ঢোলা মারু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ঢোলা মারু হল রাজস্থানের ঢোলা এবং মারুর প্রেম উপাখ্যান। এই ভারতীয় লোক কাহিনীর দুটি ভিন্ন সংস্করণ বর্তমান, একটি রাজস্থানী ও অপরটি ছত্তিশগড় রাজ্যের। এই দুই সংস্করণ একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

দেশীয় সাহিত্যে ঢোলা মারু[সম্পাদনা]

ঢোলা মারুর গল্প মূলত দেশের মৌখিক লোকগাথা ঐতিহ্যের পরিবাহক। যুগ যুগ ধরে এই গল্প গদ্য ও কবিতার আকারে প্রচারিত হিয়েছে।[১] ১৬১৭ সালে জৈন সন্ন্যাসী কুশলভের রচিত 'ঢোলস মারু রি চৌপাই' নামক একটি বই আছে যেখানে এই গল্পের পৌরানিকতার উল্লেখ রয়েছে। ১৪৭৩ সালের কিছু পাণ্ডুলিপিতেও গল্পটি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। কাশী নগরীর প্রচারিণী সভা দ্বারা সম্পাদিত 'ঢোলা মারু রা দোহা' এই লোকগাথার উপর ভিত্তি করে লিখিত এক গ্রন্থ। এই গল্পটি রাজপুত এবং রাজস্থানী ইতিহাসের সবচেয়ে মুগ্ধকর অধ্যায়ের সময়কে চিত্রিত করে।

গল্প[সম্পাদনা]

রাজস্থানী সংস্করণ[সম্পাদনা]

এই কাহিনীতে নারওয়ারের রাজকুমার ঢোলা এবং পুগল রাজকুমারী মারুর প্রেমের কথা বলা হয়েছে। শৈশবে তাদের বিয়ে হয় (বর্তমানে অবৈধ)। পরবর্তীকালে ঢোলার পিতা রাজা নল মারা যান এবং ঢোলা তার বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে মালওয়ানি নামক জনৈক মহিলাকে পুনরায় বিয়ে করেন। মারু ঢোলাকে অনেক পত্র পাঠিয়েছিল, কিন্তু মালওয়ানী ঢোলার কাছে পৌছানোর আগেই তার সমস্ত পত্র নষ্ট করে দেয়। ঢোলার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে মারু নিজে ঢোলার কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। মারু ঢোলাকে সরাসরি বার্তা পাঠায় যাতে উল্লেখ করা হয় যে মারু হল ঢোলার প্রথম স্ত্রী যাকে তিনি শৈশবে বিয়ে করেছিলেন। মারু তখন বলেছিল যে এখন সে তার মন পরিবর্তন করেছে এবং স্বাধীন জীবনযাপন করতে চায়। সে তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় এবং তার জনগনের জন্য কিছু করতে চায়। বার্তাটির একদম শেষে সে উল্লেখ করে যে ঢোলার সাথে সে তার সম্পর্ক শেষ করতে চায় এবং সে কারণেই তিনি তার সাথে দেখা করতে চায়, কিন্তু কেউ তার বার্তাগুলিকে তার কাছে পৌছাতে দিচ্ছেন না।

পুগাল থেকে একদল লোক গায়ক নারওয়ারে পৌঁছে ঢোলাকে তার প্রথম স্ত্রী মারু সম্পর্কে জানান। মারু সম্পর্কে জানার পর, ঢোলা তখন মারুর সাথে দেখা করার জন্য একটি বিপদজনক যাত্রা শুরু করে। পথে সে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। তার স্ত্রী মালওয়ানি তাকে যেতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঢোলা অবশেষে পুগালে পৌঁছেন এবং শেষ পর্যন্ত ঢোলা ও মারু মিলিত হয়।

তাদের প্রত্যাবর্তন যাত্রার সময়, মারুকে একটি বিষাক্ত সাপ কামড়ায় এবং সেই দুঃখে ঢোলা নিজের আত্মদহনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একজন যোগী এবং যোগিনী তাকে রক্ষা করেছিলেন।তারা দাবি করেন যে তারা মারুকে পুনরায় জীবিত করতে পারে। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মারুকে জীবিত করে। উমর সুমর আবার ঢোলাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু লোককথা অনুসারে ঢোলা আর মারু এক মায়াবী উড়ন্ত উটে চড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায় এবং মালওয়ানির সাথে দম্পতি সুখে জীবনযাপন করে।

ছত্তিশগড়ী সংস্করণ[২][৩][সম্পাদনা]

ছত্তিশগড় সংস্করণ অনুসারে ঢোলা রাজা নল এবং মা দময়ন্তীর পুত্র ছিলেন। ঢোলা তার আগের জন্মের একজন সুপুরুষ ছত্তিশগড়ী যুবক ছিলেন যে একদা কোনো গ্রামের পুকুরে মাছ ধরছিল। রেওয়া একজন সুন্দরী যুবতী যে তার আগের জন্মে সেই গ্রামের কোনো এক পরিবারের পুত্রবধূ ছিলেন। ঢোলার সংগে অন্তত একবার কথোপকথনের আশায় সেই রমনী সাতবার জল আনতে এসেছিল। কিন্তু ঢোলার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তার মনযোগ আকর্ষণ করতে নিম্নলিখিত কাব্যছন্দটি বলে ওঠেন:

গারি খেলেন, গারি খেলোয়া কাহায়ে, আউ লম্বে মেলে তার, সাতো লাহুত পানি আয়ে গা ঢোলা, তাই একো নাই বোলে বাত

[তুমি জেলেদের মত ছিপ দিয়ে মাছ ধরছ, আর লম্বা টোপ দিয়েছি; আমি সাতবার জল নিতে এসেছি, আর তুমি একটা কথাও বলনি আমার সাথে!]

তখন ঢোলা তার উত্তরে বলে ওঠে:

গারি খেলেন, গারি খেলোয়া কাহায়ে, আউ লম্বে মেলে তার, তোর লে সুঘর ঘর কামিন হ্যায় গোরি, তোলা একো নাই বোলে বাত

[আমি জেলেদের মত ছিপ দিয়ে মাছ ধরছি, আর লম্বা টোপ দিয়েছি; আর বাড়িতে আমার স্ত্রী আপনার চেয়েও বেশি সুন্দরী, তাই আমি আপনার সাথে একটি কথাও বলিনি!]

এই জবাব রেওয়ার হৃদয়কে তীরের মতো বিদ্ধ করে এবং অনুশোচনার সাগরে পূর্ণ করে দেয়। প্রত্যাখ্যানের আঘাত পেয়ে তিনি তার বাড়িতে ফিরে আসেন এবং তার বাগানের কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। যখন তার আত্মা স্বর্গে পৌঁছায়, তখন সেখানে ঈশ্বরের মুখোমুখি হলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে কেন সে তার প্রকৃত জীবনকাল শেষ করার আগেই স্বর্গে এসেছে। তিনি ঢোলা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গল্প বর্ণনা করেন। তখন ঈশ্বর তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে কি চায়। রেওয়া উত্তর দিল যে সে চায় ঢোলা তার স্বামী হোক। তার অনুরোধের উত্তরে, ভগবান বলেছিলেন যে ঢোলার ভাগ্যে ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে যে সে মারুর স্বামী হবে। সেই অনুযায়ী রেওয়া ঢোলাকে আজীবন স্বামী হিসাবে পেতে পারে না তবে কেবল ১২ বছরের জন্য সে ঢোলাকে পেতে পারে। এরপর ঢোলা, মারু এবং রেওয়ার আবার জন্ম হয়। ঢোলা এবং মারুর শৈশবে বিয়ে হয়।

মা দময়ন্তী তার ছেলে ঢোলাকে বারবার সতর্ক করে দিতেন যেন সে মালহিন পাড়াতে কখোনো না যায় (বর্ণভিত্তিক এলাকা, মালহিনরা হল ফুল বিক্রেতা এবং তাদের প্রধান পেশা হল বাগান করা), এছাড়া সে গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় ঘুরতে যেতে পারে। কিন্তু ঢোলা তার কথা শোনে না এবং মালহিন পাড়ার চারপাশে ঘুরতে যায় এবং সেখানে একটি তোতা পাখির মুখোমুখি হয় যে তাকে এই কথা বলে:

তোর দাদা কে নাক চুনাবতি, হুচুররাআআআ!
[তোমার বাবার নাক কেটে যাক!]

ঢোলা তার কথায় অত্যন্ত রেগে যায় এবং তার অস্ত্র দিয়ে তোতাকে আঘাত করে। তোতাপাখিটি অবিলম্বে মারা যায়। তখন এক সুন্দরী মহিলা সেখানে উপস্থিত হন যিনি এই তোতাপাখির মালিক ছিলেন। এই মহিলা ছিল রেওয়া এবং তোতাপাখিটি তার জাদুর সৃষ্টি। তিনি ঢোলার উপর চাপ সৃষ্টি করে বলেন যে তার তোতাকে আবার জীবিত করা হোক অন্যথায় ঢোলাকে তার বাড়িতে তার সাথে থাকতে হবে। রেওয়ার বাবা, হিরিয়া মালহিন এবং গ্রামের অন্যরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়না। ঢোলা রেওয়ার বাড়িতে বন্দী হয়ে এবং তার সাথে বসবাস শুরু করে।

এদিকে মারু তার যৌবন বয়সে পৌঁছায়। ঢোলার স্মৃতি তাকে ব্যাথিত করতে শুরু করে। তিনি তোতাপাখির মাধ্যমে এবং পরে ধরির (সম্ভবত একজন মানব বার্তাবাহক) মাধ্যমে ঢোলাকে বিভিন্ন বার্তা পাঠান। কিন্তু রেওয়া তার ছাছাঁদ (ঈগল) ব্যবহার করে এবং অন্যান্য অনেক উপায়ে সেই বার্তা নষ্ট করে দেয়। অবশেষে, মারু কারহা (বিয়ের উপহার হিসাবে তার বাবা-মায়ের দেওয়া একটি উট) পাঠায়। কারহা রেওয়ার গ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, কিন্তু সেও রেওয়া-র যাদুতে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বারো বছর ও তেরো পূর্ণিমার সময়কাল ধরে এক জলাভূমিতে বন্দী হয়ে পরে।

মারুর গীয়ান(বান্ধবী) নারোর শহরে(সম্ভবত বর্তমান সময়ের চাম্পা জেলা, ছত্তিশগড়) বসবাসকারী একজন বনিয়া (ব্যবসায়ী) -কে বিয়ে করেছিলেন। সেখানেই ঢোলা রেওয়ার সাথে থাকত। মারুর গীয়ান পিংলা (সম্ভবত তৎকালীন মালহার) -তে তার মাতৃ আলয়ে ভ্রমন করতে আসে এবং তখন তার বন্ধু মারুর সাথে তার দেখা হয়। মারু তাকে ঢোলার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি প্রেম-পত্র দেয়। মারু অনুরোধ করেছিল যে এই চিঠিটি ঢোলা ছাড়া অন্য কেউ যেন না দেখে কারণ এতে কিছু খুব ব্যক্তিগত বিবরণ রয়েছে যা তিনি কেবল ঢোলাকে জানাতে চেয়েছিলেন। বিজয় দশমীর প্রাক্কালে (অর্থাৎ দশেরার আগের দিন, নবমী), মারুর বন্ধু তার লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছিল এবং জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। বনিয়া পাশে বসে কিছু হিসাব-নিকাশ করছিলেন। নবমী দশেরা উদযাপনের ঢোল-আওয়াজের মধ্যে ভদ্রমহিলা একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। সে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, যে কারা এই শুভ উদযাপনের মাঝে কাঁদছে? তার স্বামী উত্তর দেয় যে সেই লোকেরা হলেন রাজা নল এবং তার স্ত্রী দময়ন্তী। তাদের একমাত্র ছেলে ঢোলা রেওয়ার প্রাসাদে গৃহবন্দী। তখন তার অবিলম্বে মারুর চিঠির কথা মনে পড়ে এবং তার স্বামীকে ঢোলার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু ঢোলাকে কখনই প্রাসাদের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। যাইহোক, রেওয়ার ১২ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় চলে আসে। ঢোলাও ভিতরে অস্বস্তির অনুভূতি অনুভব করে এবং বাইরে যাওয়ার সংকল্প করে। একাধিক অনুরোধের পরে, রেওয়া তাকে বাড়ির বাইরে বাইরে যেতে দেওয়ার জন্য রাজি হন এবং একটি শর্ত রাখেন যে তিনি খড়খদিয়া রথে (একটি বড় রথের পিছনে ছোট রথ বাঁধা) তার সাথে যাবেন। ঢোলা তাকে বোঝায় যে রেওয়াকে তার রথের পিছনে দেখে গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে এবং তার পুরুষত্ব এবং রাজকীয় কর্তৃত্ব সম্পর্কে উপহাস করবে। তাই অবশেষে রেওয়া বাড়িতে থাকতে রাজি হয় এবং ঢোলাকে দশেরা উপলক্ষে বাইরে যেতে দেওয়া হয়। বনিয়া ঠিক এই সুযোগ খুঁজছিল যাতে কোনরকমে ঢোলার সাথে দেখা করা যায়।

এবং গল্প চলতে থাকে। . . . . . .

লোকনাট্য[সম্পাদনা]

রাজস্থানী লোকনাট্যে ঢোলা-মারু ঐতিহ্যের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।[৪] রাজস্থানের লোকনাট্য ' খেয়াল ' এই অঞ্চলের শিল্পকলার একটি বড় অংশ।[৫]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে[সম্পাদনা]

এই লোককথা বহুবার চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন, এন আর আচার্যের ঢোলা মারু (১৯৫৬), মেহুল কুমারের ঢোলা মারু (১৯৮৩)।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "The Romantic Tale Dhola Maru"। ২০০৯-০৪-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৫-০৪ 
  2. "Epic traditions in the contemporary world: the poetics of community By Margaret H. Beissinger, Susanne Lindgren Wofford"
  3. "Raja Nal and the Goddess: the north Indian epic Dhola in performance By Susan Snow Wadley (Page 212)"
  4. "Rajhastani Puppets- The Dhola Maru Story"। ২০০৮-০৫-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৫-০৪ 
  5. "Dhola-Maru The Love story of Rajasthan"। ১৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ মে ২০০৯ 
  6. Rajadhyaksha, Ashish; Willemen, Paul (১৯৯৯)। Encyclopaedia of Indian cinemaবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। British Film Institute। আইএসবিএন 9780851706696। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০১২