চীনে ইসলামের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হুয়াইশেং মসজিদ হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এটি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস দ্বারা নির্মিত।

চীনে ইসলামের ইতিহাস শুরু হয় যখন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (৫৯৪-৬৭৪), জাফর ইবনে আবি তালিব, এবং জাহস সহ চারজন সাহাবী ৬১৬/১৭ সাল থেকে চীনে এসে ধর্মপ্রচার শুরু করে। তারা ৬১৫/১৬ সালে আবিসিনিয়া থেকে জাহাজে যাত্রা করে চট্টগ্রাম-কামরূপ-মনিপুর রাস্তা ধরে চীনে পৌঁছান। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস পুনরায় তৃতীয়বারের মত ৬৫০-৫১ সালে খলিফা উমরের কথায় চীনে দূতের দলের নেতা হয়ে যান। সেই দূতের দলকে চীনের সম্রাট উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করেন।[১]

ইসলামিক চীনের উৎপত্তি[সম্পাদনা]

চীন-আরব বাণিজ্যিক সম্পর্ক[সম্পাদনা]

ইসলাম-পূর্ব আরব এবং চীনের দক্ষিণ তীরের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, এবং আরব উপকূলের ব্যাবসায়ীগণের ইসলামে ধর্মান্তরিত হবার পর এই বাণিজ্য সমৃদ্ধ হয়। মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের সময়ে এই সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

বিভিন্ন স্তেপ অঞ্চলের জাতি ও সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য, যুদ্ধ, অধীনস্ততা এবং কর্তৃত্বের কারণে তৈরি হওয়া চীনের দীর্ঘ ও পারস্পরিক সম্পর্ক চীনে ইসলামী সম্প্রদায়ের জন্য টেকশই ও বৃহৎ রাস্তা খুলে দেয়। বিভিন্ন স্তেপ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যারা চীনের সংস্কৃতিতে আত্তীকৃত হয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকেই চীনে ইসলামী প্রভাব আসে। যেসব মুসলিম পারস্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে মঙ্গোলদের অধীনে সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য চীনে এসেছিল, তারা প্রশাসক, সেনাধ্যক্ষ, এবং অন্যান্য নেতৃত্বসূচক কাজে নিযুক্ত ছিলেন।

কখনও কখনও অনেক বাধা আসা সত্ত্বেও চীনে মঙ্গোলরা তাদের নিজেদের বিশ্বাস পালন করত। ইসলাম সেইসব ধর্মগুলোর মধ্যে একটি যা চীনে এখনও দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত।[২]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

চীনের মুসলিমদের ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, চীনে ইসলাম এসেছিল সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের হাত ধরেই, যিনি মুহাম্মাদ এর মৃত্যুর ২০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৬৫১ সালে ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের দ্বারা দূতগণের নেতা হয় চীনে তৃতীয়বারের মত গমন করেন। ট্যাং সম্রাট গাওজং তাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং ক্যান্টনে স্মারক মসজিদ নির্মাণ করতে আদেশ করেন। এটি ছিল দেশটির প্রথম মসজিদ যা নবী মুহাম্মাদ স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি হয়।[২][৩] হুই কিংবদন্তি অনুসারে চীনে ৬১৬/১৭ সালে সাহাবীদের চীন ভ্রমণের মাধ্যমেই চীনে ইসলামের সূচনা ঘটে।

আধুনিক ইতিহাসবিদগণ যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, চীনে ওয়াক্কাসের আসার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই,[৩] তারা বিশ্বাস করেন না যে মুসলিম কূটনীতিক ও বণিকগণ ট্যাং চীনে মধ্যযুগের শুরুর কয়েক দশকের মধ্যে পৌঁছেছিলেন।[৩] ট্যাং রাজবংশের বিশ্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, মধ্য এশিয়ার সাথে এর ব্যাপক যোগাযোগ এবং চীনের শহরে বাস করা মধ্য এশীয় ও পশ্চিম এশীয় অমুসলিম বণিক চীণে ইসলামের সূচনায় সাহায্য করেছিল।[৩]

ট্যাং রাজবংশ[সম্পাদনা]

গ্রেট মস্ক অফ জিয়ান হচ্ছে চীনের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি।

ট্যাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) বর্ষবিবরণে তা শি শিরোনামের অধীনে প্রথম কোন চৈনিক লিখিত দলিলে আরবদের সম্পর্কে জানা যায়। তা শি বা দা শি হচ্ছে তাজি এর চৈনিক শব্দ, পারস্যের লোকেরা আরবদেরকে তাজি নামে সূচিত করতেন। ৭১৩ সালের একটি তথ্যে দা শি দূতদের আসার কথা জানা যায়। চীনে মুসলিমদের প্রথম প্রধান উপনিবেশে আরব ও পারস্যের বণিকগণ ছিলেন।[৪]

৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তালাসের যুদ্ধের সময় ট্যাং রাজবংশ ও আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও এর পরপরই এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। ৭৫৬ সালে সম্ভবত পারস্য এবং ইরাকিদের নিয়ে নিয়ে একটি প্রতিনিধি দলকে আন লুশানদের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সম্রাট সু-শুংকে সাহায্য করার জন্য কানসুতে পাঠানো হয়। এরপর ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মধ্য এশিয়ায় তিব্বতীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে ট্যাং এবং আব্বাসীয়দের মধ্যে জোট তৈরি হয়। খলিফা হারুন উর রশিদ (৭৬৬-৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) এর একটি মিশন চ্যাংগানে পৌঁছেছিল।[৫]

এই তথ্য সংরক্ষিত আছে যে, গুয়াংঝৌতে কোন্দলের কারণে একটি বৃহৎ মুসলিম উপনিবেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং সেখানকার লোকজন পালিয়ে গিয়েছিল। এই সম্প্রদায় একটি বিশাল মসজিদ (হুয়াইশেং মসজিদ) নির্মাণ করেছিল, যা ১৩১৪ সালে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়, এবং ১৩৪৯ থেকে ১৩৫১ সালে এটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়।

ট্যাং রাজবংশের সময়, আরব (তা শি) ও পারসিক (পো সি) বণিকদের একটি ধীরপ্রকৃতির ধারা সিল্ক সড়ক ও সমুদ্রপথ ধরে কুয়াংঝৌ বন্দর হয়ে চীনে প্রবেশ করে। এদের সকল অভিবাসীই মুসলিম ছিলেন না, কিন্তু এদের অনেকেই যারা চীনে থেকে গিয়েছিলেন তারা চীনের মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং হুই নৃগোষ্ঠীর ভিত্তি তৈরি করে। পারস্যের অভিবাসীগণ পোলো, তাদের কুইসাইন, তাদের বাদ্যযন্ত, এবং ঔষধ সম্পর্কিত তাদের জ্ঞান চীনে পরিচিত করায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Khamouch, Mohammed। "Jewel of Chinese Muslim's Heritage" (পিডিএফ)। FTSC। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০১২ 
  2. BBC 2002, Origins
  3. Lipman 1997, পৃ. 25
  4. Israeli (2002), pg. 291
  5. Gernet, Jacques. A History of Chinese Civilization. 2. New York: Cambridge University Press, 1996. আইএসবিএন ০-৫২১-৪৯৭১২-৪