বৃহত্তর ঢাকা টেকসই নগর পরিবহন প্রকল্প

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বৃহত্তর ঢাকা টেকসই নগর পরিবহন প্রকল্প (ইংরেজি: Greater Dhaka Sustainable Urban Transport Project, গ্রেইটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট) বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (আজন্‌স্‌ ফ্রঁসেজ দ্য দেভলপমঁ) সম্মিলিত অর্থায়নে পরিচালিত একটি পরিবহন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উত্তরে গাজীপুর শহর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি দ্রুতগামী বাস গণপরিবহন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ২০৪০ কোটি টাকা। নির্মাণকাজ শেষে চালু হলে ব্যবস্থাটি প্রতি ঘণ্টায় যেকোনও একদিকে ২০ হাজার (মতান্তরে ২৫ হাজার[১]) যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হবে এবং যাতায়াতের সময় বর্তমানের তুলনায় কমে অর্ধেক হয়ে যাবে। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর থেকে আসতে মাত্র ৫০ মিনিট সময় লাগবে। প্রতি ২ থেকে ৫ মিনিট অন্তর বাস আসবে।[১][২]

ঢাকা বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড নামক সংস্থা (ঢাকা বিআরটি) ব্যবস্থাটির পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে।[২]

প্রকল্পের বিবরণ[সম্পাদনা]

প্রকল্পের আওতাধীন প্রধান নির্মাণকাজগুলি নিম্নরূপ:[২]

  1. ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস চলাচল পথ বা লেন নির্মাণ। এর মধ্যে ৪.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অংশ হবে উত্তোলিত ৪ লেনের বাসের রাস্তা।
  2. ৮ লেনের টঙ্গী সেতু পুনর্নির্মাণ
  3. ১০০টি ১৮ মিটার দীর্ঘ বহুখণ্ডবিশিষ্ট বাস[১]
  4. ৬টি উড়ালসেতু নির্মাণ[১]
  5. গাজীপুরে একটি বাস টার্মিনাল
  6. ১৪১টি সংযোগ রাস্তার উন্নয়ন (যাদের মধ্যে ৬১টি রাস্তা গাজীপুরে অবস্থিত)
  7. জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড় থেকে তুরাগ নদী পর্যন্ত উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নর্দমা নির্মাণ
  8. গাজীপুরে ৬টি বিপণীবিতানের উন্নয়ন এবং
  9. রাস্তার সমগ্র দৈর্ঘ্য ধরে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হাঁটার রাস্তা বা ফুটপাত নির্মাণ

প্রকল্পের নির্বাহী সংস্থাটি হল বাংলাদেশ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ। বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি হল সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষস্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ

গতিপথ[সম্পাদনা]

বাস করিডোরটি বিমানবন্দর সমাপনী বিরতিস্থল বা বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে শুরু হয়ে ৩নং জাতীয় মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পরে জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে এটি পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে আরও ৪ কিলোমিটার অগ্রসর হয়ে গাজীপুরের টার্মিনালে গিয়ে শেষ হবে, যা গাজীপুর বাজারের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত। সোনারগাঁও সড়ক, আশুলিয়া সড়ক ও স্টেশন রোডের চৌরাস্তাগুলিতে এবং তুরাগ নদীর উপর দিয়ে বাস করিডোরটি ভূসমতলে না থেকে উত্তোলিত পথে চলবে। এছাড়া বড় বড় চৌরাস্তাগুলির উপর দিয়ে আরও ৬টি উড়ালসেতু থাকবে।

উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহরের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ঢাকার এই নিম্ন অবস্থানের মূল কারণ হল যানজট এবং বায়ু দূষণ। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অতিমহানগরীগুলির একটি হল ঢাকা। প্রতি বছর আনুমানিক ৩-৪ লক্ষ লোক গ্রাম থেকে ঢাকাতে পাড়ি জমায়। ২০০০ সালের তুলনায় সম্প্রতি বৃহত্তর ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২ সালে এর জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালে এই বৃহত্তর মহানগরী এলাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ৫০ লক্ষ। এছাড়া ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্ববিশিষ্ট শহরগুলির একটি; এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫,৫০৮ জন লোক বাস করে। শহরের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোর অভাব, জনসেবার অপ্রতুলতা, ইত্যাদি কারণে শহরের সমস্ত জনগণের জন্য পরিবহন সেবা প্রদান দুষ্কর। ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির ব্যবহার কম হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে গাড়ির ব্যবহারও বাড়ছে, বাৎসরিক ৮% হারে। ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকাতে প্রায় ৫ লক্ষ মোটরগাড়ি চলতে পারে। ফলে পরিবহন খাত থেকে বায়ু দূষণ ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বেড়েই চলছে।[৩]

মহানগর ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর শহরের প্রান্তসীমায় অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন হচ্ছে। তাই উপশহর, নগরপুঞ্জ ও ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকার নাগরিক প্রবৃদ্ধি ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত স্থান নিয়ন্ত্রণ করে শহরের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে শহরের প্রভাব হ্রাস করা প্রয়োজন। এর সূত্র ধরে বেশ কিছু সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে ঢাকার ৬টি উপশাহরিক করিডোরের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাথে নব্য গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনকে সংযুক্তকারী করিডোরটিতে একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা স্থাপন করে নগর উন্নয়নকে আরও সুশৃঙ্খল করার সম্ভাবনাটি সবচেয়ে অনুকূল। আর এই করিডোরের ক্ষেত্রে বাসভিত্তিক দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা হল সবচেয়ে বেশি মূল্যসাশ্রয়ী।[৩]

ঢাকার উত্তর প্রান্তে টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভাগুলিকে মিলিত করে ঢাকার একটি উপশহর হিসেবে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যার প্রাক্কলিত জনসংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ, সাথে আছে এক বৃহৎ ভাসমান জনসংখ্যা। এই এলাকাটি একটি বস্ত্রশিল্পকেন্দ্র। এখানে প্রায় ২৭২টি কারখানাতে ১০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। প্রায় ৪৮৫৮টি বড় ও ছোট বাস এই করিডোরে চলাচল করে, যাদের এক-চতুর্থাংশের কোনও অনুমোদন নেই। ৬১টি অনুমোদিত শহুরে সড়কে ও ৩৮টি আন্তঃশহর সড়কে ৪৫টি কোম্পানির বাস চলাচল করে। বাসগুলির মান খুবই খারাপ। বাসের ওঠানামার স্থানগুলি একেবারেই নিম্ন পর্যায়ের এবং এগুলিতে যাত্রীদের জন্য সময়, যাত্রাপথ বা সংযোগের ব্যাপারে কোনও তথ্যই নেই। টিকিট কেনার ব্যবস্থাও উন্নত নয়। বাসচালকেরা ও দালালরা যাত্রীর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, ফলে যানবাহনের ভিড় লেগেই থাকে ও সড়ক নিরাপত্তা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে দরিদ্র পথচারীদের উপর এটি অত্যন্ত নেতিবাচক এবং তারা প্রায়শই আহত বা নিহত হন। দরিদ্র পথচারীদের অনেকেই আবার বস্ত্র কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক, তাই জেন্ডার বা লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাপারটি গুরুতর।[৩]

অর্থসংস্থান ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প[সম্পাদনা]

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (১০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ) ও ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (৪ কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ) সহায়তায় নির্মীয়মান এই প্রকল্পটির সাথে পরবর্তীতে ঢাকার অভ্যন্তরভাগে বিশ্বব্যাংকের উদোগে নির্মীয়মান বাসভিত্তিক দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাটিকে সমন্বিত করা হবে, এবং এর ফলে গাজীপুর থেকে ঢাকার কেন্দ্র পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গণপরিবহন করিডোর সৃষ্টি হবে। এছাড়া জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা সম্প্রতি ঢাকার নগর পরিবহন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন সমীক্ষা পরিচালনা করছে, যেখানে একটি পাতালরেল বাস্তবায়নের ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।[৩]

অভিঘাত[সম্পাদনা]

প্রকল্পে সব মিলিয়ে ৪.২ একর ভূমির দরকার হবে, যার মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বাকি অর্থেক সরকারি ভূমি। জনগণনা সমীক্ষা অনুযায়ী এই প্রকল্পের কারণে ১৫৩৫টি বসতবাড়ি তথা ৭২১৪ জন লোক ব্যক্তিগত ভূমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে ও পুনর্বাসন করা হবে। এ ব্যাপারে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।[৪]

বাস্তবায়নের গতি[সম্পাদনা]

প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয় এবং ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি সমাপ্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ২০১৮ সালের শেষার্ধে এসে ছয় বছরে প্রকল্পের মাত্র ২০% সমাপ্ত হয়েছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. UNB, Deal signed to build Airport-Gazipur BRT route, সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভে ২০১৮ 
  2. Bangladesh Bridge Authority, Greater Dhaka Sustainable Urban Transport Project [BRT Gazipur-Airport], সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভে ২০১৮ 
  3. Asia Development Bank, Project Data Sheet, Bangladesh: Greater Dhaka Sustainable Urban Transport Project, সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভে ২০১৮ 
  4. Social Monitoring Report, January-June 2018, 2862/63/64-BAN (SF): Greater Dhaka Sustainable Urban Transport Project (পিডিএফ), সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভে ২০১৮