মথুরা ধর্ষণ মামলা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মথুরা ধর্ষণ মামলা ১৯৭২ সালের ২ মার্চ ভারতের মধ্যে কাস্টোডিয়াল ধর্ষণের একটি ঘটনা, যেখানে মথুরা নামে এক তরুণ আদিবাসী মেয়েকে মহারাষ্ট্রের গদচিরোলি জেলার দেসাইগঞ্জ থানার চত্বরে দুই পুলিশ সদস্য দ্বারা ধর্ষিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়ার পর জনমনে হৈ চৈ ও প্রতিবাদ হয়, যা শেষ পর্যন্ত “দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৮৩ (নং ৪৩)” এর মাধ্যমে ভারতীয় ধর্ষণ আইনে সংশোধন হয়।[১] [২]

ঘটনা[সম্পাদনা]

মথুরা অল্পবয়সী এক অনাথ আদিবাসী মেয়ে, তার দুই ভাইয়ের একজনের সাথে বসবাস করে আসছিল।[৩] ঘটনাটি ১৯৭২ সালের ২ মার্চ সংঘটিত হয় বলে অনুমান করা হয়। সে সময় তার বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছর ছিল।[৩] মথুরা মাঝে মাঝে নুশি নামের এক মহিলার সাথে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। [৪] একদা সে নুশির ভাতিজা অশোকের সাথে দেখা করে, যে তাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু তার ভাই প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করে বলে যে, তার বোন নাবালক। অশোক ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপহরণ করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ কর্তৃপক্ষ অশোক ও তার পরিবারের সদস্যদের থানায় নিয়ে আসে। সাধারণ তদন্তের পরে মথুরা তার ভাই অশোক এবং তার পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। যখন তারা চলে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ মথুরাকে পিছনে থাকতে বলে এবং তার আত্মীয়দের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে।[৫] মথুরাকে তখন দুই পুলিশ সদস্য ধর্ষণ করে। এ ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে মথুরার আত্মীয় এবং স্থানীয় জনতা পুলিশ চৌকি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তখন দুই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য গণপত ও তুকারাম, অনিচ্ছায় একটি পঞ্চনামা (প্রমাণের আইনি রেকর্ডিং) দায়ের করতে সম্মত হয়।[৬] [৭]

মামলা[সম্পাদনা]

মামলাটি ১৯৭২ সালের ১ জুন দায়রা জজ আদালতে শুনানির জন্য আসে। রায়ে আসামীদের খালাস দেয়া হয়। আর বলা হয়, মথুরা 'যৌন মিলনে অভ্যস্ত' হওয়ায় তার সম্মতিতে স্বেচ্ছায় যৌনমিলন হয়েছিল; খুবজোর শুধু যৌন মিলন প্রমাণিত হতে পারে ধর্ষণ নয়।[৬] [৭] পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে বোম্বে হাইকোর্টে আপিল করা হয় এবং বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ দায়রা আদালতের রায় বাতিল করে এবং অভিযুক্তকে যথাক্রমে এক এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। আদালত বলে যে গুরুতর হুমকির কারণে সৃষ্ট ভয়ের কারণে সম্মতি বা ইচ্ছুক যৌন মিলন হিসাবে বিবেচনা করা যায় না।[৬] ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি যশবন্ত সিং, কৈলাসাম এবং কোশাল তাদের বিচারের মধ্যে তুলারাম বনাম মহারাষ্ট্র রাজ্য হাইকোর্টের রায়কে উল্টে দেয় এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের আবার খালাস দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে যে মথুরা কোনও শঙ্কা প্রকাশ করেনি; এবং এটাও যে তার শরীরে কোন আঘাতের দৃশ্যমান চিহ্ন ছিল না যার ফলে কোন জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।[৬] বিচারক উল্লেখ করেন, "যেহেতু সে যৌনতায় অভ্যস্ত ছিল, সে হয়তো পুলিশকে (যারা ডিউটিতে ব্যস্ত ছিল) তার সাথে সহবাস করতে প্ররোচিত করেছিল"।[৮] [৯]

পরে ঘটনা[সম্পাদনা]

১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে, রায় ঘোষণার মাত্র কয়েকদিন পরে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক উপেন্দ্র বক্সী, রঘুনাথ কেলকার, লোটিকা সরকার এবং পুনের বসুদা ধাগমওয়ার সুপ্রিম কোর্টে একটি খোলা চিঠি লিখেন। এতে রায়ে সম্মতির ধারণার প্রতিবাদ করা হয় এভাবে "সম্মতি বস্যতাস্বীকারের সাথে জড়িত, কিন্তু রায়টি সত্যই সত্য নয় ।” মামলার ঘটনা থেকে যা প্রতিষ্ঠিত হয় তা হল সম্মতি দেওয়া মানে স্বাভাবিক সম্মতি নয় । বিবাহপূর্ব যৌন মিলনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কি এতটাই শক্তিশালী যে, ভারতীয় পুলিশকে অল্পবয়সী মেয়েদের ধর্ষণের লাইসেন্স প্রদান করতে পারে। "[৮] স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভের পর নারী সংগঠনগুলি যারা রায় পুনর্বিবেচনার দাবি করেছিল, তাদের সংবাদ মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছাপানো হয়।[১০]দিল্লির সাহেলী সহ অনেকে রায়ের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসাবে বেশ কয়েকটি নারী গোষ্ঠী গঠন করে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে লোটিকা সরকার ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম নারীবাদী সংগঠন গঠন করে। এর নাম দেয় “ধর্ষণের বিরুদ্ধে সংগঠন” বা "ফোরাম এগেইনস্ট ধর্ষণ ", পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "ফোরাম এগেইনস্ট অপপ্রেশন উইমেন "। এ সংস্থা একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করে আইনী সংস্কারের জন্য বিতর্ক শুরু করে। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয় এবং যৌন অপরাধে বিচারিক সাহায্য চাইতে অসুবিধাগুলো তুলে ধরে এ নারী আন্দোলন।[১১] [১২] [১৩] একে অনুসরণ করে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দিল্লি, মুম্বাই, হায়দরাবাদ এবং নাগপুরসহ বিভিন্ন রাজ্যের নারীরা রাস্তায় নেমেছিল। ভারতের প্রথম নারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সীমা সাখারে, যারা নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে কাজ করে।[৩] আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে মথুরার পক্ষে রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও লোকাস স্ট্যান্ডি (আইনি অবস্থান) নেই। [১৪] অবশেষে এর ফলে ভারত সরকার ধর্ষণ আইন সংশোধন করে। [৬] [১৩]

আইনি সংস্কার[সম্পাদনা]

২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে “দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৮৩ (নং ৪৩)” এর মাধ্যমে ভারতীয় ধর্ষণ আইনে সংশোধন হয়। প্রণীত আইনের ধারা ১১৪ (এ) এর মুখোমুখি একটি বিধিবদ্ধ বিধান তৈরি করা হয়, যাতে বলা হয়েছে যে, যদি ভুক্তভোগী বলে যে সে যৌনমিলনে সম্মতি দেয়নি, আদালত অনুমান করবে যে তিনি একটি প্রত্যাখ্যানমূলক অনুমান হিসাবে সম্মতি দেননি। [৬] [১৫] [১৬] ঘটনার পর নতুন আইনও প্রণয়ন করা হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৬ (ধর্ষণের শাস্তি) ধারা ৩৭৬ (এ), ধারা ৩৭৬ (বি), ধারা ৩৭৬ (সি), ধারা ৩৭৬ (ডি), যা হেফাজতে ধর্ষণ করেছে, তার প্রয়োগ এবং সংযোজনের সাথে পরিবর্তন ঘটেছে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ধরা হবে।[১৭] “হেফাজতে ধর্ষণ” শব্দটির সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর পাশাপাশি সংশোধনটি- আসামির কাছ থেকে প্রমাণ, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা, বিচার কাজে ক্যামেরায় ছবি ধারণ, ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর বাক্যের বিধানও যুক্ত করা হয়।[১১] [১৮]

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

এই মামলাটি ভারতে নারীদের অধিকার আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হয়, কারণ এটা নারীর আইনগত অধিকার সংক্রান্ত সমস্যা, নিপীড়ন এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পর্কে আরও বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভারতজুড়ে বেশ কয়েকটি নারী সংগঠন তৈরী হয়। পূর্বে ধর্ষণ সম্পর্কে ভুল ধারণা বা রায়ে খালাস পাওয়া কারো নজরে পড়ত না, কিন্তু পরবর্তী বছরগুলিতে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীদের আন্দোলন জোর করে এবং ধর্ষিতাদের সমর্থনকারী সংগঠন এবং নারীদের অধিকার সমর্থকদের সামনে আসে। [১১] [১৩] [১৯]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Older friends"Mid-day। ১৩ জানুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০১৩ 
  2. B. Suguna (১ জানুয়ারি ২০০৯)। Women S Movements। Discovery Publishing House। পৃষ্ঠা 66–। আইএসবিএন 978-81-8356-425-0। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০১৩ 
  3. Basu, Moni (৮ নভেম্বর ২০১৩)। "The Girl Whose Rape Changed A Country"CNN। সংগ্রহের তারিখ ৭ ডিসেম্বর ২০১৩ 
  4. Basu, Moni (৮ নভেম্বর ২০১৩)। "The Girl Whose Rape Changed A Country"CNN। ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ ডিসেম্বর ২০১৩ 
  5. Maya Majumdar (১ জানুয়ারি ২০০৫)। Encyclopaedia of Gender Equality Through Women Empowerment। Sarup & Sons। পৃষ্ঠা 297–। আইএসবিএন 978-81-7625-548-6। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০১৩ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. Indira, Jaising (২০ জানুয়ারি ১৯৯৯)। "Slamming the doors of justice on women"The Indian Express। ২ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০১২ 
  7. Kamini Jaiswal (১২ অক্টোবর ২০০৮)। "Mathura rape case"। The Sunday Indian। ৩০ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  8. Khullar, p. 132
  9. "Remember Mathura?"Hindustan Times। ২৬ ডিসেম্বর ২০১২। ১৭ মার্চ ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  10. Michael T. Kaufman (২০ এপ্রিল ১৯৮০)। "Rape Case Reversal Infuriates Indian Women's Groups; Assaults on Women Reported 'I was Appailed' Class and Sexist Prejudice"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০১৩ 
  11. Epp, p. 105
  12. "In memoriam: Lotika Sarkar 1923 – 2013"। feministsindia.com। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  13. Gamble, p. 59
  14. Khullar, p. 133
  15. "Rape law, a double-edged sword in India"CNN-IBN। ১৮ জুন ২০০৯। ২২ জুন ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০১৩ 
  16. "Criminal Law (Second Amendment) Act. 46 of 1983, 113 (A) and 114 (A)" (পিডিএফ)। Law Commission of India। পৃষ্ঠা 265। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৩ 
  17. Jain, p. 12
  18. Laxmi Murthy (৮ জুন ২০১৩)। "From Mathura to Bhanwari"। Economic and Political Weekly। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০১৩ 
  19. Epp, p. 106