ইবনে আল-সিদ আল-বাতাল্যাওসি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল-সিদ আল-বাতালয়াউসি[১] (১০৫২-১১২৭), ইবনে আসসিদ, বা আবেনাসিদ নামেও পরিচিত,[২] ছিলেন একজন আন্দালুসিয়ান ব্যাকরণবিদ এবং দার্শনিক। তিনি ইসলামী পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম দিকের একজন দার্শনিক যাঁর রচনাগুলি টিকে আছে। [৩] ইবনে আল-সিদ ১০৫২ সালে (হিজরী ৪৪৪ সালে) বাদাজোজে (আরবিতে বাতালিয়াউস) আল-মুজাফফরের দরবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাদাজোজের আফতাসিদ শাসক।[৩][৪] ইবনে আল-সিদ সাহিত্যিক ও ব্যকরণ শিক্ষা লাভ করেন।[৩] তার শিক্ষক ছিলেন আবু-আল-হাসান আলী ইবনে আহমদ ইবনে হামদুন আল-মুকারি আল-বাতালয়াউসি, যিনি ইবনে-আল-লাতিনিয়্যাহ নামে পরিচিত এবং ১০৭৩ সালে মারা যান।[৫][৬] ১০৯৪ সালে বাদাজোজ আলমোরাভিডদের দখলে পড়লে,[৭] ইবনে আল-সিদ বানু রাজিনের শাসনাঞ্চলে অবস্থিত তেরুয়েলে চলে যান। সেখানে তিনি শাসক আবু মারওয়ান আবদুল মালিকের কাতিব (সচিব) পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অপমানিত হওয়ার পর, তিনি টলেডো, তারপর জারাগোজা এবং অবশেষে ভ্যালেন্সিয়ায় পালিয়ে যান।[৩][৪] জারাগোজায়, ১১১০ সালের কিছু আগে, তাঁর সাথে দেখা হয় তরুণ দার্শনিক ইবনে বাজ্জার সাথে, যিনি ব্যাকরণে যুক্তিবিদ্যার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক করেছিলেন।[৮][৩] তিনি প্রায় দশ বছর জারাগোজায় অবস্থান করেন।[৮] ভ্যালেন্সিয়াতে, তিনি ইবনে বাশকুওয়ালকে পড়ান। ১১২৭ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে (হিজরী ৫২১ সালের) ভ্যালেন্সিয়াতে তিনি মারা যান।[৪]

ইবনে আল-সিদ আরবি ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনের উপর প্রায় ২০টি গ্রন্থ রচনা করেন।[৪] তিনি একটি ফাহরাসাহ (তার শিক্ষকদের এবং তাদের অধীনে তিনি যে গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন তার একটি রূপরেখা) এবং ইবনে কুতাইবার আদাব আল-কিতাব, মালিকের মুয়াত্তা এবং আল-মাররির সাকত আল-জান্দের ব্যাখ্যা রচনা করেছিলেন। তার শেষ ব্যাখ্যাটি ইবনে আল-আরাবির কাছ থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল এবং ইবনে আল-সিদ-এর কাছ থেকে আল-ইন্তিসার মিম-মান আদালা আন আল-ইসতিবসার নামে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।[৪] ইবনে কুতাইবার ব্যাখ্যাটির শিরোনাম ছিল উদ্ভাবন (আল-ইকতিদাব)। তিনি ইসলামের অভ্যন্তরে ধর্মতাত্ত্বিক মতপার্থক্য নিয়েও লিখেছেন - সম্প্রদায়গত পার্থক্য সৃষ্টির কারণগুলোর ন্যায্য বিচার নামে (আল-ইনসাফ ফি আল-আসবাব আল-মুজিবা লি-খতিলাফ আল-উম্মা)। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনা হল প্রশ্নের বই (কিতাব আল-মাসাইল) এবং বৃত্তসমূহের বই (কিতাব আল-হাদাইক)। পরবর্তীটি দুবার হিব্রুতে অনুবাদ করা হয়েছিল (স্যামুয়েল ইবনে টিব্বন-সহ) এবং ইহুদি মহলে প্রভাবশালী হয়েছিল। এটি ব্যবহার করেন বাহিয়া ইবনে পাকুদা এবং আইজ্যাক আব্রাভানেল। মুসলমানদের মধ্যে, এটি ইবনে তুফাইল এবং ইবনে সাবিনের কাছে পরিচিত ছিল।[৩]

ইবনে আল-সিদ ছিলেন প্রাথমিক যুগের একজন দার্শনিক যিনি ইসলামী ধর্মের সাথে "প্রাচীনদের বিজ্ঞানের" (প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞান ও দর্শন) সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন। তার "বুক অব কোয়েশ্চেনস" গ্রন্থে, তিনি যুক্তি দেন যে দর্শন এবং ধর্ম একই লক্ষ্য, অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে দুটি ভিন্ন পথ। ধর্ম প্ররোচনা এবং কল্পনার মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে, আবার দর্শন যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে তা করে। এটা বলার কারণ হলো, কিছু মানুষের বোধগম্যতার এমন ঘাটতি থাকে যে তারা যুক্তি দিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। ধর্মের যুক্তি-প্রমাণ পরিশেষে মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনায় পাওয়া যায়। যেহেতু সত্যের অনুসন্ধান নির্ভর করে নৈতিকতার উপর, যা কেবল ধর্ম থেকে আসতে পারে, সেহেতু দর্শন চর্চার জন্য ধর্মকে একটা পূর্বশর্ত হিসেবেই থেকে যেতে হবে। এই যুক্তিতে ইবনে আল-সিদ অনেকটাই আল-ফারাবির উপর নির্ভরশীল।[৩]

"বুক অব সার্কেলস" গ্রন্থে, ইবনে আল-সিদ আল-আন্দালুসে নিঃসরণবাদী অধিবিদ্যা ধারণার প্রবর্তন করেন। নিওপ্লাটোবাদ এবং ব্রেদারেন অফ পিউরিটির নব্য-পিথাগোরিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া (এক প্রকার প্রাচীন রচনা-সংকলন) থেকে উদ্ভূত এই তত্ত্ব একইসাথে জটিল ও বহুমুখী। ইবনে আল-সিদ বলেন যে এই তত্ত্বের সূত্রপাত ঘটেছিল সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মাধ্যমে। 'এজেন্ট ইন্টেলেক্ট' (সক্রিয় বুদ্ধি) মানবিক বুদ্ধিকে আলোকিত করে। আর গণিত, পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্ব - এগুলোর ক্রমোর্ধ্ব অধ্যয়নের মাধ্যমে মানুষ তার উৎসে ফিরে আসার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। এরপর, সক্রিয় বুদ্ধি বা 'এজেন্ট ইন্টেলেক্ট'-এর সাথে মিলন ঘটে। পঞ্চম অধ্যায়ে ঋণাত্মক ধর্মতত্ত্বের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হয়, আর সপ্তম ও শেষ অধ্যায়ে আত্মার অমরত্বের প্রসঙ্গ আসে। আত্মা নিয়ে এই শেষ অধ্যায়টি ত্রয়োদশ শতাব্দীর সিসিলীয় প্রশ্নাবলিতে হুবহু অন্তর্ভুক্ত হয়।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. আরবি: أَبُو مُحَمَّدٍ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّيِّدِ الْبَطَلْيَوْسِيُّ
  2. Peña Martín 2007, পৃ. 425।
  3. Geoffroy 2011
  4. Lévi-Provençal 1960
  5. Rebollo Ávalos 1997, পৃ. 270।
  6. Serrano Ruano 2002, পৃ. 82।
  7. Messier 2010, পৃ. 115।
  8. Beech 2008, পৃ. 152।

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]