গির্জা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

গির্জা হল খ্রিস্টান উপাসনা পরিষেবা এবং অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত একটি ভবন। প্রাচীনতম চিহ্নিত খ্রিস্টান চার্চ হল হাউস চার্চ যা ২৩৩ এবং ২৫৬ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১১তম থেকে ১৪'শ শতক পর্যন্ত, পশ্চিম ইউরোপে গির্জা নির্মাণের একটি জোয়ার পরিলক্ষিত হয়। ইহা খ্রিষ্টানদের গণউপাসনালয়, যেখানে খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের সভ্যরা সমবেত হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করেন। ২য় খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রিস্ট ধর্মালম্বদের কোন গণ উপাসনা মন্দির স্থাপিত হয়নি, উপাসনা ছিল একান্ত বিষয়। যীশু খ্রিস্টের তিরোধানের পর তার অনুসারীরা নিজ গৃহে, দূর প্রান্তরে, নির্জন সমাধি ক্ষেত্রে ইত্যাকার স্থানে, একান্তে, ঈশ্বরের উপাসনা করতেন।[১]

লা ম্যাডেলিন, ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত একটি নিওক্লাসিক্যাল, রোমান ক্যাথলিক গির্জা।
ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোয়ানোকে সেন্ট অ্যান্ড্রু'স ক্যাথলিক চার্চের অভ্যন্তর
সেন্ট জন গির্জা, কলকাতা
সিরিয়ার আলেপ্পোতে অবস্থিত এই গির্জাটি পৃথিবীর প্রাচীনতম গির্জাগুলির একটি

কখনও কখনও, চার্চ শব্দটি অন্যান্য ধর্মের ভবনগুলির উপমার জন্য ব্যবহৃত হয়।[২] কোন খ্রিস্টধর্মীয় সম্প্রদায় বা একক ব্যক্তি কিংবা বিশ্বের খ্রিস্টান বিশ্বাসীদের সমষ্টি বুঝাতেওচার্চ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[৩] তবে পরবর্তীতে ইংরেজি চার্চ বলতে খ্রিস্টের অনুসারীদের ধমদর্শন বুঝানো হয়, যেমন অর্থোডক্স চার্চ, ক্যাথলিক চার্চ, প্রোটেস্টান্ট চার্চ ইত্যাদি। খ্রিস্টানদের বাইবেলে গির্জা শব্দটি নেই। Tertullian এর লেখায় সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় যাতে বোঝা যায় খ্রিস্টপরবর্তী ৩য় দশকে প্রথম গণউপসনালয় হিসাবে গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

খ্রিস্টান স্থাপত্যে, একটি চার্চের পরিকল্পনা দৃশ্যে বেশিরভাগই খ্রিস্টান ক্রুশ পরিদৃশ্য হয়; মাঝখানকার করিডোর ও আসন মিলে ক্রুশের উল্লম্ব বিমটির প্রতিনিধিত্ব করে, আর বিমা এবং বেদী মিলে ক্রুশের আনুভূমিক অংশটির প্রতিনিধিত্ব করে। টাওয়ার বা গম্বুজগুলো স্বর্গীয় ধ্যানের অনুপ্রাণনা দেয়। আধুনিক গির্জাগুলির বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য শৈলী এবং নকশা পাওয়া যায়। অনেকসময় অন্যান্য উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা কিছু বিল্ডিং গির্জায় রূপান্তর করতে দেখা যায়, আবার অনেক মূল গির্জার ভবন অন্য কাজেও লাগাতে দেখা যায়।

ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

সিরিকান একটি পুরানো ইংরেজি শব্দ যা চার্চ এবং চার্চের সম্পত্তির জন্য ব্যবহৃত হত

চার্চ শব্দটি প্রাচীন ইংরেজী "cirice, সিরিস" থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ খ্রিস্টান উপাসনার জন্য আলাদা করে রাখা সমাবেশের স্থান", যা আবার প্রোটো-জার্মানিক ভাষার "কিরিয়াকি" থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। সম্ভবত গথিকের মাধ্যমে এটি আমদানি করা হয়। প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা উৎসের κυρίως (কিরিওস); যার অর্থ শাসক বা প্রভু, উহা থেকে κυριακή (oikia, গৃহ) ও κυριακών δώμα (কিরিয়াকন দমা, প্রভুর ঘর) শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি হয়। ৩০০ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় উপাসনার ঘরগুলিতে, বিশেষ করে প্রাচ্যে, "কিরিয়াকন " গ্রীক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও এটি এক্কলেসিয়া বা বেসিলিকে পরিভাষার তুলনায় সেই অর্থে কম প্রচলিত ছিল।[৪]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রাচীনত্ব[সম্পাদনা]

সিরিয়ার আলেপ্পোতে চার্চ অফ সেন্ট সিমিওন স্টাইলাইটের দক্ষিণ সম্মুখভাগকে বিশ্বের প্রাচীনতম টিকে থাকা গির্জার ভবনগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয়

প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত সর্বপ্রাচীন খ্রিস্টান চার্চ হাউস চার্চ (domus ecclesiae, দমুশ এক্লেসিয়ে), ডুরা-ইউরোপোস চার্চ, যা ২৩৩ এবং ২৫৬ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।[৫]

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, উপাসনার জন্য প্রথম চার্চ হল (aula ecclesiae) নির্মাণ শুরু হয়। যদিও এর মধ্যে অনেকগুলিই পরবর্তী শতাব্দীর শুরুর দিকে ডায়োক্লেশিয়ানিক নিপীড়নের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে বৃহত্তর এবং আরও বিস্তৃত চার্চগুলি সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেটের শাসনামলে নির্মাণ হওয়া শুরু করে।[৬]

মধ্যযুগে[সম্পাদনা]

১১ থেকে ১৪ শতকের মধ্যে, পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে ক্যাথেড্রাল নির্মাণ এবং ছোট প্যারিশ চার্চ নির্মাণের একটি জোয়ার ঘটে। উপাসনার স্থানের পাশাপাশি, ক্যাথেড্রাল বা প্যারিশ চার্চগুলোতে প্রায়শই সাধারণ জমায়েত-স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত। যে সম্প্রদায়গুলিতে এগুলো ছিল, সেখানে গিল্ড মিটিং, ভোজ, রহস্য নাটক এবং মেলার মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। চার্চের মাঠ এবং দালানগুলিও শস্য মাড়াই এবং সঞ্চয়ের জন্য ব্যবহৃত হত।[৭]

রোমানেস্ক স্থাপত্য[সম্পাদনা]

১০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে রোমানেস্ক শৈলী ইউরোপ জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রোমানেস্ক শৈলী বলতে বৃহৎ এবং বিশাল ভবন বুঝানো হত, যা সাধারণত সরল, কমপ্যাক্ট, অল্প পরিমাণে সজ্জিত জ্যামিতিক কাঠামো দ্বারা গঠিত হত। রোমানেস্ক চার্চের ঘন বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে বৃত্তাকার খিলান, বৃত্তাকার বা অষ্টভুজাকার টাওয়ার এবং পিলারের উপর কুশন ক্যাপিটাল । প্রারম্ভিক রোমানেস্ক যুগে, সিলিংয়ে কফারিং ব্যবহার করা ফ্যাশনেবল ছিল, একই যুগের শেষের দিকে কুঁচকিযুক্ত ভল্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ধরনের স্থাপত্যে অভ্যন্তরটি প্রসারিত থাকে এবং ভাস্কর্যগুলির মোটিফগুলি আরও মহাকাব্যিক বৈশিষ্ট্য এবং থিম গ্রহণ করে। [৮]

গথিক স্থাপত্য[সম্পাদনা]

মিউনিখের ফ্রয়েনকির্চে মূলত একটি গথিক, মধ্যযুগীয় গির্জা।
লাস লাজাস শ্রাইন কলম্বিয়াতে অবস্থিত একটি বেসিলিকা গির্জা। গথিক পুনরুজ্জীবন শৈলীর বর্তমান মন্দিরটি 1916 এবং 1949 সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

ব্যাসিলিকা[সম্পাদনা]

ল্যাটিন শব্দ ব্যাসিলিকা বলতে রোমান শহরের ফোরামে অবস্থিত কোন রোমান পাবলিক বিল্ডিংকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হত।[৯][১০] রোমান সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান হওয়ার পর, শব্দটি একটি বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ গির্জাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে যে ভবনকে পোপ কর্তৃক বিশেষ আনুষ্ঠানিক অধিকার দেওয়া হয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এভাবে শব্দটি আজও দুটি অর্থ ধরে রেখেছে, একটি স্থাপত্য এবং অন্যটি ধর্মীয়।

ক্যাথেড্রাল[সম্পাদনা]

ক্যাথেড্রাল হল একটি চার্চ, যেখানে বিশপের আসন থাকে, সাধারণত ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান, ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্স বা ইস্টার্ন অর্থোডক্স সম্প্রদায়ে দেখা যায়। ক্যাথেড্রাল শব্দটি ক্যাথেড্রা থেকে এর নাম নেওয়া হয়েছে যার অর্থ বিশপের সিংহাসন (লাতিন: ecclesia cathedralis)। শব্দটি কখনও কখনও বড় আকারের যেকোন চার্চকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যা সঠিক নয়।

ক্যাথেড্রালের মত চার্চগুলি অগত্যা কোন বড় বিল্ডিং নয়। এগুলো ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ ক্যাথেড্রাল, ফিনল্যান্ডের পোরভোতে পোরভো ক্যাথেড্রাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেলেতে সেক্রেড হার্ট ক্যাথেড্রাল বা সুইজারল্যান্ডের চুর ক্যাথেড্রালের মতো ছোট হতে পারে। তবে, অনেকসময় কয়েকটি অ্যাবে চার্চ নিয়ে একটি ক্যাথেড্রাল যেকোন অঞ্চলের বৃহত্তম ভবন হিসেবে দেখা যেত।

তীর্থ চার্চ[সম্পাদনা]

একটি তীর্থস্থান চার্চ হল একটি গির্জা যেখানে নিয়মিত তীর্থযাত্রা করা হয়, বা তীর্থযাত্রার পথ ধরে একটি গির্জা, প্রায়শই একজন সাধুর সমাধিতে অবস্থিত, বা মূর্তি বা ধ্বংসাবশেষ ধারণ করে যার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করা হয়, মারিয়ান অ্যাপারিশনের স্থান ইত্যাদি।

সেন্ট মার্টিন ক্যাথেড্রাল, উট্রেখ্ট, নেদারল্যান্ডস
Plan of Old St Peter's Basilica, showing atrium (courtyard), narthex (vestibule), central nave with double aisles, a bema for the clergy extending into a transept, and an exedra or semi-circular apse.

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. খ্রিস্ট্রিয় গির্জার ইতিহাস
  2. Use of the term "The Manichaean Church", Encyclopædia Britannica
  3. "Church | Definition, History, & Types | Britannica" 
  4. "Church"Online Etymology Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ৮ আগস্ট ২০১৬ 
  5. Snyder, Graydon F. (২০০৩)। Ante Pacem: Archaeological Evidence of Church Life Before Constantine। Mercer University Press। পৃষ্ঠা 128। 
  6. The Contemporary Church and the Early Church: Case Studies in Ressourcement। Pickwick Publications। ফেব্রুয়ারি ২০১০। আইএসবিএন 978-1606088999  (Chapter 3)
  7. Levy। Cathedrals and the Church। পৃষ্ঠা 12। 
  8. Toman, Rolf (২০১৫-০৪-৩০)। Romanesque: Architecture, Sculpture, Painting (ইংরেজি ভাষায়)। h.f.ullmann। আইএসবিএন 9783848008407 
  9. The Oxford Dictionary of Christian Art and Architecture (2013 আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯৯৬৮০২৭-৬), p. 117
  10. "The Institute for Sacred Architecture - Articles- The Eschatological Dimension of Church Architecture" 

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

বহি:সংযোগ[সম্পাদনা]