বার্লিন ইহুদি জাদুঘর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(জিউইশ মিউজিয়াম বার্লিন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
লিবসকিন্ডের নকশাকৃত ইহুদি জাদুঘর
ইহুদি জাদুঘরের প্রবেশপথ

বার্লিন ইহুদি জাদুঘর (জার্মান: Das Jüdische Museum Berlin; ডাস্‌ য়ুডিশে মুজেউম্‌ বের্লিন্‌) ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ইহুদী বিষয়ক জাদুঘর। বার্লিনে অবস্থিত এই জাদুঘরটিতে জার্মান-ইহুদী সম্প্রদ্বায়ের প্রায় ১০০০ বছরের ইতিহাস রক্ষিত আছে। জাদুঘরের তিনটি ভবনের মধ্যে দুইটি ভবন বিশ্বখ্যাত স্থপতি ড্যানিয়েল লিবসকিন্ড নকশা করেছেন। জার্মান-ইহুদী সম্প্রদ্বায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির ইতিহাস ও হলোকস্টের ঘটনা জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ, পাঠাগার ও সংরক্ষাণাগারে মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরটি ২০০১ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এটি বার্লিনের অন্যতম দর্শকপ্রিয় জাদুঘর। ২০১২ সালে প্রায় ৭২০,০০০ দর্শনার্থী জাদুঘরটি দর্শন করে।[১] জাদুঘরের বিপরীত পাশে অ্যাকাডেমি অফ দ্য জুইশ মিউজিয়াম বার্লিন অবস্থিত। এটিও স্থপতি ড্যানিয়েল লিবসকিন্ডের নকশাকৃত। এখানে সংরক্ষণাগার, পাঠাগার, লেকচার হল এবং জাদুঘরের শিক্ষা বিভাগ অবস্থিত।[২] বার্লিন ইহুদি জাদুঘর প্রতিদিন সকাল 10:00 টা থেকে 7:00 টা পর্যন্ত খোলা থাকে।[৩]

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মাইকেল ব্লুমেনথাল ১৯৯৭ থেকে জাদুঘরটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নকশা[সম্পাদনা]

অ্যাকাডেমি অফ দ্য ইহুদি জাদুঘর

বার্লিন ইহুদি জাদুঘরের পশ্চিম অংশে অবস্থিত। বার্লিনের প্রাচীর পতনের পূর্বে এই অংশ পশ্চিম বার্লিন নামে পরিচিত ছিল।[৪] জাউঘরটি মূলত দুইটি ভবনের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে একটি বারোক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। এর নামকলিগিয়েনহাউস, এতে আগে বার্লিন জাদুঘর অবস্থিত ছিল। অন্য ভবনটি ডিকন্সট্রাকটিভিস্ট রীতিতে তৈরি, এটি স্থপতি ড্যানিয়েল লিবসকিন্ডের নকশাকৃত। এই দুইভবনের কোনটিরই ভূমির সাথে সরাসরি সংযোগ নেই। লিবসকিন্ডের নকশাকৃত ভবনটির ক্ষেত্রফল ১৬১,০০০ বর্গমিটার এবং এটি পুরনো ভবন থেকে শুরু হওয়া একটি ভূতল প্রবেশপথ দ্বারা যুক্ত। বাহ্যিকভাবে ভবনটি আঁকাবাঁকা আকৃতির।

ড্যানিয়েল লিবসকিন্ড তার নকশা সম্পর্কে বলেন, “নতুন নকশাটি বার্লিন প্রাচীর পতনের এক বছর আগে সৃষ্টি করা হয়। এই নকশাটি তিনটি ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। প্রথমত, বার্লিন অধিবাসী ইহুদিদের অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবদান ছাড়া বার্লিনের ইতিহাস উপলব্ধির অসম্ভাব্যতা। দ্বিতীয়ত, বার্লিনের চেতনায় ও স্মৃতিতে ভৌত ও আত্মিকভাবে হলোকস্টের অর্থকে সম্পৃক্ত করা। তৃতীয়ত, বার্লিনে ইহুদি জনগোষ্ঠীর শূণ্যতা এবং তাদের ধ্বংসকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমেই কেবল ইউরোপের মানবিক ভবিষ্যতের সূচনা হতে পারে।"[৫]

নতুন ভবনটির নিচতলায় দর্শনার্থীরা প্রথমে তিনটি পরস্পরচ্ছেদী করিডর দেখতে পান। স্থপতি এগুলোর নাম দিয়েছেন “এক্সিস” বা অক্ষ। এগুলোর সাথে লিবসকিন্ডের নকশাকৃত প্রথম ভবন ফেলিক্স নুসবাম হাউসের সাদৃশ্য রয়েছে। নতুন এ ভবনটির তিনটি করিডর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অরথ বহন করে: জার্মানির ইতিহাসে ইহুদি জনগোষ্ঠীর চলমানতা, জার্মানি থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর দেশান্তর, এবং হলোকস্ট[৬]

তিনটি করিডর পৃথক তিনটি অক্ষবিশিষ্ট। প্রথম অক্ষটি শেষ হয়েছে একটি দীর্ঘ সিঁড়িতে, এখান থেকে স্থায়ী প্রদর্শনীতে যাওয়া যায়। দ্বিতীয় অক্ষ জাদুঘরের সাথে হফম্যান বাগানকে যুক্ত করেছে। এই বাগানের অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমির সাথে কিছুটা অসমান্তরাল। বাগানে ৪৯টি পিলার রয়েছে। তৃতীয় অক্ষটির সাথে যুক্ত হয়েছে হলোকস্ট টাওয়ার। বার্লিন ইহুদি জাদুঘর স্থপতি লিবসকিন্ডের প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সফল স্থাপত্য।

জাদুঘরের বিপরীত পাশে লিবসকিন্ডের নকশাকৃত অপর স্থাপনাটি হচ্ছে অ্যাকাডেমি অফ দ্য ইহুদি জাদুঘর। এই ভবনের স্থানে আগে ফুলের বাজার ছিল।[৭]

স্থায়ী প্রদর্শনী[সম্পাদনা]

বার্লিন ইহুদি জাদুঘরে জার্মান-ইহুদী জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরে প্রদর্শনীর শুরুতেই রয়েছে মধ্যযুগে জার্মানি রিনে অঞ্চলের অধিবাসী ইহুদীদের জীবনধারার চিত্র। বারোক পর্যায়ের ইতিহাস মূলত বিখ্যাত ইহুদী ব্যবসায়ী গ্লিকি বাস ইয়ুদাহ লাইবের লিখিত ডায়েরি থেকে চিত্রিত হয়েছে। তার লিখিত ডায়েরিতে তৎকালীন ইহুদীদের জীবনধারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইহুদী জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নতিকে প্রদর্শন করা হয়েছে সমৃদ্ধি ও অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান-ইহুদী সৈন্যরা দেশের পক্ষে ব্যাপকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই সময়কার ইতিহাসের প্রদর্শনীতে মুখ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে বার্লিনের বিকাশ এবং ক্রমেই ইউরোপীয় একটি সমৃদ্ধ মেট্রোপলিস হিসেবে বার্লিনের উত্থান। এসময় বার্লিনে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিজ্ঞানী, শিল্পী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী হিসেবে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করে।

জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র অংশে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ইহুদীরা তাদের প্রতি বৈষম্যের প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া করেছিল। ইহুদীরা সেসব বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইহুদী বিদ্যালয় এবং ইহুদীদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান চালু করে। হলোকস্টের পরে জীবিত ইহুদীরা অভিবাসী হিসেবে জার্মানি ত্যাগ করতে চায়। সেসময় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির ইহুদীরা একত্রীত হতে শুরু করে। সেসময়ের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিচার – ফ্রাঙ্কফুর্টের আউশভিটজ টড়ায়াল এবং ডুসেলডোর্ফের মায়ডানেক ট্রায়াল। এগুলোকে প্রদর্শনীতে গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে। স্থায়ী প্রদর্শনীর সমাপ্তি হয়েছে একটি অডিও ইন্সটলেশনের মাধ্যমে। এতে উপস্থাপিত হয়েছে ১৯৪৫ পরবর্তী বিভিন্ন মানুষের শৈশব ও যৌবনকালীন সময়ের ঘটনা। ১৯৪৫-এর পরে জার্মানিতে ইহুদি জনগোষ্ঠীর নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।

বার্লিন ইহুদি জাদুঘর অ্যাকাডেমি[সম্পাদনা]

বার্লিন ইহুদি জাদুঘর অ্যাকাডেমি ২০১২ সালে উন্মুক্ত করা হয়। এর উদ্দেশ্য একটি স্থান তৈরি করা যেখানে জার্মান ইহুদী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি যেমন- ইহুদী জনগোষ্ঠীর অভিবাসন, জাতিগত বৈচিত্রতা ইত্যাদি গবেষণা ও আলোচনা করা হবে। অভিবাসনের গন্তব্যস্থল হিসেবে জার্মানি এবং উদীয়মান বহুত্ববাদী সমাজ বিষয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনার জন্য একটি উপযুক্ত কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা এই অ্যাকাডেমির অন্যতম উদ্দেশ্য।[৮][৯]

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Jewish Museum Berlin (১১ জানুয়ারি ২০১৩)। "Press information"। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  2. Rosenfield, Karissa (১৭ নভেম্বর ২০১২)। "Daniel Libeskind's Academy of the Jewish Museum Berlin Opens Today"। ArchDaily। 
  3. "Berlin Jewish Museum in Friedrichshain-Kreuzberg"। ২০২২-০৬-২৯। ২০২২-০৭-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-০১ 
  4. Berlin.de। "Berlin Wall Trail"। ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  5. Jewish Museum Berlin। "Daniel Libeskind, Jewish Museum Berlin"। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  6. Jewish Museum Berlin। "Information about the architecture"। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  7. Jewish Museum Berlin। "Information about the design and creation of the academy"। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  8. Jewish Museum Berlin। "Academy of the Jewish Museum Berlin"। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  9. Daniel Libeskind - Jüdisches Museum Berlin, by Elke Dorner. Berlin: Gebr. Mann Verlag, 3. Auflage 2006; আইএসবিএন ৩-৭৮৬১-২৫৩২-৫. (জার্মান)

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]