বিষয়বস্তুতে চলুন

পবিত্র নিদর্শন (তোপকাপী প্রাসাদ)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাক্রেড ট্রাস্ট সংরক্ষিত আছে টোপকাপি প্রাসাদের সাবেক ব্যক্তিগত কক্ষে
চতুর্থ আঙিনায় অবস্থিত ধন্য আবরণ কক্ষ
নবী মুহাম্মদের একটি চিঠি

ইসলামি পবিত্র নিদর্শনসমূহ (তুর্কি: Mukaddes emanetler),[] যেগুলোকে পবিত্র বস্তু বা সম্মিলিতভাবে সাক্রেড ট্রাস্ট নামেও ডাকা হয়, এগুলো ১৬শ থেকে ১৯শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত উসমানীয় সুলতানদের কাছে পাঠানো ধর্মীয় নিদর্শনের একটি সংগ্রহ।

১৫১৭ সালে সুলতান সেলিম প্রথম আরব বিশ্ব জয় করার পর খিলাফত পরাজিত আব্বাসীয়দের থেকে উসমানীয়দের হাতে আসে। তখন ইসলামের নবী মুহাম্মদ-এর আবরণ, যা শেষ আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল তৃতীয় সংরক্ষণ করেছিলেন, সেটি সেলিম প্রথমের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নবী মুহাম্মদ, তাঁর অনুসারী এবং তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিবেচিত বিভিন্ন নিদর্শন ইস্তানবুলের টোপকাপি প্রাসাদে আনা হয় এবং সেগুলো এখনও সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে।

এই নিদর্শনগুলো প্রাসাদের তৃতীয় আঙিনায় অবস্থিত সুলতানের সাবেক ব্যক্তিগত কক্ষসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে।

  • সম্মেলন কক্ষ (Arzhane) যা 'প্রার্থনার ঘর' নামেও পরিচিত, সেখানে সংরক্ষিত আছে মুহাম্মদের দাঁতের একটি অংশ (Dendan-ı Saadet), তাঁর দাড়ির চুল (Sakal-ı Şerif), মুহাম্মদের সিলমোহর (Mühr-ı Saadet), তাঁর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি (Name-ı Saadet), এবং তাঁর তলোয়ার ও ধনুক যা উসমানীয় স্বর্ণকাররা তৈরি করা বিশেষ বাহনে সংরক্ষিত। এসবকেই একত্রে বলা হয় সাক্রেড ট্রাস্ট (mukkades emanetler)। এই কক্ষে একজন মুফতি অবিরত কুরআন পাঠ করে থাকেন।
  • ধন্য আবরণ কক্ষ[]-এ রাখা আছে মুহাম্মদের ধন্য আবরণ ও তাঁর পবিত্র পতাকা, যা রূপার জালি ঘেরা এক চাঁদির নিচে সোনার বাক্সে রাখা হয়েছে।

ধন্য আবরণ

[সম্পাদনা]
ধন্য আবরণ কক্ষের অভ্যন্তর

ধন্য আবরণ বা পবিত্র আবরণ নামে পরিচিত বস্ত্রটি ঐতিহ্য অনুযায়ী নবী মুহাম্মদ তাঁর প্রশংসাপত্র কাসিদা বুরদা আবৃত্তির জন্য কবি কাব ইবন জুহায়র-কে প্রদান করেছিলেন। এই কবিতাটি ধন্য আবরণ কক্ষ-এর দেয়ালে অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।[] এই আবরণটির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই গজ, এটি কালো উলের তৈরি এবং ভেতরে হালকা ক্রিম রঙের কাপড়ের আস্তরণ রয়েছে।[]

প্রতি বছর রমজান মাসের পঞ্চদশ দিনে উসমানীয় সুলতান, তাঁর পরিবার ও দরবারের সদস্যরা এক বিশেষ অনুষ্ঠানে এই আবরণ দর্শন করতেন।[] এ সময় আবরণে চুম্বন অর্পণ করা হতো, যদিও সরাসরি নয়; একটি মসলিন কাপড় আবরণটির ওপর রাখা হতো এবং সেটিতে চুম্বন করা হতো। এই সুসজ্জিত রুমালটিকে বলা হতো ধন্য রুমাল (দেসতিমাল-ই শরীফ) এবং এটি প্রত্যেক দর্শনার্থীকে প্রদান করতেন মসলিন প্রধান (তুলবেন্ত আগাসি)।

আবরণটি একটি সোনার বাক্সে সংরক্ষিত থাকত, যার চাবি কেবল সুলতানের কাছেই থাকত। বাক্সটি খুলতে তিনি বিসমিল্লাহ পাঠ করতেন। মূল আবরণটি একাধিক বর্গাকার কাপড়, যেগুলোকে বোঁচা বলা হয়, তাতে মোড়ানো থাকত। এর ভেতরে আরও একটি ছোট সোনার বাক্স থাকত, যেখানে ৪০টি বোঁচা আবরণটির চারপাশে জড়ানো থাকত। সংখ্যাটি বিশেষভাবে শুভ বিবেচিত হতো।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মসলিন প্রধান প্রথম রুমালটি আবরণটির ওপর রাখতেন এবং সুলতান সেটিতে চুম্বন করতেন। এরপর পর্যায়ক্রমে রাজপুত্রগণ, ওজিরগণ, দরবারি, চাকর ও খোজারা একই কাজ করতেন। পুরো সময়টিতে কক্ষে কুরআন তিলাওয়াত চলত।

পরবর্তীতে নারী সদস্যরা আসতেন। প্রথমে আগমন করতেন সুলতানী মা, এরপর প্রধান পত্নী, উপপত্নী, কন্যাগণ, দফতরের অন্য কর্মকর্তার স্ত্রীগণ এবং মহিলা চাকররা। সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয়ের কন্যা হামিদে আয়şe সুলতান তাঁর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা Babam Abdülhamit-এ এই অনন্য আচার-অনুষ্ঠানের এক বর্ণনামূলক বিবরণ দিয়েছেন, যা নিম্নরূপ:

রমজানের পঞ্চদশ দিনে ধন্য আবরণ দর্শনের জন্য আমরা তিন দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতাম। সেই দিনে আমরা খুব সকালে উঠে আমাদের সবচেয়ে সুন্দর দীর্ঘ স্কার্টের পোশাক পরতাম, গহনা পরতাম এবং টোপকাপি প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম। আমার দাদি সুলতানী রথে উঠতেন; রথচালকেরা রাজকীয় পোশাকে থাকতেন। প্রহরীদের সাথে হারেম সফরের দায়িত্বে থাকা হালিম এফেন্দি সামনে থাকতেন। আমার দাদির রথের পেছনে অন্যান্য হারেম কর্মকর্তারা থাকতেন। এভাবে আমরা ইলদিজ প্রাসাদ থেকে টোপকাপির দিকে যাত্রা করতাম।

সেখানে আমাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে আমরা পৌঁছাতাম, যেসব অতিথিকে আগে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যেমন: বিয়ে হওয়া সুলতানগণ এবং মন্ত্রীদের স্ত্রীগণ—তাঁরাও উপস্থিত হতেন।

আর্মচেয়ার কক্ষে আমার দাদি তাঁর রাজকীয় পোশাকে ছাউনির নিচে বসতেন। আমরা সবাই তাঁর হাতে চুম্বন করতাম এবং ধন্য আবরণ কক্ষ খোলার অপেক্ষা করতাম। সাবেক সুলতান আবদুল মেজিদের স্ত্রীগণ, সেরফিরাজ ও শায়েস্তে, উপস্থিত থাকতেন এবং দাদির পাশে বসতেন। সাধারণত মিশরের খেদিভের মাও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন।

ধন্য আবরণ খোলার সময় 'বাশ মুসাহিব' হেরেমে এসে দাদিকে খবর দিতেন। এরপর তিনিই প্রথম উঠতেন, তারপরে অন্যান্য সুলতান, কাদিন এফেন্দি ও আমরা সবাই মর্যাদার ভিত্তিতে ক্রমানুসারে যেতাম ধন্য আবরণ কক্ষে। আমরা প্রত্যেকেই সাদা মসলিন মাথায় রাখতাম। ঘরে ধূপ জ্বলছিল, আর পর্দার আড়াল থেকে এক মধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শোনা যাচ্ছিল। হৃদয় নম্রতায় ভরে উঠত, আমরা ধীরে ধীরে পাদিশাহর সামনে যেতাম, তাঁকে মাটিতে সালাম করতাম, ধন্য রুমাল গ্রহণ করে তাতে চুম্বন করতাম, মাথায় রাখতাম এবং পেছনে সরে এসে নিজ নিজ স্থানে দাঁড়াতাম।

তারপর আসতেন ‘ভালিদে পাশা’ এবং প্রধান মন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও ‘শেখুল ইসলাম’-এর স্ত্রীগণ। মহিলা কোষাধ্যক্ষ ও অন্যান্য প্রাসাদের নারী চাকররাও অংশগ্রহণ করতেন। অনুষ্ঠান শেষে ‘বাশ মুসাহিব’ আবার এসে সালাম দিয়ে আমাদের প্রস্থান করাতেন।

আমাদের রথগুলো হেরেম গেটের সামনে উপস্থিত থাকত এবং আমরা আগমনের মতোই সুশৃঙ্খলভাবে ফিরে যেতাম ইলদিজ প্রাসাদে। ধীরে চলা ঘোড়াগাড়িগুলো সাধারণত আমাদের ইফতারের সময় পৌঁছে দিত।[]

আবরণটির একটি বোতাম গোলাপজলে ডুবিয়ে নেওয়া হতো। এই জল কুঁজায় ভরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হতো। একে বলা হতো ধন্য আবরণের জল (হিরকাই সা‘আদত সুয়ু) এবং এটি অলৌকিক গুণসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করা হতো।[] অনুষ্ঠান শেষে সুলতান আবরণটি আবার ৪০টি বোঁচা, ছোট সোনার বাক্স ও বড় সোনার বাক্সে মুড়িয়ে রূপার জালি ঘেরা ছাউনির নিচে রেখে দিতেন, পরবর্তী বছরের জন্য।

পবিত্র পতাকা

[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো পবিত্র পতাকা, যেটিকে ধন্য মানদণ্ড নামেও ডাকা হয়। তুর্কিতে একে বলা হয় Sancak-ı Şerif, যার অর্থ "মহান পতাকা"। ধারণা করা হয়, এটি মুহাম্মদের নিজস্ব পতাকা ছিল, অথবা অন্তত তাঁর যুগের কোনো পতাকা। উসমানীয়দের এই পতাকা কীভাবে প্রাপ্ত হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ১৫৯৩ সালে অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই পতাকা প্রথম ব্যবহৃত হয় এবং পরের বছর হাঙ্গেরিতে যুদ্ধের সময় আবার ব্যবহৃত হয়।[] পতাকাটি ১৫৯৫ সালের মধ্যেই টোপকাপি প্রাসাদে আনা হয়েছিল।[] ১৫৯৬ সালে এগের অবরোধ-এ সুলতান মেহমেদ তৃতীয় পতাকাটি নিয়ে বিজয় অর্জন করলে এটি উসমানীয় বাহিনীর বিজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।[][]

এই পতাকা মাঝে মাঝে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের উদ্দীপনা ও বিজয় নিশ্চিত করতে বহন করা হতো। সুলতান নিজ হাতে এটি বাক্স থেকে বের করতেন এবং একটি খুঁটির সঙ্গে স্থাপন করতেন। এরপর তিনি এটি পবিত্র নিদর্শনের কক্ষ থেকে সিংহাসন কক্ষে নিয়ে যেতেন, এ সময় কর্মকর্তারা "আল্লাহু আকবার!" ধ্বনি দিতেন। এরপর পতাকাটি সিংহাসন কক্ষ থেকে ‘ফেলিসিটি গেট’-এ নিয়ে গিয়ে স্থাপন করা হতো। এই কক্ষে এক আনুষ্ঠানিকতা মাধ্যমে গ্র্যান্ড ভিজিয়র পতাকাটি সুলতানের কাছ থেকে গ্রহণ করতেন। তখন গ্র্যান্ড ভিজিয়র ও শেইখুল ইসলাম উপস্থিত থাকতেন, আর সুলতান পতাকাটি চুম্বন করে বলতেন: "আমি তোমার কাছে এই ধন্য মানদণ্ড অর্পণ করছি এবং তোমাকে আল্লাহর সঁপে দিচ্ছি। তিনি যেন তোমার সহায় হন!"[]

যুদ্ধ শেষে একই প্রক্রিয়ায় পতাকাটি ফিরিয়ে আনা হতো। সুলতান নিজ হাতে এটি বহন করে কক্ষে ফিরিয়ে আনতেন এবং বাক্সে রেখে দিতেন। এ সময় কুরআনের তিলাওয়াত চলত এবং ধূপ জ্বালানো হতো।

১৬৫১ সালে জানিসারিদের বিদ্রোহ দমনে এবং সর্বশেষ ১৮২৬ সালে এই পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিল।[১০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Bozkurt, Nebı (২০০৬)। MUKADDES EMANETLER - An article published in Turkish Encyclopedia of Islam (তুর্কি ভাষায়)। 31 (Muhammediyye - Munazara)। Istanbul: TDV İslâm Ansiklopedisi। পৃষ্ঠা 108–111। আইএসবিএন 9789753894586। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০২২ 
  2. Davis (1970), p. 146
  3. Davis (1970), p. 149
  4. Davis (1970), pp. 150–151
  5. Davis (1970), p. 151
  6. Necipoğlu (1991), p. 151
  7. Davis (1970), p. 152
  8. Davis (1970), pp. 152–153
  9. Davis (1970), p. 153
  10. Davis (1970), p. 154