সুমেরুর জলবায়ু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সুমেরুর মানচিত্র। লাল রেখাটি জুলাই মাসে ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড আইসোথার্ম, সাধারণত সুমেরু অঞ্চল সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত হয়; সুমেরু বৃত্তটিও দেখানো হয়েছে। সাদা অঞ্চলটি ১৯৭৫ সালে গ্রীষ্মে সমুদ্রের বরফের গড় সর্বনিম্ন ব্যাপ্তি দেখাচ্ছে। [১]

সুমেরু জলবায়ু - দীর্ঘ ঠান্ডা শীতকাল এবং দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত গ্রীষ্মের বৈশিষ্ট্যযুক্ত। সুমেরুর জলবায়ু ভীষণ পরিবর্তনশীল। সমস্ত অঞ্চল গ্রীষ্ম এবং শীত উভয় সময়েই সৌর বিকিরণ-এর চরম অভিজ্ঞতা লাভ করে। সুমেরুর কিছু অংশ সারা বছর বরফ (সমুদ্রের বরফ, হিমবাহের বরফ বা তুষার) দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে। প্রায় সমস্ত অংশে দীর্ঘকাল ধরে তার পৃষ্ঠতলে কিছু না কিছু বরফের অভিজ্ঞতা থেকেই যায়।

সুমেরু, সমুদ্র নিয়ে গঠিত হলেও মূলত ভূমি বেষ্টিত। সুমেরুর বেশিরভাগ জলবায়ু সমুদ্রের জল দ্বারা পরিশিলীত হয়। সেখানে তাপমাত্রা কখনও −২ °সে (২৮ °ফা) এর নীচে নামতে পারে না। শীতকালে, এই অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলধারায় মেরুর ভাসমান বরফখন্ড থাকা সত্ত্বেও উত্তর মেরুকে উত্তর গোলার্ধ-এর শীতলতম স্থান হতে বাধা দেয়। কিছুটা এই কারণে সুমেরুর তুলনায় কুমেরু বেশি শীতল। গ্রীষ্মে নিকটবর্তী জলের এই উপস্থিতি, উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে উষ্ণতা থেকে রক্ষা করে।

সুমেরুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ[সম্পাদনা]

সুমেরুর বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। সর্বাধিক ব্যবহৃত সংজ্ঞা, সুমেরু বৃত্ত-এর উত্তরের অঞ্চল, যেখানে জুন সল্টিস-এ সূর্য অস্ত যায় না। জুন সল্টিস শব্দটি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং কিছু ভৌগোলিক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। তবে জলবায়ু প্রসঙ্গে দুটি সর্বাধিক ব্যবহৃত সংজ্ঞা হ'ল উত্তরের গাছ রেখার উত্তরের অঞ্চল এবং যে অঞ্চলে গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ১০ °সে (৫০ °ফা) এবং তা বেশিরভাগ ভূভাগ এলাকাতে কাকতালীয়ভাবে এক (এন.এস.আই.ডি.সি. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে)।

জাতিসমূহ, সুমেরু অঞ্চল

সুমেরুর এই সংজ্ঞাটি আরও চারটি আলাদ আলাদ অঞ্চলে বিভক্ত করা যেতে পারে:

মূল ভূখণ্ড উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয়ার উপর দিয়ে উপকূল থেকে আভ্যন্তরে প্রবেশ করলে, সুমেরু মহাসাগরের মাঝারি প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। সুমেরুীয় থেকে উপসুমেরুীয় জলবায়ুতে রূপান্তরিত হয় সাধারণত ৫০০ কিলোমিটার (৩১০ মাইল) এরও কম দূরত্বে এবং প্রায়ই আরও খুব কম দূরত্বেও সেটি ঘটে।

সুমেরু জলবায়ুর পর্যবেক্ষণ ইতিহাস[সম্পাদনা]

সুমেরুতে বেশি জনসংখ্যার অভাবে, মধ্য-অক্ষাংশ এবং নিরক্ষাংশের তুলনায়, সময়ের বড় ব্যবধানে স্বল্পক্ষণের আবহাওয়া এবং জলবায়ু পর্যবেক্ষণের ঝোঁক দেখা যায়। যদিও ভাইকিংরা সুমেরুর এক অংশে এক হাজার বছর আগে অনুসন্ধান করেছিল, এবং অল্পসংখ্যক মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সুমেরু উপকূলে বসবাস করছিল, তবুও অঞ্চলটি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ ছিল খুবই ধীর। রাশিয়ান মূল ভূখণ্ডের ত্যাম্যার উপদ্বীপের ঠিক উত্তরে, সেভেরন্যা জেমল্যা-র বৃহৎ দ্বীপগুলি, ১৯১৩ সাল পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায় নি এবং ১৯৩০-এর দশকের আগে মানচিত্র তৈরি করা হয়নি। [২]

প্রথম দিকের ইউরোপীয় অন্বেষণ[সম্পাদনা]

সুমেরুর ঐতিহাসিক অনুসন্ধানগুলি ঘটেছিল উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে অভিযানের মাধ্যমে।ব্যবসায়ীদের দ্বারা চালিত ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর অভিযানগুলি ছিল মূলত আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংক্ষিপ্ততর পথের সন্ধান করার জন্য। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয় উপকূল থেকে দূরের কোনও সুমেরু অভিযানের উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়নি এবং উভয় দিক দিয়েই একটি চলাচলযোগ্য সমুদ্রপথ খুঁজে পেতে তাঁরা ব্যর্থ হন।

আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে জাতীয় এবং বাণিজ্যিক অভিযানগুলি সুমেরু মানচিত্রের বিশদ দিকটি প্রসারিত করতে থাকে। তবে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যায়। উত্তর মেরুর চারপাশের সমুদ্র বরফ-মুক্ত, অনেকের এই বিশ্বাসের কারণেও ১৭৬০ এর দশক থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অভিযানগুলি যাত্রা শুরু করেছে উত্তর দিক দিয়ে। এই সব প্রাথমিক পর্বের অনুসন্ধানগুলি থেকে সমুদ্রে বরফের পরিস্থিতি উপলব্ধি করা এবং মাঝে মধ্যে জলবায়ু সম্পর্কিত কিছু অন্যান্য তথ্যেরও যোগান মিলেছে।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কিছু অভিযানে আরও বিশদ আবহাওয়া, সমুদ্রবিজ্ঞান এবং ভূ-চৌম্বকীয় তথ্য পর্যবেক্ষণ ও সংগ্রহের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল, তবে সেগুলি বিক্ষিপ্তভাবে থেকে যায়। ১৮৫০ এর দশকের শুরুতে নিয়মিত আবহাওয়া সংক্রান্ত পর্যবেক্ষ অনেক দেশে আরও সাধারণ হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনী বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে।[২] ফলে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অভিযানগুলি সুমেরু জলবায়ুর ছবি সরবরাহ করতে শুরু করে।

প্রথম দিকে ইউরোপীয় পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টা[সম্পাদনা]

শীতকালে কারা সাগর সাইটে প্রথম-আইপিওয়াই স্টেশনের একটি আলোকচিত্র

সুমেরুর আবহাওয়াবিদ্যা অধ্যয়ন করার জন্য ইউরোপীয়দের প্রথম প্রধান প্রচেষ্টাটি ছিল, প্রথম ইন্টারন্যাশনাল পোলার ইয়ার (আইপিওয়াই) বা আন্তর্জাতিক মেরু বছর, ১৮৮২ থেকে ১৮৮৩ সালে। এর সমর্থনে এগারোটি দেশ সুমেরুর চারপাশে বারোটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। সেই পর্যবেক্ষণগুলি জলবায়ুর বিশদ বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজনীয়ভাবে ততো বিস্তৃত বা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না ঠিকই, তবে সেগুলি সুমেরুর আবহাওয়াতে প্রথম সম্মিলিত চেহারা সরবরাহ করেছিল।

ব্রিয়া নামের একটি পরিত্যক্ত জাহাজ ১৮৮৪ সালে গ্রিনল্যান্ডের উপকূলে পাওয়া গিয়েছিল। সেটি ছিল তিন বছর আগে পরিত্যক্ত পূর্ব সুমেরু উপকূলের রাশিয়ান জাহাজ। এর থেকে ফ্রিৎজফ ন্যানসেন বুঝতে পেরেছিল, সমুদ্রের বরফ সুমেরুর সাইবেরিয়ান দিক থেকে আটলান্টিকের দিকে চালিত হচ্ছে। তিনি এই গতিটিকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্র বরফে জমাট বাঁধাতে সক্ষম একটি বিশেষভাবে নকশা করা জাহাজ ফ্রেম প্রস্তুত করে সেটিকে সমুদ্রে যাত্রা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৮৯৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৯৬ আগস্ট পর্যন্ত এই জাহাজটি পারাপারের সময় জাহাজ থেকে আবহাওয়া সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ তথ্য সংগ্রহ করে ছিল। এই অভিযানে সুমেরু মহাসাগরে বরফ পৃষ্ঠতলের সঞ্চালন সম্পর্কে মূল্যবান ধারণা পাওয়া যায়।

১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে গ্রিনল্যান্ড আইস শিট (গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাদর) এর অভ্যন্তরে প্রথম উল্লেখযোগ্য আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়েছিল। এগুলিই সম্ভবত সুমেরুর চরম জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞান সরবরাহ করে, এবং প্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নিরেট পাথরের তলায় বরফের চাদর অবস্থান করছে (এখন জানা গেছে, সেটি আসলে বরফের নিজস্ব ওজনের কারণে)।

প্রথম আইপিওয়াইয়ের পঞ্চাশ বছর পরে, ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩ সালে, দ্বিতীয় আইপিওয়াইয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। ৯৪ টি আবহাওয়া কেন্দ্র নিয়ে, এটি প্রথমটির চেয়ে বড় ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এ সময় সংগৃহীত বেশিরভাগ তথ্য প্রকাশে বিলম্ব বা প্রতিরোধ করা হয়েছিল।[২] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সুমেরুর পর্যবেক্ষণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্তটি ছিল, যখন ১৯৩৭ সালে ইউএসএসআর ৩০ টিরও বেশি নর্থ-পোল ড্রিফ্টিং স্টেশন (উত্তর-মেরু প্রবাহ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করে। এই কেন্দ্রটি পরবর্তীকালের মতো একটি ঘন বরফের ফ্লো (ভাসমান তুষারস্তর)-এর উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং প্রায় এক বছর ধরে সেটি পরিবাহিত অবস্থায় ছিল। ঐ অবস্থাতেই এর কর্মীরা বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্র পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেছেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. CIA World Factbook
  2. Serreze, Mark C.; Barry, Roger G. (২০০৫)। The Arctic Climate System। Cambridge University Press। .