বিষয়বস্তুতে চলুন

গিলমান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

গিলমান (একবচন আরবি: غُلاَم ghulām,[note ১] বহুবচন غِلْمَان ghilmān)[note ২] ছিলেন দাস-সৈনিক এবং/অথবা ভাড়াটে সৈনিক, যাঁরা পুরো ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। নবম শতকের শুরু থেকে উনবিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত ইসলামি রাষ্ট্রগুলো নিয়মিতভাবে দাসদের সৈনিক হিসেবে ব্যবহার করত। এই ধরণের প্রথা ইসলামি বিশ্বের বাইরের অঞ্চলে খুবই বিরল ছিল।[]

কুরআনে গিলমান (غِلْمَان) শব্দটি জান্নাতের ভোগ্য বস্তু হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে তারা সেবক বালকদের রূপে উপস্থাপিত। এই বিষয়টি সূরা ৫২:২৪ এবং সম্ভবত ৫৬:১৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে।[][]

শব্দমূল

[সম্পাদনা]

গিলমান (غِلْمَان) এবং এর একবচন রূপ গুলাম (غلام) শব্দ দুটি আরবি উৎসভিত্তিক, যার অর্থ ছেলে বা সেবক। এটি আরবি ḡ-l-m (غ ل م) মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত।[][]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

গিলমান ছিলেন দাস-সৈনিক, যাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে দখলকৃত অঞ্চল বা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হতো, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার তুর্কি জাতিসমূহ এবং ককেশীয় জনগণের মধ্যে থেকে (তুর্কি ভাষায়: কোলে‌মেন)। তারা দলবদ্ধভাবে যুদ্ধ করত এবং তাদের সেবার জন্য উচ্চ পারিশ্রমিক দাবি করত।[]

ইসলামি বিশ্বে দাস-সৈনিক ব্যবহারের ইতিহাস ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত, যখন আফ্রিকান দাস-সৈনিকদের মুহাম্মদ এবং রাশিদুন খিলাফতের অধীনে কাজ করতে দেখা যায়। উমাইয়া খলিফাদের আমলে স্লাভ এবং বের্বারদেরও সৈনিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ব্যাপকভাবে দাস-সৈনিক নিয়োগ শুরু হয় নবম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে।[]

আব্বাসি খলিফাদের পূর্বে, প্রথম মুসলিম শাসক যিনি দাস-সৈনিকদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন তিনি ছিলেন ইব্রাহিম প্রথম ইবনে আল-আঘলাব (শাসনকাল ৮০০–৮১২), যিনি ইফ্রিকিয়ার আঘলাবি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এই অঞ্চলে ইতোমধ্যেই বিপুলসংখ্যক কৃষিদাস এবং সাহারা মরুভূমি জুড়ে বিস্তৃত দাসবাণিজ্যের পথ ছিল।[]

গিলমানদের আব্বাসি খেলাফতে প্রবর্তন করেন খলিফা আল-মুতাসিম (শাসনকাল ৮৩৩–৮৪২)। তিনি তাদের বিশেষ অনুগ্রহ করতেন এবং নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে তাদের ওপর নির্ভর করতেন। আদালতের দলাদলি ও বিভাজন মোকাবিলায় তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ানো হয়।[] তবে আরব জনসাধারণ গিলমানদের বিরোধিতা করত, ফলে ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে দাঙ্গা দেখা দিলে আল-মুতাসিম রাজধানী স্থানান্তর করে সামর্রায় নিয়ে যান।

আল-মুতাদিদ-এর সময়ে গিলমান ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গতা অর্জিত হয় এবং তাদের প্রশিক্ষণ ছিল অভিজাত ফুরুসিয়্যা রীতিতে অনুপ্রাণিত।[১০] প্রশিক্ষণ শেষে একজন দাস গুলাম মুক্তি পেত এবং অশ্বারোহী অভিজাত বাহিনীতে যুক্ত হতো।[১০] গিলমানরা দ্রুত প্রভাব ও ক্ষমতা অর্জন করে এবং দুর্বল শাসকদের আমলে "সামর্রার বিশৃঙ্খলা" (৮৬০-এর দশকে) চলাকালে চারজন খলিফাকে হত্যা করে। পরে আহমদ ইবনে তুলুন-এর নেতৃত্বে তারা স্বায়ত্তশাসিত শাসকে পরিণত হয় এবং স্বাধীন রাজবংশ গঠন করতে শুরু করে, যার ফলে দশম শতকের মাঝামাঝি আব্বাসি খেলাফতের পতন ঘটে।

উমাইয়া শাসিত স্পেনে “সাকালিবা” (স্লাভ) দাস-সৈনিকদের আল-হাকাম প্রথমের আমলে নিয়োগ শুরু হয়। তবে দশম শতকে লিওনের রাজ্য থেকে খ্রিস্টানদের দাস হিসেবে নিয়ে আসা শুরু হলে তারা একটি পেশাদার বাহিনীতে রূপ নেয়।[১১]

একজন গুলাম তার প্রভুর খরচে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা লাভ করত এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তি অর্জন করতে পারত। গিলমানদের তুর্কি দাস নারীদের সঙ্গে বিবাহ করতে হতো, যাদের নির্বাচন করতেন প্রভুরা।[১২] কিছু গিলমান সম্ভবত আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। পারিবারিক জীবনের অনুপস্থিতি তাদের রাজবংশ স্থাপনা বা স্বাধীনতা ঘোষণায় বাধা হয়ে দাঁড়াত। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে, যেমন গজনভীআনুশতেগিন রাজবংশ।

দাস-সৈনিকরা ইসলামি সেনাবাহিনীর মূল অংশ হয়ে ওঠে, কারণ বেদুইন, গাজি যোদ্ধা এবং সাধারণ সৈন্যরা ততটা নির্ভরযোগ্য ছিল না। গিলমানরা মূল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় তাদের কাছ থেকে অন্ধ আনুগত্য প্রত্যাশিত হতো, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময়েই তারা তেমনটি করেনি।[]

দশম শতক থেকে, প্রভুরা গিলমানদের সেনাবাহিনীর অর্থায়নের জন্য ইক্তা নামে কর জমার জমি বরাদ্দ করতে শুরু করেন।[]

বুয়িদরা এবং সম্ভবত তাহিরিরাও তুর্কি দাস-সৈনিকদের ব্যবহার করে। সাফারিরা তুর্কি, ভারতীয় ও আফ্রিকান দাসদের সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করত। গজনভী রাজবংশ–যা সামানীয়দের একজন দাস-সৈনিক থেকে শুরু হয়েছিল–তাদের সামরিক বাহিনীও দাস-সৈনিক নির্ভর ছিল, প্রথমে তুর্কি ও পরে ভারতীয়দের ভিত্তিতে।

ফত আলি শাহ কাজার সূর্য সিংহাসনে আসীন, একপাশে সম্ভবত আব্বাস মির্জা এবং অপর পাশে দুইজন ঘুলাম, যারা তার ঢাল ও গদা বহন করছে; ১৮১০ সালের শাহানশাহনামা-র একটি চিত্র

তুর্কি সেলজুকরা এবং তাদের উত্তরসূরি গোরীয়রাখোয়ারেজমীয় রাজবংশ তুর্কি দাস-সৈনিক নির্ভর বাহিনী গঠন করে। সেলজুক রাজপুত্রদের একজন দাস-সৈনিক অভিভাবকের (আতাবেক) অধীনে রাখা হতো, যারা নিজেদের রাজবংশও প্রতিষ্ঠা করেছিল। মোঙ্গলদের শাসনকালে এই প্রথা কিছুদিন বন্ধ থাকলেও কারা কইয়ুনলু এবং আক কইয়ুনলু তুর্কমেন শাসকরা এটিকে পুনরায় চালু করেন। সাফাভিদ, আফশারকাজারদের মতো বিভিন্ন ইরানি রাজবংশ জর্জিয়ান, সার্কাসিয়ানআর্মেনীয় দাসদের থেকে সৈন্য সংগ্রহ করত।[১৩] (সেলজুকরা তাদের গোত্রভিত্তিক যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে দাস-সৈনিকদের দিকে ঝুঁকে পড়লেও, মোঙ্গলরা কখনোই এই প্রথা গ্রহণ করেনি)।[১৪]

দিল্লি সালতানাতেও তুর্কি অশ্বারোহী গিলমানদের প্রধান আক্রমণকারী বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মধ্য এশিয়া মোঙ্গলদের দখলে যাওয়ার পর তারা হিন্দু কিশোরদের দাস হিসেবে ধরে এনে ইসলাম গ্রহণ করিয়ে সৈনিক বানাতে শুরু করে।[১৫]

তুর্কি, স্লাভ, নুবীয় এবং বের্বার গিলমানদের মধ্যে জাতিগত সহিংস দ্বন্দ্বও ছিল।[]

কৌশল ও অস্ত্র

[সম্পাদনা]

ইসলামি খলিফারা প্রায়ই মধ্য এশিয়ার তুর্কি জাতিসমূহ থেকে দাস-সৈনিক নিয়োগ দিতেন, কারণ তারা মরুভূমির কঠিন পরিবেশে সহনশীল এবং অশ্বারোহণে দক্ষ ছিল। আব্বাসি খেলাফতে গিলমানরা মূলত অশ্বারোহণকারী আক্রমণ বাহিনী হিসেবে যুদ্ধ করত। তাদের কাজ ছিল শত্রুকে হঠাৎ ও দ্রুত আক্রমণে দুর্বল করা, এরপর মিত্র পদাতিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করত।

তারা এমন একটি বর্শা বহন করত, যা দিয়ে সহজেই শত্রু পদাতিকদের আঘাত করা যেত। এ ছাড়াও তারা একটি গোলাকার কাঠের ঢাল ব্যবহার করত, যা পশুর চামড়া অথবা পাতলা ধাতব পাত দিয়ে মজবুত করা হতো। তাদের কোমরে একটি তলোয়ার ঝুলিয়ে রাখা হতো, যাতে সহজেই বের করে ব্যবহার করা যায়; পিঠ বা বুকে নয়।[১৬]

জান্নাত

[সম্পাদনা]

কুরআনে গিলমান শব্দটি সূরা তূর, আয়াত ৫২:২৪-এ উল্লেখ করা হয়েছে: “তাদের চারপাশে পরিবেশন করবে তাদের জন্য নিযুক্ত গিলমান, যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তোর ন্যায়।” গিলমানদের সাধারণভাবে জান্নাতবাসী ঈমানদারদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ সেবক বালক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

আবার সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত ৫৬:১৭-তে বলা হয়েছে: “তাদের চারপাশে পরিবেশন করবে চিরতরুণ বালকগণ।” এখানে “তাদের” বলতে জান্নাতবাসী ঈমানদারদের বোঝানো হয়েছে এবং “চিরতরুণ বালকগণ” বলতে বোঝানো হয়েছে গিলমান[][]

দশম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, গিলমানদের সৌন্দর্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই সেবক বালকদের উপর জান্নাতের সময়-নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যও প্রয়োগ হয়, ফলে তারা বয়ঃসন্ধির সম্মুখীন হয় না বা কখনও মারা যায় না।[১৭]

কিছু গবেষক মনে করেন, যেহেতু জান্নাতে সন্তান জন্মদানের প্রয়োজন নেই, তাই সেখানে যৌনতা ভিন্নভাবে বিবেচিত হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, গিলমানদেরকে জান্নাতের জন্য প্রতিশ্রুত সুদর্শনা হুরদের পুরুষ সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "note" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="note"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি

  1. Daniel Pipes (১৯৮১)। Slave Soldiers and Islam: The Genesis of a Military System। Daniel Pipes। পৃষ্ঠা 35, 45। আইএসবিএন 0300024479 
  2. El-Rouayheb, Khaled (২০০৫)। Before Homosexuality in the Arab-Islamic World, 1500–1800। University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 131–136। 
  3. Afary, Janet (৯ এপ্রিল ২০০৯)। "The Quran and Homosexuality in the Muslim World"Sexual Politics in Modern Iran। Cambridge University Press। আইএসবিএন 9781107394353। সংগ্রহের তারিখ ৬ আগস্ট ২০২০ 
  4. "Gulam"Etimoloji Türkçe (তুর্কি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১ 
  5. "Gılman"Etimoloji Türkçe (তুর্কি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১ 
  6. "Ghulam - Oxford Islamic Studies Online"। Oxfordislamicstudies.com। ২০০৮-০৫-০৬। আগস্ট ১৯, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  7. Heath, Ian (২০১৫)। Armies of the Dark Ages। Lulu.com। পৃষ্ঠা 59–60। আইএসবিএন 978-1326233327 
  8. Johannes Preiser-Kapeller, Lucian Reinfandt, and Yannis Stouraitis (২০২০)। Migration Histories of the Medieval Afroeurasian Transition Zone Aspects of mobility between Africa, Asia and Europe, 300-1500 C.E.। BRILL। পৃষ্ঠা 419–422। আইএসবিএন 9789004425613 
  9. Shome, Ayan (২০১৪)। Dialogue & Daggers: Notion of Authority and Legitimacy in the Early Delhi Sultanate (1192 C.E. – 1316 C.E.)। Quills Ink Pvt Ltd। পৃষ্ঠা 101। আইএসবিএন 978-93-84318-44-4 
  10. Coetzee, Daniel; Eysturlid, Lee W. (২০১৩)। Philosophers of War: The Evolution of History's Greatest Military Thinkers [2 Volumes]: The Evolution of History's Greatest Military Thinkers (ইংরেজি ভাষায়)। Santa Barbara, CA: Praeger। পৃষ্ঠা 63–64। আইএসবিএন 9780275989774 
  11. Hugh Kennedy (২০১৪)। Muslim Spain and Portugal A Political History of Al-Andalus। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 117। আইএসবিএন 9781317870418 
  12. Cosman, Madeleine Pelner; Jones, Linda Gale (২০০৯)। Handbook to Life in the Medieval World, 3-Volume Set - Madeleine Pelner Cosman, Linda Gale Jones - Google Books। Infobase। আইএসবিএন 9781438109077। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০২-১২ 
  13. "BARDA and BARDA-DĀRI v. Military slavery in Islamic Iran"। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৪ 
  14. Bruno De Nicola, Charles Melville (২০১৬)। The Mongols' Middle East Continuity and Transformation in Ilkhanid Iran। BRILL। পৃষ্ঠা 47। আইএসবিএন 9789004314726 
  15. Roy, Kaushik (২০১৫)। "3"। Military Manpower, Armies and Warfare in South Asia। Routledge। পৃষ্ঠা 48–49। আইএসবিএন 978-1317321279 
  16. "Kalifit olivat orjasoturiensa armoilla" [খলিফারা ছিলেন তাঁদের দাস-সৈনিকদের করুণায়]। Tieteen Kuvalehti - Historia (Finnish ভাষায়)। নং 15/2018। Oslo, Norway: Bonnier Publications International। অক্টোবর ১১, ২০১৮। পৃষ্ঠা 40। 
  17. Günther, Sebastian; Lawson, Todd (২০১৬)। Roads to Paradise: Eschatology and Concepts of the Hereafter in Islam (2 vols): Volume 1: Foundations and the Formation of a Tradition. Reflections on the Hereafter in the Quran and Islamic Religious Thought / Volume 2: Continuity and Change. The Plurality of Eschatological Representations in the Islamicate World Thought (SET)। Leiden: BRILL। পৃষ্ঠা 301। আইএসবিএন 978-90-04-33095-5