কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম- ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৩ - মৃত্যু- ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৯) বাঙালি সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

কেদারনাথের জন্ম ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ৪ঠা ফাল্গুন (১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৩) রবিবার উত্তর ২৪ পরগণার দক্ষিণেশ্বরে। পিতা গঙ্গানারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কেদারনাথেরা ছিলেন তিন ভাই। গঙ্গাপ্রসাদ ও বিন্দুবাসিনী দেবীর মধ্যম পুত্র কেদারনাথ। দক্ষিণেশ্বর বঙ্গ-বিদ্যালয়ে ( এখনকার দক্ষিণেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় ) কিছুদিন পড়াশোনা করে উত্তরপাড়া হাই ইংলিশ স্কুলে (বর্তমান উত্তরপাড়া গভর্ণমেণ্ট স্কুল) ভর্তি হন; কিন্তু গঙ্গা পার হয়ে যাতায়াত করতে হত বলে মায়ের আপত্তিতে দু'বছর পর কুটিঘাটা স্কুলে চলে আসেন। দাদা মিরাটে বদলি হয়ে যাওয়ায় সবাই মিরাটে চলে যান। সেখানে কোন্নগর-নিবাসী কেদারনাথ দত্তের স্কুলে ভর্তি হলেন। দু’বছর পরে দাদা বদলী হয়ে চলে আসেন আম্বালায়। আম্বালায় অতি কষ্টে ইংরেজদের একটি কোচিং ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর ভর্তি হলেন লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজিয়েট স্কুলে।

কর্মজীবন ও সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]

কলকাতায় এসে কেদারনাথ প্রথমে‘হাউণ্ড এলেন কোম্পানী’র সওদাগরি দপ্তরে এবং পরে ‘কমিস্যারিয়েণ্ট অ্যাকাউণ্ট’ অফিসে কাজ করেছেন। অবশ্য ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে 'বালক' মাসিক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেনামি রচনার উপর শ্রীকেদার, দক্ষিণেশ্বর' স্বাক্ষরে 'রত্নোদ্ধার' নামে সরস পত্র লিখে সাহিত্য ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। উত্তর কলকাতায় থাকাকালে ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় 'সংসারদর্পণ’ মাসিক পত্রিকাল সম্পাদনা ও প্রকাশনা শুরু করেন। কেদারনাথের প্রথম প্রকাশিত কাব্যনাটকের 'রত্নাকর' প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এরপর তিনি আড়াই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় তিন'শ প্রাচীন কবি সঙ্গীত সংগ্রহ করে একখানি সংকলন গ্রন্থ 'গুপ্ত রত্নোদ্ধার' নামে প্রকাশ করেন। কবি হেমচন্দ্র গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও 'সাধনা’পত্রিকার ১৩০২-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাতে এই সঙ্কলনটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একটি সুদীর্ঘ নিবন্ধও প্রকাশ করেন। ‘দৈনিক চন্দ্রিকা’ও ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ‘নন্দীশর্মার নোট’ বা ডায়েরি নামে তিন বছর ধরে হাস্যরসাত্মক ‘চুটকি’ প্রকাশ করেছেন কেদারনাথ। সেনাবাহিনীতে চাকরির সময় কেদারনাথ নানা দেশ ঘুরে ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে চীনে চলে যান। ১৯০৫-এ চীন থেকে ফিরে এসে কানপুরে ষ্টোর অফিসের ভার গ্রহণ করেন এবং সেখানকার ‘বঙ্গ-সাহিত্য-সমাজ’ লাইব্রেরীর সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। তার আগ্রহ এবং উদ্যোগে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-কে আমন্ত্রণ জানান হয় - উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ বর্ধন। কেদারনাথের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যার বিয়ের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে মনস্থ করেন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে চাকরিতে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন এবং কাশীতে বসবাস শুরু করেন। কেদারনাথ 'চীনপ্রবাসীর পত্র’ নামে 'ভারতী’ পত্রিকায় ( চৈত্র ১৩১০ ও বৈশাখ ১৩১১ ) দুটি লেখা লেখেন। লেখা দুটিতে উল্লেখিত নারী শিক্ষা সম্বন্ধে তার নারীদের অর্থকরী বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাশীতে অবস্থান কালেও কেদারনাথ তার সাহিত্য চর্চা চালিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন -"অন্তরে কিন্তু সাহিত্য প্রীতির আসন পাতাই ছিল। কোথাও না লিখলেও বাড়ীতে একখানা খসরা খাতা খোলা থাকত, অবসর বিনোদনের উপায়ছলে। দশাশ্বমেধে সাধুসন্ত দেখে বেড়াই, সুযোগ হলে সঙ্গও খুঁজি। তদ্ভিন্ন বিশেষ কিছু চোখে পড়লে বাসায় ফিরে অন্তর কণ্ডুয়নবৃত্তি হিসেবে লিখে রাখি। খাতা খানি ক্রমে পুষ্ট হতে থাকে।" এই খাতা অবলম্বন করেই ‘নন্দিশর্মা’ ছদ্মনামে তার ‘কাশীর-কিঞ্চিৎ’ পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। কাশীতে তার সঙ্গে রসরাজ অমৃতলাল বসু ও কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রেরও সাক্ষাৎ হয়। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে কাশী থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা‘প্রবাস-জ্যোতিঃ’বছর খানেক সম্পাদনা করেছিলেন কেদারনাথ। দাদা গোপালচন্দ্র সাহিত্য-চর্চাও করতেন। ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ তিনি নিয়মিত লিখতেন। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন উচ্চবিত্ত, রবীন্দ্রনাথ যেমন বুদ্ধিজীবী এবং শরৎচন্দ্র যেমন নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালীদের লইয়া সাহিত্য-সংসার রচনা করিয়াছেন, কেদারনাথ তেমনই দরিদ্র বাঙালী কেরাণীদের লইয়া এক নূতন সংসার গঠন করিয়াছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ[সম্পাদনা]

  • ‘রত্নাকর’ (অভিনয় কাব্য, ১৮৯৩)
  • 'গুপ্তরত্নোদ্ধার’ ( প্রাচীন কবিদের সঙ্গীত সংগ্রহ, ১৮৯৪)
  • 'কাশীর কিঞ্চিৎ’ (রস কবিতা, ১৯১৫)
  • ‘কাশী সঙ্গীতাঞ্জলি' (১৯১৬)
  • 'চীনযাত্রী' (ভ্রমণ কাহিনী, ১৯২৫)
  • 'শেষ খেয়া' (উপন্যাস, ১৯২৫)
  • 'আমরা কি ও কে' (লিপিচিত্র, ১৯২৭)
  • ‘কবলুতি' (লিপিচিত্র, ১৯২৮)
  • ‘কোষ্ঠির ফলাফল' (উপন্যাস, ১৯২৯)
  • 'পাথেয়' (গল্প সমষ্টি, ১৯৩০)
  • ’ভাদুড়ী-মশাই' (উপন্যাস, ১৯৩১)
  • 'দুঃখের দেওয়ালী' (গল্প-সমষ্টি, ১৯৩২)
  • ’উড়ো-খৈ’ (রহস্য কবিতা, ১৯৩৪)
  • ’আই হ্যাজ' (উপন্যাস, ১৯৩৫)
  • ’পাওনা' (উপন্যাস, ১৯৩৬)
  • 'মা ফলেষু’ (গল্প সমষ্টি, ১৯৩৬)
  • ’সন্ধ্যাশঙ্খ' (গল্পসমষ্টি, ১৯৪০)
  • 'নমস্কারী' (গল্পসমষ্টি, ১৯৪৪)
  • ’স্মৃতিকথা' (১৯৪৫)। সজনীকান্ত দাশের অনুরোধে ৮২ বৎসর বয়সে তিনি নিজের জীবনের কিছু কথা নিয়ে লেখেন'স্মৃতিকথা'।

সম্মাননা[সম্পাদনা]

১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণপদকলাভ করেন। সাহিত্য-মহলে কেদারনাথ 'দাদামহাশয়’ নামে পরিচিত ছিলেন। কেদারনাথ ছিলেন ‘প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলন’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সাহিত্য সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি দিল্লী (১৯২৬), মিরাট (১৯২৭), নাগপুর (১৯৩৪), কলকাতা, কাশী প্রভৃতি স্থানে অনুষ্ঠিত‘প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলন’-এর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

শেষ বয়সে বিপত্নীক কেদারনাথ বিধবা কন্যা ও দৌহিত্রদের নিয়ে পুর্ণিয়াতে বসবাস করতেন। সেখানেই ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ১২ই অগ্রহায়ণ (২৯ শে নভেম্বর ১৯৪৯) সোমবার শেষরাত্রিতে ৮৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  • সুবোধচন্দ্র ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত সাহিত্য সংসদ, কলকাতা প্রকাশিত সংসদ বাংলা চরিতাভিধান প্রথম খণ্ড পঞ্চম সংস্করণ তৃতীয় মুদ্রণ পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৫৮-১৫৯
  • কল্লোল পত্রিকা জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ