নরওয়েজিয় মাখন সংকট

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নরওয়েজিয়ান সংবিধান দিবসে একটি প্লেট নরওয়েজিয় মাখন

নরওয়েজিয় মাখন সংকট হলো ২০১১ সালের শেষের দিকে নরওয়ের বাজারে মাখনের তীব্র ঘাটতি। নরওয়ের বাজার জুড়ে মাখনের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে এর ঘাটতি শুরু হয়েছিল। ঘাটতির কারণে দাম বেড়ে যায়। দোকানে দোকানে মাখনের আমদানির সঙ্গে সঙ্গে এর মাখনের মজুদ ভাণ্ডার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।[১] ড্যানিশ ট্যাবলয়েড বি.টি. অনুসারে, মাখনের ঘাটতির ফলে নরওয়ে "মাখন আতঙ্ক" অনুভব করছিল।[২]

ঘাটতি[সম্পাদনা]

নরওয়েজিয় ঐতিহ্যবাহী ক্রিসমাস মিষ্টি রুটি যাকে বলা হয় জুলেব্রোড বা জুলেকাকে ("ক্রিসমাস ব্রেড/কেক") এটি টুকরো টুকরো করে মাখন লাগানো।

গ্রীষ্মকালে ভারী বৃষ্টিপাত জন্য গরুদের মাঠে চরতে অসুবিধা হয়। এই গোচারণের প্রভাব পড়ে। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে দুধের উৎপাদন প্রায় ২০ মিলিয়ন লিটার (৫.৩ মিলিয়ন ইউএস গ্যালন) হ্রাস পায়। এর ফলে মাখনের দাম বেড়ে যায়।[১] একই সময়ে, চাহিদাও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে অক্টোবর মাসে বিক্রির পরিমাণ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। নভেম্বর মসে আরও ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।[৩] এই তীব্র ঘাটতির ফলে দাম বেড়ে ছিল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমদানি করা লুরপ্যাক মাখনের একটি ২৫০ গ্রামের একক (৮.৮ আউন্স) প্যাকের দাম নরওয়েজিয় মুদ্রায় ৩০০ (€৩৯; £৩২; $৫০) ছিল।[৪] নরওয়েজিয়ানদের বড়দিনের খাদ্যের একটি প্রধান অংশ মাখন দিয়ে তৈরি হয়।[৫] তাছাড়া নরওয়েজিয়ানদের কাছে চর্বি-সমৃদ্ধ, কম কার্বোহাইড্রেট খাদ্যের অংশ হিসেবে মাখন বিশেষভাবে জনপ্রিয়।[৩]

দেশীয় দুগ্ধ শিল্পকে বিদেশী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে রক্ষা করার জন্য মাখনের উপর উচ্চ আমদানি শুল্ক লাগু ছিল। এর ফলে মাখনের ঘাটতিও বজায় ছিল।[৬] যার অর্থ নরওয়েতে বিক্রি হওয়া মাখনের ৯০ শতাংশই অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়েছিল।[৭] ঐ সময় দুগ্ধ শিল্পের অনুমান ছিল ৫০০ থেকে ১,০০০ টন ঘাটতি।[৮] এদিকে ২০১০ সাল থেকে নরওয়েতে মাখনের চাহিদা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৯] টাইন নামে নরওয়ের একটি কোম্পনি সেই সময়ে নরওয়েজিয়ান মাখনের ৯০ শতাংশ উৎপাদন করত। তারাই ছিল দেশের বৃহত্তম দুগ্ধ সমবায় এবং বাজার নিয়ন্ত্রক। দুগ্ধ খামারির মাখনের উচ্চ চাহিদার সম্পর্কে তাদের অবহিত না করা এবং অভ্যন্তরীণ ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি মাখন রপ্তানি করাকে দায়ী করেছিল।[১]

প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]

ক্রমবর্ধমান সমালোচনার চাপে পড়ে, টাইন কোম্পানি চাহিদা পূরণের জন্য সরকারকে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে সস্তা দরে মাখন আমদানির অনুমতি চায়। তার জন্য মাখনের উপর থেকে শুল্ক কমাতে বলে।[১০] সরকার এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মাখনের উপর থেকে প্রতি কিলোগ্রামে আমদানি শুল্ক ৮০ শতাংশ কমিয়ে দেয়।[১১] শুল্ক দাঁড়ায় নরওয়েজিয় মুদ্রায় ২৫ (€৩.২২; £২.৬৯; $৪.১৮) থেকে নরওয়েজিয় মুদ্রায় ৪ (€০.৫১; £০.৪৩; $০.৬৬)।[১২] টাইনের একজন মুখপাত্রের মতে, এই পদক্ষেপের ফলে ২০১২ সালের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত মাখনের সরবরাহ বেড়ে যায়।[৭] মাখন সংকটের ফলে নরওয়েতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য আহ্বান জানানো হয়। দুগ্ধ শিল্পের পরিকাঠামোটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৈরি করা হয়েছিল যাতে ছোট খামারগুলিকে রক্ষা করার জন্য দাম বেশি রাখা যায়। তবে সমালোচকদের মতে এটি প্রকৃত একচেটিয়া অধিকার ছিল যা ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়।[১৩]

মাখনের এই সঙ্কট নিয়ে নরওয়ে এবং প্রতিবেশী দেশগুলির বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। একটি নরওয়েজিয় সংবাদপত্র নতুন গ্রাহকদেরকে আধা কিলোগ্রাম মাখনের প্রস্তাব দিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে আবার কিছু ছাত্ররা স্নাতক পার্টির তহবিল সংগ্রহের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে মাখন নিলাম করে।[১৪] সীমান্তের ওপারে মাখন পাচারের চেষ্টা করার জন্য বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে।[১৫] সুইডিশ অনলাইন বিজ্ঞাপন করে নরওয়েজিয়দের প্রতি প্যাকেট মাখন নরওয়েজিয় মূল্য ৪৬০ (€৫৯; £৫০; $৭৭) দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।[১৬] ডেনিশ দুগ্ধ ব্যবসায়ী কার্ল ক্রিশ্চিয়ান লুন্ড হাজার হাজার প্যাকেট মাখন ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড এবং অসলোতে পাঠিয়ে নিজের মাখনের চাহিদা বাড়াতে চেয়েছিলেন।[১] অন্যদিকে সুইডিশ সুপারমার্কেট নরওয়েজিয় গ্রাহকদের সীমান্তের ওপারে তাদের কেনাকাটা করতে প্রলুব্ধ করাে বিনামূল্যে মাখন দেওয়ার প্রস্তাব করে।[১৭] শ্বিনসুন্দের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের সুইডিশ দিকের দোকানগুলি স্বাভাবিক দামের চেয়ে কুড়ি গুণ বেশি দামে মাখন বিক্রি করেছে। এক্ষেত্রে দশজন ক্রেতার মধ্যে নয়জনই নরওয়েজিয় ছিল।[১৮] একটি ডেনিশ টেলিভিশন শো মাখন পাঠানোর জন্য দর্শকদের একটি "জরুরি আবেদন" করে। এই আবেদনের ফলে ৪,০০০ প্যাকেট মাখন নরওয়েজিয়াদের বিতরণ করার জন্য সংগ্রহ করা হয়।[৭] ড্যানিশ বিমানবন্দর এবং ফেরি যেখানে দুটি দেশের মধ্যবর্তী প্রণালী অতিক্রম করা হয় সখানকর শুল্কমুক্ত দোকানে মাখনের মজুত রাখার ব্যবস্থা করা হয়।[১৯]

ফলাফল[সম্পাদনা]

মাখন সংকটের ফলে নরওয়েজিয় খুচরা বিক্রেতারা আনুমানিক ৪৩০০ লক্ষ নরওয়েজিয় মুদ্রা হারিয়েছে।[২০] প্রগতি পার্টি টাইন সংস্থার কাছে খুচরা বিক্রেতাদের ক্ষতির জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল।[২০]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Andersen, Audrey (১৪ ডিসেম্বর ২০১১)। "Butter shortage puts the knife into Norwegian Christmas plans"The Guardian। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  2. Bakalus, Silla (৫ ডিসেম্বর ২০১১)। "Norge i smør-panik: Sælges for 600 kroner kiloet på nettet"B.T. (tabloid) (ডেনীয় ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০২০ 
  3. "Norway butter shortage: 'margarine is just not the same'"The Daily Telegraph। ১৪ ডিসেম্বর ২০১১। ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  4. Kirkbak, Jesper (১১ ডিসেম্বর ২০১১)। "Et kilo smør koster nu over 1000 kroner"B.T. (tabloid) (ডেনীয় ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০১২ 
  5. Taylor, Adam (১৯ ডিসেম্বর ২০১১)। "The Incredible Norwegian Butter Shortage Is A Result Of 'Soviet Conditions' In The Industry"The Business Insider। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  6. Hovland, Kjetil Malkenes (১৯ ডিসেম্বর ২০১১)। "Norway: Embarrassed By Butter Shortage"The Wall Street Journal। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  7. "Spreading butter crisis forces cut in import tax"The Scotsman। ১৫ ডিসেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  8. Langton, James (১৭ ডিসেম্বর ২০১১)। "Norwegian butter crisis churns up Christmas shortages"The National। Abu Dhabi। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  9. "Norway butter crisis spreads as nation consumes entire stock"Metro (British newspaper)। ১৪ ডিসেম্বর ২০১১। ৪ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  10. Berglund, Nina (৮ ডিসেম্বর ২০১১)। "Calls rise to bust butter 'monopoly'"। newsinenglish.no। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  11. Myklebost, Nils (১৪ ডিসেম্বর ২০১১)। "Norwegians battle butter shortage in peak season"Associated Press। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  12. Malkenes Hovland, Kjetil (১৯ ডিসেম্বর ২০১১)। "As National Butter Shortage Bites, Norwegians Get Churning"The Wall Street Journal। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ 
  13. Charter, David (১৪ ডিসেম্বর ২০১১)। "A bitter search for butter"The Times। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  14. Ode, Kim (১৯ ডিসেম্বর ২০১১)। "Brother, could you spare some smor?"Star Tribune। Minnesota। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  15. "Swedish butter hustlers arrested in Norway"The Local। ১৯ ডিসেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৬ 
  16. Orange, Richard (১৯ ডিসেম্বর ২০১১)। "Swedes arrested for butter smuggling"The Daily Telegraph। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  17. Andersen, Audrey (২০ ডিসেম্বর ২০১১)। "Butter shortage takes the biscuit in Norway"The Irish Times। ২১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  18. "Swedes in Norwegian butter smuggling bust"The Local। ১৯ ডিসেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  19. Mellingsater, Olaf (১৩ ডিসেম্বর ২০১১)। "Prices spike as butter shortage spreads through Norway"CNN। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১২ 
  20. FrP Requires Tine to Pay for Butter Crisis in Norway, 12 March 2012