সুবেদী গ্রাহক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিভিন্ন ধরনের আলোক সংবেদনশীল সুবেদী গ্রাহক

সুবেদী গ্রাহক বা ইংরেজি পরিভাষায় সেন্সর (ইংরেজি: Sensor) হলো এক ধরনের সুবেদী (উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল) যান্ত্রিক, রাসায়নিক বা ইলেকট্রনীয় কলকৌশল বা ব্যবস্থা যা পরিবেশের কোনো উপাদানের (শব্দ, তাপ, আলো ইত্যাদি) উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে, এগুলির মাত্রা পরিমাপ করতে পারে ও এগুলির প্রতি সাড়া দিতে পারে।[১]

মুলত সুবেদী গ্রাহক হচ্ছে এক ধরনের কনভার্টার বা পরিবর্তক যা পরিবেশগত কোন পরিবর্তনকে একটি সংকেত বা সিগন্যালে পরিণত করে যা পরবর্তীতে একটি মাধ্যমে পড়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি পারদ তাপমানযন্ত্র বা থার্মোমিটারের কথা বলা যেতে পারে, যা তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে কাচের নলে আবদ্ধ তরল পারদের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটিয়ে নলের কাচের গায়ে অঙ্কিত মাপনীর সাহায্যে পাঠযোগ্য তাপমাত্রার মান প্রদর্শন করে। তবে বর্তমানে ইলেকট্রনীয় বিজ্ঞানের আলোচনায় সুবেদী গ্রাহক বহুল ব্যবহৃত এক ধরনের কলকৌশল (ডিভাইস), যা পরিবেশগত কোনও পরিবর্তনকে ও শক্তিকে বৈদুত্যিক সংকেতে রূপান্তর করে।

আধুনিক সুবেদী গ্রাহকগুলির উদ্ভাবনের আগে ১৯শ শতকে খনিকূপে বিষাক্ত বাতাস শনাক্ত করার জন্য ক্যানারি পাখি, ভূমিকম্পে জীবন্ত বা মৃত ব্যক্তি, মাদক ও বিস্ফোরক শনাক্ত করার জন্য় ঘ্রাণশক্তিবিশিষ্ট কুকুর ইত্যাদি ব্যবহার করা হত ও ক্ষেত্রবিশেষে এখনও হয়ে থাকে।[১]

ইলেকট্রনীয় সুবেদী গ্রাহক[সম্পাদনা]

ইলেকট্রনীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় বর্তমানে বেশ কিছু সুবেদী গ্রাহক ব্যবহার করা হয়। এগুলি হল:

  • সংস্পর্শ-সুবেদী গ্রাহক (কন্টাক্ট সেন্সর)
  • তাপমাত্রা-সুবেদী গ্রাহক (টেম্পারেচার সেন্সর)
  • দূরত্ব-সুবেদী গ্রাহক (ডিসটেন্স সেন্সর)
  • নৈকট্য-সুবেদী গ্রাহক (প্রক্সিমিটি সেন্সর)
  • স্পর্শ-সুবেদী গ্রাহক (টাচ সেন্সর)
  • অবলোহিত সুবেদী গ্রাহক (ইনফ্রারেড সেন্সর)
  • আলোক ট্রানজিস্টর (ফটো ট্রানজিস্টর)
  • আলোক ডায়োড (ফটো ডায়োড)
  • অবস্থান-সুবেদী গ্রাহক (পজিশন সেন্সর)

সুবেদী গ্রাহকের ধর্ম[সম্পাদনা]

একটি সুবেদী গ্রাহক কতটুকু উপকারী, তা মূল্যায়ন করতে সেটির কিছু ধর্ম অধ্যয়ন করা আবশ্যক। নিচে একটি সুবেদী গ্রাহকের কিছু ধর্ম উপস্থাপন করা হল।[২]

  1. স্থানান্তর অপেক্ষক (Transfer Function): যেকোনও সুবেদী গ্রাহক যে রাশিটি পরিমাপ করছে (x) এবং যে রাশিটি নির্গত করছে (y), তার মধ্যে একটি গাণিতিক অপেক্ষকধর্মী সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ y = f(x)। এটিকে ঐ সুবেদী গ্রাহকের স্থানান্তর অপেক্ষক বলে।
  2. পূর্ণ মাপনী উৎপাদ (Full Scale Output, FSO): কোনও সুবেদী গ্রাহকের উৎপাদিত মানের সর্বোচ্চ সীমাকে পূর্ণ মাপনী উৎপাদ বলে।
  3. সংবেদনশীলতা (Sensitivity): গাণিতিকভাবে এটি হল ক্রমাঙ্কন বক্ররেখার ঢাল, যা পরিমাপ করে প্রবিষ্ট উপাত্তের ক্ষুদ্র পরিবর্তনের জন্য নির্গত বা উৎপাদিত উপাত্তের কতটুকু পরিবর্তন হবে।
  4. দ্রুতি (Speed): কোনও সুবেদী গ্রাহক কত দ্রুত একটি পরিমেয় রাশির পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দিতে পারে এবং পরিমেয় রাশিটিকে অপসারণ করার পরে সেটি কত দ্রুত তার আদি নির্গত মানের ৯০% পরিমাণে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, তাকে দ্রুতি কথাটি দিয়ে বোঝানো হয়।
  5. নির্বাচন ক্ষমতা (Selectivity): সুবেদী গ্রাহকটির অন্যান্য রাশি ও পরিবেশগত উপাদানের উপস্থিতিতে সেগুলি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে উদ্দীষ্ট পরিমেয় রাশিটিকে পরিমাপ করার ক্ষমতা।
  6. স্থিতিশীলতা (Stability): পরিমেয় রাশির প্রতি সাড়া প্রদানে ও প্রবিষ্ট-উৎপাদ চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে একই রকম আচরণ প্রদর্শন করার ক্ষমতা। যদি এইসব চরিত্রে পরিবর্তন আসে, তাহলে সুবেদী গ্রাহকটিকে অপেক্ষাকৃত কম স্থিতিশীল গণ্য করা হয়।
  7. বিভেদন ক্ষমতা (Resolution): পরিমেয় রাশির যে ন্যূনতম পরিবর্তন সাফল্যের সাথে শনাক্ত করা সম্ভব, তাকে সুবেদী গ্রাহকের বিভেদন ক্ষমতা বলে।
  8. সঠিকতা (Accuracy): কোনও সুবেদী গ্রাহকের উৎপাদ বা বহির্গত মান কতটুকু সঠিক, তার পরিমাপ। মূলত একই কার্যসম্পাদন পরিস্থিতিতে একটি প্রমিত বা মান সুবেদী গ্রাহকের সাথে তুলনার মাধ্যমে এটি নির্ণয় করা হয়।
  9. রৈখিকতা/অরৈখিকতা (Linearity/Non-Linearity): একটি আদর্শ সুবেদী গ্রাহক প্রবিষ্ট-উৎপাদের মধ্যে রৈখিক সম্পর্ক প্রদর্শন করে; কিন্তু বাস্তব বিশ্বে প্রায়শই এটি অরৈখিক হয়।
  10. সমতাবিধান/পুষিয়ে নেওয়া (Offset): প্রবিষ্টের মান শূন্য হলে সুবেদী গ্রাহক যে মান উৎপাদন করে।
  11. শিল্পোৎপাদনযোগ্যতা (Manufacturability): অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধর্মটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সুবেদী গ্রাহক কেবল গবেষণার বিষয় নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য হতে হয়। যদি এটির শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়া অতি জটিল বা অতিদীর্ঘ হয় তাহলে এটি শিল্পখাতের দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই হয় না।
  12. ব্যয় (Cost): যদি সুবেদী গ্রাহক নির্মাণের খরচ খুব বেশি হয়, তাহলে এটি বাজারে আনা যায় না এবং অন্যান্য প্রস্তুতকারকদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায় না। তাই যতদূর সম্ভব ব্যয় হ্রাস করতে হয়।
  13. নান্দনিকতা/মোড়কজাতকরণ (Aesthetics/Packaging): লক্ষ্য বাজারের উপর নির্ভর করে এমনভাবে সুবেদী গ্রাহকটিকে মোড়কাবদ্ধ করতে হয় যেন এটি একই সাথে সর্বোত্তম কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি সহজেই স্থাপনযোগ্য, রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য, ও প্রতিস্থাপনযোগ্য হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Miquel Porta; John M. Last, সম্পাদকগণ (২০১৮), A Dictionary of Public Health (২য় সংস্করণ), Oxford University Press 
  2. A. Sengupta; C.K. Sarkar, সম্পাদকগণ (২০১৫), Introduction to Nano: Basics to Nanoscience and Nanotechnology, Springer, পৃষ্ঠা 209