নির্মলা (উপন্যাস)
লেখক | মুন্সি প্রেমচাঁদ |
---|---|
মূল শিরোনাম | নির্মলা (निर्मला) |
অনুবাদক | অলোক রায় এবং ডেভিড রুবিন[১] |
প্রচ্ছদ শিল্পী | ওরিয়েন্ট পাপেরব্যাক্স (অলোক রায়) এবং অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া পেপারব্যাক্স (ডেভিড রুবিন) |
দেশ | ভারত |
ভাষা | হিন্দি |
ধরন | কল্পকাহিনী |
প্রকাশিত | জানুয়ারী ১৯২৭[১] |
আইএসবিএন | ৯৭৮০১৯৫৬৫৮২৬২ (অক্সফোর্ড ইন্ডিয়ার অনুবাদকৃত সংস্কার)[২] |
নির্মলা (হিন্দিঃ निर्मला) একটি হিন্দি উপন্যাস যার রচয়িতা হিন্দি ও উর্দু ঔপন্যাসিক মুন্সি প্রেমচাঁদ। এই আবেগপ্রধান উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র নির্মলা নামে এক কিশোরী যাকে জোরপূর্বক তার পিতার বয়সী এক বিপত্নীককে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। উপন্যাসটির আখ্যান (plot) হচ্ছে নির্মলার স্বামীর সন্দেহ যে তার ছেলের সাথে নির্মলার অবৈধ সম্পর্ক আছে, যে সন্দেহ ছেলেটির মৃত্যুর কারণ হয়।
এই মর্মভেদী উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এর মূল বিষয়বস্তুতে ফুটে উঠেছে নির্মলার সংস্কারমূলক আলোচ্যসূচি, যেখানে তুলে ধরা হয়েছে যৌতুক, অসমজুটিত বিবাহ এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলি। উপন্যাসটিতে কল্পিত কাহিনীর মাধ্যমে ১৯২০ এর ভারতীয় সমাজে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। নির্মলা ১৯২৮ সালে চাঁদ নামে এক মহিলা সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়, এবং সেখানে উপন্যাসটির নারীবাদি চরিত্রটি চিত্রিত প্রকাশিত হয়। নির্মলা অনেকটা ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত গোদান (Godaan) উপন্যাসের মত, যার মূল বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের গরীবদের শোষণ, এবং সেটা বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়। নির্মলা উপন্যাসটি প্রথম অনুবাদ করেন ডেভিড রুবিন ১৯৮৮ সালে “The Second Wife” নামে, এবং ১৯৯৯ সালে এটি অনুবাদ করেন প্রেমচাঁদের নাতি অলোক রায়, “Nirmala” নামে।
আখ্যান
[সম্পাদনা]উদয়ভানু লাল নামে একজন আইনজীবী তার ১৫ বছর বয়স্কা কন্যা নির্মলাকে বালচন্দ্র সিংহের ছেলে ভূবনমোহন সিংহের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। পরে উদয়ভানু খুন হন তার শত্রু মাথায়ির হাতে যাকে উদয়বানু এক সময় বিচারের মাধ্যমে জেলের সাজা ভোগ করান। উদয়ভানুর মৃত্যুর কারণে বালচন্দ্র আনুষ্ঠানিক বিবাহ থেকে সরে আসে কারণ সে উদয়ভানুর মৃত্যুর কারণে কোন বড় ধরনের যৌতুক আশা করেনি। অর্থনৈতিক সমস্যা নির্মলার মা কল্যাণিকে বাধ্য করে তার কন্যাকে তোতারাম নামে নির্মলার চেয়ে ২০ বছর বয়সে বড় এক আইনজীবীর সাথে বিয়ে দিতে। তোতারাম তার অল্পবয়স্ক সুন্দরী স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করতে অনেক চেষ্টা ক’রে অসফল হয়। তার প্রতি নির্মলার কোন প্রকার আবেগ ছিল না, শুধু ছিল সম্মান ও কর্তব্যজ্ঞান, যা স্ত্রীর তার কাছে প্রত্যাশিত ভালবাসা পূরণ করতে পারেনি।[৩]
তোতারামের প্রথম বিবাহ থেকে ৩ ছেলে ছিল। তার সর্বজ্যোষ্ঠ ছেলে মানসারাম ছিল নির্মলার চেয়ে এক বছরের বড়। খুব শীঘ্রই তোতারাম নির্মলা এবং মানসারামের মধ্যে সম্পর্কের ব্যপারে সন্দেহ পোষণ শুরু করেন। সন্দেহ এবং হিংসার বশে তোতারাম মানসারামকে একটি হোস্টেলে ভর্তি করতে বাধ্য হয়, এবং এই সিদ্ধান্তটিই পরে তাদের অনুতাপের কারণ হয়। হোস্টেলের পরিবেশে মানসারামের স্বাস্থ্যের ক্রমেই অবনতে ঘটে। হাসপাতালে মানসারামের চিকিৎসা করেন ভূবনমোহন। যখন ভূবনমোহন নির্মলার ব্যপারে জানতে পারেন তখন তিনি অনুতপ্ত হয় তার ভাইয়ের সাথে নির্মলার বোন কৃষ্ণের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। নির্মলার দুঃক্ষ তাকে প্রতিনিয়ত প্রচন্ড যন্ত্রণা দিতে থাকে। মানসারাম অবশেষে যক্ষায় মারা যায়।[১] তোতারাম তার ছেলের মৃত্যুতে অপরাধবোধে ভেঙ্গে পড়েন। কিছুদিন পরই তোতারামের দ্বিতীয় সন্তান জিয়ারাম নির্মলার গহণা চুরি করে বাসা থেকে পালিয়ে যান। পরে সে আত্মহত্যা করে। তোতারামের তৃতীয় সন্তান সিয়ারমও বাসা থেকে পালিয়ে যা এক ভন্ড ঋষির খপ্পরে পড়ে। সন্তান হারানোর বেদনায় মর্মাহত তোতারাম তার একমাত্র জীবিত সন্তান সিয়ারামের সন্ধানে রওনা হন।
এদিকে ভূবনমোহন নির্মলার জীবনে ফিরে আসে তার বান্ধবী সুধার স্বামী হিসেবে। সে নির্মলাকে প্রলোভিত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার স্ত্রী জেনে ফেললে তাকে কঠিনভাবে সমালোচনা করেন। ভূবনমোহন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং নির্মলার প্রতি তার ভালবাসা ও দুঃখে আত্মহত্যা করেন।[৪] এতগুলি দুঃখজনক ঘটনা এবং তার দুর্বল স্বাস্থ্যের ফলে নির্মলা তার মেয়ে আশাকে তোতারামের বিধবা বোন রুকমিনির তত্ত্বাবধানে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। প্রৌঢ় তোতারাম ফিরে এসে জানতে পারেন নির্মলা আর নেই।[৫][৬]
চরিত্রসমূহ
[সম্পাদনা]· নির্মলা, মূল চরিত্র; একটি ১৫-বছর বয়স্ক কিশোরী যাকে বাধ্য করা হয় তার চেয়ে ২০ বছরের বড় তোতারামকে বিয়ে করতে।[৭]
· (মুন্সি) তোতারাম, নির্মলার স্বামী এবং একজন আইনজীবী।
· রুকমিনি, তোতারামের বিধবা বোন।
· মান সারাম, তোতারামের প্রথম বিবাহ থেকে তার সর্বজ্যোষ্ঠ ছেলে; তার বাবার সন্দেহ তার সাথে তার স্ত্রী নির্মলার অবৈধ সম্পর্ক আছে। তোতারাম তাকে জোরপূর্বক হোস্টেলে বাস করতে বাধ্য করে এবং হোস্টেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে তার মৃত্যু হয়।
· জিয়ারাম, তোতারামের প্রথম বিবাহ থেকে তার দ্বিতীয় ছেলে; সে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তার পিতাকে দায়ী করে, এবং নির্মলার গহণা চুরি করে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। পরে সে আত্মহত্যা করে।
· সিয়ারাম, তোতারামের প্রথম বিবাহ থেকে তার তৃতীয় ছেলে। তাকে এক ভন্ড ঋষির খপ্পরে পড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
· ভূবনমোহন সিংহ, নির্মলার প্রাক্তন প্রেমিক। নির্মলার বাবার মৃত্যুর পর সে জানতে পারে যে সে কোন বড় ধরেনের যৌতুক পাবে না, তাই সে নির্মলাকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানায়।
· সুধা, ভূবনমোহনের স্ত্রী ও নির্মলার বান্ধবী। সুধার মাধ্যমেই ভূবন জানতে পারে নির্মলা হচ্ছে সেই মেয়ে যাকে সে যৌতুকের কারণে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। সুধার সমালোচনা তাকে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দায়।
· উদয়ভানু লাল, নির্মলার পিতা।
· কল্যাণী, নির্মলার মাতা, যিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে মেয়ে নির্মলাকে তোতারামের কাছে বিয়ে দেন।
· বালচন্দ্র সিংহ, ভূবনমোহনের পিতা
· পণ্ডিত মোটারাম, একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি এবং ধর্মযাজক।
· ভুঙ্গি, তোতারামের বাসার কাজের মেয়ে।
· আশা, নির্মলার ঘরে তোতারামের মেয়ে।
· রঙ্গিলি বাঁঈ, বালচন্দ্র সিংহের স্ত্রী
· কৃষ্ণা, নির্মলার বোন।
পটভূমি
[সম্পাদনা]স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের পটভূমিকায় রচিত নির্মলায় প্রস্ফুটিত হয়েছে ১৯২০ দশকে ভারতীয়দের চিন্তাধারা ও সামাজিক পরিবেশের একটি বাস্তব চিত্র।[৮] এতে চিত্রায়িত হয়েছে যৌতুক প্রথার ক্ষতিকর দিক, এবং এর ফলে লেখকের সামাজিক সংস্কার ও নারীর পদমর্যাদা বৃদ্ধির ইচ্ছা ফুটে উঠেছে। লেখকের কথায় বর্ণিত হয়েছে তার দেশে দারিদ্রতা, এবং চিত্রিত হয়েছে ভারতের গ্রামাঞ্চলের মানুষের দারিদ্রতা, জাতিপ্রথা এবং ধনির হাতে দরিদ্রের শোষণ।[৯] উপন্যাসটির সময়সীমা ৬ বছর, যার মধ্যে নির্মলার ছাত্রী থেকে স্ত্রী ও অতঃপর মাতায় রূপান্তরের চিত্র ফুটে উঠেছে। সে সময়টায় সমাজে আত্মমর্জাদা এবং পরিচিতি খুবই জরুরি। খাদ্য ভক্ষণ করা হত অত্যন্ত সামাজিক আচারবিধির মাধ্যমে। বাড়ীতে মহিলারা পুরষদের সাথে খেতে বসত না এবং পুরুষদের খাওয়া শেষ হলে তাদের খাওয়ার অনুমতি দেয়া হত। তখন হাসপাতাল এবং শরীরে রক্ত দেয়ার প্রতি মানুষের একটা ভীতি ছিল,তাই আমরা দেখতে পাই ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ফলে তোতারামের অপরাধবোধ। যে সময়ে উপন্যাসটি লেখা হয়, তার অনেক প্রজন্মের পর মানুষের চিন্তাধারা, আবেগ ও আকাংক্ষায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। নির্মলায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে ভারতের একটি সময়ের চিত্র যখন একটি তরুণীর সবচেয়ে বড় পাপ ছিল একটি স্বামীর প্রয়োজন যে তাকে যৌতুক ছাড়াই গ্রহণ করবে।[১০]
প্রকাশনা
[সম্পাদনা]নির্মলা ছিল ভারতে সেই সময়ে লেখা প্রেমচাঁদের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির একটি, যখন নারীর উপর নির্দয় ব্যবহার প্রচুর লেখক ও কবির লেখায় ফুটে উঠে। বইয়ের আকারে প্রকাশের পূর্বে নির্মলা চাঁদ নামে একটি সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশনা শুরু করে ১৯২৫ এর নভেম্বরে।[১১] সেই সময়ই প্রেমচাঁদ প্রথম সিদ্ধান্ত নেন তার লেখায় সামাজিক সমস্যাগুলি তুলে ধরতে।[১২][১৩] উপন্যাসটি প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় ১৯৮৮ সালে।[১৪]
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]ফ্রানচেসকা ওরসিনি নির্মলাকে অভিহিত করেছেন সামাজিক সচেতনতা এবং নাটকের সমন্বয়ের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে।
গুলজারের মতে উপন্যাসটি একটু দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এবং একই আবেগ বারবার ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু তবুও এতে আছে ঘটনার দিক পরিবর্তন ও কিছু অসঙ্গতি।[১৫]
উপন্যাসটির উপর ভিত্তি করে প্রচুর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেমন “তেহরীর মুন্সি প্রেমচাঁদ কি,” যার পরিচালক গুলজার এবং প্রদর্শিত হয়েছিল দূরদর্শনে। নির্মলার ভূমিকায় অভিনয় করেন মারাঠি অভিনেত্রী আম্রাতা সুবাস, যিনি তার চরিত্রের জন্য প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন।[১৬]
১৯৮৭ সালে অনন্যা খারে দূরদর্শন টিভি সিরিয়ালে মূখ্য ভূমিকায় ছিলান।
টীকা
[সম্পাদনা]যদিও নির্মলা শব্দের অর্থ হচ্ছে “নিষ্কলঙ্ক” ও “পুণ্য” উপন্যাসটির প্রথম অনুবাদক ডেভিড রুবিন এটার নামকরণ করেন “The Second Wife” বা “দ্বিতীয় স্ত্রী”।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ "Shodhganga" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ মে ৪, ২০১৪।
- ↑ "ISBN"। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৩, ২০১৪।
- ↑ "Shodhganga" (পিডিএফ)।
- ↑ "Nirmala"। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৩, ২০১৪।
- ↑ "Tribune India"। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ২৪, ২০১৪।
- ↑ "OUP"। Oxford databases। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৩, ২০১৪।
- ↑ "Nirmala by Premchand in Hindi"। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৫, ২০১৪।
- ↑ "Ops The Second Wife"।
- ↑ Lal, Anupa। THE PREMCHAND READER Selected Stories 1 (Introduction)। আইএসবিএন 9788170702139।
- ↑ Rubin, David (২০০৫)। "Translator's Introduction". The Second Wife। Orient Paperbacks। পৃষ্ঠা 9–10। আইএসবিএন ISBN 812220418X
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য)। - ↑ Chandra Gupta, Prakash। Makers Of Indian Literature Prem Chand। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 35। আইএসবিএন 8126004282।
- ↑ Rubin (2005-12-01), David (২০০৭)। The Second Wife Translated from Hindi। আইএসবিএন 9788122204186।
- ↑ Rubin, David (২০০৫)। "Translator's Introduction". The Second Wife। Orient Paperbacks। পৃষ্ঠা 5–6। আইএসবিএন 812220418X।
- ↑ "NTM" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ২৬, ২০১৫।
- ↑ Tankha, Madhur। "Premchand had a great influence on me: Gulzar"। The Hindu। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৯, ২০১৪।
- ↑ Trivedi, Harish। "Outlook India"। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ৮, ২০১৪।