বিচিত্রতা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Variegation of fruits and wood in Ficus carica Panascè, a bicolor (yellow-green) common fig cultivar. This Italian cultivar is a chimera

বিচিত্রতা (ইংরেজি: Variegation) হচ্ছে একই প্রজাতির গাছের পাতায় নিরেট সবুজের পরিবর্তে এক সাদা-হলুদ আর সবুজ রঙের অদ্ভুত মিশ্রণ। এদের অধিকাংশেরই কিনারা থাকে শাদা আর ভেতরটা সবুজ। কিন্তু কখনো এমন কিছু পাতাও দেখা যায় যা ঠিক এর উলটো, কিনারা সবুজ আর ভেতরটা শাদা। মজার ব্যাপার হল, একই প্রজাতির একটি গাছে এমন দু-ধরনের পত্র-বৈচিত্রই দেখতে পাওয়া যায়, শাদার ভেতরে সবুজ এবং সবুজের ভেতরে শাদা।

একটি শাদা-সবুজ বিচিত্র পাতার নক্সা কেমন হবে তা নির্ভর করে কোথায় কোন অঞ্চল থেকে কোষ-রূপান্তর ঘটেছে তার উপর। গাছের ওপরের দিকের বৃদ্ধি হয় গাছের ডগায় যেখানে থাকে ভাজক-কলা, যা খুব দ্রুত কোষ বিভাজন করে গাছকে বড় করে তোলে। এসব ভাজক-কলার বাইরের স্তরের কোষগুলি পাতার উপরিভাগ আর কিনারা নির্মানের জন্যে দায়ী, আর ভেতরের দিকের কোষ পাতার বাকি অংশের জন্যে। যদি বাইরের কোষে মিউটেশান হয় তাহলে কিনারা হবে ক্লোরোফিলশূন্য শাদা, আর ভেতরটা হবে সবুজ, ক্লোরোফিলময়। আর ভেতরের কোষে রূপান্তর হলে কিনারা হবে সবুজ, আর ভেতরটা শাদা। এই বৈচিত্র যে কেবল পাতায় থাকতে পারে তা নয়, কাণ্ডেও দেখা যেতে পারে এর প্রভাব, যেমন বিচিত্র ইক্ষু। কালে কস্মিনে ফলে বা হঠাৎ বীজেও দেখা যেতে পারে এই বিচিত্রতা।

প্রতিফলন[সম্পাদনা]

Variegation in holly leaves
Reflective variegation in Pilea cadierei.

কিন্তু কিমেরাসম্ভূত শুধু শাদা বা হলুদ রঙের জন্যে পত্র-বৈচিত্র নয়, বিস্তৃত চিন্তায় আরো কিছু কারণেও বৈচিত্র দেখা দিতে পারে গাছে। এলুমিনাম প্ল্যান্টের পাতার ওপরে একটু ফুলো দেখা যায়। এর কারণ সবুজ ক্লোরোফিল-এর ওপরে একটি স্বচ্ছ স্তর থাকে যার ভেতরে থাকে বায়ুস্তর। এই বাইরের স্তরের ওপর সূর্যের আলো পড়লে তা প্রতিফলিত আর প্রতিসরিত হয়ে রূপালি রঙ ধারণ করে। পাতায় রূপালি রঙ তৈরি হবার জন্যে অবশ্য আরো কারণ থাকতে পারে যেমন, ইন্ডোর পান্ডা প্ল্যান্টের পাতায় সূক্ষ্ম এবং স্বচ্ছ রোম থাকে যার ওপর রোদের আলো পড়লে রূপালি রঙ ঝিকমিক করে ওঠে। কলেরেডো স্প্রুস-এর পাতা রূপালি দেখায় কারণ সূঁচের মতো সরু পাতার গায়ে মোম জড়ানো থাকে এদের। তবে যে কারণেই পাতাকে রূপালি দেখাক না কেন, গাছের পাতার ভেতরে এমনিতে কিন্তু কোনো রূপালি রঙ মজুদ থাকে না। পাতায় অন্যান্য যে সব রঙ থাকে তার ভেতরে আছে এন্থোসায়ানিন, ক্যারোটিনয়েড, জ্যান্থোফিল ইত্যাদি। এক ধরনের খলিফা গাছ বা Acalypha-র শাদা অংশের ওপরে লাল-গোলাপি এন্থোসায়ানিন রঙ বিস্তৃত হয়ে পড়লে শাদা অংশ গোলাপি দেখায় আর সবুজ অংশ দেখা যায় মেরুন রঙের। রঙিন বৈচিত্রের একটি সুন্দর উদাহরণ হল বেগোনিয়া যার রোমশ হুল থেকে বিচিত্র রঙ দেখা দেয়।

গাছের শাদা অংশের ওপর হলুদ জ্যান্থোফিল রঙ থাকে এক ধরনের প্রতিরক্ষার জন্যে কারণ শাদা অঙ্গ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে নষ্ট হতে পারে। জ্যান্থোফিল কোষে কিছুটা আলোকরশ্মি শোষিত হয় বলে সালোকসংশ্লেষণ হয়। আউটডোরে যেসব ভেরিয়েগেটা গাছ দেখা যায়, যেমন বিচিত্র মন্দিরা তাদের শিরা-উপশিরার শাদা অংশের জায়গায় হলুদ রঙ দেখা যায়। উদ্ভিদের সামগ্রিক রঙ-বৈচিত্রের কথা ভাবলে বিচিত্র উদ্ভিদজগতকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, এলবিনো বৈচিত্র এবং রঙিন বৈচিত্র। মূলত সবুজকণাশূন্য এলবিনোর সঙ্গেই সম্পর্ক আলোচিত কিমেরা গাছের, রঙিনের সঙ্গে নয়।

উদ্ভিদের অসুস্থতা[সম্পাদনা]

একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, রোগের কারণেও কিন্তু অনেক সময় গাছে ভেরিয়েগেশন দেখা দিতে পারে। এতে অনেক ক্ষেত্রে গাছের কোনো ক্ষতিও তেমন চোখে পড়ে না। ১৭ দশ শতকে টিউলিপ-এর একটি প্রজাতির জন্যে লোকজন পাগল ছিল যা মূলত ছিল একপ্রকার মোজেইক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত গাছ। ঢাকার রাস্তায় আয়ল্যান্ডে আমি কিছু টগর গাছ দেখেছি যা সুস্থ টগরের মতো নয় কিন্তু সহজে বোঝার উপায় নেই সেগুলি রোগগ্রস্ত। ইসরাইলে টগর গাছে এক ধরনের টোবামোভাইরাস দেখা দিয়েছিলো এক যুগ আগে। ভয় হয় সেই রোগ আবার ছড়িয়ে পড়ছে না কি আমাদের টগরে, সিলেটে যার আদুরে নাম দুধফুল। আমাদের দেশের শিমের পাতাও এমন ‘বিন ইয়েলো মোজেইক ভাইরাস’-এ আক্রান্ত হয় কখনো যার বিস্তার ঘটে এফিডের মাধ্যমে। এতে পাতার অঞ্চল এমন সমানভাবে ভেরিয়েগেটা হয় যে মনে হয় ভিন্ন কোনো প্রজাতি বা উপপ্রজাতির গাছ। আমরা আর কি বলবো, এই ভুল করেছেন আমেরিকার খ্যাতনামা ট্যাক্সোনমিস্টরাও, তারাও মোজেইক ভাইরাসে আক্রান্ত গাছকে ভেবেছেন নতুন কোনো কাল্টিভার বা আবাদ করা শস্য।

যে সব গাছের পাতা বিচিত্র হয়, মূলত শাদা এলবিনো অংশের কারণে, সেসব গাছ স্বভাবতই কিছুটা দুর্বল হয়, কারণ শাদা অংশে ক্লোরোফিলের অভাবে খাদ্য উৎপন্ন হয় না। পুষ্টির অভাবে এসব গাছ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং গাছে ফুলও ধরে কম। এ ধরনের গাছ বেশিরভাগ দেখা যায় ইনডোরে যেখানে আউটডোরের তীব্র সূর্যালোকে শাদা অংশ জ্বলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। মূলত সারা পৃথিবীতে ইন্ডোরের অধিকাংশ গাছ এসেছে আমাজনের বর্ষাবন থেকে। বড় বড় কাছের ক্যানপিতে ঢাকা থাকে বলে এই বনের মেঝেতে গুল্ম বা ক্ষূপ জাতীয় গাছের ভাগ্যে আলোক জোটে খুবই কম। তাই উত্তরাধিকার সূত্রেই স্বল্পালোকে অভ্যস্ত এসব গাছ ইনডোরেই ভাল থাকে বেশি। কখনো কখনো দেখা যায় টবে বা মাটিতে ধবধবে শাদা এলবিনো চারা গজায়, কিন্তু ক্লোরোফিল না থাকার কারণে শেকড়ের মজুদ খাবার শেষ হলেই এই গাছ মরে যায়। তবে একটা ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম বেশ চাক্ষুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড-এর জঙ্গলে বেশ কিছু বিশাল আকারের শাদা এলবিনো গাছ দেখা যায়, যার ভেতর ক্লোরোফিলের লেশমাত্র নেই। অথচ সবুজ বনানীতে বরফের মতো শাদা এই পরমাশ্চর্য মহীরুহ বেঁচে থাকে শতবর্ষব্যাপী। এরা খাদ্য সংগ্রহ করে অন্য গাছের শেকড় থেকে যারা মাটিতে প্রোথিত একই শেকড় থেকে জন্মানো সহোদর।

বাগানের উদ্ভিদ[সম্পাদনা]

বাগানের উদ্ভিদের ভেতর আছে সর্পিলা বা Sansevieria trifascata, জাপানি টাকু বা Euonymus japonica এবং ডোরা মাদার বা পারিজাতের একটি ভ্যারাইটি Erythrina variegata।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]