আর্য চক্রবর্তী রাজবংশ
আর্য চক্রবর্তী | |
---|---|
রাষ্ট্র | শ্রী লঙ্কা |
উপাধি | সিনকাইয়ারিয়ান, সেতুকাভালান, কংকাইয়ারিয়ারকুন |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১২৭৭ |
প্রতিষ্ঠাতা | কুলাসেকারা সিনকায়ারিয়ান |
শেষ শাসক | জাফনা রাজ্যেের ক্যানকিলি II |
বিলুপ্তি | ১৬১৯ |
শাখা | নেই |
আর্য চক্রবর্তী রাজবংশ (তামিল: ஆரியச் சக்கரவர்த்திகள் வம்சம், সিংহলি: ආර්ඓචර්ය චක්්කා ජවංශය ) ছিলেন শ্রীলঙ্কার জাফনা রাজ্যের রাজা। ১২৭৭ থেকে ১২৮৩ সাল পর্যন্ত প্রাচীনতম শ্রীলঙ্কার সূত্রে এ নামের একজন সামরিক নেতাকে পান্ডিয়ান সাম্রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; যিনি পশ্চিম শ্রীলঙ্কার উপকূলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সিংহলির রাজধানী ইয়াপাহুওয়া থেকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধ্বংসাবশেষ বুদ্ধের দাঁত দখল করে নিয়ে যান। পান্ডিয়ান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে ১২৭২ থেকে ১৩০৫ সাল পর্যন্ত একই রাজবংশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের আধুনিক কালের তামিলনাড়ু রাজ্যে অনেকগুলো শিলালিপি পাওয়া যায়। সমসাময়িক দেশীয় ঐতিহাসিকগন যেমন সেকারসেসেকারামালাই এর মতে - রাজবংশটিকে ভারতের আধুনিক রামনাথপুরম জেলার বিখ্যাত হিন্দু তীর্থ মন্দির রামেশ্বরমের আর্য ব্রাহ্মণ বংশীয় বলে দাবি করেছেন।[১] যারা ১৩ শতক থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত জাফনা রাজ্য শাসন করেছিল, রাজবংশের শেষে পর্তুগিজ দ্বিতীয় ক্যানকিলি দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল।
উৎপত্তি তত্ত্ব
[সম্পাদনা]কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জি ও সমসাময়িক আদালতের ইতিহাসে এ রাজবংশের উৎপত্তি বা তারা কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আধুনিক ইতিহাসবিদরা কিছু পারস্পরিক বিপরীতধর্মী তত্ত্ব প্রদান করেছেন।
পাণ্ড্য সামন্ত পরিবার
[সম্পাদনা]বর্তমান তামিলনাড়ুতে যারা নিজেদেরকে আর্যচক্রবর্তি বলে দাবি করে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শিলালিপি থেকে অনুমান করা যায়- তারা বর্তমান রামানাথপুরম জেলার সেভিরুক্কাই নাড়ু নামক উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এসেছিল। তারা ভূমি পরিচালনা এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদে অধিষ্ঠিত ছিল। পান্ড্য রাজা মারাবর্মন কুলাসেকরনের সময়ে বিখ্যাতদের অধিকাংশই আধুনিক রামনাথপুরম জেলার তামিল ব্রাহ্মণদের একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।[২] জাফনা রাজ্যের রাজারা সেথুকাবলার উপাধি দাবি করেন যার অর্থ "সেতুর অভিভাবক"।[৩]
চক্রবর্তী উপাধিটি পান্ড্য রাজ্যে সাধারণত বংশ বা চাকরির পদবী হিসাবে ব্যবহৃত হত বলে মনে করা হয়, যেমন মারাভাচক্রবর্তী যেটি একজন মারাভার প্রধানের এবং সেইসাথে মালাভাচক্রবর্তী যেটি মালাভা প্রধানের অন্তর্গত। তামিল ভাষায় আরিয়ার শব্দ দ্বারা সম্ভ্রান্ত বা পণ্ডিত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ বা আর্যাবর্তদের বোঝানো হয়। সে দিক বিবেচনায় আর্যচক্রবর্তী উপাধিটি পান্ড্য রাজ্য জুড়ে একইভাবে প্রচলিত শিরোনামের সাথে সার্থক বলে মনে হয়।[৪][৫] আর্য চক্রবর্তী উপাধিটি পান্ড্য রাজ্যের অধীনে সামরিক চাকরিতে ব্যবহৃত উপাধি হিসেবে ১২ শতকের শিলালিপিতে পাওয়া যায়। এই শিরোনামটি প্রায়শই রামান্থপুরমের মারাবর্মন কুলাসেকরনের শিলালিপিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।[৩]
শিলালিপিতে উল্লিখিত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন- দেবর আর্য চক্রবর্তী, আলাকান আর্য চক্রবর্তী, মিনাতুঙ্গান আর্য চক্রবর্তী এবং ইরামন আর্য চক্রবর্তী। দেবর আর্য চক্রবর্তীর অন্তত দুটি পরিচিত শিলালিপি রয়েছে, একটি ১২৭২ সালের রামনাথপুরমের সোভাপুরীতে, দ্বিতীয়টি রামানাথপুরমের তিরুপুলানিতে (১৩০৫)। ধারনা করা হয় তিনি একজন মন্ত্রী বা সামন্তবাদী ছিলেন, শিলালিপিতেও সেথুমুকাম উপাধি ছিল যা "সেতুর ক্রমানুসার " নির্দেশ করে।[২]
সিংহলীর প্রাথমিক সূত্র অনুসারে, আর্যচক্রবর্তি নামে একজন যুদ্ধবাজ বা মন্ত্রী ১২৭৭-১২৮৩ সালের মধ্যে পান্ড্য রাজা মারাবর্মন কুলাসেকরনের পক্ষে সিংহলের রাজধানী ইয়াপাহুওয়া আক্রমণ করে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধের দাঁতের অবশেষ নিয়ে গিয়েছিলেন।[৬][৭]
রামেশ্বরম থেকে ব্রাহ্মণ
[সম্পাদনা]জাফনায় আর্য চক্রবর্তী শাসনামলে রচিত সেকারসেসেকারমালাই এর বর্ননা অনুযায়ী- রাজাদের প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষরা রামেশ্বরম হিন্দু মন্দিরের পাসুপাতা সম্প্রদায়ের ৫১২ জন আরিয়ার নামক ব্রাহ্মণ পুরোহিত বর্ণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৫১২ জনের মধ্যে দুজনকে আরিয়ার রাজা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল।[১] পান্ড্য রাজ্যে লেখক ছিলেন এমন একজনকে অন্য রাজ্যের সাথে যুদ্ধের সময় রাজাকে সহায়তা করার জন্য ডাকা হলে তারা হোয়সালা ও কর্ণাটকের রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।[৯][১০]
জাতবর্মন সুন্দর পান্ড্যের শাসনামলে পান্ড্যরা তাদের হোয়সালা শত্রুদের পরাভূত করে এবং ১২৫৪ সালে হোয়সালা রাজা বীর সোমেশ্বরাকে হত্যা করে।[১১]
রামেশ্বরম হিন্দু মন্দিরের সাথে তিভাইয়ারকুন ("টিভাইয়ের রাজা"), কান্তমালায়ারিকুন ("কান্তমালাইয়ের আরিয়ান রাজা") এবং সিতুকাভালান ("সেতুর রক্ষক") এর সম্পর্ক বিষয়ে উপাখ্যানগুলো থেকে জানা যায়, কারণ তিভাই, সেতু এবং কান্তমালাই নামগুলোর সাথে একই জায়গা: রামেশ্বরম যুক্ত ছিল।[১১]
গঙ্গা রাজবংশ
[সম্পাদনা]রসনায়গম মুদালিয়ার[১২] এবং স্বামী জ্ঞানপ্রগাসারের মতে আর্য চক্রবর্তী রাজবংশ পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের সাথে যুক্ত ছিল। রসনায়াগম এর মতে, রামেশ্বরম শহরের এক ব্রাহ্মণ কলিঙ্গ মাঘের পরিবারের সদস্যেকে বিবাহ করেছিলেন, একজন আক্রমণকারী যে নিজেকে ভারতের কলিঙ্গ রাজ্যের বলে দাবি করে। মাঘ দৃশ্যত পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের অন্তর্গত ছিল। জাফনা রাজ্যের রাজকীয় পতাকা পূর্ব গঙ্গার রাজকীয় চিহ্নের অনুরূপ। গঙ্গা নিজেও ব্রাহ্মণের উৎপত্তি বলে দাবি করেছেন। আর্য চক্রবর্তী রাজাদের দ্বারা তৈরি সেতু মুদ্রাতেও অনুরূপ প্রতীক রয়েছে।[১৩]
স্বামী জ্ঞানপ্রগাসার বিশ্বাস করেন যে প্রথম আর্যচক্রবর্তীকে সিনকাইরিয়ান (সিনকাইনাকর থেকে আরিয়ান) নামেও ডাকা হয়, যিনি স্বয়ং কলিঙ্গ মাঘ।[৯] এ রাজারা পূর্ব গঙ্গা বংশোদ্ভূত ছিল এই দাবির সমর্থনে তিনটি প্রধান যুক্তি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। প্রথমটি তাদের মুদ্রার অনুরূপ যন্ত্র; ষাঁড়ের পালঙ্ক এবং অর্ধচন্দ্রাকৃতি পূর্ব গঙ্গা এবং আর্য চক্রবর্তীদের দ্বারা জারি করা মুদ্রার উপর আঘাত হানে। দ্বিতীয়টি হল তাদের উৎসগত ঐতিহ্য প্রায় অভিন্ন। শেষটি হল কঙ্ককাইনাদান (গঙ্গার দেশ থেকে) এবং কংকাইয়ারিয়ান (গঙ্গা রাজবংশের আরিয়ান) উপাধির উৎপত্তিগত অনুমান।[৯] এস. পাথমানাথনের জাফনা রাজ্যের ইতিহাস অনুসারে,[১৪] এগুলো কেবলমাত্র সাদৃশ্য স্থাপন করে, কিন্তু কোনো চূড়ান্ত সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে না। পথমনাথন বিশ্বাস করেন যে, আমরা পূর্ব গঙ্গার সাথে আর্যচক্রবর্তী রাজবংশকে স্পষ্টভাবে যুক্ত করতে পারি না এবং প্রভাবের উপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ মিল ব্যাখ্যা করতে পারি, এমনকি পশ্চিম গঙ্গা রাজবংশের বংশধররাও যারা চোল সাম্রাজ্যের কাছে ১০০০ সালের দিকে তাদের পরাজয়ের পর তামিল ভূমিতে চলে গিয়েছিল এবং তাদের সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে যা পবিত্রতম নদী গঙ্গার তীরে হিন্দু পবিত্র শহর বারাণসী থেকে উৎপত্তির দাবিকে প্রতিফলিত করে।[৯][১৫]
জাভাকা-কলিঙ্গ আক্রমণকারীরা
[সম্পাদনা]এস. পারনাবিতানা আর্য চক্রবর্তীর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে একটি অভিনব ধারণা প্রদান করেন। তার মতে আর্য চক্রবর্তীরা মালয় প্রধান চন্দ্রভানুর বংশধর [১৬], যিনি ১২৪৭ সালে তামব্রলিঙ্গ থেকে দ্বীপটি আক্রমণ করেছিলেন। তার মতে ভারতীয় কলিঙ্গ রাজ্যের উদ্বাস্তু এবং অভিবাসীরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একই নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং যাদের মধ্যে কিছু বিভিন্ন কারণে উত্তর শ্রীলঙ্কায় আসেন এবং জাফনা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।[১৭] এই মতটি প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ কে.এ. নীলকান্ত শাস্ত্রী কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই বলে দাবী করেন,[১৮] এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক যেমন লুই চার্লস দামাইস (১৯১১-১৯৬৬), ইন্দোনেশিয়ান বিষয়ক গবেষণায় বিশেষজ্ঞ[১৯], ইউটাকা ইওয়ামোটো (১৯১০-১৯৮৮), একজন বৌদ্ধ পণ্ডিত, এবং এস. পাথমানাথন। তারা দাবি করে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কলিঙ্গ নামে কোনো রাজ্য ছিল না এবং এই ধরনের দাবিগুলো হো-লিং নামক একটি এলাকার জন্য চীনা নামের ভুল পাঠের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যা আসলে কলিঙ্গ নয় ওয়ালাইনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে। এস. পথমনাথন আরও দাবি করেছেন যে চন্দ্রভানু স্পষ্টভাবে পদ্মবংশের বংশের দাবি করেছিলেন যেখানে এস. পারনাবিতান আর্য চক্রবর্তীতে গঙ্গাবংশের বংশীয় পদ যোগ করেছিলেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে এস. পারনাবিতান যে শিলালিপিগুলো তাঁর তত্ত্ব তৈরি করতে ব্যবহার করেছিলেন তা আর্য চক্রবর্তীদের সাথে জাভাক সংযোগ বোঝানোর জন্য অন্য কোনও পণ্ডিত দ্বারা পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হয়নি। [২০][২১]
অন্যান্য উৎস
[সম্পাদনা]সমসাময়িক ইতিহাস
[সম্পাদনা]জাফনা রাজ্যের প্রাচীনতম স্থানীয় তামিল ইতিহাসগুলি মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল। ১৭৩৬ সালে কবি মায়িলভাকানা পুলাভার দ্বারা সংকলিত গদ্য ইয়াল্পনা ভাইপাভা মালাই তে তথ্যগত সূত্র হিসাবে কাইল্যা মালাই, ভাইয়া পদল, পাররাসেকরন উলা এবং রাসামুরাই নামক পূর্বেকার সময়ে লেখা চারটি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাসামুরাই (বা রাজাদের তালিকা) পাওয়া যায়নি এবং একমাত্র ইয়াল্পনা ভাইপাভা মালাইয়ের মাধ্যমেই উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো ১৪ শতকের আগে রচিত নয় এবং ঐতিহাসিক উপাখ্যানের সাথে মিশ্রিত লোককথার কিংবদন্তি রয়েছে। কিন্তু সেকারাসেকারান পঞ্চম (১৪১০-১৪৪০) এর শাসনামলে সোমা সারমন দ্বারা জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর রচিত সেকারসাসেকারান মালই তে ঐতিহাসিক যাচাইযোগ্য তথ্য রয়েছে[২২] এবং রাজ্যের প্রাথমিক ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য হামফ্রে কডরিংটন থেকে এস. পাথমানাথন পর্যন্ত ইতিহাসবিদরা যেগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। [২৩]
সিংহলীর কালানুক্রমিক ইতিবৃত্ত যেমন কুলাভাংসা, রাজাভালিয়া এবং বেশ কয়েকটি সন্দেশায়ার ইতিহাস, যেমন কোকিলা সন্দেসায়া এবং সেলালিহিনি সন্দেসায়ায় রাজ্যের প্রথম ও মধ্যবর্তী সময়কাল এর কার্যক্রম এবং ১৪৫০-১৪৬৭ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী কোট্টে রাজ্যের শেষ দখলের বিষয়ে মূল্যবান তথ্য রয়েছে। কুলাভাংসা ১২৭৭ থেকে ১২৮৩ সময়কালে আর্য চক্রবর্তী নামে একজন মন্ত্রীর সিংহলীর রাজধানী ইয়াপাহুয়াতে আগমন এবং বিজয়ের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। মন্ত্রী বুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ রাজধানী থেকে পান্ডিয়ান রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[২৪] রাজাভালিয়া ১৭ শতকে রচিত একটি প্রাথমিক সূত্র উল্লেখ করে যে আর্য চক্রবর্তীরা কান্ডায়া রাজ্যের উদারতা এবং দক্ষিণ নিম্নভূমি থেকে কর আদায় করত।[২৫]
কোট্টে রাজা কর্তৃক প্রেরিত একজন সামরিক নেতা সপুমল কুমারায়ার বিজয় সিংহলি সাহিত্যিকদের উপর একটি অদম্য ছাপ ফেলেছিল বলে মনে করা হয়। মুলগিরিগালার ইরুগালকুলা তিলাকা পিরিভেনা মন্দিরের প্রধান সন্ন্যাসী কর্তৃক ১৫ শতকে রচিত কোকিলা সন্দেশায় ("কোকিলা পাখির বার্তা") সপুমল কুমারায়ার এর বিজয় গাথা বর্ণনা করা হয়েছে। বইটিতে শ্রীলঙ্কার উত্তরের দেবী নুওয়ারা ("দেবতার শহর") থেকে নাল্লুর শহরের ("সুন্দর শহর") দক্ষিণাংশ পর্যন্ত রাস্তায় কুকু পাখির বিচরন সম্পর্কে একটি সমসাময়িক বর্ণনা রয়েছে।
শিলালিপি
[সম্পাদনা]- লাহুগালা
দেদিগামা থেকে শাসনকার্য পরিচালনাকারী গাম্পোলা’র রাজা পঞ্চম পরাক্রমবাহু (১৩৪৪-৫৯) আর্য চক্রবর্তীর সাথে যুদ্ধের পরাজয়ের পর দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আমপারা জেলার মাগুল মহা বিহারায়া নামক স্থানে পিছু হটে যান। লাহুগালা নামক স্থানের শিলালিপি থেকে যার স্পষ্টতার প্রমান পাওয়া যায়।[২৬]
- মেদাওয়েলা
হরিস্পত্তুভার মেদাওয়ালার একটি বো-বৃক্ষের কাছে প্রাপ্ত ১৩৫৯ সাল খচিত মেদাওয়ালার শিলালিপি প্রকাশ করে যে গাম্পোলা রাজ্যের অন্তর্গত গ্রামগুলি থেকে কর সংগ্রহের জন্যমার্তান্ডা সিনকাইয়ারিয়ান কর সংগ্রহকারীদের নিয়োগ করেছিলেন।[২৭]
- কোটাগামা
কেগালে জেলায় প্রাপ্ত কোটাগামা শিলালিপিগুলি পশ্চিম শ্রীলঙ্কার জাফনা রাজ্যের আর্য চক্রবর্তী রাজাদের রেখে যাওয়া বিজয়ের তথ্য বহন করে।[২৮][২৯] প্রত্নতত্ত্ববিদ, এবং মুদালিয়ার রসনায়গম ব্যবহৃত অক্ষরের শৈলীর প্যালিওগ্রাফিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে শিলালিপিটি ১৫ শতকে H.C.P বেল দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। যদি এই পরের সময়কাল বিবেচনা করা হয় তবে এই শিলালিপিটি সিংহলী সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে সাধারণত গৃহীত তত্ত্বের বিপরীতে তথ্য প্রকাশ করে যে ১৩৯১ সালে আর্য চক্রবর্তী রাজাদের মুখোমুখি হওয়া স্থানীয় সরদার আলগাক্কোনরা তার প্রচেষ্টায় বিজয়ী হয়েছিলেন। [২৮][৩০]
- রামেশ্বরম মন্দির
১৪১৪ সালের একটি শিলালিপিতে দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু মন্দির রামেশ্বরমে এর গর্ভগৃহ সংস্কারের বিষয়ে সাথে জয়বীর সিনকায়ারিয়ান বা তার উত্তরসূরিকে কৃতিত্ব প্রকাশ করে। এটি নির্দেশ করে যে সংস্কারের জন্য পাথরগুলি বর্তমান পূর্ব শ্রীলঙ্কার ত্রিনকোমালি শহর থেকে পাঠানো হয়েছিল। এই শিলালিপিটি ১৮৬৬ সালে ধ্বংস হয়ে যায়।[৩১]
- টেনকাসি দশ
সিঙ্গাই, অনুরাই এবং অন্য রাজাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী রাজা টিনেভেলির আরিকেসারি পরাক্রম পান্ড্যের সম্পর্কে তেনকাসি দশ শিলালিপি তে উল্লেখ রয়েছে। সিঙ্গাই বা সিনকাইনাকর হল আর্য চক্রবর্তীদের রাজধানী এবং অনুরাই হলো যে কোনো সিংহলী রাজধানীর নাম। শিলালিপিটিতে ১৪৪৯/৫০ এবং ১৪৫৩/৫৪ এর মধ্যবর্তী সময় খচিত।[৩২]
- মার্কো পোলো
ইল মিলিয়নে ("দ্যা মিলিয়ন" বা দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো) বই থেকে জানা যায় বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের জন্য মার্কো পোলো একজন ভেনিসিয়ান ব্যবসায়ী এবং অভিযাত্রী হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ১২৯২ এবং ১২৯৪ সালের মধ্যে বর্তমান শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের একটি বন্দরে পৌঁছেছিলেন। তাঁর মতে স্থানীয় রাজা ছিলেন একজন স্বাধীন শাসক যিনি অন্য কোনো রাজাকে শ্রদ্ধা করতেন না।[৩৩] তিনি রাজার নাম দেন ক্যান্থেম্যান, যাকে সিনকায়ারিয়ানের দুর্নীতিবাজ বলে মনে করা হয়।[৩৪] পোলোর পরে ১২৯১ সালের ডিসেম্বরে (বা ১২৯২) মন্টেকোরভিনো’র জন নামক ফ্রান্সিসকান ধর্মপ্রচারক, ভ্রমণকারী এবং রাষ্ট্রনায়ক পশ্চিম ইউরোপীয়দের দ্বারা করোমন্ডেল উপকূলের প্রথম দিককার সৌন্দর্য বিষয়ে প্রশংসার উল্লেখযোগ্য বিবরণ লিখেছিলেন। তিনি জাফনার সাধারণ এলাকায় ষাটটি সমুদ্রগামী জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন।[৩৫]
- ইবনে বতুতা রহ
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে বতুতা ছিলেন একজন মরক্কোর যাযাবর[৩৬] পণ্ডিত এবং মালিকি ইসলামিক আইনের আইনশাস্ত্রবিদ এবং একাধারে কাজি বা বিচারক। তিনি একজন ভ্রমণকারী এবং অভিযাত্রী হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত। ১৩৪৪ সালে তিনি আর্য চক্রবর্তীর আতিথিয়েতা গ্রহন করেন এবং তাঁর সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ লেখেন। তার মতে রাজা পাক স্ট্রেটে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তা মাছ ধরার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং ইয়েমেন পর্যন্ত দেশগুলির সাথে ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। রাজাও ফার্সি ভাষায় কথা বলতেন এবং দ্বীপের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায়, পুত্তলাম অঞ্চলে অবস্থিত। তিনি দারুচিনির দক্ষিনের অন্যান্য শাসকদের কাছ থেকে রাজস্ব গ্রহণের জন্যও পরিচিত ছিলেন।[৩৭]
- জিওভানি ডি মারিগনোলি
১৪ শতকে দূর প্রাচ্যের একজন উল্লেখযোগ্য ভ্রমণকারী জিওভান্নি দে' মারিগনোলি ১৩৩০ থেকে ১৩৫০ সালের পর্যন্ত মাঝে মাঝে শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন। তিনি দেশ, জনগণ এবং তৎকালীন রীতিনীতি সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন। তার মতে দ্বীপের উত্তর অংশটি একজন রাণী দ্বারা শাসিত ছিল। যিনি তার শ্রোতাদের কাছ থেকে মূল্যবান উপহার গ্রহন করতেন। এই রানীকে একজন আর্য চক্রবর্তী যুবকের মা বলে মনে করা হয় এবং তিনি তার যুবক পুত্রের পক্ষে শাসন করেছিলেন। ১৩৭৫ সালে আঁকা তথাকথিত "কাতালান মানচিত্র"ও নির্দেশ করে যে উত্তর শ্রীলঙ্কা একজন রাণী দ্বারা শাসিত ছিল।[৩৮] মারিগনোলির আগে আরেকজন ভ্রমণকারী ফ্রিয়ার অরড্রিক ১৩২২ সালে জাফনায় অবতরণ করেছিলেন; তিনিও রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা লিখেছেন। তার মতে-
"এই রাজার কাছে যে স্বর্ণ, রৌপ্য ও মুক্তা ছিল তা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না"।[৩৯]
পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক দলিল
[সম্পাদনা]সিলনের সাময়িক এবং আধ্যাত্মিক বিজয়ে, ফাদার কোয়েরোজ ঐতিহাসিক দলিলে লিপিবদ্ধ করেছেন কালক্রমে, গুজরাটের রাজকীয় বংশধর বলে দাবি করা আদিবাসীদের থেকে আরুস নামে কিছু ব্রাহ্মণ এসেছিল, মাদুরার নায়েকের অনুগ্রহে তারা রামঙ্কোরে একটি প্যাগোডা তৈরি করেছিল। তারা জাফনাপাত ‘র রাজার সাথে বাণিজ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে। তাদের মধ্যবর্তী কোন একজন রাজকন্যাকে বিয়ে করে। পরবর্তীতে তার বংশধররা রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়।[৪০] এই বক্তব্যটি অনেক ত্রুটিতে পরিপূর্ণ কিন্তু মৌলিক কাহিনীর ধারা আধুনিক ঐক্যমতের সাথে মানানসই বলে মনে হয়। ফাদার কোয়েরোজের সময়সূচিও অসংগতিপূর্ণ। আর্য চক্রবর্তী রাজবংশ ক্ষমতায় এসেছিল এবং রামেশ্বরমের ব্রাহ্মণরা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাদুরাই নায়কদের ক্ষমতা গ্রহনের অনেক আগে। এছাড়া গুজরাটি বংশীয় রাজাদের পৈতৃক ধারার থেকে উৎপত্তির বিষয়টি স্থানীয় দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তৎকালীন গুজরাট থেকে নয় বারাণসী শহরকে বর্তমান উত্তর প্রদেশের হিসেবে ধরে নেয়া হয়।[৪১]
বর্তমান ঐক্যমত
[সম্পাদনা]এস. পাথমানাথন, প্যাট্রিক পিবলস এবং কে.এম. এর মতো ইতিহাসবিদদের বর্তমান ঐকমত্য পোষনকারীদের মধ্যে ডি সিলভা বলছেন যে আর্যচক্রবর্তীরা ছিল পান্ড্য সামন্ত পরিবার যারা কলিঙ্গ মাঘ এবং চন্দ্রভানু আক্রমণের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার পর ক্ষমতা দখল করে। পরিবারটি ছিল রামানাথপুরম হিন্দু মন্দিরের সাথে যুক্ত এবং তামিল ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত। এটি পূর্ব গঙ্গার পরিবার এমনকি চন্দ্রবানুর উত্তরসূরিদের মধ্যেও বৈবাহিক সূত্রে আত্মিয়তার সম্পর্ক থাকতে পারে, তবে এর জোড়ালো প্রমাণের অভাব রয়েছে। রাজকীয় পতাকা ও মুদ্রায় পূর্ব গঙ্গার প্রভাব অনস্বীকার্য। রাজ্যের তামিল ইতিহাস দ্বারা উল্লিখিত কুলিংগাই চক্রবর্তী হতে পারে কলিঙ্গ মাঘ। [৪২][৪৩][৪৪][৪৫][৪৬]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Pathamanathan, The Kingdom of Jaffna, p. 9
- ↑ ক খ Pathmanathan, Subramanium (১৯৭৮)। The Kingdom of Jaffna (পিডিএফ) (তামিল ভাষায়)। M. Rajendran। পৃষ্ঠা 11। ১০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ ক খ Holt, John (২০১১)। The Sri Lanka Reader: History, Culture, Politics (ইংরেজি ভাষায়)। Duke University Press। পৃষ্ঠা 83। আইএসবিএন 978-0822349822।
- ↑ "Salem District, Namakkal Taluk, Namakkal. Narasimha-Perumal Temple – In The Underground Cellar, Near The Entrance Into The Central Shrine (A.R. No. 11 of 1906)"। South Indian Inscriptions। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৩-১৭।
- ↑ Pathmanathan, Subramanium (১৯৭৮)। The Kingdom of Jaffna (পিডিএফ) (তামিল ভাষায়)। M. Rajendran। পৃষ্ঠা 11–13। ১০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ Kunarasa,The Jaffna Dynasty, p. 66
- ↑ Gnanaprakasar, A Critical History of Jaffna, p. 83
- ↑ Gnanaprakasar, S. A critical history of Jaffna, p. 84
- ↑ ক খ গ ঘ Pathamanathan, The Kingdom of Jaffna, pp. 4–5
- ↑ Kamath, A concise history of Karnataka : from pre-historic times to the present, p. 118
- ↑ ক খ Pathamanathan, The Kingdom of Jaffna, p. 15
- ↑ Rasanayagam, M., Ancient Jaffna, pp. 303–304
- ↑ Perera, H., Ceylon & Indian History from Early Times to 1505 A.D., p. 353; Coddrington, H., Ceylon Coins and Currency, pp. 74–75
- ↑ Spence, Sri Lanka: History and the Roots of Conflict, p. 116
- ↑ Kamath, A concise history of Karnataka: from pre-historic times to the present, p. 118
- ↑ Malays and all South East Asians are knows an Javakas or "Javanese" in Indic literature.
- ↑ Paranavitana, Senarat। "The Aryan Kingdom in North Ceylon": 174–224।
- ↑ Sastry, K.A. Nilakanta। "Ceylon and Sri Vijaya": 125–140।
- ↑ Damais, Luis Charles। "transcription Chinoise- Ho -ling comme designation de Java": 93–141।
- ↑ Pathamanathan, The Kingdom of Jaffna, pp. 5–8
- ↑ Liyanage, The Decline of Polonnaruwa and the rise of Dambadeniya, p. 136; Recuil des Inscriptions du Siam II, 26, tr. 27.
- ↑ The throne name of Gunaveera Cinkaiariyan.
- ↑ Gnanaprakasar, A Critical History of Jaffna, p.#; Pathmanathan, The Kingdom of Jaffna, pp. 14–16
- ↑ Pathmanathan, The Kingdom of Jaffna, p. 8
- ↑ de Silva, A History of Sri Lanka, p. 136; "Looking anew at Kandyan combat strategies"। Betty Weerakoon। ২০১১-০৬-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-০২।
- ↑ Holt, Buddha in the Crown: Avalokitesvara in the Buddhist Traditions of Sri Lanka, p. 102
- ↑ de Silva, A History of Sri Lanka, p. 136
- ↑ ক খ Rasanayagm, Ancient Jaffna, p. 364
- ↑ Coddrington, Short history of Ceylon, p. 89
- ↑ Coddrington, K. Ceylon coins and currency, pp. 74–76; "From Devundera to Dedigama"। S. Pathiravithana। ৬ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-১৯।
- ↑ Gnanaprakasar, A Critical History of Jaffna, pp. 99–102; Kunarasa, The Jaffna Dynasty, pp. 67–68
- ↑ "The Kotte Dynasty and its Portuguese allies"। Humphry Coddrington। ১০ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০১-০৩।
- ↑ Gnaprakasar, A critical history of Jaffna, p. 84
- ↑ Nadarajan, History of Sri Lanka, p. 75
- ↑ Natarajan, History of Ceylon Tamils, p. 76
- ↑ Ross E. Dunn, The Adventures of Ibn Battuta – A Muslim Traveler of the 14th Century, University of California, 2004 আইএসবিএন ০-৫২০-২৪৩৮৫-৪.
- ↑ Gnanaprakasar, A Critical history of Jaffna, pp. 85–88
- ↑ Natarajan, History of Ceylon Tamils, pp. 78–79
- ↑ How Eulenspiegel had his horse shod with gold shoes, for which the King of Denmark had to pay.। Routledge। ২০০১-০৮-০৮। পৃষ্ঠা 139–140। আইএসবিএন 978-1-315-78679-7।
- ↑ Fernao de Queyroz, The Temporal and Spiritual Conquest of Ceylon p. 48
- ↑ Pathamanathan, The Kingdom of Jaffna, p. 10
- ↑ Coddrington, Ceylon Coins and Currency, p. 74
- ↑ Coddrington, Short history of Ceylon, pp. 91–92
- ↑ Pathmanathan, The Kingdom of Jaffna, pp. 1–13
- ↑ de Silva, A History of Sri Lanka, p. 132
- ↑ Peebles, The history of Sri Lanka, pp. 31–32