বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:DeloarAkram/বিজিপাতা ৫১

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

দেউড়ির কাজী পরিবার

আঠার শতকের শেষার্ধে ও উনিশ শতকে বন্দরশহর চট্টগ্রামে ইসলামি শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে কাজির দেউড়ির কাজি পরিবারের অবদান অবিস্মরণীয়। কাজি পরিবারের দু পুরুষ মির আবদুর রশিদ ও মির এহিয়া আজীবন শহর চট্টগ্রামের আরবি ও ফারসি শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী ছিলেন ।[১][২]

কাজির দেউড়ির কাজি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মির আবদুল গণি। তাঁর পুত্র ছিলেন মির আবদুর রশীদ ও মির এহিয়া ছিলেন তাঁর পৌত্র। কাজি পরিবারের আদিপুরুষ ছিলেন বোগদাদ নিবাসী বনিফাতেমি বংশীয় আরব বণিক সৈয়দ আলফা হোসাইনি। তিনি গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহর আমলে ১৪১১ খ্রিষ্টাব্দে বাণিজ্য উপলক্ষে বঙ্গদেশে আগমন করেন। সৈয়দ আলফা হোসাইনি চৌদ্দখানি বাণিজ্য- জাহাজের একটি বহরের মালিক ছিলেন। ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানরাজ গৌড় অধিকৃত চট্টগ্রাম অধিকার করে নিলে যুবরাজ নশরত শাহকে চট্টগ্রাম অভিযানে পাঠানো হয়। সৈয়দ আলফা হোসাইনি এই অভিযানের সময় তাঁর ১৪ খানি জাহাজের বহরটি যুদ্ধের

পরিবহন কাজের জন্য প্রদান করেছিলেন নশরত শাহকে। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর নশরত শাহ তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সৈয়দ আলফা হোসাইনিকে সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি জায়গির প্রদান করেন এবং তিনি তখন এদেশে বসতি স্থাপন করেন। সন্দ্বীপের মোল্লা মঈনউদ্দিন ও চট্টগ্রামের কাজি মির আবদুল গণি সৈয়দ আলফা হোসাইনির বংশধর।

মির এহিয়ার পিতামহ মির আবদুল গণি কৈশোরে চট্টগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য শাহজানাবাদে গমন করেন। তিনি সেখানকার উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করার পর দিল্লী গমন করেন এবং তৎকালীন দিল্লী সম্রাটের কাছ থেকে ইসলামাবাদের কাজি ও মুফতির সনদ ও জায়গির লাভ করে চট্টগ্রাম ফিরে আসনে। কাজি আবদুল গণি আধুনিক চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের পূর্বদিকস্থ এলাকায় নিজ বসতবাড়ি, দেউড়ি ও একখানি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে কাজি মির আবদুল গণির দেউড়ির স্মারকরূপে সেই এলাকাটি কাজির দেউড়ি নামে খ্যাত হয়।

কাজি মির আবদুল গণির পুত্র মির আবদুর রশিদ। তিনি একজন সমাজহিতৈষী লোক ছিলেন। তিনি পৈতৃক জায়গিরের আয় থেকে কাজির দেউড়িতে একখানি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। শেষ বয়সে তিনি পতন যুগের মোগল সম্রাট আহমদ শাহর রাজত্বকালে (১৭৪৮-১৭৫৪ খ্রি.) বাংলার নবাব শাহমদ জঙ্গ নওয়াজেশ মোহাম্মদ যার প্রদত্ত সনদ মূলে মাদ্রাসা মসজিদ প্রভৃতি পরিচালনার জন্য শাহি ৬০ দ্রোণ নিষ্কর লাখেরাজ জমি প্রাপ্ত হন। সে সনদের সারমর্ম হলো

তারিখ, মোগল সম্রাট আহমদ শাহর রাজত্বের ষষ্ঠ বছর ১১ই রবিউস সানি । নবাব শাহমদ জঙ্গ নওয়াজেশ মোহাম্মদ খাঁর সীলমোহর অংকিত।

ইসলামাবাদ পরগণার শাসনকর্তার কর্তৃত্বাধীন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মাতব্বর, চৌধুরী, তালুকদার, রায়ত ও কৃষবৃন্দকে জানানো যাচ্ছে যে, সৈয়দপুর প্রভৃতি পরগণায় খাজনা ও জোয়েদাদ ছাড়া শাহি ঘাইট দ্রোণ জমি মির আবদুর রশিদকে তাঁর ভরণপোষণ, মসজিদ, একটি মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহ ও গবেষক পণ্ডিত এবং গরিবদের বৃত্তি প্রদান প্রভৃতি সৎ কাজ উপলক্ষে দান করা হলো।

এর কিছুদিন পর মির আবদুর রশিদ পরলোকগমন করেন।


তাঁর পুত্র মির এহিয়া আঠার শতকের শেষ দিকে কাজির দেউড়িতে অনুগ্ৰহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি পৈতৃক কাজির দেউড়ি মাদ্রাসা সম্প্রসারণ করেন। পৈতৃক জমিদারির অর্ধেক আয় মাদ্রাসার ব্যয়, পণ্ডিতগণকে বৃত্তি দান ও ভিক্ষুকদের লঙ্গরখানায় ব্যয় করতেন। এই সময় কাজির দেউড়ি মির এহিয়া মাদ্রাসার এক হাজার ছাত্র বিনা খরচায় আহার ও বাসস্থানের সুবিধা ভোগ করে শিক্ষা লাভ করতেন। মির এহিয়ার নুর বিবি, আয়মনা বিবি ও হানিফা বিবি নামে তিন কন্যা সন্তান ছিলেন । তিনি নুর বিবিকে সৈয়দ গোলাম হায়দর, আয়মনা বিবিকে দেয়ানত খাঁ ও হানিফা বিবিকে সন্দ্বীপের বক্তিয়ার মাহিসওয়ার নামক সুপ্রসিদ্ধ ইসলাম প্রচারকের বংশধর মোহাম্মদ ফজলের সাথে বিয়ে দেন এবং ফজলকে তাঁর জমিদারি ও মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফজলের মৃত্যুর পর তৎপুত্র মখলকুর রহমান ও তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র

আহমদুর রহমান মির এহিয়া এস্টেটের মালিক হন। কিন্তু ততদিনে মির এহিয়া স্টেট তাঁর তিন কন্যার মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এদিকে তখন চট্টগ্রামের কালেক্টার মি. হার্ডে নবাবের প্রদত্ত সনদ জাল বলে অজুহাত দিয়ে মির এহিয়া স্টেট বাজেয়াপ্ত করেন। আহমদুর রহমান এর বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন। অনেকদিন মোকদ্দমা চলে। এ সময় কাজির দেউড়ির মির এহিয়া মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মি. স্টেনফোর্থ ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে তারিখে মির এহিয়ার সম্পত্তির সনদ বৈধ বলে স্বীকার করেন এবং সম্পত্তির আয় ও মোকদ্দমা ব্যয় বাবদ ৯১৫৭ টাকা ডিক্রি প্রদান করেন। কিন্তু মাদ্রাসা পরিচালনার ব্যয় নিয়ে আহমদুর রহমানের সাথে বিরোধ বাধে। অনেক তালবাহানার পর আহমদুর রহমান ডিজিপ্রাপ্ত টাকা থেকে তিন হাজার ও সম্পত্তির আয় থেকে তিন শত টাকা একটি মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য দিতে রাজি হন। অবশেষে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের আইন মতে চট্টগ্রামের কালেক্টার বাহাদুর নিজে মাদ্রাসা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে তিন হাজার টাকার একটি চিরস্থায়ী দানপত্র প্রদান করে মির এহিয়া ফান্ডের পত্তন করা হয়। উক্ত তিন হাজার টাকা ও মির এহিয়া স্টেটের আয় থেকে তিন শত টাকা দিয়ে একটি স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু চট্টগ্রামের মুসলমানরা এর বিরোধিতা করে একটি মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তখন কালেক্টার বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা পাহাড়ে একটি স্থাপন করেন। কিন্তু সেখানে যখন মোহসিন ফান্ডের অর্থে নিউস্কিম মাদ্রাসা স্থাপিত হয় তখন মির এহিয়া মাদ্রসা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর শামসুল ওলামা ডক্টর কামাল উদ্দিন সাহেবের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এবং দেনদরবারের পর "মির এহিয়া ফান্ডে'র টাকা থেকে চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসা ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রগণকে মাসিক ৪টাকা হারে ৮টি বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করে শিক্ষাহিতৈষী মির এহিয়ার স্মৃতি জাগরুক রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ভিন্নদেশী ও বিধর্মী ইংরেজ কালেক্টার যদি তিন হাজার টাকার মির এহিয়া ফাণ্ডের সৃষ্টি না করতেন তবে তাও তাঁর অযোগ্য বংশধরগণের ব্যক্তিগত ভোগে চলে যেত।

  1. চৌধুরী, আব্দুল হক (অক্টোবর ২০০৯)। "মীর এহিয়া মাদ্রাসা"মুক্তযুদ্ধ ই আর্কাইভ। বাংলাবাজার, ঢাকা: গতিধারা (সিকদার আবুল বাশার)। পৃষ্ঠা ২২৩–২২৫। আইএসবিএন ৯৮৪৪৬১৪০১১ |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য)। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুলাই ২০২৩ 
  2. "মীরসরাই উপজেলা, চট্টগ্রাম (ভাষা ও সংষ্কৃতি)"mirsharai.chittagong.gov.bd। সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা: উপজেলা শিল্পকলা একাডেমী, মীরসরাই। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৬