। ডিওআই:10.1098/rsbl.2014.0945। পিএমসি 4298197। পিএমআইডি 25540159।
{{সাময়িকী উদ্ধৃতি}}: ভ্যাঙ্কুভার শৈলীর ত্রুটি: 1 নামে নাম (সাহায্য) - ↑ হান্ট ইআর, এবং অন্যান্য (১১ এপ্রিল ২০১৮)। "Asymmetric ommatidia count and behavioural lateralization in the ant Temnothorax albipennis"। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস। ৮ (১): ৫৮২৫। বিবকোড:2018NatSR...8.5825H। ডিওআই:10.1038/s41598-018-23652-4। পিএমসি 5895843। পিএমআইডি 29643429।
{{সাময়িকী উদ্ধৃতি}}: ভ্যাঙ্কুভার শৈলীর ত্রুটি: 1 নামে নাম (সাহায্য)