কোভিড-১৯ এ বাংলাদেশে শিশুর উপর প্রভাব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ শিশু মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উচ্চ বিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব পরিবারে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চাপের মধ্যে আছে।

পারিবারিক সহিংসতার শিকার শিশু[সম্পাদনা]

কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক পরিবারে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব শিশুর জীবনে প্রভাব ফেলে। কোভিড-১৯ মহামারীতে শিশু ও নারীদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাকে তরান্বিত করেছে। এই মহামারী পারিবারিক সহিংসতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণে। বাল্যবিবাহ হয়েছে অনেকের। ২০২০ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, এই তিন মাসে দেশে ২১৩ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষিত হয়েছেন ১১৬ জন শিশু।[১] এভাবে ২০২০ সালের মে মাসে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) তার কর্মএলাকার মোট ৫৩,৩৪০ জন নারী ও শিশুর সাথে ফোনে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করে বলে। এদের মধ্যে ১৫,৯০৬ জন শিশু কথা বলে। শিশুদের সবাই কিশোর কিশোরী। জানা যায় ১৩১৯ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। শুধু মে মাসে ২১৭১ জন শিশুর মধ্যে ১৬২১ জন শিশু পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া বাল্যবিয়ে, কাজের জায়গায় সহিংসতা, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির চেষ্টার শিকার হয়েছে। নির্যাতিত শিশুদের মধ্যে ১৪৭৭ জন মেয়ে ও ৬৯৪ জন ছেলে। মেয়ে শিশুদের মধ্যে ১০১৩ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে, ১৭০ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে, ২৩৩ টি বাল্যবিয়ে থামানো গেছে, ১৯ জন শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ১৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, ২১ জন অপহরণ হয়েছে, ১৯ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ত্রাণ আনতে গিয়ে ৩ জন মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।[২]

কোভিড-১৯ এ শিশুশ্রম[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োাজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবের কারণে আরও লাখ লাখ শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে রয়েছে। দরিদ্র পরিবারে অভাব, অর্থনৈতিক চাপ ও স্কুল বন্ধের কারণে শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে শ্রম বিক্রি করে। অনেক পরিবার কাজ হারানোর ভয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরে আনে না। ফলে তারা সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয় এবং এ খারাপ পরিবেশে তারা বেড়ে ওঠে। তারা সুস্থতা খুঁজে পায় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭০% জন (১১ কোটি ২০ লাখ) কৃষিখাতে, ২০% জন (৩ কোটি ১৪ লাখ) সেবাখাতে এবং ১০% জন (১ কোটি ৬৫ লাখ) শিল্পখাতে কাজ করে। ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ২৮% জন এবং ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ৩৫% জন স্কুলের বাইরে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর হার বেশি। শহরাঞ্চলের (৫ শতাংশ) চেয়ে গ্রামাঞ্চলে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার (১৪ শতাংশ) তিনগুণ বেশি। এ শিশুশ্রম শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে, পড়াশোনাকে ব্যাহত করে, তাদের অধিকার ও ভবিষ্যতের সুযোগগুলোকে সীমিত করে এবং আন্তঃ-প্রজন্মগত দুষ্টচক্রে পড়ে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন,

মহামারির মাঝে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দরিদ্রতা বৃদ্ধি আরও অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে–যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে এবং তার জন্য তারা সকল পন্থাই অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আমাদের এখন শিশুদের প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং এই ক্ষতিকারক শিশুশ্রমের মূলে যে সকল সামাজিক সমস্যাগুলো রয়েছে তা নিরসনে জোর দেয়া প্রয়োজন।[৩]

শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে।[৪] নিঃসন্দেহে এটা বাস্তবায়ন হলে শিশুরা শ্রমমুক্ত জীবনযাপন করবে।

অনলাইন ক্লাসে শিশু[সম্পাদনা]

কোভিড-১৯ এর কারণে সরকার অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এতে শিশুরা কতটুকু শিখতে পেরেছে তা মূল্যায়ন করলে ফলাফল পাওয়া যাবে। এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় শিশুদের বেশিরভাগ সময় স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের সামনে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু মোবাইল ও কম্পিউটারের স্ক্রিন ও হেডফোন ব্রেন ও চোখের যে ক্ষতি করেছে তা কীভাবে ঠিক হবে? এতে শিশুরা মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং দৃষ্টি শক্তিতে তা প্রভাব ফেলে। এটার পাশাপাশি বিভিন্ন অশ্লীল ভিডিও দেখে নৈতিকতা নষ্ট করে। ভিডিও গেম খেলে মেজাস করে খিটখিটে।[৫] সেটা থেকে শিশুরা সহজে ভালো হতে পারে না।

কোভিড-১৯ এ দরিদ্র পরিবারে শিশু[সম্পাদনা]

লকডাউনের কারণে দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা কাজ না পেয়ে অভ্যুক্ত থাকে, শিশুরাও অভ্যুক্ত থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দা চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ৬৪ শতাংশ শিশুর পরিবার কঠিন খাদ্য সংকটে রয়েছে। খুব ছোট পরিসরে জরিপটি করা হলেও এ থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। আর তা হলো দরিদ্র পরিবারগুলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা যেন বিষফোর উপসর্গ। খাদ্য সংকটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগে। শিশুর পুষ্টির অভাব হলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে, স্নায়ুরোগে ভুগে, ওজন কমে যায়। এছাড়াও ঘরে বসে থেকে শিশুরা একাকীত্বে ভুগে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। শিশুর হাঁটা, কথা বলা, দৌঁড়ানো, ছবি আঁকা, নাচ ইত্যাদি করতে পারে না। শিশুর আচরণগত পরিবর্তন, বিষণ্নতা, মানসিক ট্রমা হতে পারে। বাবা-মায়ের মানসিক চাপের প্রভাব শিশুদের দেহ ও মনে পড়ে। যার ব্যাখ্যা হয়তো শিশু সরল মন বুঝতে পারে না। এতে বাবা-মায়ের উপর তার ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, তাদের সাথে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন বেড়ে যেতে পারে এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শে আসতে পারে। সবমিলিয়ে শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি একটা ট্রমা থেকে যাবে।[৬] দেশব্যাপী ৩৯৯৭ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ৫২.৮৭ ভাগের মধ্যে বিষণ্নতার উপসর্গ এবং শতকরা ৪০.৯১ ভাগের মধ্যে দূর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্যের উপসর্গ রয়েছে। আঠার থেকে ২৮ বছর বয়সী ৩৩৩১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে চালানো আরেক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ১২.৮ ভাগের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দিন দিন শিশু সমাজ ধ্বংস হবে। ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা শাবনাজ জাহেরিন বলছেন, “ক্ষুধা, অপুষ্টি ও একাকীত্ব ছাড়াও শিশুরা ঝুঁকির মুখে পড়বে আরো নানা ভাবে।”[৭]

বিবাহবিচ্ছেদে শিশু[সম্পাদনা]

করোনার সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের হারও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। মহামারিকালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন। ২০২০ সালে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১২ হাজার ৫১৩টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছে নারী, বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছে পুরুষ।[৮] স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ শিশুদের জীবনে বেশি প্রভাব পড়ে। তারা মারমুখী, নেশাগ্রস্থ, বখাটে হয়।

শিশুর জীবন উন্নয়নে পরামর্শ[সম্পাদনা]

এহেন পরিস্থি থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রথম বাবা-মাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দুর করতে হবে। তাদের মনের যত্ন নিতে হবে।[৯] শিশুকে বুঝাতে হবে তার বাবা-মা তাকে অনেক ভালোবাসে। সর্বজনীন শিশু সুবিধার জন্য সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুরা যাতে সার্বক্ষণিক মোবাইল-কম্পিউটারে না থাকে সে দিকে নজর রাখতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোর উপার্জন ক্ষেত্র সহজ করা যাতে পরিবারগুলোকে পারিবারিক উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে শিশুদের অবলম্বন করতে না হয়। শিশুশ্রমকে প্রভাবিত করে এমন ক্ষতিকারক লৈঙ্গিক রীতিনীতি এবং বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।[৩] খেয়াল রাখতে হবে “সুস্থ শিশু সুস্থ দেশ তাতেই সোনার বাংলাদেশ।”

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. প্রতিবেদক, নিজস্ব; ডটকম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। "কোভিড-১৯ পারিবারিক সহিংসতা বাড়িয়েছে বহু গুণে: স্পিকার"bangla.bdnews24.com। ২০২১-১০-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  2. "MJF | মে মাসে ১৩,৪৯৪ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকারএরমধ্যে ৪১৬০ জন প্রথম সহিংসতার শিকার" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  3. "শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে : দুই দশকে প্রথম বৃদ্ধি"www.unicef.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  4. "বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ শিশু"ভিওএ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  5. "করােনাকালে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি ও তার ভবিষ্যৎ" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৬ 
  6. Welle (www.dw.com), Deutsche। "শিক্ষার্থীদের 'ঘরে' ও 'মনের ঘরে' করোনার প্রভাব | DW | 21.05.2021"DW.COM। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  7. "করোনাভাইরাস: শিশুরা যেভাবে এই মহামারির নীরব শিকার"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৪ 
  8. "বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ"ittefaq। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৬ 
  9. "করোনাকালে শিশু-কিশোরদের মনের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন"Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৬