ব্যবহারকারী:Habib7619
শিরোনাম লেখ
[সম্পাদনা]মৃৎশিল্পের সম্ভাবনা ও নারীর অবদান
বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত ও অশিক্ষিত নারীদের একটি বিরাট অংশ দেশজ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে কুটির শিল্পে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অবদান অনস্বীকার্য। কুটির শিল্পের একজন দক্ষ কর্মী বলতেই বোঝায় একজন নারীকে। শহর, বন্দর ও গ্রামে এসব নারী অত্যন্ত ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সাথে সুনিপুণ হাতে কুটির শিল্পজাত পণ্য তৈরি করে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পাশাপাশি মৃৎশিল্প আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। প্রাচীন কাল থেকে এ দেশের নারীরা এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। আধুনিককালে এই ক্ষেত্রে নারীর অবদান কোনভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশে মৃৎশিল্প অতি প্রাচীন। মৃৎশিল্পের উৎস অনুসন্ধানে সবার আগে আসে রাজশাহীর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতির কথা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ১৩ শতকের বহু স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন এসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে মাটি বা টেরাকোটার যে শিল্পকর্ম আছে, তা মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যের চমৎকার উদাহরণ। মৃৎ অর্থ মাটি। এর সাথে শিল্প শব্দটির সংযোগে মৃৎশিল্প শব্দটির উৎপত্তি। যারা এই শিল্পকর্মে জড়িত তাদেরকে কুমার বা কুম্ভকার বলা হয়। বর্তমানে তাদেরকে মৃৎশিল্পী হিসাবেও অভিহিত করা হয়। পরিবার কেন্দ্রীক এই শিল্পে একজন পুরুষ শিল্পীর সাথে অবশ্যই একজন নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত। এর ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায় না বললেই চলে। মৃৎশিল্পকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন (১) আর্থেন ওয়ার, (২) স্টোন ওয়্যার ও (৩) পোরসালিন। দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্র স্টোন ওয়্যারের অন্তর্ভুক্ত। কুমার বা কুম্ভকাররা এই শিল্পের ধারক ও বাহক। মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি। কুমাররা সাধারণ মাটি দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করেন। এরপর এগুলোকে চুল্লিতে আগুনে পোড়ানো হয়। মাটিকে মসৃন করে ছেনে স্টোন ওয়্যারের শ্রেণীভুক্ত তৈজসপত্রগুলোকে সাড়ে এগারশ’ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ১৫শ’ ডিগ্রী তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এসবের নানন্দনিক উপকরণগুলোকে রং-তুলির সাহায্যে দৃষ্টি নন্দন করে তোলা হয়। মাটি দিয়ে যেসব জিনিস তৈরি করা হয় তার মধ্যে হাঁড়ি, পাতিল, ঢাকনা, কলসী, জলকান্দা, পিঠা তৈরির সাজ ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে টেবিল ল্যাম্প, ফটোফ্রেম, ভাস্কর্য, ফুলদানি, মোমদানি, এসট্রে, কলমদানি, ঘণ্টা, কলম, কাপ, ওয়াল শোপিস ও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ইত্যাদি। মাটি দিয়ে তৈরি এসব পণ্যকে প্রথমে রোদে শুকিয়ে পরে আগুনে পুড়িয়ে টেকসই করে রং দিয়ে দৃষ্টি নন্দন করা হয়। দেশের হাট-বাজারে এবং গ্রামীণ মেলায় এসব পণ্য প্রদর্শিত হয়। রাজধানী ঢাকার শিশু একাডেমীর সামনে মাটির তৈরি নান্দনিক শিল্পকর্মের বছরব্যাপী বিক্রি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় মাটির তৈরি এসব পণ্যের বেশিরভাগ আসে পার্শ¦বর্তী রায়েরবাজার, কালিয়াকৈর, ফুলপার ও মানিকগঞ্জ এবং পটুয়াখালী, রাজশাহী, শরীয়তপুর ও কুমিল্লা থেকে। এসব পণ্য তৈরিতে নিরলস শ্রম দিয়ে আসছেন এ দেশের গ্রামীণ নারীরা। পণ্য তৈরি, পোড়ানো, রংকরা থেকে শুরু করে বাজারজাত করার ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে চলেছে। এসব শ্রমজীবী নারীর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগই অশিক্ষিত, বাকি ১০ ভাগ সামান্য লেখাপড়া জানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু জীবিকার জন্য নারীরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অন্যান্য শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মতো মৃৎশিল্পের নারীরাও মজুরি বৈষম্যের শিকার। পুরুষের সমান কাজ করেও তারা একজন পুরুষ শ্রমিকের মজুরির দুই-তৃতীয় লাভ করে। নারী উন্নয়নে এসব মৃৎশিল্পীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দৃষ্টি দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মৃৎশিল্প একটি উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় খাত। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা নারীদের এতটুকু অবসর নেই। নেই কোনো বিনোদন, নেই ভালো খাবার-দাবার। সংসারের কঠিন ঘানি টানা এসব শ্রমজীবী নারীর সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়তে পারে না। ছোট্ট দুধের শিশুকে নিয়েও নারীকে কাজে বের হতে হয়। এ চিত্র আরো করুণ। এসব খেটে খাওয়া নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। অথচ বর্তমানে এই শিল্প দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর সহজলভ্য হওয়ায় মৃৎশিল্প অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। একদিকে দামে সাশ্রয়ী ও টেকসই হওয়ায় এবং প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করার সুযোগ থাকার কারণে প্রস্তুতকারকরা ক্রেতাদের বাড়তি সুবিধা প্রদানের জন্য ক্রেতারা প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসবের পরও বাংলাদেশে এই শিল্পটির কদর কম নয়। এখনও এমন কোন বাড়ি বা ঘর পাওয়া যাবে না, যেখানে মৃৎ পণ্য নেই। ঘর-গেরস্থালী থেকে শুরু করে নান্দনিক শিল্পকর্ম হিসাবে এই পণ্যগুলো এখন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের রান্নাঘর ছাড়াও ড্রইং রুমে শোভা পাচ্ছে। কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি এসব পণ্য দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে চাহিদা রয়েছে। মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি নদীমাতৃক বাংলাদেশে সহজলভ্য। অথচ এই কাঁদামাটি ভারতের পশ্চিম বাংলায় দুর্লভ। এ কারণে এই শিল্পটির সম্ভাবনা বাংলাদেশে উজ্জ্বল। সরকারি, বেসরকারী সহায়তায় এই শিল্পটির প্রসার একদিকে যেমন কুমার সম্প্রদায়কে তাদের বাপ-দাদার পুরনো ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখে স্বাবলম্বী করতে পারবে, তেমনি এগুলো বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আমাদের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে পারে। মৃৎ সামগ্রীর বাণিজ্যিক প্রসারের জন্যে মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা এবং তাদের তৈরি পণ্যের প্রদর্শনী ও বাজারজাত সুনিশ্চিত করতে হবে। ঐতিহ্যপূর্ণ এসব শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে মৃৎশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটবে। অনেক শিল্পমনষ্ক মানুষ মনে করেন, আধুনিক মৃৎশিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেলে এরা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে। তবে সেক্ষেত্রে সুদবিহীন ঋণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। মৃৎশিল্পীদের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ ও অনুদান এবং বিনাসুদে অথবা সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে সহজেই এ শিল্পের গৌরব টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। </nowiki>