বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:Deshivirus2050/EditCounterOptIn.js

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

লক্ষ্য করুন: প্রকাশ করার পর, পরিবর্তনগুলো দেখতে আপনাকে আপনার ব্রাউজারের ক্যাশে পরিষ্কার করার প্রয়োজন হতে পারে।

  • ফায়ারফক্স / সাফারি: পুনরায় লোড-এ ক্লিক করার সময় শিফট টিপে ধরে রাখুন, অথবা হয় Ctrl-F5 বা Ctrl-R টিপুন (ম্যাকে ⌘-R টিপুন)
  • গুগল ক্রোম: Ctrl-Shift-R (ম্যাকে ⌘-Shift-R) টিপুন
  • এজ: Ctrl ধরে রাখা অবস্থায় Refresh-এ ক্লিক করুন, অথবা Ctrl-F5 টিপুন।
  • অপেরা: Ctrl-F5 টিপুন।
                        তার চলে যাওয়া
                                                     শিলন রেজা
গত কয়েকটি মাস থেকে আজব কিছু ঘটনা ঘটে আসছে তুষারের জীবনে। তুষার বুঝে উঠতে পারছেনা আসলে ভুলটা কার? কখনই এমন ঘটেনি। হটাৎই কয়েকটি দাবীর মুখে তুষার তার বাবা-মাসহ বড় অভিভাবকদের সাথে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে আসা। ঢাকার সোবহানবাগে একটি ফ্যামিলির সাথে সাবলেট থাকতেছে। কাজ করে একটি ফাস্টফুডের দোকানে। ধানমন্ডিতেই দোকানটি।মনে একেবারেই স্বস্থি পাচ্ছেনা।বারবার ফেলে আসা দুঃখিনী মায়ের কথা ও প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসছে।ছোট ভাইয়ের চপলতাও তুষার কে নাড়া দিচ্ছে, কিন্তু উপায় নায়। সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে তার বাসায় ফিরবেনা।
এদিকে শীতের দিনেও বৃষ্টির লেগেই আছে।অস্থিরতা ক্রমে বাড়ছে।বারবার রিমার ফোন।এই মেয়েটা একটা পাগল। বিয়ের একবছর পার হয়ে গেল তার তুষার কে চাই ই চাই।তুষার ভাবে কোনপথে যাওয়া উচিৎ তার।রিমার সাথে তার সম্পক পারিবারিক। রিমা তার মেজো খালামনির বড় মেয়ে। তুষারের মায়েরা চার বোন। তুষারের মা হলো সবার বড়।রিমা তার বাবা-মায়ের খুব আদরের মেয়ে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরি। যাইহক তুষার সুন্দরের ধার ধারেনা। তুষারও তাকে একটু একটু ভালবাসে। তা-নাহলে এই বৃষ্টির কথা ভাবারতো কোন কারণ নেই।তুষার হেটে চলেছে আনমনে, মাথার উপর ছাতা আছে কিন্তু সে ছাতা জমিনের সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণে ধরে রেখেছে।এলোমেলো বাতাসে শরীর পুরো ভিজে যায় সেদিকে খেয়াল থাকেনা।এরই মধ্যে রিমা প্রায় ২৫বার রিং দিয়েছে তুষার উপেক্ষা করেছে।আজকাল রিমার কথার প্রসঙ্গ বদলে গেছে।তুষারের ভাবনার অনেক বাইরে চলে গেছে।রিমা তার যৌবনের লোভনীয় ইমোশনাল দিক তুলে ধরে।আর গেল তিনদি্ন সে বলে তুষার আমি তোমার কাছে চলে আসবো তুমি তৈরি থাকো। তুষার টগবগে পুর্ণ এক যুবক।তার কথাতে সে দারুণভাবে শিহরিত হয়।কাজে ততো মন বসাতে পারেনা।এভাবে দুসপ্তাহ পার হয়ে যায়।পরেরদিন রিমার বান্ধবি সোহানি ফোন করে, কীরে তুষার কেমন আছিস? জানিস রিমা তোকে অনেক ভালবাসে। তোর জন্যই সে বেচে আছে বলা যায়।নাহলে তো কবেই আত্নহত্যা করে মারা যেত। কথাগুলো সে এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো।
পরে তুষার কে আবার কথা বলার সুযোগ নাদিয়েই আবার বলে, হ্যারে তুষার ও যদি তোর কাছে চলে আসতে চাই তুই ওকে গ্রহণ করবি না? প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে আবার শুরু করে।তোরা দুজন অনেক সুখি হবিরে।এটা আমার বিশ্বাস।শোন ওর কাছে হাজার তিনেক টাকা আছে।তাই দিয়ে কিছুদিন চল্বি।পরে নাহয় ওর কানের রিংটা বিক্রি করে দিবি।এভাবে কিছুদিন থাকলে সবাই মেনে নিবে।হঠাৎ করে তার ফোনটা কেটে গেল।তুষার বেলকনির ধারে দাঁড়িয়ে ভাবে তার ভবিষ্যৎ অবস্থা। এভাবেই আরো দুদিন পার হয়ে গেল।সকালটা বিদঘুটে অন্ধকার, কখন যে দুপুর বারটা বেজে গেছে টের পাইনি।ঘুম থেকে হালকা করে উঠে নাস্তা করে নামাজ পরে আবার ঘুম।মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ছুটে গেল, ওপাশ থেকে রিমার কান্নাজড়িত কণ্ঠ।এই শুনেন শ্যামলি বোনতো আপনাকে সব বলেছে তাইনা।আমি আগামি কাল সকালে যেভাবে হোক মেহেরপুর পৌছাবো। আপনি আমাকে নিতে আসবেন।কী আসবেন তো?আপনি যদি আমাকে নিতে না আসেন তাহলে কিন্তু আমি আত্নহত্যা করবো।কারণ ওর সাথে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিনা।
তুষারের হাতপা শীতল হয়ে আসে।অজানা এক ভাললাগা ভর করে তাকে।ঠিক আছে আমি যাব মেহেরপুর পর্যন্ত।যদি তুমি না আসো তখন কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ঘৃণা করব।
রিমা বলল, আমি সকাল আটটার দিকে পৌছে যাব, আপনি চিন্তা করেননা।আমি আসবই, তবে আপনার ওয়াদার দিকে খেয়াল রাইখখেন।
তুষার টিকটিক করা দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো, রাত ৭টা ৩৭ মিনিট।জেআর পরিবহন ট্রাভেলার্স ইয়ারুল ভাইকে ফোন দিল।তিনি জানালো টিকিট বুক্ড, কোনোখালি নাই তবে আপনি যেহেতু আমাদের পরিবহনের নিয়োমিত প্যাসেঞ্জার একটা ব্যবস্থা করতে পারি এবং সেটা হচ্ছে ড্রাইভারের পাশের সিটটা আপনাকে দিতে পারি। খরচও ১০০টাকা কম নিবো।তুষারও সাতপাচ নাভেবে রাজি হলো, কয়টার বাস।
রাত সাড়ে দশটার, ইয়ারুল জবাব দিলো, তুমি চলে আসিও সময় মত। ঘাড় ব্যাগটা নিয়ে রওনা দিল গাবতলী বাস কাউন্টারের দিকে। টিকিটের টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে হলরুমে বসে পাবলিক টেলিভিশন দেখতে শুরু করল।খেলার চ্যানেল টেনক্রিকেটে পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া ২য় ওয়ানডে ম্যাচ চলছে। তুষারের চোখ টিভি স্ক্রিনে থাকলেও অন্তরের চোখ দিয়ে সে রিমার উজ্জ্বল যৌবনের স্নৃতিমাখা অতীত কে আওড়াচ্ছে। পাশের অসহায় ভিক্ষুকটি বারপাঁচেক বলেছে ভাইজান কালথাইকা কিছুই খাইনি যদি কটা টাকা দ্যান তই কিছু খেতাম। ভিক্ষুকের দিকে নাতাকিয়েই পাঁচটাকার একটা কয়েন তার দিকে বাড়িয়ে দেই। ভিক্ষুক টাকাটা নিয়ে নীরব প্রস্থান করে। মিনিট পাঁচেক পরেই ভাবে ভিক্ষুক ছেলেটা বলল সে গতদুদিন থেকে খাইনাই। পাঁচটাকাই তেমন কি হবে।
মাথাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুচোখে গুগলসাচ্ লাগায়। নাহ, কোথাও নাই।ভাবল পাঁচমিনিটের মধ্যে সে কতদুরেই বা যাবে। খুজতে খুজতে গাবতলী আন্ডার-পাসিং এ আসতেই দেখে যে ছেলেটা ওখানের ফুটপথের দোকান থেকে গরুরভুড়ির ভুট চাচ্ছে পাঁচটাকার। কিন্তু দোকানি তাকে দেখে ভ্রুকুচকে বলল, পাঁচটাকার দেয়া যাবেনা। ছেলেটি এবার আকুতি নিয়ে বলল, ভাই কাল থাইক্কা কিছুই খাইনাই ভাই দেনা যত কমই হউক, আমি যে ক্ষিধের জ্বালাই মরে যাচ্ছি।একটু পানি খাইয়া আজকের মত ঘুম দেবগা। দুজনের কথা কাটাকাটি হতে থাকাই এবার আমি সামনে এগিয়ে যাই। দোকানদার কে বললাম কয়টাকার দেয়া যাই। দোকানি আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য ঘাবড়ে গেল, বিশ, তিরিশ ও পঞ্চাশ টাকার। আমি বললাম পঞ্চাশ টাকার একপ্লেট দাও। কোন এক আনুবিক কারণে দোকানি প্লেটে একটু বেশিই দিয়ে দিল। প্লেটটি হাতে নিয়ে আমি ছেলেটিকে ডেকে বললাম নাও এগুলো সব তোমার। ছেলেটির খুশি বোঝা গেল তার ব্রাশ নাকরা অমসৃণ দাতগুলোর মাধ্যমে।মিনিট তিনের মধ্যেই গরম টিকাগুলা শেষ করে ফেললো। আমি তাকে বললাম কিরে আর কিছু খাবি। সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।আমি তাকে নিয়ে জে-আর কাউন্টারের ঠিক পিছনের খাবারের হোটেলে ঢুকলাম। তাকে ভালোভাবে ফ্রেশ হতে বললাম। ফ্রেশ হয়ে আসার পর আমি তাকে মুখোমুখি বসালাম। তুমি যে দুদিন ধরে ভালোমত কিছুই খাওনি তা বোঝা যাচ্ছে।
বলো কী খাবে?
সে একনিঃশ্বাষে অনেকগুলা খাবারের নাম বলল।
সবগুলোই আনতে বললাম ওয়েটারকে।
সবখাবার গুলো সে খাওয়ার পরই কথা বলল, ভাইজান আল্লাহ্ আপনের অনেক ভালা করব, নিশ্চিত ভালা করবো। এবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ভাইজান আমিতো সবই খাইলাম, আপনি কিছু খাইবেন না?
আমি বললাম, হ্যা খাবো বলে দুটি কোলড্রিংস আনতে বললাম। কোলড্রিংসের মুখ খোলার আগেই কাউন্টার থেকে ইয়ারুল ভাইয়ের ফোন আসলো, কীরে সাড়ে দশটা বাজে তুই এখনো গাড়িতে উঠিসনি কেন? তুই এখন কোথায়? আমি বললাম আপনাদের কাউন্টারের পিছনের হোটেল টাতে আছি।
তাড়াতাড়ি মেইনরোডে আয় বলে ফোন রাখল ইয়ারুল ভাই।
ফোন রাখার পর ভিক্ষুক ছেলেটাকে বললাম, শোনো আমার একেবারেই সময় নেয়। আমি আসি বলে মেইনরোডে এসে দাড়ালাম।
মিনিট তিনের মধ্যেই বাস চলে আসলো, সাথে ইয়ারুল ভাই আমাকে ড্রাইভারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
বাস ছেড়ে দিলো। গাবতলী থেকে ছেড়ে এসে প্রথম একটু থামল হেমায়েতপুর-সাভার-নবীনগর পেরিয়ে এসে মানিকগঞ্জ। যাত্রী চেক-আপ হলো। ডি-লাইনের ৪নং সিটের যাত্রী অনুপস্থিত থাকায় সুপারভাইজার আমাকে ওখানে বসতে বললো। আমি মনেমনে খুশিই হলাম। বাসের মধ্যে প্রচুর চিন্তারঘোর মাথায় আসলো। যেকাজে যাচ্ছি সেটা ঠিক কিনা বেঠিক ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এও ভাবলাম সকালে যদি তাকে বাস-স্ট্যান্ডে নাপায় রিমা ভাববে যে তুষার একটা কাপুরুষ। আবার তার যে রাগ হয়তো সেখানেই সে একটা সিনক্রিয়েট করে ফেলবে।এসব ভেবে যাচ্ছি একমনে। পাশের সিটের লোকটি একটু বসষ্ক, বাবার বয়সী নাহলেও চাচার বয়সী বলা যায়।আমাকে অনেকবার অ্যাটেনশান করার চেষ্টা করে ব্যথ হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। আমার চোখে ঘুম একেবারে নাই। হঠাৎ বাসের অডিও প্লেয়ারটা ছাড়া হলো। হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের গান মনে হচ্ছে।এসব গান আমার একেবারে ভালো লাগেনা, কিন্তু আজব! আজকে কেন জানি আমার গান গুলোকে ভিশন ভালো লাগছে। আর গানগুলো আমায় টানছে ভিশন করে।বুঝে উঠে পারছিনা। চোখ বুঝে সুরেসুরে গানটা গলাতে চলে আসছে।সামান্য অবচেতন হয়েছিল লোকটি, সচেতন হওয়ার পর চেষ্টা অব্যাহত থাকলো। আবারো পাচ কি ছয়বার আমাকে বিভিন্নভাবে ডাকলো, এইযে শুনছেন তবুও কেন জানি রেস্পন্স করতে চাচ্ছিলাম না।মনেমনে ভাবলাম আর একবার ডাকলে তবেই উত্তর নিব। কিন্তু অদ্ভুত ভাবার কথা স্বরণ হতেই লোকটি তার বন্ধ করে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো মনে হয়।
এবার আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, আঙ্কেল আমাকে কি ডাকছিলেন।লোকটি অত্যন্ত সচেতন তার প্রমাণ ঝটপট উত্তর, হ্যা হ্যা তোমাকে অনেকবার ডেকেছি। কিন্তু বারেবারেই আমি তোমার দৃষ্টিফেরাতে ব্যর্থ হয়েছি।
তোমাকে অনেক ভারসম্যহীন লাগছে, মনে হচ্ছে তুমি কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। না, মানে মনে কিছু নাকরলে বলি তুমি কি কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছ। তাকে নিয়েই চিন্তিত কী?
লোকটির কথা পুরোপুরি সত্যও না আবার একটুও মিথ্যার মিশ্রনও নেই। আমি মনের অজান্তেই বলে ফেললাম হ্যা আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন  কী করে?
শোনো তোমার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সব। আসলে কী তাই আমি মনে মনে ভাবলাম। লোকটিকেও মনে হচ্ছে কিছুটা উত্তেজিত, কোনো বিষয় নিয়ে।সাহস করে বলেই ফেললাম, আপনাকেও কিন্তু উত্তেজিত মনে হচ্ছে।লোকটি রহস্যময় একটা হাসি দিলো।
এবার আমি উনার সম্বন্ধে জানলাম, উনার নাম লিয়াকত আলি, ঢাকার গুলশানে থাকে, ওখানে উনার একটি বিশাল কাচামালের আড়ত আছে। খুব মিশুক এবং সদা হাস্যজ্জ্বল যার প্রমাণ তার কথাবাতায়। চুয়াডাঙ্গার বড়দরবেশপুরে তার বাবার বাড়ি ছিল।বাড়ি থেকে অনেক বছর আগে উনি চলে আসেন। আর কখনো তিনি বাড়ি ফিরে আসেননি। আজকে আসার কারণ একটি মেয়ে। মেয়েটি মেহেরপুর শহরের মহিলা ডিগ্রী কলেজে পড়ে। তার সাথে উনি দীর্ঘদিন ফোনে কথা বলতেন। মেয়েটা বিবাহিত। স্বামী মেহেরপুর যুবলীগের সহসভাপতি।নাম সাহাবুল আলম। স্বামী সাহাবুল নিশা করে প্রতিরাতেই। বাড়ি ফিরেই জোর করে  তার জৈবিক চাহিদা পুরণ করে।দিনের বেলা সারাদিন ঘুমায়। কোনো কাজ তেমন করে না।তবে অর্থনৈতিক অবস্থ্যা ভালো। তাদের একটা মেয়েও আছে।মেয়েটার নাম লিজা।প্রথমে রংনাম্বারে কথা হয়। তাদের মাঝে অনেকবার দেখা হয়।এত বয়সের তারতম্য সত্যেও রেহেনা লিয়াকত নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখায় লিয়াকত সাহেব কেও। লিয়াকতও অল্প অল্প করে রেহেনাকে ভালবাসতে থাকে যদিও এর আগে তার দুবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু যৌন বিষয়ক সমস্যার জন্য ছাড়াছাড়ি হয়েছে দুবারই। আসলে সমস্যাটি লিয়াকত সাহেব নিজেরই।এই পর্যন্ত বলে উনি থামেন।
আমি ভীষণ ভাবে অবাক হই, যুগল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে।ঘটনাক্রমে উনি আবার আমার পাশের  সিটের যাত্রি।শীতের রাতেও আমার কপালে ঘাম চলে আসে।আমি মনেমনে ভাবি আমিতো আমার পুরনো প্রিয়াকে ফিরে পাবো আজকে কিন্তু আঙ্কেল? এই পর্যন্ত ভাবার পর জিজ্ঞাসা করে ফেলি আবার, আপনি কি দরবেশপুরে নামবেন?
পাগল তুমি? উনার আশ্চর্যজনক উত্তর।আমি ওখানে যায়নি প্রায় ১৮ বছর। আমার দিতীয় বউটা বাদ যাবার পর আমি অসহায় হয়ে যায়, সবাই আমাকে যেন কেমন করে দেখতো, আর বিভিন্ন রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম যেটা একজন পুরুষ হয়ে মানা দায়।এজন্যই আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। আর যোগাযোগ করিনি।আমি রেহেনা সাথে তিনবছরের সম্পর্কে প্রায় পাচবার দেখা করেছি কোনবার দরবেশপুর নামিনি।
আমি নাকলজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, আপনার এমন শারীরিক সমস্যার কথা কি আপনার প্রিয় মানুষটি জানে? আংকেল।
উনি এবার বড়বড় চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।তবে লোকটা রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার যথেষ্ট সক্ষমতা রাখে।শোন বারবার আংকেল আংকেল বলবানা। পারলে লিয়াকত ভাই বলে ডেকো খুশি হবো।
আমি এবার কিছুটা অবাক হলাম। যেকিনা আমার চাচার বয়সী তাকে কিনা ভাই বলবো।অসম্ভব! মনেমনে ভাবলাম। তবে আরেকটা প্রশ্ন করার দরজা খুলে গেল। পরের প্রশ্নটা ছিল এরকম, আপনার বর্তমান বয়স কত?
লোকটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো, পরে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল, ষোল বছর।
আমার মুখ দিয়ে অনিচ্ছা সত্তেও বের হলো যে ষো----ল--! 
ল উচ্চারিত হওয়ার আগেই উনার উত্তর ষোলের চারগুন।মানে আমি চারটি কৈশোর পেরিয়ে এসেছি।
লিয়াকত সাহেব লোকটা যথেষ্ট মেধাবি ও হাস্যরসিক তাকে ভাই বলতে সমস্যা হবে না।কারণ যতটা বয়স ভেবেছিলাম ততটা নয়।৪৮ বছর তেমন কোনো বয়সই না।এই সময়ে বরং আরো রোমান্টিকতা বাড়ে যেমন বলিঊড বাদশা শাহরুখ খানের বর্তমান বয়স ৫৪ বছ্রর।তবুও উনার রোমান্টিকতার ঘাটতি নাই।সে ইচ্ছে করলে হাজার হাজার মেয়েকে একদিনে বিয়ের পিড়ীতে বসাতে পারবেন।যাইহক আমার মাঝে আরো জিজ্ঞাসু চিত্ত টিকটিক করতেছে।
আপনি কি আজকেও তার সাথে দেখা করার জন্যই যাচ্ছেন?
আসলে আজকে আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি।সত্য কথা বলতে কি আজকে আমি তার আহবানে সাড়া দিয়েছি ও আমার সাথে চলে আসার জন্য প্রস্তুত।আমি অনেক ভাবার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কথাগুলো উনি এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন।
আম্র বিস্ময়ের মাত্রা এবার আর বাড়লো না তবে জিজ্ঞাসু প্রশ্নগুলো পেটের মধ্যে কিলবিল করতে শুরু করলো।
উনি যে আসবেন এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে? তাছাড়া মেয়েরা মুখে এক কথা বলে পেটে থাকে আরেক কথা এবং করে দেখায় তৃ্তীয় আরেকটা। এই পর্যন্ত বলে থামলাম।
লিয়াকত ভাইয়ের মুখে হাসির আভা সুর্যোদয়ের মত ফুটতে লাগলো।উত্তরটা দিল এভাবে আমার বিশ্বস রেহেনা আমাকে ঠকাবেনা। আর মোট কথা হলো সে আমার এতো অক্ষমতার কাছে পরাজিত তাকে তো যেকোন মুল্যে বিশ্বাস করা যায়।
উনি এবার আমার মুখোমুখি বসে আমকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি এতো চিন্তিত কেন জানতে পারি? তোমার কেইসটা কি?
আমিতো অন্য কারণে যাচ্ছি, আমার উত্তর।
না, তোমার মুখ ও চোখ দেখে মনে হচ্ছে অন্য কিছু। উনি বললেন।
মনেমনে আবারো বললাম লোকটার ফেইস রিডিং পাওয়ার ব্যাপক। তার বিশালত্বর কাছে আমি হার মানতে ছাচ্ছিলামনা।তাই নিরব ছিলাম।
আবারো বলল, আমাকে বলেই দেখো, তা ছাড়া আমি কোন না কোন ভাবে তোমার সাহায্যে আসতে পারি।যেহেতু আমিও মেহেরপুরেই যাচ্ছি।
এবার  তার সরল বিনয়ের কাছে হার মানলাম।আমার আদি থেকে এই পর্যন্ত সবকিছু খুলে বললাম।এখন কেন জানিনা নিজেকে হালকা লাগছে।
উনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।হটাৎ বাসটা থামলো। ব্যাপারটা বুঝার জন্য লুকিং গ্লাস টেনে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। না আকাশে আর মেঘ নাই জোস্ন্যা ফুটতে শুরু করেছে। চাদের আলোয় পুরো এলাকা আলোকিত। সামনের দিকে চোখ যেতেই বাসের লাইন, প্রচন্ড ভিড়।বুঝতে পারলাম আরিচা ঘাট চলে এসেছি। কিন্তু যা জ্যাম দেখতেছি তাতে তো এখানেই সকাল হয়ে যাবে।
মনের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে লাগলো ক্রমেই। মনে হচ্ছে পুরো জমিনটাই উল্টায়ে গেছে। সুপার ভাইজার মামুন ভাইকে দেখলাম  দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। গাড়ি এখানে প্রায় ঘন্টা খানেক হলো ঠাই দাঁড়িয়ে আছে একটুও সামনে যাচ্ছেনা। যাবে কী করে সামনের গুলাও তো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রচন্ড ক্ষিধা পেয়েছে, সামনে অল্প অল্প আলোতে একটি হোটেল দেখলাম খোলা আছে।গিয়ে বসলাম।কী কী আছে ভাই?
ভাত, মাছ, মাংস, ডিম ও সবজি। হোটেলের কর্মচারি বলল।
সবজি ও মাংস অর্ডার দিলাম। কোন কথা ছাড়াই পরপর দুপ্লেট খেয়ে নিলাম। এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে। আরেক প্লেট ভাত আনতে বললাম। পরের প্লেটটাতে সবজি মিশানোর পর ঘড়ির দিকে চোখ গেল। রাত 2:25 বাজে। কিযেন ভাবার পর আর খাওয়া হলোনা। নজর গেল পাশের টেবিলে, দেখলাম সুপার ভাইজার মামুন ভাই খেতে বসেছে।
আমি হাতটা ধোয়ার পর মামুন ভাইয়ের টেবিলে মুখোমুখি বসলাম, উনার সিগারেটের প্যাকেটটা  টেবিলের উপরেই ছিল। একটা সিগারেট বের করে মুখে নিলাম।পকেটে হাত দিয়ে লাইটার টা খোজার চেষ্টা করলাম। মনে পড়লো লাইটার তো ব্যাগের মধ্যে। মামুন ভাই ফায়ার বক্স টা এগিয়ে দিলেন। সিগারেটটা ধরিয়ে কয়েকটা টান দিতেই মামুন ভাই ফোন রিসিভ করলো। কাকে যেন বললেন কি অবস্থা, কতক্ষণ লাগবে? কী দুইটা ফেরী নষ্ট হয়ে গেছে।মামুন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
মিনিট দুয়েক পরে আমাকে বললেন, চলেন বাইরের চায়ের দোকানটাই বসি।রাতটা চাদনী ভালো লাগবে।
আমি কোন কিছু না বলেই অনুসরণ করলাম। বাইরের চায়ের দোকানওয়ালাকে চা দিতে বললেন একটু কড়া করে।খুব শীত করছিল বলে কান পট্টিটা ভাল করে সেট করলাম।চাদরটাও ভাল করে গায়ে দাঁড়িয়ে দিলাম। সাধারণত শীতের সময় যত দামি পোশাকই পরিনা কেন এই চাদরটা আমার গলার দুপাশ দিয়ে ঝুলানো থাকে। চাদরটা গায়ে জড়ানোর পর নিজেকে তিন-চার বার দেখে নিলাম। আমি আসলে এটাকে শীতের ফ্যাশন মনে করি।ঠিক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যেমন তার দলীয় প্রতিক হিসাবে গামছা দুকাধে ঝুলিয়ে রাখে তেমন আর কি।চা খাওয়ার পর মামুন ভাই আমারে জিজ্ঞাসা করে আরেকটা সিগারেট দাবে কী না?
কোন কথা না বাড়িয়েই হাত বাড়িয়ে নেয়। ম্যাচ বক্সের খচাত শব্দে কাঠিতে আগুন জ্বলে ওঠে। তা থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটা আমার দিকে আগিয়ে দেয় মামুন ভাই। কিন্তু হতাৎই হাল্কা বাতাসে নিভে যায় সেটা। এবের নিজে থেকে ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট টা জ্বালায় আমি। দুটান দিয়েই জিজ্ঞাসা করি আচ্ছা মামুন ভাই মেহেরপুর পৌছাতে কয়টা বাজবে আনুমানিক বলতে পারবেন?
সকাল এগার সাড়ে এগারোটা বাজবে তো বটেই, উনার সোজা উত্তর।
কথাটা শুনেই আমি চমকিয়ে উঠি। পাশের বাশের মাচান টাতে বসে পড়ি ভতাৎ করে। মামুন ভাইও কিছুটা হচকচিয়ে যায় তবে কিছু বলেনা। আমি সিগারেটে জোরে জোরে টান লাগায়।এবার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখে আমার অন্ধকার ভর করে।চোখ বন্ধ করে থাকি কিছুক্ষণ। সর্ষেফুলের ফোটা ফোটা আলোক ভেদ করে প্রিয়ার মূখটা পর্দায়িত হয়।যেন মেহেরপুর বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক করছে মেয়েটা। চোখ দুটি ছলছল করছে অশ্রুতে। ক্ষানিকটা অবিশ্বাস আর প্রতারণার মাঝে ডুবছে মনে হচ্ছে।এভাবে মেয়েটা হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। আমার কাছে ফোনও নাই যে ফোন দিবে একটা। এভাবে একটা একটা করে তিনটা ঘন্টা অপেক্ষা করার পর বাসার দিকে আবারো ফিরে যায় ব্যাগ নিয়ে জোরে জোরে কাদতে কাদতে। লসিমন গাড়িতে উঠতে উঠতে বলতে থাকে বেঈমান কাপুরুষ তুমি জীবনে সুখী হবে না। ঘটনাগুলো দ্রুতই ঘটতে থাকে। একসময় বাসায় পৌছায় দেখে যে অনেক মানুষ জোড়ো হয়েছে, তার লিখে যাওয়া চিঠিটা পড়ছে আর নানা রকম মন্তব্য করছে।যার মধ্যে নব্বই শতাংশই পচা কথা। সবাই তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। রাত গভীর থেকে গভীর হয়, সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে, রিমা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে সবার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে একজনের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া অনেক ভালো। ওড়নাটা ফ্যানের সাথে শক্ত করে বাধে, নিজেকে শেষ করে ফেলার মনস্থ করে।গলাতে কন্ঠ আতকে ওঠে।ডানহাতের মাঝে মধ্যমা আংগুলে আগুনের স্প্ররশ পাইতেই লাফিয়ে উঠি। সম্বিত ফিরে পায়, ওহহ তাহলে বসে বসে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।
তারপরেও আমার ভয় যায়না।আমি ভাবনায় ডুবি যে এখন যা স্বপ্ন তা আজকের পর হয়তো সত্যিও হয়তে পারে।কারণ বাসের আসায় বসে থাকলে মেয়েটার কাছে বেঈমান-কাপুরুষ হতে হবে। সর্বপরি যদি এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তখন নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবনা। তড়িঘড়ি করে উঠে বাসে যায়, গিয়ে দেখি পাশে বসা রোমিও লিয়াকত সাহেব নাই। ভাবলাম বাইরে গেছে হয়তো। আমার সোল্ডার সিলিং ব্যাগটা উপরের ডেক্স থেকে বের করতে গিয়ে বুঝলাম লিয়াকত ভাইয়ের ব্যাগটা নেই। মনে খটকা লাগলো, পাশের সিটের যাত্রি কে জিজ্ঞাসা করলাম উনি বললেন যে লিয়াকত ভাই নাকি চলে গেছে।লঞ্চ করে নাকি পার হবেন ওপারে থেকে নাকি বাস পাওয়া যায়, সেভাবে যাবেন। উনাকে নাকি সকাল আটটার আগেই মেহেরপুর পৌছাতে হবে নাহলে বড় রকমের সর্বনাশ হয়ে যাবে। পরে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাকে দিলেন, আরো বললেন ফোন করতে বলেছেন।
কার্ডটা এক হাতে নিয়ে না দেখেই মানিব্যাগে রেখে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম বাস থেকে।মামুন ভাইকে খোজার ইচ্ছে ছিল, একবার ভাবলামও পরে আবার সামনের দিকে এগুতে থাকলাম জোরে জোরে পা চালিয়ে।প্রায় ঘন্টাখানেক হাটার পর লঞ্চের কাছে পৌছালাম। লঞ্চের মধ্যে উঠলাম তেমন কোন ভীড় নাই। অর্ধেকটাই ফাকা। লঞ্চ পার হয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়ে দেখি তিনটা দশ বাজে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চলন্ত বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, মেহেরপুর গামী বাসের জন্য।পাচ-ছয়টা জিজ্ঞাসা করে খুবই হতাশ হলাম।হতাৎ আমার পাশে একটা ট্রাক দাড়ালো। ড্রাইভার নেমে দাড়িয়েই প্রস্রাব করতে শুরু করলো। আসলে ট্রাক ড্রাইভার গুলো সব এমনি হয়। পাশ দিয়ে যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করল লাইটার আছে কিনা? পরপর চারবার জানতে চাইলো। পাচবারের বেলায় আমি বললাম কী আপনার সমস্যা কি? ক্ষানিকটা রাগের সুরেই। আমারটা তেলে ভিজে গেছে।
অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্যেও ব্যাগ থেকে লাইটার বের করলাম। লোকটি একটা সিগারেট আমার দিকে আগিয়ে দিয়ে বলল, নেন ধরেন।
আমার রাগের মাত্রা টা ধৈর্যাতিক্রম করে ফেলল, কিন্তু প্রকাশ করলাম না। শুধু উনার দিকে চোখ টাটালাম।
ওনার খেয়াল তখন আকাশের নিভু নিভু চাদটার দিকে।  কয়েকটা টান মেরে আরেকটা রোমান্টিক কথা বলল, এই তারা ভরা রাতে চাদনী আলো শুধু প্রেমিকার সাথে বসে গল্প করলে জীবনটা সার্থক হতো। এমন রাত যে আমি কবে পাব, হায়রে আল্লাহ্।
এবার মেজাজটা চরমে উঠে গেল, সরাসরি বলেই ফেললাম, ওই মিয়া আপনি যান তো এখান থেকে, আপনার কাছে ওসব কথা কে শুনতে চেয়েছে। যান ফোন করে আপনার প্রিয়ারে ওগুলা শুনান খুব খুশি হবে।
লোকটা রাগলো না তবে আমার সমস্যাটা বুঝতে পারল মনে হয়। বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন নিশ্চয়? উনার প্রশ্ন।
আমার রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেল, আমার দরকার বাস। এই ব্যেটা ট্রাকওয়ালা এতকথা বলে কেন?। লোকটি অদ্ভুতভাবে প্রস্তাব দিলো, কোথায় যাবেন ভাইজান, বলেন আমি যদি সেই রাস্তায় যায় তবে অবশ্যই আপনাকে পৌছে দিতে পারব।
 আমি কোন কথা বললাম না।
ট্রাকওয়ালা গিয়ে ট্রাক স্ট্রার্ট দিল। এবার লুকিং গ্লাস দিয়ে আমার দিকে আবারো জোরে জোরে প্রশ্ন করল, যদি মেহেরপুর যান তবে আমি পৌছে দিতে পারি। আপনি আমার সাথে আইতে পারেন।
আমি হতবম্ব হয়ে গেলাম তবে নীরব থাকলাম। ট্রাকটা ছেড়ে গেল সামনের দিকে, বিশ গজ হবে আর কী। আমার মাথায় সিদ্ধান্ত গুলো দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার জন্য প্রসেসিং হচ্ছে। ট্রাকওয়ালা কে জোরে ডাক দিলাম।ভেবেছিলাম উনি শুনতে পাবেন না। কারণ ট্রাকটা অনেকটা দূরে চলে গেছে।আমি হতাশ হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। মনে হল আমার সামনের সব সুযোগ গুলোয় হাত ছাড়া হয়ে গেল।
কার যেন ডাকের আওয়াজ পেলাম, তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বের করে আমাকে ডাকছে, কিছু কি বললেন?
আমি দৌড়ে গেলাম, আপনি কি মেহেরপুর যাবেন?
ড্রাইভারের হাসি হাসি মুখে জবাব এলো হো হো, ভাইজান মেহেরপুরেই যামু। আপনি যদি মেহেরপুর যান তো উঠতে পারেন। টাকা লাগবে না।
ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসলাম।একি পিছনে তো অনেক জায়গা, আসলে আমি মনে করেছিলাম, ট্রাকে তো জায়গা থাকেনা তাই অন্য কিছু ভাবছিলাম। আপনার ট্রাকে তো দেখি গোটা পাচেক লোক যেতে পারবে।
ড্রাইভারের সদয় উত্তর লোক যেতে পারে কিন্তু আমি লোক উঠায় না। আপনাকে দেখে কেমন যেন চিন্তাগ্রস্ত লাগলো তাছাড়া মনে হল সসাম্নে কোন স্থানে হয়ত আপনাকে তাড়াতাড়ি পৌছাতে লাগবে। এজন্যই আপনারে সাহায্য করার কথা ভাবলাম। তারপরেও আজ আমার হেল্পার আসে নাই। একা একা তো ভালো লাগেনা, পাশে একটা লোক থাকলে বিভিন্ন কথা বার্তা বলে ক্লান্তি দূর করা সম্ভব হয়।
এতগুলো কথা একবারে বলে থামে। ততক্ষণে আমরা প্রায় দশ কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করে এসেছি। আমার সাথে ড্রাইভারের টুকটাক অনেক কথা হলো। হঠাৎ মনে পড়লো লিয়াকত সাহেবের কথা। মনে পড়তেই কার্ডটা বের করে দেখলাম, সেখানে তার আড়তের ঠিকানা প্রিন্টের কালিতে লেখা আছে। টিএনটি নাম্বার দেওয়া আছে। কোন ফোন নাম্বার নাই। ভাবলাম টিএনটি তো আড়তে ও বাসায় আছে এখন তো উনি ডাকার বাইরে। হতাশ হয়ে আবার মানিব্যাগে কার্ডটা রাখতে গিয়ে কার্ডের পিছনের দিকে নজর গেল।একটা এয়ার্টেল নাম্বার লেখা সেখানে।
ড্রাইভারের সাথে একটু আগে লিয়াকত সম্পর্কে কথা হয়েছে। তাই আস্তে করে বললাম, আপনার ফোন থেকে কি একটু কল দিতে পারি?
ড্রাইভার মিজান ফোনটা আগিয়ে দিল।
নাম্বারটা উঠিয়ে ফোন দিলাম। ইউজার বিজি দেখাচ্ছে।
পাচমিনিট পরে আবার পরপর তিনবার ফোন দিলাম, নেটওয়ার্ক ইরোর, বিজি, ইত্যাদি শো করলো। এয়ার্টেল সিমের উপর এজন্যই রাগ হয় সব জায়গায় নেটওয়ার্ক থাকেনা। চিন্তা ছেড়ে দিলাম ভাবলাম আর হয়ত দেখা হবেনা। ট্রাক ফরিদপুর সিএনজি ফিলিং স্টেশনে এসে থামল। বুঝলাম তেল নিবে। কিছুক্ষণ পর আবার চলতে শুরু করল। পাশে একটা বাস দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। তারপাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল মনে হচ্ছে চেনা চেনা লাগছে।লিয়াকত ভাই মনে হচ্ছে। আবার ভাবলাম চোখের ভুল নাতো। এবার চোখের ভুল কাটানোর জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, সত্যিই তো  লিয়াকত ভাই বাসের ড্রাইভারের সাথে কথা বলছেন। আমার বলার আগেই ড্রাইভার মিজান ভাই ট্রাক থামালো। আমি নেমে গিয়ে লিয়াকত সাহেবের হাতটা ধরলাম, কী ব্যাপার কি করছেন?
সেই পুরনো হাস্যোজ্জ্বল মুখে চিন্তা বিরাজমান। আবেগি আখি দুটি প্রায় অশ্রুসিক্ত। উনি ড্রাইভার কে বলছেন আমি কি সকাল আটটা নয়টার দিকে মেহেরপুর পৌছাতে পারব?
অবশ্যই পারবেন, মাঝখান থেকে বললাম, আমার সাথে চলেন। উনাকে আমাদের ট্রাকের কাছে নিয়ে আসলাম। মিজানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এবার লক্ষ্য করলাম উনার আগের চেহারা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অনেক কথায় কথায় আমরা একে একে মাগুরা, কামারখালি, ঝিনাইদাহ, চুয়াডাঙ্গা, শেষে মেহেরপুর এসে পৌছালাম। যখন ট্রাক থেকে নামলাম তখন সকাল সাতটা বাজতে এখনো ২০ মিনিট বাকি।
মিজান ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেলে আমি ও লিয়াকত ভাই গিয়ে বাসস্ট্যান্ড মসজিদে নামাজ পড়তে যাব দেখি সবাই তখন নামাজ শেষ করে বের হচ্ছে। আমরা কাজা নামাজ শেষে দুজন দুজনার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিদায় নিলাম। 
রেহেনার বাসা মেহেরপুর পৌরকলেজ পাড়াতে হওয়ায় উনি আমার উলটা দিকে রওনা হলেন, কারণ রিমা আমাকে কোর্ট রাস্তাতে দাড়াতে বলেছে, যেটা মুজিবনগর রোডে। উনি বললেন রেহেনা নাকি সাড়ে নয়টার দিকে আসবে বলেছে তাই উনি সাড়ে নয়টার টিকিট বুক করলেন। যেটা নয়টা পয়তাল্লিশে ছেড়ে যাবে। আমি কোন টিকিট কনফার্ম করলাম না, কারণ ও কখন আসবে নির্দিষ্ট করে বলেনি।
তুষার গিয়ে দাড়ালো কোর্টরোডের রায়পুর-আটকবর সড়ক বাসস্ট্যান্ডে। সে ভাবল শ্যামলি আপার নাম্বারে একটা ফোন করবে। পরপর দুবার ফোন দিল কোন রেসপন্স নাই। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।শেষবারের মত ফোন দিল।এবার শ্যামলি আপা ফোনটা রিসিভ করে বলল আস্তে আস্তে, তুই টিকিট কেটে রাখ আমি যেভাবে হউক আটটা সাড়ে আটটার দিকে বের করে দেবো।
তুষারের কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। এবার গেল টিকিট কাউন্টারের দিকে। নয়টার টিকিট বুকিং দিল।পরে যদি টিকিট না পাওয়া যায় তবে ঝামেলা হতে পারে। ধরা খওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি দুটি টিকিট নিলো। ভাবতে ভালো লাগছে, এতোটা রাস্তা পাশাপাশি সিটে বসে যাবে।কিছুক্ষণ পর থেকে দুজন দুজনার অনেক আপন মানুষ হয়ে যাবে।
দূর ছায় এখনো আসার নাম নাই আমি কি ভাবছি এসব! তুষারের চোখেমুখে হালকা হাসির আভা ফুটে উঠল। কারণ তাদের ভালবাসার সম্পর্কটা কখনও গভীর হয়নি। তুষার একবার রিমাকে ঈদের দিন প্রস্তাব করেছিল কথাও ঘুরতে যাবার জন্য তবে রিমা হ্যা অথবা না কোনটাই বলেছিল না।। তবে তুষার ধরেনিয়ে ছিল নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। এজন্যই রিমার নামে যেকোন ছেলের কথা সে আমলে নিতোনা। কিন্তু বছর দুয়েক পরে রিমা তুষারের সব বিশ্বাস কে ভেঙ্গে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল।তবে রিমার ভাষ্যমতে তাকে জোর করে বিয়ে করানো হয়েছিল। সে নাকি কবুল পর্যন্ত বলেনি। তাছাড়া বাবার সম্মান রাখতেই নাকি এমন করেছিল।
তার স্বামিকে তুষার কখনও দেখেনি। শুনেছে উনি নাকি ক্যাবলাকান্ত টাইপের আনস্মার্ট ছেলে। সারাক্ষণ লুঙ্গি পরে থাকে। কথা ভাল করে বলতে পারেনা। তবে উনারা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, জমি জায়গা আছে চাষ আবাদ করে। সুন্দরি মেয়েরা সাধারণত স্মার্ট ছেলেকে জীবন সঙ্গি হিসাবে চান। তাই হয়ত তুষারের কাছে তার ফিরে আসা।
বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তুষার। আবারও দেখল সকাল ৮টা ৪০ বাজে। এখনো আসার কোন নামগন্ধ নাই। নিজের প্রতি রাগ হলো। নিজের ঔদ্ধত্য কে আবারও গালি দেয়।
রিমা বলেছে লসিমন অথবা করিমন গাড়িতে করে আসবে, আবার বাস পেলে বাসেও আসতে পারে। তাই সব দিকে নজর রাখল।
একে একে ত্রিশটা লসিমন গাড়ি চলে আসল নাহ! কোনটাতে রিমা নাই। এদিকে নয়টা ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। বাস ছেড়ে চলে গেছে। দুইটা টিকিট গৎসা গেছে।
 আবার ফ্যাক্স-ফোনের দোকানে থেকে কল দিল শ্যামলির নাম্বারে। এবার ওপাশ থেকে একটা ভারি পুরুষ কণ্ঠ ফোন রিসিভ করল।কোন কথা না বলেই কেটে দিল। তুষার বুঝতে পারলো লোকটা শ্যামলির স্বামী। লোকটা আরেক বজ্জাত। আমি মাঝে মাঝে শ্যামলি কে কল করলে উনি শ্যামলির ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাত। ভুল বুঝতো। মনে করত আমার সাথে তার কোন গোপন সম্পর্ক আছে। তাই আর কথা বলতাম না যেন তাদের সংসাররে অশান্তি বাধে। ফিরে আসার পথে দোকান দার বলল, ভাই আপনার ফোন, আপনাকে চাচ্ছে। ভাবলাম হয়ত রিমা অথবা শ্যামলি।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ভারি ঐ পুরুষ কণ্ঠটা শুনে তাই তুষার আবারো লাইন কেটে দিল।আর দোকানদার কে বলল ভাই আবার ফোন দিলে বলবেন, ভুল করে চলে গেছে। দোকানি সেটা বলেছিল কিনা সেটা তুষারের অজানায় থেকে গিয়েছিল।
আবার ফিরে আসল আন্তনগর বাসস্ট্যান্ডে, টিকিট কাটার জন্য। এগারোটার গাড়ির টিকিট পেল। কি মনে হওয়ার এবারো দুইটি টিকিট কিনলো। এখন বাজে দশটা পচিশ। এখনও ৪৫ মিনিট দেরি আছে। সময় যেন থেমে গেছে, কান্নায় বুকটা ফেটে আসছে, কাদতেও পারছে না। পাশের চায়ের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল।
 হতাৎ চোখ আটকে গেল রাস্তার ওপারের দৃশ্যপটে চোখ পড়াতে। একটা ছাপা বোরখা পরা মেয়ের হাত ধলে কাউন্টারের দিকে আসছে লিয়াকত ভাই। নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল তুষার।
উনি যদি আমাকে এমন বিষন্ন অবস্থায় দেখে তাহলে কি ভাববে? তাছাড়া যদি রিমার প্রসঙ্গ আসে তাহলে আমি কি জবাব দেব। না উনার সামনে না পড়ায় ভালো। তাছাড়া রিমার সম্বন্ধে বেশি বেশি বাড়িয়ে বলা হয়েছে।বাসের মধ্যে আমি বলেছিলাম কি রাত কি দিন কি ঝড় কি বজ্রপাত সব উপেক্ষা করে আমার একটা আহবানে সাড়া দিয়ে আসতে প্রস্তুত। এখন যদি বলি আমি একা ফিরে যাচ্ছি, তাহলে তার কাছে আমি করুণার পাত্র ছাড়া কিছুই থাকবনা।
আমি লিয়াকত ভাই সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান ছিলাম যে লোকটার একেতো একপা কবরে আবার যৌন সমস্যা, আবার মেয়েটা শহুরে। এটা কি সম্ভব সাথে একটা পাচ বছরের বাচ্ছা আছে।
বাচ্ছার কথা মনে আসতেই রেহেনা আপার কথা চিন্তায় উদয় হলো, রেহেনা আপা কি অতোটুকু ছোট বাচ্ছা রেখেই নিজের সুখের জন্য সংসার ত্যাগ করবেন?
মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বুঝতে পারছেনা এটা কি চিন্তার জন্য নাকি ধুমপানের জন্য। তুষার বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় জানে গোল্ডলিফ সিগারেটে নিকটিনের মাত্রা সর্বাধিক। এজন্য এমন হতে পারে।বাসি পেটে অনেকগুলো সিগারেট খাওয়া হয়েছে। তুষার সবসময় বেনসান সিগারেট পছন্দ করে, এখানে বেনসান তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না।তাইতো গোল্ডলিফ গ্রহণ করা।
মিনিট দুয়ের মধ্যে একটু স্বস্তি ফিরে আসলে কৌতুহল মিটাতে কাউন্টারের আসেপাশে যায়, তারপর যা দেখে তাতে তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেয়। তুষার দেখে পাচবছরের ধবধবে সাদা একটি কন্যা সন্তান লিয়াকত ভায়ের কোলে।
ধরা খেয়ে গেলাম লিয়াকত ভায়ের কাছে, উনি একপাশে সরে এসে আমাকে বললেন, কয় ভাবি সাহেবা কয়।
আমি কোন কথার জবাব দিতে পারলাম না, তাই নীরব থাকলাম।
মিয়া তুমি তো কয়ছিলা আসবেই কয় তাহলে। আসেনাই তো আসবে না আমি জানি। উনি একটু রাগ রাগ করে বললেন।
আমার নীরবতা আর চোখের টলোমলো জলের ফোটাটা রেহেনা আপা দেখতে পেয়েছিলেন বলেই লিয়াকত ভায়ের হাত একটু চাপ দিলেন যেন উনি চুপ করে যান। তাই হল উনি চুপ করে গেলেন।
আমি এতক্ষণে রেহেনা আপার দিকে লক্ষ্য করলাম। উদ্দেশ্য ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা। বোরখার সাথে স্কার্প পরা ছিল তাই মুখ দেখতে পারতেছিলাম না, তবে চোখ পড়ল লিয়াকত সাহেবের হাতে রাখা হাতটার উপর।কী ফর্সা ধবধবে মসৃণ হাত। দুটি হাতের পার্থক্য সহজেয় লক্ষ্য করা যায়।লম্বা হবে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, চুলগুলো বেশি বড় না হলেও ২ ফুট তো হবেই। সর্বোপরি অসাধারণ এক সুন্দরি এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বাচ্ছাটির দিকে এবার মনোযোগ দিলাম, বাকপ্রতিবন্ধি, এজন্যই রেহেনার উপর স্বামির নির্যাতন বেড়েছিল।
ওদের গাড়ির সময় হয়ে গেল ওরা চলেও গেল।
কিছুক্ষণ পরেই আমার গাড়ি ছাড়বে। আমি আগে থেকেই গাড়িতে গিয়ে বসলাম। পাশের খালি সিটটার কথা ভাবতেই মনটা বিষন্যতায় ভরে উঠতে শুরু করল।তুষারের ভাবনা জুড়ে এগুলো ভাসছিল। পাশের খালি সিট টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
গাড়ির কন্টাক্টর এসে জানিয়ে গেল গাড়ি আধা ঘন্টা লেট করে ছাড়বে।
 মনেমনে মালিক কর্তৃপক্ষ কে খুব গালি দিলেন।মেজাজটা বেজায় খারাপ হয়ে গেল।গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তুষারের হঠাত মনে পড়ল মেহেরপুরে তার একটা ফ্রেন্ড আছে দেখি তার সাথে যোগাযোগ করা যায় কিনা। বন্ধু তার নাম রাশেদ। কলেজ জীবনের বন্ধু। ওর নাম্বারটা মুখস্থই ছিল। দোকান থেকে ফোন করলাম না খোলা নাই।
বুকে প্রচন্ড কষ্ট আর ব্যর্থতা ছবি ফুটে উঠল। তারপরেও ভাবল যাক আমি নিজের বিবেকের কাছে তো হারেনি। সে মাথা উচু করে বলতে পারবে সব বাধা অতিক্রম করে আমি মেহেরপুর পর্যন্ত গিয়েছিলাম কিন্তু রিমা আসে নাই। রিমা তো বলতে পারবেনা যে আমি একটা বেইমান। একটা কাপুরুষ। এসব আজেবাজে চিন্তা তুষার কে বিষন্যতাই ভুগাতে থাকে।
আবার তুষারের নিজের উপর খুব রাগ হয়, খারাপ লাগে, যে সে একটা মোবাইলও কিনতে পারেনি। এইতো মাস চারেক হল তুষার রাগ করে বাসা ছাড়া। তার বাবাটা বড় খ্যাচখ্যাচে। অকারণেই প্রতিবিগাতি হয়ে ওঠে তুষারের উপরে। তুষার মেডিকেল ভর্তিপরিক্ষা দিয়েছিল। রংপুর মেডিকেল কলেজে ১১৭তম হয়েছিল। তারপরেও সে ভর্তি হয়নি। ঢাকার প্রতি তার অজানা একটা টান কাজ করে। ঢাকার বাইরে কোথাও থেকে পড়াশুনা করবে ভাবতে পারেনা। ঢাকাতে যদি রিক্সাও চালাতে হয় তবুও রাজি কিন্তু ঢাকার বাইরে যেতে নারাজ। এজন্যই বাবার সাথে রোজ তার ঝগড়া হত। একপর্যায়ে সে বাসা ছেড়ে আসে। আসার সময় শুধু তার দুইটা ডাইরি ও চাদর এবং সাধনার গিফট করা প্যান্ট পরে চলে আসে।বাবার কিনে দেওয়া কোন পোশাকই সে আনে নাই।
আজকে আবার বাড়ির কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে। ফিরে যাবে বাড়ি? এমন প্রশ্ন মন কে করে। না থাক। বাড়ি ফিরে গেলে অশান্তি। অভাবি সংসারে দুঃখের অবাধ বিচরণ। তুষার কে তার বাবা একেবারে দেখতে পারেনা। তুষার নিজেও জানেনা কেন এমন করে। যা ভালবাসা পাই সবটুকুই তার মায়ের কাছ থেকে।
চায়ের দোকানের একপাশে বসে সিগারেট টানছে আর ভাবনাতে ডুবছে। ভেবেছিল যে রিমাকে নিয়ে সে নতুন করে বাঁচবে। কিন্তু হায়রে জানিনা তার খবর কি।
তুষার রাগ করে আসার সময় বাড়িতে মোবাইল টা রেখে এসেছিল। এরপর আর ফোন কেনা হয়নি। বন্ধুর কাছ থেকে তার একটা অব্যবহৃত ফোন ধার নিয়েছিল কিছুদিনের জন্য। সেটাও গাবতলীতে গাড়িতে উঠার আগে হারিয়ে ফেলেছিল। ফোন চালু থাকলে হয়ত রিমা জানিয়ে দিতে পারত আসবে কিনা। কিন্তু সে সুযোগ আগে থেকেই হাত ছাড়া হয়েগেছে।
নিজের অসুবিধা, দুর্বলতা সবকিছু তুষার কে রিমা প্রসঙ্গে ভুল বোঝা থেকে দূরে রাখে। এবার গাড়ি ছাড়ার সময় গেছে। কন্টাক্টর এসে সবাই কে গাড়িতে উঠতে বলল।
তুষার গাড়িতে উঠার আগে শেষবারের মত আরেক বার তাকায় পিছনের দিকে, না কোন উপস্থিতি নাই। দোকান দার কে টাকা মিটিয়ে অল্প অল্প পায়ে গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে সুপারভাইজারের কাছে জিজ্ঞাসা করলো গাড়ি কি এখনি ছাড়বে। হ্যা জবাব আসলো।
সবার শেষে তুষার গাড়ির সিড়িতে যেইনা পা দেবে অমনি পিছন থেকে সিনেমার নায়িকার ভঙ্গিতে নাম ধরে ডাক, তুষার, তুষার যেও না প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা, আমাকে নিয়ে যাও, আমি এসেছি। 
বাসে না উঠে তার পথের দুরত্ব কমাল, বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়লো রিমা। তুষার প্রথম শিহরিত হল। তার খুশির সিমা অতিক্রম করল।
এবার সুপারভাইজার শাহজাহান ভাই তুষার কে বলল, কি তুষার ভাই যাবেন না? গাড়িতো ছেড়ে দিয়েছি।
আসছি বলে তুষার রিমাকে গাড়িতে উঠায়ে দিল, জানালার পাশের সিট টাতে ওকে বসতে দিল।
তুষারের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল রিমা। কিছুক্ষণ দুজন কোন কথা বলল না। এভাবে হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার মানুষটি চিরদিনের জন্য তার ঘাড়ে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাল। ঝড়ের মত ফিরে আসল তুষারের জীবনে। ওর কাছে মনে হল যেন স্বাধীনতা যেন একাই পাকিস্তানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করল। চোখে মুখে হাসির আভা যেন ফুরাতেই চাচ্ছেনা। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে এই জীবনের জন্য নিজের সব কিছু বিসর্জন দেওয়া যায়।
ঢাকাতে পৌছানোর পর তুষার তার কয়েকটা বন্ধু-বান্ধবীর ফোন দিল। তারা আসলো, বিয়ের আয়োজন করলো, বিয়ের হলো এক পর্যায়ে।
রিমা ও তুষারের জীবন ভালই কাটছিল।
বিয়ের চারদিনের মাথায় হটাৎ করে লিয়াকত ভায়ের কথা মনে পড়ল।মোবাইল না থাকায় ফোন করা হল না, সোজা উনার দেওয়া আড়তের ঠিকানায় পৌছাল।
তুষারের নজর পড়ল, লিয়াকত ভাই  চেয়ারে বসে পেপার পড়ছিল। উনার কাজের লোকগুলো কাজে ব্যস্ত। উনি পেপার থেকে চোখ না উঠায়ে বিভিন্ন কাজের জন্য তাগিত দিচ্ছিলেন।
একটা জিনিষ লক্ষ্য করল, লিয়াকত সাহেবের শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক আকারে। আগের থেকে অনেক ফর্সা লাগছে, চুলের কাটিংও পরিবর্তন করেছে, সব মিলিয়ে এটা  মনে হচ্ছে রেহেনা আপা উনাকে স্মার্ট করে ফেলেছেন।
পেপার নামাতেই আমার সাথে চোখাচোখি। আরে অই মুই চোইক্কে ভুল দেখতাছি না তো। আরে মিয়া ওখানে খাড়ানো কেঠাই। আরে এই তো আমাগো তুষার সাহেব নি।
আমার মুখের হাসির ঝলক দেখে উনি প্রশ্ন করে বসলেন, কী ব্যাপার এত খুশি খুশি মনে হচ্ছে কোন খবর আছে মনে হয়। ভাবি সাহেবা কি ফিরে আইছিল মনে হয়।
আমারে নিয়া চেয়ারে বসাল। মানিক বলে একজন কর্মচারীকে ডাকলেন, এই ব্যাটা এটা আমার খুব ঘনিষ্ট লোক। এর সেবা কর। উনি বাতাস দিতে লাগল এই শীতের সময় ও আমার কপালে ঘাম দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক অনেক চা-নাস্তা নিয়ে আসল অন্য আরেকজন।
উনি অন্য একটা টুল টেনে আমার মুখোমুখি বসলেন। কিভাবে সম্ভব হল তা জানতে চাইল। আমি সব কিছু খুলে বললাম। উনি আমার থেকে বেশি খুশি মনে হল।হটাত এক কর্মচারীর হালকা চিল্লাচিল্লীতে সেদিকে দৃষ্টিপাত হতেই চোখ ছানাবড়া। দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল দেখলাম লিয়াকতের কর্মচারীরা রেহেনা আপার আগের স্বামীর মেয়ে লিজা কে কোলে করে নিয়ে আসছে। লিজার পোশাকে অনেক পরিবর্তন দেখলাম। অনেক দামি দামি পোশাকে জড়ানো শরীর। মুখে সদা হাসি উপস্থিত। এর আগে যখন মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ডে দেখেছিলাম লিজা মানুষিক ভাবে ভারসম্যহীন একটি প্রতিবন্ধি মেয়ে। মুখে হাসি ও কান্না কোনটাই উপস্থিত ছিল না।এখন সদা হাসি ওর মুখে লেগে আছে। শুধু মাত্র মুখের ভাষার অক্ষমতা। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম কল্পনা মনে হবে কিন্তু সত্যি হতে কতক্ষণ। কথাটা হল লিয়াকতের কাছে থাকলে হয়ত লিজা একদিন সুস্থ্য হয়ে যাবে।
এসব ভাবনাতে কিছুটা ছেদ পড়ল লিয়াকতের ধমকে। দৌড়ে গিয়ে এক কর্মচারীকে থপাস করে একটা চড় দিল। মুখের কথা গুলা ছিল এমন, আমার মেয়ের যদি কিছু হত তোদের সব গুলারে কুত্তা দিয়ে খায়াতাম।
খুব ভাল লাগছিল যখন লিজা লিয়াকত সাহেবের কোলে খুব ঘনিষ্টভাবে ছিল। হটাৎ করে উনি ফোন রিসিভ করলেন। কথা বলে যা বুঝলাম ওপাশের কলার ছিল রেহেনা ভাবি।
এইপ্রথম আমি মনেমনে ভাবি সম্বন্ধন করেই ফেললাম। আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম আর নাস্তা খাচ্ছিলাম। হটাৎই লিজা আমার কোলে এসে বসলো। আমি অবাক হয়ে জায়গা করে দিলাম। লিজার নিস্পাপ চোখে তখনও দুষ্টমির হাসি খেলা করছিল।
নাস্তা শেষ করতেই রেহেনা ভাবি এসে হাজির হল। এই প্রথম দেখলাম ভাবিকে । বাসস্ট্যান্ডে বোরখা পরে ছিল বলে দেখতে পারেনি ভাল করে। তাছাড়া উনার স্বামি যুবলীগের সহসভাপতি তো তাই রেহেনা কে সবাই চেনে শাহজাহানের বউ বলে।উনি নাকি রেহেনা আপা কে জোর করে বিয়ে করেছিলেন।
গোলাপী কালারের থ্রীপিচ পরে আছেন অসম্ভব সুন্দরি এক মহিলা। একমিনিট চোখ বন্ধ করে দুজনকে মিলিয়ে দেখলাম। বয়সের পার্থক্য ছাড়া দুজনার ভালবাসাতে, বোঝাপড়াতে কোন খাদ নাই। রেহেনা আপাকে দেখলাম খুব খুশি খুশি চেহারা। রেহেনা লিয়াকত আলির পাশে খুব ঘনিষ্টভাবে দাড়িয়ে ছিল। দুজনকে আবারও একপলকে দেখলাম ভালকরে। না, বয়স ছাড়া কোথাও কোন প্রব্লেম নাই।
এবার রেহেনা ভাবি মুখ খুলল কি তুষার ভাই অমন করে কি দেখছেন?
আমি প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলাম, আপনারা সারাজীবন এমন করে পাশাপাশি থাকেন আমি আল্লাহর কাছে এই পার্থনা করি। আজকে আমার মনটা খুব খুশি হয়ে গেল।
যাইহক সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমি আজকের মত আসি বলে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় উনারা দুজন আমার দুটি হাত ধরে ফেলল, না, ভাইজান, না খেয়ে গেলে ছাড়ছিনা। তাছাড়া এখন সন্ধ্যা হতে অনেক দেরি।
তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে আসার ক্ষমতা আমার ছিলনা।
ওদের সাথে লিয়াকত আলির বাসাতে গেল তুষার। রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিল, একপর্যায়ে ছোখ আটকে গেল ওয়েটিং রুমের বাধানো ফোটোটাতে। লিয়াকত ও রেহেনার মাঝে লিজার ছবিটা লিয়াকতের গালে গাল ঠেকানো অবস্থায় দেখলে বোঝায় যায়না যে লিজা লিয়াকতের মেয়ে নয়।
কি সুন্দর করে সাজানো সবকিছু, অ্যাকুইরিয়ামের পাশের দেয়ালে লিজার একটা ছবি বড় করে লাগানো। রুমগুলো দামি দামি আসবাবপত্রে ভরপুর।
আস্তে আস্তে লিয়াকত ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্মান সাথে শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। রেহেনা ভাবি যথেষ্ট পাকা এক গৃহিণী, সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে সিদ্ধহস্তে।যেকোন মানুষ ওদের দুজন কে একসাথে দেখলে মন ভাল হয়ে যাবে আমার এটা বিশ্বাস।
খাওয়া দাওয়া করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিল।আমি এখন যায় ভাই, রিমা একা একা আছে বলে তুষার বেরিয়ে আস্তে চাইল।
ওনারা এবার আর না করল না রিমার একা থাকার কথাটি শুনে।আসার সময়  ভাবি শুধু বলল, আরেকদিন রিমা ভাবি কে সঙ্গে করে আইনেন। আমরা ত দেখি নাই, খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি হ্যা সম্মতি দিয়ে আসবো এমন সময় আবারো আমাকে থামালো লিয়াকত ভাই, একটা কার্ড বের করে আমার হাতে দিল, নতুন মোবাইল সিম কিনেছেন এইজন্য।
আসার সময় উনার আড়তের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, আবারো চোখ আকটালো নিয়ন বাতিতে যেটা লিয়াকত ভায়ের দোকানের টাইটেল নেইম।যেটা নিয়ন আলোতে জ্বলজ্বল করছে লিজার নামটা। আমি এতোটাই অবাক হলাম যে উনার প্রতি সম্মান আমার হাজার হাজার গুন বেড়ে গেল।
বাসায় আসার পর দেখলাম রিমা গোলাপি রঙের শাড়ি পরে আছে। আমি তো রিতিমত অবাক শাড়ি পেল কোথায়? প্রশ্ন করার আগেই আমার সাব-লেটের আপা এগিয়ে আসলেন, বলতে শুরু করলেন, বিয়ে তো করেছেন বউকে শাড়ি দেওয়া লাগে এটা জানেন কি?
আমি জবাব শুন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। আজ মাসের আঠাশ তারিখ। হয়ত দুদিন ওথবা তিনদিন পরেই বেতনপাবে তুষার। তখন সবকিছু দেবে ভাবে সাথে একটা মোবাইলও কিনে দেবে ভাবে।
চারদিন পরে বেতন পেল, রিমার জন্য দুইটা থ্রীপিচ, দুইটা শাড়ি সেট ও কিছু কসমেটিকস পন্য কিনে ফেলল।আর অল্প দামের মধ্যে একটা চাইনা ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট কিনল।
এগুলা তুষার যখন রিমাকে দিল তখন রিমার মুখের হাসি দেখে কে, কি সুন্দর হাসি যেন মুক্ত ঝরে পড়ছে।
তুষারও কিছু স্বস্তিতে আসল, মনে মনে ভাবল যাক ভালবাসার মানুষটা তো খুশি হয়েছে।
দুসপ্তাহ পরে লিয়াকত ভাইয়ের কার্ডটা বের করে দেখল এবার তিনি গ্রামীন ফোণ সিম ব্যবহার করছেন। মোবাইলে নাম্বারটা উঠায়ে ফোন দিল উনার নাম্বারে, ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেই লিয়াকত ভাই বলে উঠল আরে মিয়া এতোদিন পরে মনে হয়ল।
না মানে মনে তো পড়ে সব সময়ই কিন্তু সময় পাইনা, তাছাড়া আপনি তো একদিনও ফোন করেন নি।
আমাকে উনি বললেন, এখন একটু আমার এখানে আসতে পারবে?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বাজে, বলে ফেলল, হ্যা পারব, কিন্তু কেন?
আসো পরে বলছি, উনি বললেন।
তুষার বাহিরেই ছিল, একটা সিএনজি ভাড়া করে আধা ঘন্টার মধ্যে পৌছাল।
সেই আগের মত করে বসাল, কর্মচারীগুলোকে একটু সরে যেতে বলল। সবাই সরে গেলে তুষারের হাত ধরে বলল, তুষার ভাই  আমি চাই তোমার এই হাসিমুখ্যটা সব সময় থাকুক ওইদিন বাসের মধ্যে এবং মেহেরপুর কাউন্টারে তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। আর এখন তোমাকে অনেক সুখি একজন মনে হচ্ছে।আমি চাই আপনি সারাজীবন এমন হাসিখুশি ভাবে জীবন যাপন করেন।
আমি কিছু বুঝছি না।
শোনেন একটা কথা বলি, মেয়ে আপনার কাছে চলে এসেছে মানলাম, আপনাকে ভালবাসে বলে। তবে আপনি যদি তাকে ভালভাবে বহন করতে না পারেন তবে কিন্তু তার ভালবাসা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাবে।
আমি এবার বুঝলাম, তাই দেরি না করে বলে ফেললাম না না এমনটা কখনও ঘটবেনা। আমি তাকে আসার সাথে আসার আগে আমার সীমাবদ্ধতা টাকে অনেকবার বলেছি। সে কি বলেছে জানেন?
বলেছে পোশাক, ভালোখাবার ভালো বাড়ি, বিলাসিতা কোনটাই চাইনা, চাই শুধু আমার বুকে একটু খানি স্থান।
এরপর আর কোন কিছু বলার থাকে? বলেন!
লিয়াকত সাহেব বিঙ্গজনের মত গম্ভীর্যভাবে বলল, সবই তো বুঝলাম মিয়া তবে বাসা বাসা যে একবার ওনি ছেড়েছে তাহলে অবশ্যই বাসা থেকে ওকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে, নইলে কিন্তু পচতাতে হবে।
মা কিংবা বাবার সাথে কথা বলতে চাইবে যেহেতু আপনি বলেছেন মেয়েটি বাবা মায়ের অনেক আদরের। তো কথা অবশ্যই বলতে চাইবে। ওদের সাথে কথা বললেই দেখবেন আপনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।
তুষার এসবে বিশ্বাস করেনা বলে বিষয়টা আমলে নিলনা।
এবার উনি বললেন শোন মিয়া অর্থনৈতিক যেকোন সমস্যাতে সবার আগে আপনার এই ভাইটার কাছে আসবেন। যদি শুনি আপনি অর্থনৈতিক কোন সমস্যাতে ভুগছেন অথচ আমাকে বলেন নি তবে খুব কষ্ট পাবো।
আর শুনেন, আগামি শুক্রবার ভাবি সাহেব কে নিয়ে আমার বাসায় অবশ্যই আসা লাগবো।
ওইদিন কার মত তুষার বিদায় নিয়ে চলে আসল।
তুষার ও রিমা দুজনা আলাদা বিছানাতে ঘুমায়। কারণ রিমার আগের বিয়েটার ডিভোর্স লেটার এখনো হাতে পাইনি, এজন্য মানবিক কারণেই দুজন আলাদা থাকতে হয়।
কয়দিন থেকেই দেখে ও্বর মনে ছটফটানি কাজ করে তুষার লক্ষ্য করে রিমাকে। কিছু একটা বলবে বলবে ভাবে কিন্তু তেমন কিছুই বলেনা। শুধু রিমা বলে তুমি আমার জন্য যা করলে তা অনেক, সত্যিই তুমি বড়মাপের একজন মানুষ।
আমি আবার কি করলাম যা করেছি তা তো আমার ও তোমার দুজনার জন্যেই তাইনা? আর হ্যা শোনো ঐ যে তোমাকে লিয়াকত ভাইয়ের কথা বলেছিলাম না? উনাদের বাসায় আগামি শুক্রবার দাওয়াত আছে। তুম্মি আমার দেওয়া গোলাপি থ্রীপিচ টা পরবে। গোলাপি রঙ্গে তোমাকে বেশ লাগে। মনে থাকবে?
হ্যা বলে আস্তে করে। তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমায়। আমি ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি সে কি যেন তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম তেলাপোকা। সে আমাকে জাগতে দেখে বলে এই শুনো ঐ টারে তাড়ায়ে দেইতো।
আমি বিছানার পাশে বসে তাড়াতে গেলে, তেলাপোকাটা রিমার দিকে ছুকে আসে, আর তাতেই রিমা আমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আমার খুব ভাল লাগে বিষয়টা। তার স্তনের হালকা চাপ অনুভব করে আমার ঘাড়, অমনি শরীরের উঞ্চতা টের পায়।তেলাপোকা টা চলে যাওয়ার পর ও আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি লাইট নিভিয়ে আবারও শুয়ে পড়ি।
সারারাত ছটফট করি আর ভাবি ডিভোর্স লেটারটা তাড়াতাড়ি উঠিয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে। যাতে ওই লোকটা আর কোন অধিকার না করতে পারে। তখন রিমা শুধু হবে আমার চিরদিনের মত।
সকালে উঠে আগে গেলাম সেই উকিল লোক টার কাছে। ধানমন্ডি ৩২ নং চেম্বারে। উনি বললেন এতো তাড়াতাড়ি বের করতে গেলে অনেকগুলো টাকা খরচ করা লাগবে।
আমি বললাম, তাও কত টাকা লাগবে?
এই ধরেন হাজার পঞ্চাশেক, উনার ধাধালো জবাব।
আকাশ থেকে পড়লাম। এতো কেন? আমার প্রশ্ন।
এবার আমার দিকে বড়বড় কর তাকালেন, তুমি অন্য একজনের বউ বের করে আনবা, আবার তাকে তালাক দেওয়ার জন্য ওর কোন গার্ডিয়ান নাই, পুরো প্রক্রিয়াটিই তো বেআইনি, সো এক্ষেত্রে তো একটু টাকা খরচ করা লাগবই।
এইধরণের হাজার খানেক পচা কথা শুনিয়ে দিলেন।
আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলোনা তুষার। বেরিয়ে পড়ল। প্রচন্ড চিন্তা ভর করে থাকল তার মাথা জুড়ে।
সারাদিন কাজে মনছিল না।তাই আজকে কারো কাছ থেকে কোন বখশিশও নেয়নি তুষার এবং চায়নি।
পরেরদিন শুক্রবার। দাওয়াত থাকায় সেজেগুজে সকাল সকাল রওনা দিলাম গুলশানের উদ্দেশ্যে। একটা সিএনজি ভাড়া করে সোজা গিয়ে নামলাম লিজা ম্যানশানে।
আমাদের জন্যই ওরা ওয়েট করছিল বলল।ভিতরে নিয়ে গেলে আমি লিয়াকত ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। সারাদিন দুই পরিবারের মধ্যে অনেক কথা হল। এমন ভাল মুহুর্তেও আমার মনে কোন স্বস্তি-শান্তি ছিল না।
কারণ আমি তো রাত হলেই কষ্ট পেতে শুরু করি। ভালবাসার মানুষ টি এত কাছে তবুও তার কাছে আমি যেতে পারিনা। এখনো আমরা বৈধ স্বামি-স্ত্রী হতে পারিনি।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ভাবি-ভাইজান আমাদের অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।
ওখানে গিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া, সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। প্রচুর ফুল ছিটানো হয়েছে বিছানোর ওপর। আমার প্রিয় ফুল পলাশ, তারই উপস্থিতি বেশি ওখানে।
রেহেনা ভাবি কথাই কথাই রিমার কাছ থেকে হয়ত জেনে নিয়েছে যে এখনও আমাদের বাসর-রাত হয় নাই।তাছাড়া ভাবি একবার আমাকে দুপুরের দিকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার প্রিয় ফুল সম্পর্কে।
নিজের প্রতি খুব রাগ হলো। এতো সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। লাল টুকটুকে শাড়ি পরানো হয়েছে ওকে। দুর্ভাগ্য এতোসুন্দর বাসর সাজানো হলেও দুজন কে আলাদা থাকতে হবে।
একবার মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে রিমাকে জড়িয়ে ধরে মন ভরে আদর করি। ভুলে যায় সব বৈধ ও অবৈধ প্রশ্ন।কিন্তু কাছাকাছি হওয়াতে দেখলাম রিমার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।
আমি দিতীয় সেকেন্ড আর ওই কথা গুলা ভাবিনি। ওর পাশাপাশি বসে থুতনি টা হাত দিয়ে তুলে ধরলাম, চোখের জলটা নিজ হাতে মুছে দিলাম, শোনো যতদিন তোমার ডিভোর্স লেটারটা না পাঠাচ্ছি ততদিন যেমন দূরে আছি তেমনি থাকবো। তুমি একদম টেনশান নিয়োনা।
রিমা চোখ মোটা মোটা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ কোন রকম অভিব্যক্তি ছাড়াই। আমি উঠে যাচ্ছিলাম ও হাতটা ধরে বসালো। ঠোটে একটা গভীর কিস দিয়ে বলল, তুমি সত্যিই অনেক ভালো, যতই তোমাকে দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। তুমি আমার ভাবনা থেকেও অনেক বেশি ভালো।
তুষার নিজে প্রচন্ড তপ্ত আগুনে পুড়ছিল। নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে দুজনা আলাদা করে শুয়ে পড়ল।
ওইদিনের এমন কান্ডটা লিয়াকত সাহেব জানালা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। মনে মনে অনেক আপসোস করেছিলেন। ভাবেন সকালে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন রিমার ডিভোর্সের প্রসেস এখনও কেন সম্পন্ন করা হয়নি। নাকি টাকার জন্য আটকে আছে।
তুষার এতোটা চাপা স্বভাবের যে নিজের সমস্যার কথা কাউকে বলতে নারাজ। লিয়াকত মনে মনে ভাবে সেইতো আমার সবথেকে বড় উপকারটা করেছে, সেদিন যদি ট্রাক থেকে নেমে আমাকে না নিয়ে আসতো তবে এতসুখের জীবন আমি কখনও পেতাম না।
রেহানা মেয়ের গুনের কয়হা বলে শেষ করা যাবে না। তার তত্ত্বাবধানেই তো ডাক্তারি পরামর্শে আজ আমি সুস্থ্য জীবন যাপন করছি। কোনরকম যৌন সমস্যা আমার মাঝে আর বিরাজ করছেনা। সবই তো রেহেনার অবদান। আর রেহেনার কাছে পৌছানোর মুল দাবীদার তো তুষার সাহেব।
তুষার সারারাত ঘুমাতে পারেনা। একবার ভাবে লিয়াকত ভাইকে কি বল্লবে যে তার কিছু টাকা দরকার। ডিভোর্স সংকান্ত্র সমস্যা টিকে সমধানের জন্য। একদিন তো উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, যেকোন অর্থনৈতিক সমস্যার কথা তাকে জানানো হয়।
তুষার ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে লিয়াকত সাহেব কে ডেকে ছাদে যায়। একনিশ্বাসে বলে ফেলে তার সমস্যার কথা।
লিয়াকত ভাই সবকিছু শোনার পর তুষার কে টাকা দেয়, সেটা নিয়ে তুষার জমা দেয় উকিলের কাছে। উকিল জানায় দশদিনের মধ্যে বের করে দেবে।
দশদিন! এতোসময় কেন?
উকিলের ঝাজালো জবাব, তো কি এখনি দিয়ে দেবে কাগজ পত্র।
আসলে ব্যাটা কখনো এলএলবি পড়েইনি। উকিলের মুহুরী ছিল। থাকতে থাকতে নিজেই উকিল নাম নিয়ে ফেলেছে।এজন্য কথাতে কোন লজিক নাই।
তুষার বাসায় আসে। মনে মনে ভাবে যাকগা চার চারটি মাস যেতে পারল আর দশদিন কি এমন কষ্ট হবে। অবশ্যই যত কষ্টই হউক রিমাকে খুশি রাখতেই হবে। রিমা চাই আমাদের মিলনটা যেন বৈধ হয়।
রিমা এসে জিজ্ঞাসা করে আজ কে কি কাজে যাবে না?
দুদিন ছুটি নিয়েছিলাম, তুষার বলে থামে।
রিমা আসতে করে তুষারের হাতটা ধরে বলে, জানো মার জন্য খুব মন খারাপ করছে। ছোটো ভাই টাকেও খুব মনে পড়ছে। চোখের পানি আর বাধ মানতে চাইনা।
তুষার সব কিছু সহ্য করতে পারে, পারেনা কারো চোখের জল কে দেখতে। মুহুর্তেই তার মন নরম হয়ে যায়।
রিমা আবার বলতে শুরু করে তোমার মোবাইলে কি টাকা আছে? আমি মার সাথে একটু কথা বলব প্লিজ তুমি নিষেধ করনা।
তুষার মনে মনে ভাবে কি! মেয়েটা পাগল নাকি? ভয় ডর লজ্জ্বা, কিছুই কি নাই নাকি যে বাসাতে কথা বলতে চাচ্ছে?
শুধু এইটুকু বলল আসতে করে, যদি বাসায় কথা বললে সমস্যা হয়?
না কোনো সমস্যা হবেনা আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো, তারা মনে হয় সব কিছু মেনে নেবে।
আমার মনটা কিছুটা উৎফুল্ল হল।রিমার মেনে নেওয়ার কথা প্রসঙ্গে। ভুলে গেলাম লিয়াকত ভাইয়ের সতর্ক বাণী কে।
ফোনটা তার হাতে দিয়ে বাথরুমে গেলাম, ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ভিতর থেকেই জোরে জোরে কথা বলা শুনা যাচ্ছে। কৌতুহল বসত বাথরুমের দরজা খুলে দিলাম যাতে কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পারি।
দেখলাম খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে। এতোটাই অবাক হলাম বলে বোঝানো যাবেনা। মনে হচ্ছে এমন কোনো ঘটনা কখনও ঘটেনি। একবার শোনা গেলো তাকে বাসায় যাবার জন্য বলছে। সাথে এও বলল কোন সমস্যা হবেনা। তোমার আব্বা মেনে নিয়েছে।
আমি খুবই অবাক হলাম এজন্য যে, বাসা থেকে পালিয়ে আসার পর তো এটাই প্রথম কথা, অথচ কোন অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই। মা-মেয়ের এতো স্বাভাবিক কথা বার্তা ভাবা যাই?
অবাক হওয়ার মাত্রা বেড়ে গেলো, যখন দেখলাম ও ওর বাবার সাথেও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। নিজেকে খুব অসহায় ভাবে আবিস্কার করলাম।
কথা শেষ হতেই আমি প্রশ্ন করলাম, আশ্চর্য বিষয় তুমি ফোন দিলে এতকিছুর পরে তবুও তারা তোমাকে একটুও বকাঝকা করল না।
রিমা এতোক্ষণে একটা রহস্যময় হাসি দিল, আমাকে তারা অনেক অনেক ভালবাসে। আমার সব আবদার তারা মেনে নিতে রাজি আছে,। তাছাড় তুমি জানো আমি তাদের একমাত্র মেয়ে।
এবার তুষারের মাঝে কিছুটা সন্দেহ ভরা বিরক্তি এসে ভর করল। এর কারণ ও সমস্যার সমাধান খোজার চেষ্টা করল।
দুদিনপর রেহেনা ভাবি ও লিয়াকত ভাই ফোন দিল ওদের ওখানে যাবার জন্য বলল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিএনজি করে পৌছালাম ওদের ওখানে আড়তের সামনে। বকুল সরকার বলে এক কর্মচারী এসে বলল, ভাইজান ও ভাবিসাব দুজনাই বাসাতে আছেন, আপনেরে ওখানে যাইতে কইছে।
বাসাতে যাবার সাথে সাথে রেহেনা ভাবি  আমাকে নাস্তার টেবিলে বসালেন। সাধারণত বিকেলের দিকে আমি কিছু খায়না। অগত্যা দুইটি বিস্কুট ও একগ্লাস পানি খেয়ে থামলাম। কারো অনুমতি ছাড়াই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। পরপর দুইটা সিগারেট শেষ করলাম।
এই শীতের সময়ও আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছিল।
রেহেনা আপা হটাৎই বলে উঠল আজকাল কি বেশি বেশি সিগারেট টানা হচ্ছে মনে হয়।
আমি কোন উত্তর দিলাম না, মাথার মধ্যে ওই চিন্তা সুড়সুড়ি দিচ্ছিল।
কোনো সমস্যা আপনার, লিয়াকত ভাই উৎসুক ভঙ্গিতে জানতে চাইলো?
তুষারের হাসি মুখে না জবাব টাতে দুজনাই ভীষণ আশ্চর্য বোধ করলেন।
লিয়াকত ভাই বললেন তুষার ভাই যদি আমাকে আপন মনে করেন তবে আপনার শুভাকাংখী হিসাবে একটা কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম। অনুমতি পেতে পারি কি?
জী অবশ্যই, বলুন কি বলবেন? তুষার বলল।
আপনি যেদিন ভাবী কে আমাদের এখানে এনেছিলেন সেদিন ভাবী নাকি উনার বাড়িতে আম্মা, আব্বা, ভাই, বোন সবার সাথে কথা বলেছিলেন অনেক্ষণ যাবত ধরে। তই সমস্যা ওইখানে না। সমস্যা হলো কথা বলার ধরণ দেখে।আপনি কি এগুলা সম্বন্ধে জানেন?
তাছাড়া এমন ভাবে নাকি কথা প্রকাশ করছিল, এমন যে উনি আগের স্বামীর ঘরেই আছেন। বলছিল, বারবার একটি কথাই তা হল আম্মা আমি ভীষণ বড় ভুল করেছি। তোমরা আমাকে নিয়ে যাও, আমি এখানে অনেক কষ্টে আছি ইত্যাদি আরো অনেক কথা।
এই কথাগুলো আমি আপনার ভাবির মুখ থেকে শুনছি। বুঝছেন নি। মনে হয়েছিল আপনাকে এটা জানানো ফরজ তাই ডেকে আপনাকে জানালাম।
আমার নিজের কাছে খুব ছোট লাগছিল। তাই ওয়িদিন কার ঘটনাটি যেটা ভেবেছিলাম লিয়াকত ভাই কে জানাবো সেটা গোপন করলাম। মুখে শুধু বললাম, না তেমন কিছু ঘটবে না ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া রিমা আমাকে খুবই ভালবাসে। আমার জন্যই তো স্বামির ঘর ছেড়েছে। আপনি নিশ্চিত থাকেন।
লিয়াকত ভাই আবারো প্রসঙ্গ টানলো, আমিও চাই সে ধরণের কোন কিছু না ঘটুক। তবে আপনারে একটা অনুরোধ করি বড় ভাই হিসাবে, সেটা হলো ওকে বাড়িতে কথা বলা বন্ধ করে দিন, যদি জীবনে সুখি হতে চান?
আমিও মনে মনে এমন আইডিয়া করেছিলাম।
এবার প্রসঙ্গ পাল্টালাম। লিজার প্রসঙ্গ আনলাম। লিয়াকত ভাই কে বললাম ধানমন্ডি ল্যাব-এইড হসপিটালে নাকি একজন বিদেশি টনছিল স্পেশালিস্ট এসেছেন। এখনও সপ্তাহ খানেক থাকবেন। উনারা নাকি জন্মবধির চিকিতসা করে মুখের বাক ফিরিয়ে আনতে সক্ষম।আমার একটা পরিচিত ডাক্তারের মাধ্যমে কথা বলেছিলাম। ওইদিন আমি লিজার ব্যাপারটা উনাকে বলেছিলাম। উনি আমাকে রোগিসহ উপস্থিত হতে বলেছেন। এজন্যই মুলত আসা।
দেখলাম দুজনারই চোখ ঠিক ঠিক করছে। আমার কথা গুলা মনযোগ দিয়ে শুনছেন।আমার মনে হয় ওখানে একটু লিজা মামনি কে দেখালে ভাল হত।
লিয়াকত ভাই প্রথম বলাতেই রাজি হয়ে গেলেন। কারণ এই কয়েকমাসেই লিজাকে উনি অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছেন। যেকোন মুল্যেই লিজার মুখের ভাষা ফিরিয়ে আনতে চান। রাতের ডিনার করেই যেতে বলছিল, আমি রিমার কথা বলে এড়িয়ে গেলাম।
বাসায় পৌছালাম, রিমার মুখে সবসময়ই হাসি উপস্থিত ছিল।ওকে আমি ওর হাসি মাখা মুখের ওপর কোন অভিযোগ করতে পারলাম না।
এভাবে আমার আরও দুদিন পার হয়ে গেলে আমার সাব-লেটের আপা ইয়াসমিন আমার কাছে ফোন দিল, বলল ভাবি জানের দিকে একটু খেয়াল রাইখেন। উনার মতিগতি ভাল ঠেকছে না।
ও প্রায় আমার ফোন থেকে কাকে কাকে যেন ফোন দেয়, আর সবাই কেই শুধু বলে আমি অনেক অনেক বিপদে আছি। সাহায্য চাইলে করতে পারবি তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি কিছুই বললাম না, ফোনের লাইনটা আস্তে করে কেটে রেখে দিলাম।
মালিক আমাকে আজ সকাল সকাল ছুটি দিয়ে দিল।
তিনটার মধ্যেই বাসায় আসলাম। এসেই খাটে শুয়ে পড়লাম। আধা ঘণ্টা পরে ইয়াসমিন আপা আসলেন আমার ঘরে।
চেয়ারটা টেনে নিয়ে নিলেন নিজের হাতে। আমার মুখোমুখি বসে বললেন ভাবী বাইরে গেছে। আপনাকে খাবার দেয়?
হ্যা দেন।
খাবার দেবার পর আপা জিজ্ঞাসা করলেন, কই জানতে চাইলেন নাতো যে রিমা একা একা গেছে নাকি সাথে আরও কেউ গেছে। তাছাড়া ঢাকা শহরে গেল কোথায়?
আমি তখনও নীরব থাকলাম।
এবার উনি জানতে চাইলেন যে ঢাকা শহরে রিমার পরিচিত কোন বড় ভাই আছে নাকি?
না নেই তো কেন?
আজকে একটা ছেলে এসেছিল বাসাতে, লোক টা লম্বা ও অনেক ফর্সা। তার সাথেই রিমা বাইরে গেছে।
তুষার মনে মনে খুব রাগ করল তবে প্রকাশ করল না।
কিছুক্ষনের মধ্যেই রিমা চলে আসলো। হাতে কয়েকটি শপিং ব্যাগ। ব্যাগ গুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো এবং বাথরুমে গেলো কোন কথা না বলে।
ব্যাগের নিচে ঠিকানা লেখা ছিল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স। তাহলে কি রিমা বসুন্ধরা তে গিয়েছিল অথচ আমাকে একটি বারও বলার প্রয়োজন মনে করল না?
তুষার ভীষণ অবাক হলো, তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না। যখন তুষারের প্রচণ্ড রাগ হয় তখন সে তোতলাতে থাকে। তবে আজকে তার মুখ দিয়ে কোন কথায় বের হলো না। 
রিমা এসে নিজে থেকেই বলল, জানো হাসান ভাই এসেছিল আমাকে দেখতে, আর এগুলো উনি আমাকে কিনে দিয়েছে। তুমি তো জানো আসার সময় আমি কিছুই আনতে পারিনি। তাছাড়া তোমার কাছে তো এইমুহুর্তে তোমার কাছে টাকা বেশি নাই যে আমাকে পোশাক কিনে দিবে।
তুষার নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করল, কিছুই বলতে পারল না।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে টানতে ছাদে গেল। চোখের কোনায় পারি টলমল করছে। কাউকে কিছুই বলতে পারছেনা। মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদবে। সেটা সে নিজের কন্ট্রোলে আনলও আবাসিক এলাকা বলে। তবে তার দুঃখিনী মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারল না।
কতদিন হয়ে গেল মাকে দেখেনি। মা তার জন্য কিইনা করেছে। তাকে পড়ালেখা করানোর জন্য নিজে ধারদেনা করেছে। সুদের উপর টাকা নিয়ে তাকে দিয়েছে, যেন পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেয়ে সব দেনা পরিশোধ করে দিবে। কিন্তু কি করতে কি করে ফেলল। একটা মেয়ের প্ররোচনায় পড়ে আজ সে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন। তার বাবাও তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখত। সবার আশায় তুষার পানি ঢেলে দিয়ে আজ কত কষ্টে ভুগছে। এখন বুঝতে পারছে পৃথিবীতে বাবা-মা ছাড়া সন্তানের কষ্ট কেউ দাখে না।
রাগ করে আসার সময় মাকে বলেছিল, আমি বিয়ে খেতে যাচ্ছি। দুদিন পেরই চলে আসবো।
মায়েরা সন্তানের মনের খবর জানে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত একটা অসীম ক্ষমতা। এজন্যই বলেছিল, তোর বাবার কথায় রাগ করে চলে যাবি, জানি তুই আর ফিরে আসবি না। কিন্তু আমি কি ভাবে থাকবো এটা একবারও ভাবলি না। তোর জন্য আজ আমি এতো দেনার মধ্যে, আমি এসব ধারদেনা কিভাবে শোধ করবো। তোর বাবা বলেছে সে এক টাকাও দেবে না। যাইহোক যাচ্ছিস যা আমি আটকাবো না। তবে সময় মত খাওয়া দাওয়া করিস।
আজকে মায়ের সেই অশ্রু ভেজা আঁচল খানা তুষারের ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে। এসব কথা ভেবে তুষার অনেকক্ষণ একা একা কাঁদল।
হটাতই ছাদে ইয়াসমিন আপা ও ওনার ছেলে তারিক আদনান কখন ছাদে এসেছে তুষার বুঝতে পারেনি। তারিক আদনান তুষারের হাতটা পিছন থেকে না বলেই আচমকা ধরে ফেলল, মামা কি করো? মামা তুমি কাঁদছ কেন?
কই, না তো মামা। আমি কাঁদবো কেন? তুষার বিষণ্ণ ভাবে উত্তর দিল।
তুষার ভাই, আমার মনে হয় ওকে আটকাতে হলে ওর সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। নাহলে আপনাকে ভবিষ্যতে আরও অনেক কাদতে হবে।
তার কি নিজের বিবেক নাই, যে তাকে সব কথা বলতে হবে।
আপনি ওকে খুব ভালবাসেন তাই না? ইয়াসমিন আপা জিজ্ঞাসা করল।
আমি এতো কিছু বুঝিনা। আমি ওকে খুব খুব ভালোবাসি। আমার ভালবাসার গভীরতা এতোটাই যে তার চোখের উপর চোখ রেখে আমি ওকে কোন কথা বলতে পারিনা। আমি ওর মুখের হাসির জন্য সব কিছু করতে পারি। বড় কথা আমি ওকে প্রচণ্ড রকম বিশ্বাস করি।
ইয়াসমিন আপা এবার হেসে হেসে একটা কথা বলল, আমাকে যদি আপনার দুলাভাই এমন ভালবাসত তার জন্য আমার নিজেকে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলাম। আপনার মত সহজ-সরল মানুষ আমি পৃথিবীতে আমি খুব কমই দেখেছি।
ইয়াসমিন আপা আমার ঢাকাতে রাগ করে আসা থেকে সব বিষয় জানে। তাছাড়া তারিক আদনান কে আমি ফেলে আসা আমার  বড় আপুর ছেলে মানিকের মত করেই ভালোবাসি।
তারপরেও আপনি নিজের থেকে একটু তাকে সাবধান করে দেন, সেতাই মনে হয় ভালো হবে।
তুষার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
রিমা এবার আস্তে করে বলল, এই তুমি কি খুব রাগ করেছো? ঠিক আছে তোমাকে না বলে আর আমি বাহির হবো না। এবার একটু হাসো।
আমি স্বাভাবিক হলাম ওর প্রতিজ্ঞা বাক্যে।
এই দেখো, হাসান ভাই আমাকে একটা মোবাইল করেছে। এখন যেকোনো সময় আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। যেখানেই যাই না কেন তোমাকে জানিয়ে জেতে পারবো।
এবার আমার বুকের মধ্যে কে যেন মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড টাতে জোরে জোরে আঘাত করছে। মোবাইল গিফট পাওয়া দেখে আমি শুধু বললাম উনি দিল আর তুমি নিয়া নিলা।
হ্যা, উনি তো আমাকে গিফট করেছেন কেন নিবো না?
মেজাজ এবার আমার চরমে উঠে গেলো। তারপরেও নিজে কে অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখলাম এটা দেখে যে ভালবাসার মানুষ টা কত খুশি খুশি লাগছে আজকে। আমার কষ্ট তাকে বুঝতে দিলাম না।
জানালা দিয়ে শুধু ইয়াসমিন আপা বুঝলেন আমার কষ্ট টাকে। আমাদের রুমে এসে বসলেন, রিমা কে কিছু বলতে চাচ্চিলেন। আমি ইশারায় নিষেধ করলাম।
উনি আর কিছু বললেন না। আমাকে ইশারা করে উনার ঘরে যাবার জন্য ডাকলেন।
আমি গেলাম না। রিমা কে বললাম, শোন এভাবে উনার কাছ থেকে তুমি ফোন নিলে সেটা আমার কাছে কেমন লাগবে। তুমি বরং অনাকে ফোনের দামটা দিয়ে দিয়ো। তাহলে এটা একেবারে তোমার হয়ে যাবে।
রিমা কিছুটা রাগের ভঙ্গিতে বলল, ঠিক আছে।
পরেরদিন সকাল বেলা কাজে যাওয়ার আগে ইয়াসমিন আপার কাছে গেলাম। উনি আমাকে বসতে বললেন।
কিছুক্ষণ পর দুকাপ কফি এনে এককাপ আমাকে দিলেন, এককাপ উনি নিয়ে খেতে শুরু করলেন।
কি মন খারাপ নাকি, তুষার ভাই? উনার প্রশ্ন।
না মন খারাপ নয়। ইয়ে মানে আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা। ভীষণ লজ্জারও ব্যাপার। 
উনি এবার আমার কাছ ঘেঁষে বসলেন, কি বলুন না?
আমি কিছুটা ইতস্ত বোধ করলাম। বললাম, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেন?
টাকার কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন, মুখের অভিব্যক্তি চেইঞ্জ হয়ে গেল।
আমি চলে আসতে চাচ্ছিলাম উনি দাঁড়াতে বললেন। কিছুক্ষণ পরে একটি টাকার বান্ডেল এনে আমাকে বললেন, কত টাকা দরকার।
হাজার বারো হলেই হবে, মনে হয়ত অই ফোন তার দাম বারো হাজারের উপরে হবেনা।
উনি আমাকে পনেরো হাজার টাকা গুনে গুনে দিলেন, বললেন যদি দাম ওর থেকে বেশি হয় তাই রাখতে বললেন।
আমি টাকা টা রিমার হাতে দিয়ে বললাম, ওনাকে দিয়ে দিও মনে করে।
এভাবেই চলছিল, এদিকে রিমার মোবাইলে কথা দেখা করা, তাদের সাথে ঘোরা বাড়তে লাগল। এখন আর শুধু হাসানের সাথে কথা বলে না, এখন অন্যান্য অনেক ভাইয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগলো।
হটাৎ একদিন বাসাতে এসে দেখল রিমা নাই। ইয়াসমিন আপাকে জিজ্ঞাসা করা হলে উনি বলল, আমি নিষেধ করেছিলাম, রিমা বলেছে তার ইচ্ছে হলে যা খুশি করবে তাতে যেন আমি নাক না গলায়। আপনি নাকি তাকে পুর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন।
আমি আপাকে বললাম ঠিক আছে।
খুব ক্লান্তি লাগছিল, তাই একটু শোবার জন্য বিছানাপত্র একটু ঝাড়তে গিয়ে বিছানার নিচে ৬ টা স্টার সিনেপ্লাক্সের ইংলিশ মুভি দেখার টিকিট পেলাম। মাথা চক্কর দিতে লাগল। তার সব বিশ্বাস যেন আজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে সিডরের তাণ্ডব শুরু হলো। আইলার ঝড়ের বেগে তার হৃদয়ে আঘাত করতে থাকল। নিজেকে খুবই বাজে মনে হতে লাগলো।
সমস্ত বিশ্বাস আজ এখানে থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু নিজে ভেঙ্গে পড়লো না। মনে মনে ভাবলো, একটা লোক যদি তার সহযোগী হয়, এবং একসময় যদি সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় তবে তাকে হাত বাড়িয়ে  উঠিয়ে নিয়ে চলায় হচ্ছে মানসিক কাজ একজন বিবেকবান মানুষের।
তার ভালবাসার মানুষটি যদি অসৎ সঙ্গে সামান্য পথ বিচ্যুত হয়ে থাকে তাকে শুধরানোর দায়িত্বও কিন্তু তার নিজের। যেহেতু তার সব দায়িত্ব সে নিজে নিয়েছে।
সেদিন বাসাতে রিমার ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায়। সেদিন প্রথম তুষার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে। এবং এক পর্যায়ে দুজনার মধ্যে একরকম উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে থাকে। একপর্যায়ে তুষার রিমাকে একটা থাপ্পড় দেয়। এবার দুজনার কথায় বন্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
রিমা কাঁদতে থাকে একনাগাড়ে।
সারাটি রাত তুষার নিজেকে খুব পাপী বিবেচনা করেছে। ভেবেছে কখন সকাল হবে কখন তার কাছে সরি বলা হবে। ভাবে সকাল হলেই ক্ষমা চাইবে, জান তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি আসলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।
সকালে নামাজের পর মোনাজাতের বিষয় ছিল কান্না জড়িত কণ্ঠে রিমা প্রসঙ্গে।
নামাজ শেষ হলে তুষার ভাবে রিমা জাগলে তাকে বলবে জান তুমিও আমাকে কষে একটা  থাপ্পড় মারো যাতে আমিও অমন কষ্ট পায়।
দেখে রিমা সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। তার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে যেকোন মানুষের কষ্ট নিমিষেয় দূর হয়ে যাবে। একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি। মনে হচ্ছিল এখনই প্রাণ ভরে রিমা কে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু বাধা এখনও একটা ডিভোর্স পেপার।
তুষার ভাবে ঘুমাক অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদছে বেচারি, এখন আর তার আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর প্রয়োজন নেয়। বরং কাজ থেকে ফিরে এসে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।
কাজে এসে তার মন টেকে না। বারবার ভুল করে ফেলে। মালিক তুষারের খুব ভক্ত। ২ টার দিকে একটা বড় ভুল করলে মালিক একান্তে তুষার কে ডাকে, তুষার, তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ যে বাব্রবার ভুল করে ফেলছ। আমাকে বল, মনে করতে পারো আমি তোমার বন্ধুর মত।
অনেক রকম আশার বাণী শোনার পর তুষার মালিক কে সব কথা খুলে বলে।
মালিক বলে, তুমি এখন বাসায় চলে যাও, তোমার তিনদিন ছুটি নাও আমি তোমাকে ছুটি দিচ্ছি। ভাবীকে নিয়ে একটু ঘুরো ঢাকা শহরে।  ভাবী রুমের মধ্যে একা একা থাকতে থাকতে অমন হয়ে গেছে। চিন্তা করনা একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। 
আর শোন এই টাকা গুলো রাখো বলে হাজার পাচেক টাকা বের করে তুষারের হাতে ধরিয়ে দেয়।
তুষার খুশি মনে বাড়িতে আসতে আসতে ভাবে আজকে মনে হয় আমার অর্থভাগ্য ভালো। আশার পথে রিমার যা যা পছন্দ সবগুলো কিনে আনে।
রাস্তার মধ্যেই লিয়াকত ভাইয়ের ফোন আসে, কি মিয়া ভালো আছেন নি?
তুষারের মন টা খুব ফুরফুরে ছিল তাই জবাব দেইও হাসতে হাসতে, হ্যা হ্যা খুব ভালো আছি।
তুষারের হাসিটা শুনে লিয়াকত ভাই ওপাশ থেকে বলে আহারে আজকে আমার প্রাণটা জুড়ায়ে গেলো। শোন মিয়া আগামি কাল কে হচ্ছে আমার লিজা মামনির ৬ষ্ট জন্ম বার্ষিকী পালন করমু ধুমধাম করে। তুমি কিন্তু সকাল সকাল ভাবিরে লইয়া হাজির হইবা। মনে থাকবনি?
হ্যা হ্যা অবশ্যই যামু। লিজা মামনির জন্মদিন আর আমি যামুনা, এটা কি হয়!
রিক্সা ডেকে সোবহান বাগের দিকে যাবার জন্য, এবার ফোন আসে উকিলের নাম্বার থেকে। কিছুটা খুশির মাত্রা বেড়ে যায়। উকিল সাহেব জিজ্ঞাসা করে আপনি এখন কোথায় আছেন? আমি বলি বিএমআই নাম বলি। উনি আমাকে বলেন আপনি ওখানে থাকেন, আপনার জন্য সুখবর আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে উনি এসে আমাকে একটা কাগজ দেয় বলে, এই নেন আপনাদের বিয়ের সার্টিফিকেট। এখন আর কোন বাধা নাই। বলে উনি চলে যান।
আমি এবার প্রচণ্ড রকম খুশি হয়ে যায়, ভাবি কতদিন পরে আজকে রাতে আমার ভালবাসার মানুষের সান্নিধ্যে যেতে পারবো। তাকে আমার বুকের সাথে নিয়ে আদর করতে পারবো। আসার পথে রিক্সায় বসে এমন হাজার খানেক চিন্তা করেছিলাম।
হটাত মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ আটকে গেলো, ইয়াসমিন আপা ৯২ বার ফোন দিয়েছে। যা এখন স্ক্রিনে মিসড কল হয়ে রয়েছে। সেট সাইলেন্ট মুডে ছিল বলে বুঝতে পারিনি।
কিন্তু একটা জিনিষ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াল যে ইয়াসমিন আপু এতবার ফোন দেবার কারণ কি? উনি তো সচরাচর আমাকে এই টাইমে ফোন করেন না। তাছাড়া উনি জানেন যে আমি এই সময় কাজে ব্যস্ত থাকি। নাকি কোন দুর্ঘটনা, না না আমি এসব কি ভাবছি। আমার রিমার কিছুই হতে পারেনা।আমার মাথায় কোন কাজ করছিল না। রাতের কথা ও সকালের কথা গুলো দৃশ্যটা মনে করে মাথা হ্যাং হয়ে আসছিল। এসব চিন্তাতেই পৌছালাম দরজার কাছে।
আজকে কলিং বাজাতেই ভুলে গেলো তুষার বাইরে থেকেই রিমা রিমা করে চিৎকার করতে থাকে আড়ষ্ট গলাতে। তুষারের গলাটা ধরে আসছিল। দরজা জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। ইয়াসমিন আপুর ছেলে তারিক আদনান দরজা খুলে, বলে ফেলল মামা, আন্টি আর নাই।
তুষার কি বলবে বুঝতে পারে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। মনে মনে বলতে থাকে রিমা তোমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।
ইয়াসমিন আপু একটা চিঠি এনে তুষারকে দেয়, যেটা রিমা লিখেছে। চিঠির ভাষা টা এমন ছিল-
প্রিয় তুষার
জানি তুমি আমাকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসো। এজন্য তোমার কাছে আমার একটা চাওয়া। জানি আমি যদি তোমার কাছ থেকে তোমার হৃদপিণ্ড টাও চাই, তুমি টা দিতে দ্বিতীয় সেকেন্ড ভাববে না। চাওয়ার কথাটা পরেই বলি। তোমার সাথে দীর্ঘ পাঁচটি মাস কাটিয়েছি। আমার কোন শখ আহ্লাদ তুমি পূরণ করতে পারনি। পুর্বে আমার যেখানে বিয়ে হয়েছিল তারা অনেক ধনিলোক। তাদের তুলনায় তুমি কিছুই নও। আবেগ দিয়ে ভালবাসা যায় কিন্তু ঘর বাধা যায় না। এটা আজ আমি বুঝতে শিখেছি। তোমার কাছে থাকলে আমাকে তুমি কখনও সুখি করতে পারবে না। হয়ত সুখি করার সর্বচ্চো চেষ্টা করবে। ভালবেসে সুখি করতে না পারলে সেটাকে ভালবাসা বলেনা। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যে নাই টা নয়, আছে তবে অগননাযোগ্য। 
আমি সবসময় আনন্দ আহ্লাদ ও স্নেহের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। সেগুলো মিস করে আমার এখানে থাকা সম্বব হচ্ছে না। তাছাড়া তুমি আমাকে এখনই গায়ে হাত তোলা শুরু করেছো, না জানি ভবিষ্যতে কত অত্যাচার আমায় করবে। তোমার ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে এসেছিলাম তোমার কাছে। আমার প্রতি দুর্বলতা অনেক গভীরে। তোমার ভালোবাসার মাপ আমি চাইনা, কারণ তা গভীর থেকে গভীরতর, অসীম  আকাশের মত। আমার ভালোবাসার মাপ তোমাকে দিতে পারি। কারণ আমি তোমাকে কখনও মন থেকে ভালবাসিনি। স্বার্থের জন্যই তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল। আমি যেখানে আটকা পড়েছিল সেখান থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনের জুড়ি ছিলনা।
এজন্যই তোমার সাথে আমার কোন শারীরিক সম্পর্ক হতে দেইনি। আজকে উকিলের কাছ থেকে নোটিশ জানানোর জন্য ফোন এসেছিল। এতক্ষণ হয়ত তোমার কাছে আমার পূর্বের তালাক নামার পেপার টা পৌছে গেছে। তুমি হয়ত আজকে খুব খুশি হবে। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছিনা। এজন্য আমার সরে যাওয়া। আমি তোমার অভাবি জগতে অবসর নিলাম। আমাদের বিবাহ নাটকের একটা ফটোকপি হয়ত তোমার কাছে আছে। ছিরে ফেলো। এটাই চাওয়া। চাওয়াটাকে একটু বর্ধিত করে বললে, বলতে হয় আমাকে ভুলে যেও। মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়ো না কারণ তাহলে আমার আর হাসানের জীবনে স্বাভাবিকতা বিকৃত হবে। শেষে একটি কথা বলে শেষ করবো, তোমার কথাটাই আজ তোমাকে বলব, মনে আছে তুমি বলতে, ভালোবাসা মানে আমার কাছে হল, ভালোবাসার মানুষ টাকে সুখি করা। প্লিজ আমার সুখের জন্য যা করার দরকার তা তুমি বেঁচে থেকে করবে। প্রমিজ করো।
ইতি
তোমার রিমা
চিঠি টা বার কয়েক পড়ে তুষার সেন্সলেস হয়ে যাই। রাতেই ডাক্তার দেখে যাই। হাল্কা সুস্থ হয়। সারা রাত ধরে উল্টা পাল্টা বকতে থাকে। ইয়াসমিন আপু সারারাত তুষারের পাশে বসে কাটায়। ইয়াসমিন মনে মনে তুষার কে পছন্দ করত। ওর স্বামি বেশির ভাগ দেশের বাইরে থাকে। তিন-চার মাস পরপর আসে তো মদ খেয়ে সারাআরাত সারাআদিন ঘুমায়। একটু টাকে ভালোবাসার জন্য তার দিকে তাকায় না। এজন্য তুষার কে নিয়ে নতুন করে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে। রিমার অনুপস্থিতে সেই চাওয়া টা প্রবল হয়ে উঠে।
উনারা যে বাসাতে থাকে সেটা ইয়াসমিন আপার নামে লিখে দিয়েছেন ইয়াসমিন আপার বাবা। ওর বাবার দুইটা বউ। তাই ওখানে থাকেনা। স্বামিকে নিয়ে এখানে থাকতেন। কিন্তু ওর স্বামীটা একেবারে খচ্চর। একটুও ভালবাসে না।
তুষার যেমন করে রিমা কে ভালবাসত তা দেখেই তুষারের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেছে। সারারাত তুষার কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। ওইদিন তুষারকে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল। তাই বুঝতে পারেনি তুষার।
পরেরদিন রাতেও ইয়াসমিন উনার সাথে ছিলেন। তুষার হাল্কা হাল্কা জেগে ছিলেন, তাই যখন ইয়াসমিন আপা উনাকে জড়ায়ে ধরে তখন তুষার নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তখন ইয়াসমিন আপা তুষার কে উষ্ণ আহবান জানান। তুষার নিজেকে কনট্রোলে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অনেকদিনের খুদা সে মিটিয়ে নেয় ইয়াস্মিনের কাছ থেকে।
পরেরদিন রাতে ভাবে কখন ভোর হবে, এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় আজানের ধ্বনি কানে আসে। তখনি ইয়াসমিন আপা, লিয়াকত ভাই কিংবা, রেহেনা এবং ফার্স্ট ফুডের মালিক কাউকে না জানিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।
                                  সাত বছর পর
সময় অনেক গড়িয়েছে, ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের সেই ফার্স্ট ফুডের দোকান এখন আর নেই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় আসলে দলীয় ক্যাডার রা ফার্স্ট ফুডের দোকানের মালিক ইউনুছ ভাইকে খুন করেছে ছাত্রলীগের ছেলেরা। দখল করেছে তার মালিকানা, ঢাকার প্রতিটা জায়গায় খুন হচ্ছে ডিজিটাল কায়দায়। বিরোধী দল বিএনপির সব নেতাদের নামে দুর্নীতির মামলা করে জেলে আটকে অত্যাচার করছে। দলীয় নেতাদের নামে যেসব দুর্নীতির মামলা ছিল তা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে সাথে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট সহ। পুলিশ ও র্যা ব বাহিনী বেপরোয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। বিদেশি চক্র শামিল হচ্ছে তাদের সাথে। ভারত কোন ঠাসা করে ফেলছে আমাদের। সব সংযোগ নদীতে বাধ দিয়ে মরুভুমি করে ফেলছে আমাদের কে। প্রতিদিন সীমান্তে খুন করছে বাঙালিদের। তিস্তা নদীতে বাধ দেওয়া রুখতে যে ব্যক্তি আন্দোলন শুরু করেছিল সেই ইলিয়াস আলি কে গুম করে ফেলল তারা। হাজার হাজার শিক্ষক কে চাকরি থেকে অবসরে পাঠাল মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই কারণ তারা বিএনপি সাপোর্ট করে। যে মেহেরপুরে কখনও দুর্নীতির ঘটনা গন্মাধ্যমে আসে নাই সেই মেহেরপুরের দুর্নীতির খব্রর প্রথম-আলো তে শিরনাম হায়ে ছাপা হলো। মেহেরপুরের জয়নালের দুর্নীতির আলোই আলোকিত। অগছিত মন্ত্রীসভা দেশটাকে ডিজিটাল বিশৃঙ্খলার দেশ তৈরি করে চালাচ্ছে। পথের ট্রাফিক পুলিশ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত উৎকোচে উৎসাহিত। হটাত করেই আবার ঢাকাতে তুষারের পুনর্বাসন হয়। তুষার মনে মনে খুজতে থাকে লিয়াকত ও রেহেনা ভাবিদের কে। মধ্যবাড্ডার সেই আড়ত এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কারযালয়। এবং বাসাটাতে এখন উনারা থাকেন না। খোজ নিয়ে জানা যায় ওখানে এখন থাকেন যুবলীগের গুলশান এলাকার সচিব গোলাম আব্বাস ।
 লিজা ম্যানশানের নামটা উঠিয়ে ওখানে ফারজানা নিকেতন লেখা হয়েছে। মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম। এতবছর পরে এসে এমন কষ্ট পাবো ভাবতে পারিনি।
বাসাটির উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে, ভিতরে ঢুকে তেমন কাউকে পেলাম না, পুরো রুমগুলো মনে হচ্ছে মদ খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসলাম, নিজের দারওয়ান কে জিজ্ঞাসা করলে উনি তুষার কে বলল, বাবু এখানে কেউ থাকে না, এটা রাতে মদ খাওয়া, মেয়েদের সাথে ফুর্তি করার জন্য মালিক ব্যবহার করেন।
আচ্ছা বলতে পারবেন ফারজানা টা কে?
হ্যা কেন নয়। ফারজানা হচ্ছে আব্বাস ভাইয়ের বিবি। উনারা আগে এখানে থাকতেন, বছর দুয়েক হবে উনারা আলাদা থাকেন।
আচ্ছা এই বাসাটার নাম আগে লিজা ম্যানশান ছিল এটা কি আপনি দেখেছেন?
হ্যা বাবু দেখেছি, আমি যখন আসলাম তার পরেই তো নামটা চেইঞ্জ করেছে।
আচ্ছা এটা বলতে পারবেম কি আগে যারা এখানে ছিল, তারা এখন কোথায়, মানে বলছিলাম যাবার আগ কি বলে গেছে?
না বাবু আমি এসেই দেখি উনারা এখানে থাকেন। তবে যখন নাম চেইঞ্জ করেছে তখন বুঝতে পারছি এই বাড়িটা উনি কারো কাছ থেকে দখল করেছেন।
এখন এটা বলেন উনার ফ্যামিলি কোথাই থাকে?
সাহেব তো কিছুদিন আগে বিদেশ গেছেন, আম্মাই যে কোথায় থাকে সেটা আমি জানিনে। তবে এটা জানি উনি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসাবে আছেন। নামটা হচ্ছে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি। ম্যাথ ক্লাসটা উনি নেন। 
আমি উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসলাম। এবার তার চাকরিটা সোনালি ক্যারিয়ারে পরিপূর্ণ। এখন সে একজন নামীদামী আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার। তখনি তুষার পড়াশোনা করতো, তবে কাজের চাপে এবং রিমা তার জীবনে ফিরে আসাসহ অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য পড়াশোনাতে ছেদ পড়ে।
রিমা যখন চলে যায় তার কাছ থেকে তখন ভেবেছিল তার আর বাঁচা হবেনা। মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েও মরতে পারেনি, রিমার শেষ অনুরোধ রক্ষা করবে বলে। হটাত কানাডা স্কলারশিপ পেয়ে যায়, চলে যায় কানাডা তে। বিএসসি শেষে ওখানে চার বছর চাকরি করে ফিরে আসে বাংলাদেশে, সেই ঢাকা শহরে। কানাডাতে যাবার সময় লিয়াকত ভাইকে বলে যাওয়া হয়নি। প্রতিদিন মনে পড়ত। ফোন নাম্বার মনে না থাকায় কল দিতে পারেনি। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেই লিয়াকত ভাইয়ের সাথে একবার হলেও দেখা করবে।লিজার কি অবস্থা সেটাও জানার খুব ইচ্ছে জাগে মাঝে মাঝে।
এজন্যই সব অভিমান ভুলে দেশে আসা। কিন্তু এসব কি অবস্থা। দেশে শুধুই কি দুর্নীতি হয় সবখানে।
এভাবে প্রায় দুবছর তুষার তাদের খুজতে থাকে। একদিন তুষার একটা ফ্রেন্ডের সাথে বসুন্ধরা শপিং মলে যায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও। তুষার সপ্তম তলাতে  রেলিং স্ক্রিলের ব্যান্ডে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ ছিল নিচ তলার ফল্ডিং স্টেপের চলন্ত সিঁড়ির মানুষ গুলোর মাঝে রেহেনা ভাবী, লিয়াকত ভাই কে খুজছিলাম।
হটাতই চোখ আটকে গেলো একটা চেনা মুখে। কিছুটা চমকে গেলো তুষার। দেখে রেহেনার মুখটা। কিন্তু তার দুই পাশে দুইটা মেয়ে ছিল। একটার বয়স ১৪ হবে অন্যতার বয়স ৬ হবে আর কি।
তুষার দ্রুত লিফট করে নিচে নেমে যায়। ভুল করে প্রথমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে যায়। নিজের এই ভুলতার জন্য নিজে নিজের ওপর রাগ করে তবে পরক্ষণেই দক্ষিণের রাস্তাটিতে রাস্তার সামনে ওরা তিনজন একটা গাড়ীর সামনে দাড়ায় এটা দেখতে পাই তুষার। ছোট মেয়েটার নাম লিমা বলে ডাক দিল শুনলাম। ওই মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে। মেয়েটাকে খুব আপন আপন মনে হচ্ছে। কেন এমন লাগছে মনে তা বুঝতে পারছি না। লিজা কে দেখলাম অনেক বড় ও সুন্দর হয়ে গেছে। রেহেনা ভাবির দিকে এবার লক্ষ্য করলাম, হ্যা অনেক পরিবর্তন হয়েছে তবে শরীরের সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে।
এবার সামনে দাড়াতেই চিনে ফেলল, তুষার ভাই না?
তুষারের মুখে প্রত্যাশিত হাশি ফিরে এলো। হ্যা আমি তুষার। আপনাদের আমি দুই বছর থেকে খুজছি। অনেক জায়গাতে খুজেছি, কোথাও পাইনাই। এখানে আপনাকে এভাবে পাবো বিশ্বাস করতে পারিনি।
অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হতাৎ বড় মেয়েটা ডেকে উঠলো আম্মু চলো, বাসায় যাবে না?
আমি অতি আশ্চর্য হলাম তবে প্রচণ্ড মাত্রায় খুশি হলাম যে লিজা মামুনি এখন কথা বলতে পারে! 
রেহেনা ভাবী বললেন লিজাকে, লিজা বাইরে এসো মামুনি। দেখো তো চিনতে পারো কিনা?
বাইরে এসে কিছুক্ষণ আমাকে দেখার পর বলল, এটা তুষার চাচ্ছু না?
রেহেনা ভাবী, এবার বলল হ্যা এটা তোমার তুষার চাচ্ছু যাকে তোমার আব্বু খুব ভালোবাসতো। যার কথা তোমাদের খুব করে বলত। তুমি যার কোলে সবসময় থাকতে চাইতে।
এবার লিজা আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরল, চাচ্ছু তুমি কোথায় চলে গিয়ে ছিলে আমাদের ছেড়ে। এতদিন কেন আমাদের খোজ নেও নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেসব প্রশ্নের উত্তর ছিল শুধুই নিরবতা।
আমি এপাশ ওপাশ করছিলাম সেটা রেহেনা ভাই বুঝতে পারছিল, তাই আমাকে কিছুটা সময় দিতে চাইলেন। ড্রাইভার কে বললেন, লিমা ও লিজা মামুনিদের নিয়ে যাও। আমি পরে ফিরবো। 
ড্রাইভার যাওয়ার পর একটি ক্যাব ভাড়া করতে বললেন, ক্যাব আসলে ভাবী বলল, বুড়িগঙ্গা নদীতে যেতে।
ঢাকা শহরের ভিড় ঠেলে বুড়িগঙ্গা আসতে আমাদের রাত এগারো টা বেজে গেলো। সেই মুহূর্তে সবাই ফিরে যাচ্ছিল। আমরা একটা নৌকা ভাড়া করতে গেলে নৌকা মালিক বলছিল এখন হবেনা। পরে রেহেনা ভাবী কে দেখার পর উনি বললেন, মামনি তুমি নৌকা নিবে, তাহলে নাও আমি ঘুমাতে যাচ্ছি, তোমরা নৌকা এই জাগাতে বেধে চলে যেও।
দুজনে নৌকাতে উঠেছি অনেকক্ষণ, কোন কথা নেই।
তুষার বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারেনা, তাই শুরু করল, লিয়াকত ভাই কোথায়?
রেহেনার দুচোখে তখন শ্রাবণের ধারা ঝরছে। আমি বোকার মোট প্রশ্ন টি আরেকবার করে ফেললাম।
এবার রেহেনা আপা আর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা।
আজ ছয় বছর হয়ে গেলো উনি আমাকে একা করে চলে গেছেন। হয়ত ওই জগতে উনি শান্তিতেই আছেন, কিন্তু আমি তো একবিন্দুও শান্তিতে নাই। উনি মারা যাবার সময় বলেছিলেন আপনাকে খুজে বের করতে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আপনি যেদিন লিজার জন্মদিনে উপস্থিত হতে পারেননি,  
পরের দিন সকাল সকাল আমরা যখন আপনার বাসাতে যাই তখন আপনার সাব-লেটের ইয়াস্মিন আপা খুব কান্না করছিলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন সব ঘটনা। আপনার ভাইজান খুব কষ্ট পাইছিলেন।
ভাইজান কি অসুস্থ হয়ে ছিলেন?
না তিনি অসুস্থ ছিলেন না তাঁকে অসুস্থ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী মহাজোট ক্ষমতায় আসলে তার ছাত্র সংগঠন ও যুবলীগের নেতাদের সাথে আপনার ভাইয়ের ছোটো একটা গণ্ডগোল বাধে। তারা আপনার ভাইজান কে আড়ত থেকে বিতারণ করেই ক্ষান্ত হননি। উনাকে একদিন বাসা থেকে তারাই, সেদিনই প্রথম আপনার ভাই প্রতিবাদ করেছিল। বাসা টা ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। শুধু বলছিলেন আমি এখান থেকে যামুনা গেলে আমার ছোটো ভাই এসে আমাদের খুজে পাবেনা। তোমার কথা বারবার বলছিল। একদিন রাতে তোমার ভাই কে বাসা থেকে ডেকে নিয়া যায় যুবলীগের গুলশান এলাকার আব্বাস মাস্তান। আপনার ভাইকে মেরে ফেলে রেখেছিল আশুলিয়ার বিলে। সেখান থেকে পুলিশ আনে হাসপাতালে। তারপর আর উনি সুস্থ হতে পারেন নি। তোমার ভাই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি চিন্তায় পড়ি। আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। খুব অসহায় হয়ে যখন দিন কাতাছিলাম তখনি আসে আপনার সাব-লেটের আপা ইয়াস্মিন। উনি আমাকে টাকা দিয়ে অনেক টা হেল্প করে। একমাস পরে যখন তোমার ভাই অল্প অল্প সুস্থ হয় তখনি আবার খবর আসে ইয়াস্মিন আপা আমাদের ডাকে।
দেড় বছরের একটা মেয়ে সন্তান আমার কোলে তুলে দেয় এবং বলে এটা নাকি আপনার বাচ্ছা। যাকে আমি লিমা নামকরণ করে মানুষ করছি।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে যায় বলি অসম্ভব এটা হতে পারেনা।
কিন্তু এটাই হয়েছি;ল সীদিন রাতে। যেদিন তুমি খুব অসুস্থ হয়েছিলে। ইয়াসমিন আপা আপনাকে খুব পছন্দ করত তাই উনি ঘুমের ওষুধ খাওয়াইছিল এবং উনি উনার প্রশান্তি লাভ করে ছিল আপনার দারা।
আমি কিছুটা অতীতে ফিরে গেলাম, সেদিনের কথা মনে পড়ছিল, যেদিন ইয়াসমিন আপা আমার কষ্টের ভাগীদার হতে চাচ্ছিলেন। আমার অসুস্থতা কে আমার সম্মতি বলে হয়ত ব্যবহার করেছেন।
রেহেনা আপার উপর খুব ঘৃণা কাজ করছিল প্রথম প্রথম কিন্তু পরে যখন শুনলাম উনি আপনার জন্য উনার স্বামী কে ছেড়েছেন। সর্বোপরি উনি আপনার বাচ্ছা কে জন্ম দিয়েছেন। মারা যাবার সময় যখন বলেছিলেন আমি তুষার কে পাইনি তো কি হয়েছে তুষারের সন্তানের মা হতে পেরেই ধন্য। সেদিন থেকে উনাকে ঘৃণার বদলে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এসেছি। আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন ফিরে আসবেন অন্তত আপনার সন্তানের টানে। ইয়াসমিন আপাও বলত আপনি একদিন না একদিন আসবেন!
আমিও এবার আর রাগ করলাম না ইয়াসমিন আপার উপর বরং স্বীকৃত দিতে ইচ্ছে করছিল। লিমা কে এখন খুব আরেকবার দেখতে মন চাচ্ছিল। এজন্য যখন বসুন্ধরা সিটি শপিং কম্পলেক্সে দেখেছিলাম তখনি বুঝেছিলাম যে এর সাথে মনে হয় আমার কোন রক্তের সম্পর্ক আছে। মনটা খুব উপফুল্ল হচ্ছিল বুঝলাম। পরক্ষনে রেহেনা আপার দিকে নজর যেতেই আবারও লিয়াকত ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল।
তারপর কি হল। আমি প্রশ্ন করলাম।
ইয়াসমিন মারা যাবার সময় তার যাবতীয় সম্পত্তি আপনার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। আপনার ওয়ারিশ হিসাবে সব কিছুর মালিক হতে পারবে লিমা। উনি মারা যাবার আগে আমাদের মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসাতে রেখে গেছেন। উনার ব্যবসার দায়িত্বও আমাকে অস্থায়ী ভাবে দিয়ে গেছেন। আপনার ভাইজান ব্যাংকে প্রায় বিশ কোটি টাকা জমা রেখেছিলেন এবং দুইটা প্রিমিয়াম করেছিলেন যেটা থেকে আরও আট কোটি টাকা পেয়েছিলাম। আপনার নামে উনি একটা অংশীদারি ব্যবসা করছিলেন যেটার মালিক একমাত্র আপনি। সেটা ও আমি অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব পালন করছি। যেটার বর্তমান মোট অর্থ চারশ কোটি টাকা। এগুলো সবই আপনার। 
অর্থনৈতিক কারণের দোহায় দিয়ে একদিন আপনার প্রিয় মানুষ টা আপনাকে কষ্ট দিয়ে চলে গেছে। এসব বিষয়ে উনি সব জানতেন। এজন্য খুব আপসোস করতেন। উনি এভাবে বলতে লাগলেন।
নৌকা বাইতে বাইতে কতদুর এসছি জানিনা। ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বাজে। সেদিন চাঁদ উঠেছিল রাত একটার দিকে। চাঁদের আলোর প্রতিফলন পানি থেকে ফিরে গিয়ে রেহেনা ভাবির ফর্সা অবয়বে মিশে গিয়েছিল। অসাধারণ লাগছিল। মনে হচ্ছিল পূর্ণিমার চাঁদের এক খণ্ড নৌকাতে খসে পড়েছে। গভীর দৃষ্টি তে কয়াল মেঘের ছায়া। দুরের বস্তিতে কুপির মত আলো গুলো সরিষার ফুলের মোট চিকচিক করছে। 
কথা বলার সূচনা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তবুও বললাম সব বাধা পেরিয়ে বাঁচা টাই তো জীবন।
চোখের ফুয়ারা যেন বুড়িগঙ্গা নদীর জোয়ার বাড়িয়ে ছিল। বেঈমান তোমার ভাই , আমাকে একা এই ঢাকা শহরে রেখে চলে গেলো আকাশের তারা হয়ে।
আমি নিজে আবেগ আপ্লুত হয়। কানা আসে বুক ভেঙ্গে। বুকের মধ্যেই চাপা দেই কষ্ট টাকে।
বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় করে ঘোরা ওর সব থেকে প্রিয় শখ। মাঝে মাঝেই আমাকে নিয়ে আনত এখানে। আমি আগে ওইভাবে আসতে চাইতাম না। সেদিন পূর্ণিমা রাতে তোমার ভাই আমাকে এনেছিল এখানে নৌকা চড়াতে। 
একটা নৌকা ভাড়া করে সারাটি রাত নদীতে ভেসে ভেসে গল্প করলাম। শেষরাতে আমার কোলে মাথা রাখে। তারপর একের পর এক ওয়াদা করিয়ে নেয় আমাকে দিয়ে। তারপর শুধু আমাকে বলেছিল আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমায়?
আমি অনুমতি দিলাম, রেহেনা আপা বললেন। একটু ঘুমায় বলে ঘুমালেন, আর জাগলেন না।
অনেকক্ষণ দুজনে নীরবে সময় পার করলাম, সেই সাথে চোখের জল বিসর্জন দিলাম বুড়িগঙ্গা কে।
আমি অনেকক্ষণ পর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হলাম।
পরক্ষনে বলল, উনি তোমার বিষয়ে সব জানেন। ইয়াসমিন আপার কাছ থেকে তোমার সম্পরকে সব জানছে। তোমার কষ্ট গুলো উনাকে খুব ব্যথিত করত। মনে মনে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছিলেন।
তার লেখা ডায়েরি তে তোমার আদি-অন্ত লিখে গেছেন। তোমার কষ্ট গুলো কে সহজ করার কথাও লিখেছেন। ডায়রিটা তোমাকে দিতে বলেছিলেন, যেভাবে হউক।
তারপর বললেন তুমি আর বিয়ে করনি?
আমি প্রসঙ্গ টা বদলাতে চাইলাম কিন্তু পরক্ষনেই ব্যর্থ হলাম।
ইতিমধ্যেই চাঁদ পূর্ব আকাশ অতিক্রম করে পশ্চিমের শেষপ্রান্তে চলে এসেছে। ডুবো ডুবো পর্যায়ে লালের আভা ও হালকা বাতাস ভাবির সামনের চুলগুলোকে উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছিল।
ডায়রিটা এবার বের করে দিল। বলল লাস্টে তোমার জন্য একটা চিঠি লিখেছে অনুরধ করে। যেটা পাক্ষিক দৃষ্টিতে তোমার আমার জন্য মানা সম্ভব নয় তবে আমি তার সব কথা মানার জন্য রাজি আছি। হটাতই একটা দমকা হাওয়া চিঠিটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো।
আমি জানতে পারলাম না তাতে কি লেখা ছিল তবে ভাবির অস্থিরতা এবং আমার দিকে করুণ চাহনি তার সারাংশ কে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। নৌকা এসে পৌঁছে গেলো বার্কল্যান্ড বাধে। দুজনা ফিরে ফিরে যাবার চেষ্টা না করে জৈবিক চাহিদা মেটাতে চাইছিল আখি চতুরগালে। অবশেষে তুষার হার মানল রেহেনার আকুতির কাছে। 
প্রিয়া চলে গেছে তবে বেশি কিছু নিয়ে গেছে জীবন থেকে, টাই সেদিন রেহেনা কে দেবার মত কিছুই ছিল না শরীরটা ছাড়া। সম্মতি এবং অসম্মতি মনের মধ্যে সিডরের মত আঘাত হানছিল। চোখ দুটি আকাশে ছড়িয়ে দিলাম। অনন্ত অসীম আকাশে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়, সমাধান খুজতে দেরি হয় না।