জেমা ফ্রিজিয়াস

জেমা ফ্রিজিয়াস (জন্ম; জেম্মে রেইনসার্জুন;[১] ৯ ডিসেম্বর ১৫০৮ - ২৫ মে ১৫৫৫) ছিলেন একজন ওলন্দাজ চিকিৎসক, গণিতবিদ, মানচিত্রকর, দার্শনিক এবং যন্ত্র প্রস্তুতকারক। তিনি গুরুত্বপূর্ণ গোলকগুলো প্রস্তুত করেছিলেন, তাঁর সময়ের গাণিতিক যন্ত্রগুলোর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং নেভিগেশনে নতুন গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। তার নামানুসারে জেমার রিংসমূহের নামকরণ করা হয়েছে। জেরারডাস মারকেটর এবং আব্রাহাম অর্তেলিয়াসের পাশাপাশি ফ্রিজিয়াসকেও নেদারল্যান্ডীয় মানচিত্রাঙ্কন শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এই শাখার স্বর্ণযুগের (প্রায় ১৫৭০ – ১৬৭০) ভিত্তি স্থাপনে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন৷
জীবনী
[সম্পাদনা]ফ্রিজিয়াস ডোককুম, ফ্রিজল্যান্ড (বর্তমান নেদারল্যান্ডস)-এর এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্পবয়সেই তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। পরে তিনি গ্রোনিঞ্জেনে চলে আসেন এবং ১৫২৫ সালের শুরুর দিকে বেলজিয়ামের লুভেন (লুভাইন) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৫৩৬ সালে তিনি তার এম.ডি. ডিগ্রি গ্রহণ করার পর লুভেনেই 'মেডিসিন বিভাগে' যোগ দেন এবং আজীবন সেখানেই কর্মরত থাকেন। তিনি মূলত মেডিসিন বা ঔষধীশাস্ত্র বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন কিন্তু তার পাশাপাশি তিনি গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোলও পড়াতেন। তার মৃত্যুর পর তার সন্তান কর্নেলিয়াস জেমা তার সমস্ত কাজকে বিশ্ববাসীর জন্য প্রকাশিত করেছিলেন।


লুভেনে তার প্রভাবশালী শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন ফ্রান্সিসকাস মোনাকাস, যিনি সম্ভবত ১৫২৭ সালের বা তার কাছাকাছি কোনো সময়ে লুভেনের স্বর্ণকার গাস্পার ভ্যান ডার হেইডেনের সহযোগিতায় একটি বিখ্যাত গ্লোব তৈরি করেছিলেন।[২] মোনাকাসের নেতৃত্বে এবং ভ্যান ডার হেইডেনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় ফ্রিজিয়াস গ্লোবস এবং গাণিতিক যন্ত্র তৈরির জন্য একটি কর্মশালা স্থাপন করেছিলেন যা টাইকো ব্রাহের মতো সমসাময়িক জ্যোতির্বিদদের দ্বারা তাদের গুণমান এবং যথার্থতার জন্য প্রশংসিত হয়েছিল।তাদের দ্বারা প্রস্তুত ১৫৩৬ সালের পার্থিব গ্লোব এবং ১৫৩৭ সালের স্বর্গীয় গ্লোবের বিশেষ খ্যাতি ছিল। প্রথম গ্লোবটি তৈরির সময় ফ্রিজিয়াস ভ্যান ডার হেইডেনের সহায়ক লেখক ছিলেন এবং প্রযুক্তিগত কাজেও তিনি হেইডেনকে সহায়তা করেন। জেরার্ডাস মার্কেটর যিনি সেই সময় ফ্রিজিয়াসের অধীনস্থ ছাত্র ছিলেন, তিনি খোদাইয়ের কাজে সহায়তা করেছিলেন। দ্বিতীয় গ্লোবটির কাজ শুরু করার সময় মার্কেটর সহ-লেখক হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
১৫৩৩ সালে, তিনি প্রথমবার জরিপ বা সার্ভে করার কাজে তার বিখ্যাত ত্রিভূজায়নের (ট্রায়াঙ্গুলেসন) পদ্ধতির প্রচলন করেন যা আজও ব্যবহার হয় (চিত্রটি দেখুন)।এই পদ্ধতিতে একটি ভূমিরেখা বা বেসলাইন স্থাপন করে, (উদাঃ, এক্ষেত্রে ব্রাসেলস এবং অ্যান্টওয়ার্প শহরের সংযোগকারী রেখা) অন্যান্য শহরের অবস্থান (যেমন, মিডেলবার্গ, গেন্ট ইত্যাদি) নির্ণয় করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট শহরের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য একটি কম্পাস-এর সাহায্যে ভূমিরেখার দুই প্রান্ত থেকেই এক এক করে দিকনির্দেশ গ্রহণ করা হয় ও দুই প্রান্ত থেকেই দুটি দিকনির্দেশকারী রেখা অঙ্কন করা হয়। যেখানে দুটি রেখা পরস্পরকে ছেদ করছে সেখানেই অনুসন্ধানকারী শহরের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। এটি ত্রিভূজায়নের ধারণার একটি তাত্বিক উপস্থাপনা মাত্র-অবস্থানভিত্তিক বিধিনিষেধের কারণে ব্রাসেলস বা অ্যান্টওয়ার্প থেকে মিডেলবার্গকে দেখা অসম্ভব। তবুও, এই ধারণাটি শীঘ্রই পুরো ইউরোপ জুড়ে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।

এর বিশ বছর পর ১৫৫৩ সালে, কীভাবে একটি নির্ভুল ঘড়ি ব্যবহার করে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করা সম্ভব সেই সম্পর্কে তিনিই প্রথম আলোকপাত করেন।[২] জিন-ব্যাপটিস্ট মরিন (১৫৮৩-১৬৫৬) কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাননি যে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ে ফ্রিজিয়াসের পদ্ধতি কার্যকর হবে। এই ব্যাপারে তার একটি উদ্ধৃতি খুব বিখ্যাত যেখানে তিনি বলেছিলেন যে,"আমি জানি না যে শয়তান দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়কারী সময়যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম কিনা তবে মানুষের চেষ্টা করা বোকামি।"।[৩] ঘটনাচক্রে এর ঠিক দুই দশক পরে জন হ্যারিসন একটি পর্যাপ্ত নির্ভুল ঘড়ি বা সাফিসিয়েন্টলি অ্যাকুরেট ক্লক প্রস্তুত করতে সক্ষম হন।
ফ্রিজিয়াস ক্রস-স্টাফ, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত রিং ("জেমা'স রিংস" নামে পরিচিত) সহ অনেক নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার ও উন্নতিসাধন করেছিলেন। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখ্য, জেরার্ডাস মারকেটর (যিনি তার সহযোগী হয়েছিলেন), জোহানেস স্টাডিয়াস, জন ডি, আন্দ্রেস ভেসালিয়াস এবং রেমবার্ট ডডোয়েন্স।
৪৬ বছর বয়সে লুভেনে তার দেহান্ত হয়। তার সন্তান কর্নেলিয়াসের এক বিবরণ অনুসারে তিনি কমপক্ষে ৭ বছর ধরে কিডনির পাথরের সমস্যায় ভুগছিলেন এবং তাতেই তিনি মারা যান।[৩]
বর্তমানকালে চাঁদের একটি ক্রেটার তার নামে নামাঙ্কিত। ষোড়শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ও আবিস্কারক গিয়ালেরাস আরসেনিয়াস ছিলেন তার ভাগ্নে।
উল্লেখযোগ্য কাজ
[সম্পাদনা]- কসমোগ্রাফিয়া (১৫২৯) ভন পেট্রাস এপিয়ানাস, জেমা ফ্রিজিয়াস কর্তৃক টিকাবদ্ধ৷
- ডি প্রিন্সিপিয়াস অ্যাস্ট্রোনমিয়া এট কসমোগ্রাফিয়া (১৫৩০), মূলত নভোচারী এবং মহাকাশগ্রন্থ৷
- ডি ইউসু গোলবি অথবা গ্লোবের ব্যবহার (১৫৩০)৷
- এরিথমেটিকা প্রাক্টিশিয়া মেথোডিউস ফ্যাসিলিস অথবা পাটিগণিত ব্যবহারের সহজ পদ্ধতি (১৫৪০)৷
- ডি অ্যানিউলি অ্যাস্ট্রোনমিকি ইউসু[৪] অথবা বার্ষিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যবহার (১৫৪০)৷
- ডে রেডিয়ো অ্যাস্ট্রোনমিসিও এট জিওমেট্রিকো অথবা রেডিওর জ্যোতির্বিজ্ঞানে এবং জ্যামিতিতে উপযোগিতা (১৫৪৫)৷
- ডে অ্যাস্ট্রোলবিও ক্যাথোলিকো (১৫৫৬)৷
-
কসমোগ্রাফিয়ার পৃষ্ঠা থেকে
-
এরিথমেটিকা প্রাক্টিশিয়া মেথোডিউস ফ্যাসিলিস
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ He was cited as Jemme Reinersz in the 1533 edition of Peter Apian's Cosmographia.
- ↑ ক খ There is no English biography of Van der Heyden (or Gaspar a Myrica c1496—c1549) but he has an entry in the Dutch Nationaal Biografisch Woordenboek.
- ↑ ক খ "Longitude1"। Groups.dcs.st-and.ac.uk। ২০১৬-১১-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৩-১৯।
- ↑ Usus annuli astronomici - Rainer Gemma Frisius। ১৫৪৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৩-১৯ – Internet Archive-এর মাধ্যমে।
annuli astronomici.
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
- ও'কনর, জন জে.; রবার্টসন, এডমুন্ড এফ., "Regnier Gemma Frisius", ম্যাকটিউটর হিস্টোরি অব ম্যাথমেটিকস আর্কাইভ, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয় ।
- গণিত উদ্ভববিজ্ঞান প্রকল্পে Gemma (Jemme Reinerszoon) Frisius
- Description of the Camera Obscura in 1544 by Frisius
- Arithmeticae practicae methodus facilis From the John Davis Batchelder Collection in the Rare Book and Special Collection Division at the Library of Congress