বিপণন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিপণন কার্যক্রম সম্পর্কে একটি বই

বিপণন বা বাজারজাতকরণ (ইংরেজি: marketing) হলো পণ্য বা মূল্যের বিনিময়ে কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রয়োজন ও অভাব পূরণ করার সামাজিক এবং ব্যবস্থাপকীয় কার্যক্রম।[১] Converse-এর মতে, "সময়গত, স্থানগত এবং স্বত্ত্বগত উপযোগ সৃষ্টি করাই বিপণন"। আমেরিকান মার্কেটিং এ্যাসোসিয়েশন-এর প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে:

বিপণনের মৌলিক ধারণাসমূহ[সম্পাদনা]

  • প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদা
  • বাজারজাতকরণ অর্পণ
  • মূল্য ও সন্তুষ্টি
  • বিনিময়, লেনদেন এবং সম্পর্ক
  • বাজারসমূহ

বিপণন অর্পণ[সম্পাদনা]

বিপণন ১০টি বিষয় বা দশ ধরনের সত্তা বাজারজাত করে থাকে[২]:

পণ্য বিপণন মূলত এবং প্রাথমিকভাবে পণ্যই বাজারজাত করে থাকে। যেমন: টেলিভিশন, চকলেট, পেনসিল, উড়োজাহাজ ইত্যাদি।
সেবা অগ্রগামী বিশ্বে পণ্যের পাশাপাশি সেবাও বিপণন হচ্ছে। উদাহরণ: বিমান, সেলুন বা পার্লার, হিসাববিদ, প্রোগ্রামার ইত্যাদি।
ঘটনা বিভিন্ন সময়ানুগ ঘটনাও বিপণন হয়। যেমন: বাণিজ্য মেলা, ক্রীড়া অনুষ্ঠান বার্ষিকী ইত্যাদি।
অভিজ্ঞতা অনেক ফার্মই, কিংবা ব্যক্তি কোনো কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে দিতে একসময় অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে তা বিপণন করে থাকেন। যেমন: ক্রিকেট খেলোয়াড়ের কাছে প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞ পর্বতারোহীর সাথে এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গে অভিযান ইত্যাদি।
ব্যক্তি তারকা ব্যক্তিত্বের বিপণন হয়ে থাকে, যেমন: ওপরাহ্‌ উইনফ্রে, টায়রা ব্যঙ্ক, ম্যাডোনা প্রমুখ নিজেরাই একেকজন ব্র্যান্ড।
স্থান বিভিন্ন স্থান, এলাকাও বাজারজাত হতে পারে, যেমন: পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান বাজারজাতকরণ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে কক্সবাজারের প্রচারণা।
সম্পত্তি অস্পৃশ্য সম্পত্তির মালিকানা, চাই স্থাবর সম্পত্তি, কিংবা আর্থিক সম্পত্তি বিপণন করা হয়। যেমন: বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এজাতীয় বাজারজাতকরণে সম্পৃক্ত।
সংগঠন বিভিন্ন সংগঠন তাদের লক্ষ্য-ক্রেতাদের কাছে তাদের ভাবমূর্তি প্রস্ফুটিত করতে বিপণন করে। যেমন: বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, সংগীত-নৃত্যকলা সংগঠন ইত্যাদি।
তথ্য তথ্যও পণ্যের মতো বিপণন হয়। যেমন: অভিধান, বিশ্বকোষ, ম্যাগাজিন, বই-পুস্তক ইত্যাদি।
ধারণা প্রত্যেক বাজার অর্পণই মূলত একটি ধারণা। অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য সংক্রান্ত এমন ধারণার বিপণন করে। যেমন: Revlon বলে: "কারখানায় আমরা প্রসাধনী তৈরি করি, দোকানে আমরা আশা বিক্রয় করি।"

বিপণনের তত্ত্ব বা মতবাদসমূহ[সম্পাদনা]

বিপণন দিনে দিনে তার ধারণাগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।বিপণনের উন্মেষের সূচনালগ্নে ক্রেতাকে যেভাবে দেখা হতো, আজ,বিপণনের যুগে ক্রেতাকে তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে দেখা হয়। আর এভাবেই বিপণন কতিপয় মতবাদ বা তত্বে যুগে যুগে আলাদা হয়ে গেছে।

উৎপাদন মতবাদ[সম্পাদনা]

উৎপাদন মতবাদ (Production Concept) বিপণনের লক্ষ্য-সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে পুরোন মতবাদ। এই মতবাদ মতে, ক্রেতা সেই পণ্যই আকৃষ্ট হবে, যা সহজলভ্য ও সুলভ। এই মতবাদের মূল লক্ষ্যই থাকে অধিক উৎপাদন, কম উৎপাদন খরচ এবং বিস্তৃত বণ্টন। এই মতবাদ কাজ করে দুরকম পরিস্থিতিতে:

১) যখন যোগানের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায়

২) যখন পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং দাম কমাতে উৎপাদন বাড়াতে হয়

তবে এতদসত্ত্বেয় উৎপাদন মতবাদের একনিষ্ঠ প্রয়োগ অনেক সময় কোম্পানীকে 'ক্রেতার চাহিদা পূরণের' মূল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে রাখে।[১]

পণ্য মতবাদ[সম্পাদনা]

ক্রেতা শুধুমাত্র সেই পণ্যে আকৃষ্ট হবে, যা গুণ, মান, বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল এবং পণ্যটির উৎকর্ষ সাধন করা হয়- এই মতবাদে দীক্ষিত পণ্য মতবাদ (Product Concept)। এতে উৎপাদক যেন বিশ্বাস করেন যে, একটা ভালো মানের 'ইঁদুর-ধরা ফাঁদ'ই ক্রেতাকে আকৃষ্ট করবে, কিন্তু একজন ক্রেতা যে ইঁদুর ধরা ফাঁদের বদলে ইঁদুর মারার পথ খুঁজতে পারেন, তা ভাবা হয় না। তাই পণ্য মতবাদও বাজারজাতকরণ ক্ষীণদৃষ্টির (Marketing myopia) পরিচয় দেয়। তাছাড়া এই মতবাদে অনেক সময়ই সম্ভাব্য প্রতিযোগীকে বিবেচনা করা হয় না।[১]

বিক্রয় মতবাদ[সম্পাদনা]

ক্রেতা ততক্ষণ কোনো পণ্য ক্রয় করবে না, যতক্ষণ কোম্পানীর পক্ষ থেকে পণ্যের পক্ষে জোরালো প্রচার ও প্রসার কার্যক্রম হাতে না নেয়া হয়- এমনটাই ধারণা বিক্রয় মতবাদের (Selling Concept)। সাধারণত সচরাচর প্রয়োজন হয়না বা কেনা হয়না এমন পণ্যের ক্ষেত্রে বিক্রয় মতবাদ কাজে লাগানো হয়; যেমন: বীমা পলিসি, বিশ্বকোষ ইত্যাদি। আবার অনেক কোম্পানীর, চাহিদার চেয়েও যোগান বেশি দেবার ক্ষমতা থাকলে তারাও বিক্রয় মতবাদ ব্যবহার করে। কিন্তু বিক্রয় মতবাদ অনেকাংশেই ব্যবসায়িক ধ্যান-ধারণার মতবাদ; এতে অনেক সময়ই যা উৎপাদন করা হয়, তা বিক্রয় করার চিন্তা করা হয়, কিন্তু বাজার যা চায়, তা বিক্রয় করার চিন্তা করা হয় না।

বিপণন মতবাদ[সম্পাদনা]

বিক্রয় মতবাদের ক্ষীণদৃষ্টিকে সামলে নিয়ে জন্ম হয় বাজারজাতকরণ মতবাদের (Marketing Concept)। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে উদ্ভব হয় এ মতবাদের। এ মতবাদ মতে, ক্রেতাদের চাহিদা ও সন্তুষ্টির নিমিত্তেই লক্ষ্যার্জন করতে হয়। বিক্রয় মতবাদের 'পণ্যের জন্য ক্রেতা' ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে 'ক্রেতার জন্য পণ্য' ধারণার মতো যুগান্তকারী অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণার জন্ম দেয় এই মতবাদ। কিন্তু এ মতবাদও শুধুমাত্র ক্রেতা-ভোক্তা, আর কোম্পানীর বাইরে আর কিছু নিয়ে ভাবে না, তাই এই মতবাদও সর্বাধুনিক মতবাদ নয় বলে অনেকে মনে করেন।[১]

সামাজিক বিপণন মতবাদ[সম্পাদনা]

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের পর সমাজের উপযোগিতা, স্বার্থ বিবেচনা করে যে বিপণন মতবাদের উন্মেষ ঘটে তা সামাজিক বিপণন মতবাদ (Social Marketing Concept) হিসেবে পরিচিত। এই মতবাদ অনুসারে ক্রেতা-ভোক্তা, কোম্পানীর পাশাপাশি সমাজের, ভালোর এবং নৈতিকতার দৃষ্টিতে বিপণন পরিচালনার ধারণা উৎপত্তিলাভ করে। এতে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সমাজের কল্যাণ মুখ্য হয়ে ধরা পড়ে।[১]

সামগ্রিক বিপণন মতবাদ[সম্পাদনা]

কিন্তু অপরাপর সকল মতবাদই কোনো না কোনো দৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বলে এই ফাঁক পূরণ করতে একবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভব হয় সামগ্রিক বিপণন মতবাদের (Holistic Marketing Concept)। এই মতবাদে মনে করা হয়, বিপণনের ক্ষেত্রে সংঘটিত সকল ঘটনা বা কর্মকান্ডেরই একটি বৃহৎ, সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকা উচিত।[২] এই মতবাদ মূলত বিপণন ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা ও জটিলতা নিরসনে সহায়তা করে। এই মতবাদে মূলত চারটি অংশকে প্রাধান্য দেয়া হয়:

  • সম্পর্ক বিপণন
    • ক্রেতা
    • প্রণালী (চ্যানেল)
    • সহযোগী
  • সমন্বিত বিপণন
    • যোগাযোগ
    • পণ্য ও সেবা
    • প্রণালীসমূহ (চ্যানেলসমূহ)
  • অভ্যন্তরীণ বিপণন
    • বিপণন বিভাগ
    • উচ্চতর ব্যবস্থাপনা
    • অন্যান্য বিভাগ
  • সামাজিক দায়বদ্ধ বিপণন
    • নৈতিকতা
    • পরিবেশ
    • বৈধতা
    • সমাজ

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Principles of Marketing (10th Edition), Philip Kotler & Gary Armstrong, Pearson Prentice Hall (International Edition), আইএসবিএন ০-১৩-১২১২৭৬-১; প্রকাশকাল: ২০০৩-২০০৪। পরিদর্শনের তারিখ: এপ্রিল ১৭, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  2. Marketing Management (12th Edition), Philip Kotler & Kevin Lane Keller, Prentice Hall India, আইএসবিএন ৮১-২০৩-২৭৯৯-৩; প্রকাশকাল: ২০০৬। পরিদর্শনের তারিখ: এপ্রিল ১৭, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  3. বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা, মো: জাহিদ হোসেন শিকদার, দেওয়ান জোবাইদা নাসরীন, মো: মঞ্জুরুল আলম; কাজী প্রকাশনী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০০৬। পরিদর্শনের তারিখ: এপ্রিল ১৭, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।