কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৭৭ - ১৯২৯ ) ব্রিটিশ ভারতের একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও স্যার রোনাল্ড রস-এর সহ-গবেষক ছিলেন। রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার বীজানুবাহী হিসাবে অ্যানোফিলিস মশাকে চিহ্ণিত করে ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯০৩ সালে সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়।

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা শহরের এনটালি পাড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন ৷ তাঁর পিতামহ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একজন খ্যাতনামা আয়ুর্বেদাচার্য এবং সাংখ্য দর্শনে পারঙ্গম ব্যক্তি ছিলেন। কিশোরীমোহনের বাবা ননীলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক। পানিহাটিতে তাঁদের নিবাস ছিল 'নিলামবাটি' নামে একটি বিশাল বাড়ি যা পরবর্তিকালে তারা বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে নিলামবাটীর নামফলকটি থাকলেও, কিশোরীমোহনের পরিবারের সদস্যরা পানিহাটির বাইরে বসবাস করতে চলে গেছেন। কিশোরীমোহনের দুই অগ্রজ ভ্রাতা লালমোহন ও হরিদাস সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার শিক্ষক ছিলেন। নিলামবাটীর বিপরীতে তার বন্ধু অনাদি চট্টোপাধ্যায়ের বোন ক্ষেত্রপ্রসাদীকে তিনি কুড়ি বছর বয়সে বিবাহ করেন কিশোরীমোহন। কিশোরীমোহনের তিন পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ লক্ষীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার এরিয়ান এবং উয়াড়ি ফুটবল ক্লাবের খ্যাতনামা খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ছিলেন ছেনি বাঁড়ুজ্জে নামে পরিচিত। কিশোরীমোহনের দুই দৌহিত্র, জ্যেষ্ঠ কন্যা অমিতার ছেলেরা, সমীর রায়চৌধুরী এবং মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত হাংরি আন্দোলন-এর জনক।

শিক্ষা[সম্পাদনা]

পানিহাটিতে প্রাথমিক শিক্ষার পর কিশোরীমোহনকে কলকাতার মাতুলালয়ে ইংরেজি স্কুলে পড়ার জন্য পাঠানো হয়। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি ভালো ফলাফল করতেন। মাতুলালয় থেকেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের স্নাতক হন। রোনাল্ড রস তার পরীক্ষার ফলাফল ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মের অভিজ্ঞতার জন্য বহু ছাত্রের ইনটারভিউ এবং হাতেনাতে গবেষণাগারে কাজ দেখার পর কিশোরীমোহনকে নির্বাচন করেছিলেন। এতদ্ব্যতীত পানিহাটি থেকে রোনাল্ড রস-এর মহানাদস্হিত গবেষণাগারে নৌকায় যাবার সুবিধা ছিল। পানিহাটি সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল থেকে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের কিশোরীমোহন রোনাল্ড রসের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতেন। রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কিশোরীমোহনের আয়ুর্বেদাচার্য ঠাকুরদার রোগী। কিশোরীমোহন নিজেও তার নবলব্ধ বিজ্ঞানের শিক্ষা ও ঠাকুর্দার আয়ুর্বেদের ঔষধের সঙ্গে সামঞ্জস্য খোঁজার প্রয়াস করতেন, এবং স্বদেশি ও বিদেশি ঔষধের এই মেলবন্ধনও তদানীন্তন ইউরোপীয় ডাক্তারদের তার প্রতি আগ্রহান্বিত করেছিল।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

ঠাকুর্দার সঙ্গে থাকার সময়ে, যখন কিশোরীমোহন প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ছিলেন, তিনি আয়ুর্বেদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। গরিব ও দুস্হ রোগীদের অবস্হায় তিনি বিপন্ন বোধ করতেন। কলকাতায় যাবার পর গরিব ছাত্রদের নিঃশুল্ক গৃহশিক্ষা দিতেন। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার পর তিনি রোনাল্ড রসের সঙ্গে মহানাদ ও কলকাতায় তার সহগবেষকরূপে চাকুরি করেছেন। রস স্বদেশে চলে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরয়া রোগ সম্পর্কে বাংলার গ্রামে-গ্রামে প্রচারের কাজ নেন। সেই সূত্রে তার বন্ধু বিধানচন্দ্র রায় তাকে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত করে নেন এবং কিশোরীমোহন আন্দোলনকারীদের বার্তাবাহক হয়ে ওঠেন। ম্যালেরিয়া-বিরোধী প্রচারের জন্য কিশোরীমোহন ম্যাকিজ লন্ঠনের সাহায্যে গ্রামে-গ্রামে স্লাইড প্রদর্শন করতেন। স্লাইড তৈরিতে তাকে সাহায্য করতেন গঙ্গার অপর পারের ফোটোচিত্র শিল্পী লক্ষীনারায়ন রায়চৌধুরী, যিনি ছিলেন ভারতের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফোটো-আর্টিস্ট।

রাজনীতিতে যোগ দেবার পর ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্হাপক সভার নির্বাচনে কিশোরীমোহন বিধানচন্দ্র রায়-এর প্রচার কর্তা নিযুক্ত হন ; নির্বাচনে বিধানচন্দ্র রায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন।

ম্যালেরিয়া-বিরোধি অভিযানে কিশোরীমোহন গ্রামাঞ্চলের দুস্হ গরিব চাষি তাঁতি জেলে কামার কুমোরদের আর্থিক অবস্হার প্রতিকার হিসাবে পানিহাটির কয়েকজন বাল্যবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্হাপন করেন পানিহাটি কোঅপারেটিভ ব্যাংক যা আজ একটি সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান। তিনি বিশেষ করে তাঁতিদের সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন। বিলাত থেকে মিলে তৈরি কাপড় আসার পর তাঁতিদের প্রায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল । কিন্তু মিলে তৈরি কাপড়ের মশারি হয়না বলে গরিবদের পরিবারে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন তিনি ।

অত্যধিক কর্মকাণ্ডের দরুন তার স্বাস্হ্যে অবনতি ঘটতে থাকে এবং ১৯২৯ সালে তিনি ম্যানেনজাইটিস রোগে মারা যান ।

সম্মাননা[সম্পাদনা]

রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার পাবার পর কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের এক প্রতিনিধিদল উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নেতৃত্বে লর্ড কার্জনের সঙ্গে দেখা করে কিশোরীমোহনকেও আবিষ্কারের জন্য সম্মানিত করার অনুরোধ জানান । প্রতিনিধি দলে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায় । লর্ড কার্জন বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের গোচরে আনলে দিল্লি দরবারের সময়ে দিল্লিতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্হিতিতে ১৯০৩ সালে ডিউক অফ কনট কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক তুলে দেন । পরবর্তীকালে কলকাতার সেনেট হলে বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে কিশোরীমোহনকে সম্বর্ধিত করা হয় । সংবর্ধনা সভার সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ । প্রধান বক্তৃতা দেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী । অন্যান্য বক্তাদের অন্যতম ছিলেন বিধানচন্দ্র রায় যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন ।

রাস্তার নামকরণ[সম্পাদনা]

পানিহাটি শহরে মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ একটি রাস্তা কিশোরীমোহনের নামে নামকরণ করেছেন কিশোরীমোহন ব্যানার্জি রোড

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  • উলি বিজেল এবং ক্রীস্টোফে বোয়েটে । দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল । সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যানকাসটার, ২০১৩
  • অ্যান এইচ কেলি এবং উলি বিজেল । নেগলেকটেড ম্যালেরিয়াজ : দি ফ্রন্টলাইন অ্যান্ড ব্যাক অ্যালিজ অফ গ্লোবাল হেল্হ । বায়োসোসাইটিজ, সংখ্যা ৬ । লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স, ২০১১
  • শাশ্বত সিকদার । ছ্যান । হরিণাহরিণী পত্রিকা । কোয়ার্ক পাবলিশার্স । কলকাতা, ২০০৪
  • বারবারা রোমানিক । ট্র্যান্সফরমিং দি কলোনিয়াল সিটি : সায়েন্স অ্যান্ড দি প্র্যাক্টিস অফ ডোয়েলিং ইন 'দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম' । মোজাইক ৩৮ নং সংখ্যা, ২০০৫
  • ক্লেয়ার চেম্বার্স । পোস্টকলোনিয়াল সায়েন্স ফিকশান : অমিতাভ ঘোষেজ 'দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম' । দি জার্নাল অফ কমনওয়েলথ লিটারেচার, সংখ্যা ৩৮, লন্ডন, ২০০৩
  • অমিতাভ ঘোষ । 'দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম' । ২০০১
  • মলয় রায়চৌধুরী । ছোটোলোকের ছোটোবেলা । চর্চাপদ প্রকাশনী, কলকাতা ২০০০

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]