চৌতিশা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

চৌতিশা হল ভারতীয় সাহিত্যে সাহিত্য রচনার একটি ধারা। মধ্যযুগীয় কবিতায় লিখনশৈলীর জনপ্রিয় একটি রূপ ছিল এটি। এটি সীমাবদ্ধ লেখালিখির একটি রূপ যেখানে প্রতিটি পংক্তি বর্ণমালার পরপর অক্ষর দিয়ে শুরু হয়, সাধারণত প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু হয়। 'চৌতিশা' শব্দের অর্থ চৌত্রিশ, যা বাংলা অথবা ওড়িয়া লিপির মোট ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা বোঝায়। [১][২]

বাংলা সাহিত্য[সম্পাদনা]

চৌতিশা মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের একটি প্রমুখ ধারা।[২] এর একটি বিশেষ ধরন হল এতে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে আদিতে রেখে চরণ রচনা করা হয়। কখনও বা একই বর্ণ দিয়ে একই চরণে একাধিক পদও রচিত হয়। চৌত্রিশটি বর্ণকে আশ্রয় করে এরূপ কবিতা রচিত হয় বলে একে বলা হয় চৌতিশা। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এ-ধারার ব্যাপক চর্চা হয়েছে।

চৌতিশার প্রচলন প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও দেখা যায়। সংস্কৃতে প্রধানত দেবদেবীর স্তব রচনার উদ্দেশ্যেই এ আঙ্গিকে শ্লোক রচিত হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে চৌতিশা আছে। দেবদেবীর স্তবমূলক চৌতিশা বাংলা মঙ্গলকাব্যের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের একটি অঙ্গ। এতে চরণগুলির প্রথম পদ অবশ্যই বর্ণানুক্রমিক হয়ে থাকে। মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চন্ডীতে শ্রীপতি সওদাগর কারাগারে বন্দি অবস্থায় কালীদেবীর স্ত্ততি গেয়ে তাঁর কৃপা লাভ করে এবং দেবীর কল্যাণে রাজদন্ড থেকে মুক্তি পায়। এখানে চৌতিশা শুরু হয়েছে ‘ক’ দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ‘ক্ষ’ দিয়ে। এর প্রথম চরণ ‘কালী কান্তি কপালিনী কপালকুন্ডলা’ এবং শেষ চরণ ‘ক্ষেণেক ধরিয়া রাখ আমি দীন হীন’। সর্বমোট ৬৭টি জোড় চরণ বা ১৩৪টি পংক্তিতে চৌতিশাটি রচিত। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এরূপ জোড়-পদের সংখ্যা ৫০টি। নায়ক সুন্দর শ্মশানে কালীস্তুতি করে তাঁর কৃপায় মৃত্যুদন্ড থেকে মুক্তি পায়। এখানে ‘অ’ দিয়ে শুরু এবং ‘ক্ষ’ দিয়ে শেষ হয়েছে, যেমন: ‘অপর্ণা অপরাজিতা অচ্যুত অনুজা’ এবং ‘ক্ষুব্ধ হই ক্ষোভ পাই ক্ষীণাঙ্গী ভাবিয়া’

মধ্যযুগে একাধিক মুসলিম কবিও এই আঙ্গিকে কবিতা রচনা করেছেন, তবে প্রসঙ্গ ও বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলমান কবির পক্ষে দেবস্তুতি সম্ভব নয় বলে তাঁরা সঙ্গত কারণেই অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।  শেখ ফয়জুল্লাহ্ জয়নবের চৌতিশা, বাহরাম খান লায়লীর চৌতিশা,  সৈয়দ সুলতান জ্ঞানচৌতিশা উক্ত আঙ্গিকে রচনা করেছেন। দোভাষী পুথির কবি মুহম্মদ ফসীহ ‘আরবী ত্রিশ হরফে মুনাজাত’ শিরোনামে এ আঙ্গিকে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করেছেন।

পনেরো শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহের জয়নবের চৌতিশা একটি শোককাব্য। কারবালার করুণ কাহিনি নিয়ে রচিত এই কাব্যে ইমাম হোসেনের সহধর্মিণী বিবি জয়নবের বিলাপের কথা বর্ণিত হয়েছে। ষোলো শতকের কবি বাহরাম খানের লায়লী-মজনু কাব্যে বিরহিণী লায়লীর বিলাপে একই আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে। কবি এখানে ‘ক’ দিয়ে শুরু করে ‘ক্ষ’ দিয়ে ত্রিপদী ছন্দে কবিতা রচনা শেষ করেছেন, যেমন: ‘কমল নয়ান পিয়/ কঠিন তোহ্মার হিয়/ করুণা ছাড়িয়া দূরে গেলা’ এবং ‘ক্ষেমিতে মনের মান/ ক্ষিতিত চৌতিশা ভাণ/ ক্ষুদ্রবুদ্ধি দৌলত উজির’। ষোলো শতকের অপর কবি সৈয়দ সুলতান সুফি ও যোগতত্ত্বের বিষয় অবলম্বনে জ্ঞানচৌতিশা রচনা করেছেন। এখানে বিষয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। জ্ঞানচৌতিশা একটি খন্ডকাব্য। এতে প্রতি বর্ণে ৪টি করে মোট ১৩৬টি চরণ পয়ার ছন্দে রচিত।

আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ ফসীহ পয়ার ছন্দে আরবি অবলম্বনে চৌতিশা রচনা করে এ-ধারায় নতুনত্ব আনেন। তিনি ৩০টি আরবি হরফের প্রত্যেকটি দিয়ে ৪টি করে মোট ১২০টি চরণ রচনা করেছেন। এর শুরু ‘আলিফ’ এবং শেষ ‘ইয়ে’ হরফ দিয়ে, যেমন: ‘আলিপে আল্লার নাম মনে করি সার’ এবং ‘ইতি সমাপ্ত এবে মোর মুনাজাত’। এভাবে মুসলমান কবিগণ আরবি-ফারসি উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে চৌতিশা রচনা করেছেন। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট এই কাব্যধারা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

ওড়িয়া সাহিত্য[সম্পাদনা]

চৌতিশা ওড়িয়া ভাষার প্রাচীনতম কবিতা শৈলীর একটি। [৩] মধ্যযুগীয় ওড়িয়া সাহিত্যে অসংখ্য চৌতিশা রচিত হয়েছে। প্রাচী সমিতি (১৯২৫-৩৪) মধ্যযুগীয় কবিতার চারটি খণ্ড সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছে এবং এতে শত শত চৌতিশা রয়েছে। [৪] [১]বহুল পরিচিত প্রাচীনতম চৌতিশা হল মার্কণ্ড দাস রচিত কেশব কৈলি[৫]

বলদেব রথ, বনমালী দাস, দীনকৃষ্ণ দাস প্রমুখ বিখ্যাত কবি যারা চৌতিশা সাহিত্য লিখেছেন।

গঠন[সম্পাদনা]

সাধারণত কবিতাগুলো অক্ষর দিয়ে শুরু হয় এবং କ୍ଷ দিয়ে শেষ হয়। প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পদ বা লাইন একই অক্ষর দিয়ে শুরু হয়।

কমললোচন চৌতিশা, বলরাম দাস প্রতিবর্ণ
ମଳ ଲୋଚନ ଶ୍ରୀହରି । ରେଣ ଶଙ୍ଖ ଚକ୍ରଧାରୀ ।।

ଗ ଆସନେ ଖଗପତି । ଟନ୍ତି ଲକ୍ଷ୍ମୀ ସରସ୍ୱତୀ ।।

ରୁଡ଼ ଆସନେ ମୁରାରି । ଗୋପରେ ରଖିଲେ ବାଛୁରୀ ।।

মল় লোচন শ্রীহরি । রেণ শঙ্খ চক্রধারী ॥

গ আসনে খগপতি । টন্তি লক্ষ্মী সরস্বতী ॥

রুড় আসনে মুরারি । গোপরে রখিলে বাছুরী ॥

চৌতিশা কবিদের নেওয়া কিছু কাব্যিক স্বাধীনতা আছে। যেমন / ଞ (ঙ, ঞ) অক্ষরের জায়গায়, ନ (ন) দিয়ে শুরু হওয়া শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় কারণ সেই অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া কোনও শব্দ নেই।

কিছু কবি অক্ষরের ক্রম উল্টে লিখেছেন এবং କ୍ଷ থেকে শুরু করে দিয়ে শেষ করেছেন। একে বলা হয় ওলট চৌতিশা[৬]

সাধারণত চৌতিশার ৩৪টি স্তবক/স্তব থাকে। অন্যান্য জনপ্রিয় বিকল্পগুলো হল:

  • ২ শ্লোক চৌতিশা- প্রতিটি শ্লোক চরণে ১৭ টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে।
  • ৩ শ্লোক চৌতিশা- ১২টি ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ১০টি ব্যঞ্জনবর্ণ বিশিষ্ট দুটি চরণ।
  • ৬ শ্লোক চৌতিশা- যেমন- উপেন্দ্র ভাঞ্জের চিতৌ চৌতিশা
  • ৯ শ্লোক চৌতিশা- যেমন- দামোদর দাস রচিত হনুমন্ত জনন চৌতিশা

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Mansinha, M. (১৯৬২)। History of Oriya Literature। Sahitya Akademi. Histories of literature। New Delhi। পৃষ্ঠা 45। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  2. "চৌতিশা - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৪-১৮ 
  3. Mazumdar, B.C. (১৯২১)। Typical selections from Oriya literature। Typical selections from Oriya literature। Baptist Mission Press। পৃষ্ঠা xxi। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  4. Datta, A. (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian Literature: Devraj to Jyoti। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 1740। আইএসবিএন 978-81-260-1194-0। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-১৫ 
  5. Mansinha, M. (১৯৬২)। History of Oriya Literature। Sahitya Akademi. Histories of literature। New Delhi। পৃষ্ঠা 46। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  6. Mohanty, J.B. (১৯৯৩)। Banamali Das। Makers of Indian literature (জার্মান ভাষায়)। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 32। আইএসবিএন 978-81-7201-449-0। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-১৫ 

টেমপ্লেট:Odia languageটেমপ্লেট:Odia literature