বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:Sumasa

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস : স্মৃতির মণিকোঠায়

সুকান্ত দাস

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকের কথা। তখন আমরা হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। জাতীয় সেবা প্রকল্পের নরসিংহ দত্ত কলেজ ইউনিটের সম্পাদক অধ্যাপক নীলিম মিত্র জানালেন, ''তোমরা কয়েক জনের একটা গোষ্ঠি তৈরি করে স্বনামধন্য ডা. বিরল মল্লিকের কাছে প্রাথমিক প্রতিবিধানের পাঠ নেবে তিনদিনের নিবিড় শিক্ষাক্রমে।'' যথারীতি প্রাথমিক প্রতিবিধানের পাঠ সমাপ্ত হল। প্রথম দফায় আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হল হাওড়া শহরাঞ্চলে কয়েকদিনের বিসিজি টিকা দেওয়ায় পুরকর্মীদের সাহায্য করা।

এবার জাতীয় সেবা প্রকল্পের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষ্ণপদ ঘোষ ও আমাকে পাঠানো হল তখনকার পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে। প্রকল্পটি ছিল একটি সেবা প্রতিষ্ঠান খ্রিস্টান এজেন্সি ফর সোশ্যাল অ্যাকশনের তখনকার বিশ্ব প্রধান মিস্টার জন পি হেস্টিংস এবং তাঁর স্ত্রী মেরির সঙ্গে বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) থেকে আসতে থাকা হাজার হাজার শরণার্থীর একটা সমীক্ষা তৈরি করা। ব্যাপারটা আমাদের কাছে সুদূর অজানায় পাড়ি বলেই মনে হয়েছিল। যাইহোক, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের এক ভোরে আমরা কলকাতার সিমলা অঞ্চলের এক বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করলাম। আসলে সিমলায় বিবেকানন্দের বাড়িটাও সেই প্রথম দেখলাম গাড়ির চালক ব্যানার্জিবাবুর কল্যাণে !

সারাদিন অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ঠেঙিয়ে সন্ধের পর আমরা পাঁচজন উঠলাম ইসলামপুরের সার্কিট হাউসে। মাঝে দু-তিন জায়গায় থামতে হয়েছিল গাড়ির ও আমাদের খাবার সংগ্রহের জন্যে। আর আমাদের অবাক করে দিয়ে মিস্টার হেস্টিংস নিজেও কিছুক্ষণ গাড়ি চালালেন ! রাতে একটা ঘরে সাহেব ও মেমসাহেব এবং পাশের ঘরে আমরা তিনজন। পরদিন সকালেই হিলি সীমানায় খানিক সমীক্ষা করতে যাওয়া হল। কিন্তু অবস্থা খুবই করুণ ছিল, কেননা তখনই শরণার্থীদের ভিড় বেড়েছে ওখানে ! যাঁদের তখনই সহায়তা দরকার।সব বুঝে সংস্থার প্রধান তাড়াতাড়িই কলকাতায় ফিরে এলেন পরবর্তী পদক্ষেপ করার জন্যে।

১৯৭১ খ্রিস্টা্ব্দের এপ্রিল মাসে তপন মণ্ডল, জিতেন সাহাসহ আমরা চারজন জাতীয় সেবা প্রকল্পের অধীনে খ্রিস্টান এজেন্সি ফর সোশ্যাল অ্যাকশন সংস্থায় শরণার্থীদের সেবা করার কাজে বনগাঁ সীমান্তে যাই। বনগাঁয় আমরা যশোহর রোডের ধারে 'সলভেশন আর্মি'র বাগানবাড়িতে ঘাঁটি করি। প্রথমে আমাদের কাজ ছিল তখন যেসব শরণার্থী শিবির চালু হয়েছে সেখানে ডাক্তারদের সাহায্য করা এবং শিশু ও রোগীদের নন-ফ্যাট ড্রাই মিল্ক সরবরাহ করা। পরে আরো অনেক জিনিস, যেমন, জামাকাপড়, চাদর, মাদুর, তাঁবু ইত্যাদি বিলি করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে ডাক্তারদের বিভিন্ন দল আমাদের সঙ্গে শরণার্থীদের সেবায় যুক্ত ছিলেন। কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, অসম, ওডিশা এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডাক্তাররা আসেন। তাঁদের মধ্যে কেরালা থেকে এসেছিলেন ডা. জেকভ, কলকাতা থেকে ডা. গোপাল মুখার্জি, ডা. মাইতি এবং কালীঘাটের ডা. মুখার্জি।

পরবর্তীকালে সারা বনগাঁ মহকুমায় ১৫টা শরণার্থী শিবির সংগঠিত হয় সরকারিভাবে। সেখানে কার্ড বানিয়ে রেশনিং অথবা রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হত সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে। ১৫টা শরণার্থী শিবিরের মধ্যে গাঁড়াপোতা, বাগদা, হেলেঞ্চা, মামাভাগনা, বয়রা, আংরাইল ইত্যাদি ছিল। আমাদের কর্মীসংখ্যাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কলকাতা থেকে প্রদীপ ড্যানিয়েল, ঢাকার জ্যোতি হাজরা, খুলনার অজিত বৈরাগী, পান্নলাল ও হীরালাল সাহা সিলেটের সলোমন মণ্ডল, পাবনার অবকাশ বারুই ও প্রদীপ বৈদ্য, উত্তর ২৪ পরগনার গৌরাঙ্গ সরকার ও রাজু ঘোষ এবং আরো অনেকে। অতিথি সমাজসেবী কামনাশশী দে আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আর বনগাঁয় আমাদের প্রধান ছিলেন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, শ্যামনগরের বিবেকানন্দ যশ।

বনগাঁর সলভেশন আর্মির চত্বরে প্রথমে ৫০ এবং পরে ৭৫ শয্যার বুলেট ইনজুরির চিকিৎসার জরুরি হাসপাতাল আমাদের তত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল।কারণ তখন যুদ্ধ ভয়ংকর আকার নিয়েছে। প্রথম দিকে এলএমজি আর মর্টারের আওয়াজে রাতে ঘুম হতনা ! পরে আস্তে আস্তে বেনাপোল, ঝিকরগাছা, যশোহর দখল হওয়ার পর আমরা একটু স্বস্তি পাই !

একটা বড়ো কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত ছিলাম; তাহল, জেট ইনাকুলেটর বা মেশিনে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়া। কারণ বনগাঁ সীমান্তে সেসময় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসছেন আর ওই অঞ্চলে কলেরা মহামারিরূপে দেখা দিয়েছে। আমরা এবং রেডক্রস এই দুই সংস্থার দশটা জেট ইনাকুলেটর মেশিন পুরো বনগাঁ সীমান্তে কাজ করতে থাকে। আমাদের থেকে ওই ভ্যাকসিন নিয়ে স্লিপ দিলে তবে শিবিরে কার্ড করা যাবে, এরকম সরকারি নির্দেশ জারি হয় ; কেননা, তখন জুন-জুলাই মাসের প্রবল বৃষ্টির ফলে বন্যায় বাগদা, মামাভাগনা সমেত কিছু শরণার্থী শিবির জলে ডুবে যাওয়ায় শিবির অন্যত্র সরাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।কলেরা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় কয়েকজনের প্রাণহানিও ঘটে, আর তাতেই সকলকে সজাগ হয়ে যেতে হয়। আমাদের জেট ইনাকুলেটরে ভ্যাকসিন দেওয়ার ছবি সেই সময় 'অমৃতবাজার পত্রিকা' ও 'যুগান্তর' সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। এমনকি বেনাপোল ক্যাম্প যখন ভারতীয় সেনা তথা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে ; ওখানে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডা. মুখার্জির আমন্ত্রণে এক বর্ষাদিনের বিকেলে প্রায় দু-হাজার সেনা জওয়ানকে আমরা কলেরা ভ্যাকসিন দিয়ে আসি। যুদ্ধে আহত সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি সেনানীদেরও সেবা করতে পেরে আমরা গর্ববোধ করেছিলাম। ক্যাপ্টেন ডা. মুখার্জি ও তাঁর সেনাকর্মীদের আতিথেয়তা ছিল মনে রাখার মতো।

সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদেরও কঠিন নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে কাজ করতে হত। তবে একদিন বয়রা শরণার্থী শিবিরে কাজ সেরে ইছামতী নদী নৌকোয় পার হয়ে সোজা সাগরদাঁড়ি গাঁয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি ছুঁয়ে নিজেদের ধন্য মনে করলাম !

আমাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর দুই গাড়ি চালক নূর মিয়া ও আনসার আলির সঙ্গে ওদের বাড়ি ঝিকরগাছায় গিয়েছিলাম। তখন ইছামতী নদীর ওপর ঝিকরগাছার হার্ডিঞ্জ সেতুতে লেখা দেখলাম : 'হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রিকন্সট্রাক্টেড বাই বম্বে রেজিমেন্ট, ইন্ডিয়ান আর্মি '।

তার পরের ইতিহাস তো সকলের জানা ! পর পর যশোহর, ঢাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে। চূড়ান্ত সাফল্যের পর পাকিস্তানের সেনানায়ক জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ, তাঁকে আমাদের চত্বরের পাশেই যশোহর রোড দিয়ে কলকাতায় আনা, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান এবং তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির কলকাতা ব্রিগেড ময়দানে যৌথ সভা ! তখনো আমরা বনগাঁয়। আস্তে আস্তে শরণার্থী শিবির গোটানো হচ্ছে। সীমানা খোলা ! মুক্ত নতুন বাংলাদেশ ! 'জয় বাংলা' স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত !!

আমরা বনগাঁ ত্যাগ করলাম ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। গর্বের সঙ্গে নতুন বাংলাদেশের মুক্তিপ্রাপ্ত নাগরিকদের পেট্রাপোল সীমান্তে চোখের জলে বিদায় দিলাম ! তবে সেটা ছিল আমাদের সকলেরই আনন্দাশ্রু !!