ক্রান্তীয় মরুভূমি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাহারার দৃশ্য

ক্রান্তীয় মরুভূমি (ইংরাজী: Tropical desert) ৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি অক্ষাংশ-এর মধ্যে অবস্থিত। পরিবেশ খুব চরম প্রকৃতির। পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মাসিক তাপমাত্রা এখানেই দেখা যায়। বৃষ্টিপাত বিক্ষিপ্ত; কয়েক বছরের মধ্যে বৃষ্টিপাত আদৌ লক্ষ্য করা যায় না। এই চরম পরিবেশ ও জলবায়ু ছাড়াও, বেশিরভাগ ক্রান্তীয় মরুভূমি বালি এবং পাথরে আচ্ছাদিত। এই রকম খুব সমতল এবং গাছপালার অভাবের কারণে, ক্রান্তীয় মরুভূমি অঞ্চল বায়ু গতি রোধ করতে পারে না। বায়ু প্রবাহে ভূমিক্ষয় হওয়ার সাথে সাথে বালি, শিলা ও অন্যান্য উপকরণ বহন করে। এগুলি ইওলিয়ান প্রক্রিয়া হিসাবে পরিচিত। বায়ু ক্ষয়-এর কারণে সৃষ্ট ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য এবং আকার-আকৃতি বহু রকমের, যেমন নিম্নচাপ এবং অপসারণ, ইয়ারড্যাং, উল্টানো ভূসংস্থান এবং বালুঝড়। এই অতি শুষ্ক ও তাপে শুধুমাত্র বিশেষ উদ্ভিদকুল এবং বিশেষ আচরণগত এবং শারীরিক ব্যবস্থা সম্পন্ন প্রাণীকুল ছাড়া বাঁচতে পারে না। এরকম চরম পরিবেশ এবং উদ্ভিদের অভাবের কারণে কোনও উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাও ক্রান্তীয় মরুভূমিতে দেখা যায় না। যদিও ক্রান্তীয় মরুভূমিকে কঠোর এবং বন্ধ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবুও তা প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক সম্পদ-এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং অর্থনৈতিক বিকাশ-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিস্তার[সম্পাদনা]

ভৌগোলিক বিস্তার[সম্পাদনা]

ক্রান্তীয় মরুভূমির বিস্তার

ক্রান্তীয় মরুভূমিগুলি কর্কটক্রান্তী এবং মকরক্রান্তীর মধ্যবর্তী উভয় মহাদেশের অভ্যন্তর এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। এই ক্রান্তীয় মরুভূমিগুলির মধ্যে রয়েছে, উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, অস্ট্রেলিয়ান মরুভূমি, পশ্চিম এশিয়ার আরবীয় মরুভূমি এবং সিরিয়ান মরুভূমি, দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর সোনোরান মরুভূমি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোজাভে মরুভূমি, ভারত এবং পাকিস্তানের থর মরুভূমি, আফগানিস্তানের দস্ত-ই-মারগো এবং রেগিস্তান মরুভূমি এবং ইরানের দস্ত-ই-কবির এবং দস্ত-ই লুট

নিয়ন্ত্রণ কারক[সম্পাদনা]

নিরক্ষরেখা বরাবর ক্রান্তীয় অঞ্চলটি প্রায় ৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৩ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে একটি বেষ্টনী গঠন করে। একে বলা হয় ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স অঞ্চল। ক্রান্তীয় তাপ এই অঞ্চলে একটি অস্থির বায়ু সৃষ্টি করে। তার ফলে এখানে ক্রান্তীয় আরোহণ প্রক্রিয়াতে আর্দ্রতা হ্রাস পেয়ে বায়ুর ভর অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে ওঠে। [১]

ক্রান্তীয় মরুভূমি-জলবায়ুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য নির্ধারক হ'ল সেখানে সারা বছর ধরে ক্রান্তীয় উচ্চ চাপের উপস্থিতি। হ্যাডলি সেলস বা কোষসমূহ নামে পরিচিত শুষ্ক ও উষ্ণ অবতরণকারী বায়ুকোষগুলি এর সাথে জড়িত। বিশেষত, হ্যাডলি কোষসমূহ বায়ুকে শুষ্ক করে ঘনীভবনে বাধা দেয়। অতিরিক্তভাবে, আর্দ্রতার উৎস থেকে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে শুষ্কতাও বৃদ্ধি পায়। [২]

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

তাপমাত্রা[সম্পাদনা]

অতিরিক্ত (Spare) মেঘ

দিনের বেলায় শক্তির গ্রহণ এবং রাতে তাপের নিষ্ক্রমণ উভয়ই বেশি হওয়ার কারণে ক্রান্তীয় মরুভূমিতে গড় দৈনিক তাপমাত্রা, পৃথিবীর যে কোনও অংশের তুলনায় সর্বোচ্চ থাকে। এই ঘটনায় এখানে দৈনিক তাপমাত্রার সীমানা অত্যন্ত বেড়ে যায়। বিশেষ করে, নিম্ন উচ্চতায় অভ্যন্তরের মরুভূমিতে, দিনের বেলায় তা ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যেতে পারে এবং রাতে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেতে পারে। তাপমাত্রার দৈনিক পরিসর থাকে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। [৩]

ক্রান্তীয় মরুভূমিতে তাপমাত্রার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, এখানে জল এবং উদ্ভিদের অভাবের জন্য তাপের কুপরিবাহিতার কারণে তাপের শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। নিম্নগামী বাতাস, প্রভাবশালী উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে, মেঘমুক্ত আকাশে এসে প্রচুর পরিমাণে কুপরিবাহিতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে মেঘহীন আকাশ, দিনের তাপমাত্রাকে রাতে দ্রুত ছেড়ে দিতে সময় নেয় না।[৩]

বৃষ্টিপাত[সম্পাদনা]

ক্রান্তীয় মরুভূমিতে বৃষ্টিপাত খুবই অনিয়মিত। নিম্ন অক্ষাংশের মরুভূমিতে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৫০ মিমি এরও কম হয়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা খুব কম - মরুভূমির অভ্যন্তরে কেবল মাত্র ১০% থেকে ৩০%। কিছু মরুভূমিতে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয় না। কারণ সেগুলি মহাসাগর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। শুষ্কতার মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে, উচ্চ-চাপের কোষসমূহ এবং উচ্চ তাপমাত্রাও। [৩]

বাতাস[সম্পাদনা]

ক্রান্তীয় মরুভূমির শুষ্কতায় বায়ুর ব্যাপক অবদান রয়েছে দেখা যায়। যদি বাতাসের গতি ৮০ কিলোমিটার/ঘণ্টার বেশি হয়, তবে এটি ধূলিঝড় এবং বালুঝড় উৎপন্ন করতে পারে। এর ফলে পাথুরে পৃষ্ঠের যথেষ্ট ক্ষয় সাধিত হয়। [৪] সে জন্যই বলা হয়, বিভিন্ন ভূমিরূপ গঠনে বায়ু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ঘটনা ইওলিয়ান প্রক্রিয়া হিসাবে পরিচিত। ইওলিয়ান প্রক্রিয়া দু ধরনের হতে পারে: অবনমন এবং ঘর্ষণ

প্রথমত, অবনমন-এর কারণে স্থলভাগের তল, হালকা নীচের দিকে নেমে যায়। ফলে অবনমন ফাঁপ সৃষ্টি হয়, যাতে সমভূমি, অববাহিকা, ব্লোআউটস, বায়ু-ক্ষয়জনিত সমভূমি এবং অধিবৃত্ত আকারের মতো দেখতে বালিয়াড়ি গড়ে উঠতে পারে। [৫] দ্বিতীয়ত, ইওলিয়ান প্রক্রিয়া ঘর্ষণ-এর দিকে পরিচালিত করে। এর ফলে নিম্নভাগ কেটে গিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিরূপ গঠন করে। [৫]

ভূমিরূপ[সম্পাদনা]

বিভিন্ন ধরনের ইওলিয়ান প্রক্রিয়ার কারণে, ক্রান্তীয় মরুভূমিতে বিভিন্ন ভূমিরূপ পাওয়া যায়। প্রধান ভূমিরূপগুলি হ'ল বালিয়াড়ি, অপসারণ (ডিপ্রেসন) এবং প্যান, ইয়ারড্যাং এবং উল্টানো ভূসংস্থান

বালিয়াড়ি[সম্পাদনা]

বালিয়াড়ি

ক্রান্তীয় মরুভূমিতে বিভিন্ন ধরনের বালিয়াড়ি দেখা যায়। তার মধ্য উল্লেখযোগ্য হ'ল, গম্বুজাকৃতি বালিয়াড়ি, আড়াআড়ি বালিয়াড়ি, বারচান্স, তারাআকৃতির বালিয়াড়ি, ছায়া বালিয়াড়ি, রৈখিক বালিয়াড়ি এবং অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি। [৬]

অপসারণ (ডিপ্রেসন)[সম্পাদনা]

কোনও মরুভূমির ডিপ্রেসন অনেক কারণে ঘটতে পারে। যেমন বায়ুজনিত ক্ষয়, প্রশস্ত অগভীর ওয়ার্পিং এবং ব্লক ফল্টিং, স্রোতধারাজনিত ক্ষয়, কার্সট ক্রিয়াকলাপ, লবণের আর্দ্রতা জনিত অপচয় এবং প্রাণীঘটিত (জুজেনিক) প্রক্রিয়া। প্রতিটির প্রতিনিধিত্বকারী উদাহরণ রয়েছে আফ্রিকার অববাহিকা অঞ্চলে, যেমন ফারাফরা, বাহারিয়া, দাখলা, কাতারা, সিওয়া এবং কারঘা। [৭]

প্যান[সম্পাদনা]

প্যান, দক্ষিণ এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মরুভূমির উচ্চ সমভূমিতে বিস্তৃত। প্যান গঠনের জন্য দায়ী কারণগুলির মধ্যে একটি হ'ল উদ্ভিদ-মুক্ত ভূমি এবং কম আর্দ্রতা, বাকি গুলি হ'ল কম জল বিশিষ্ট টেবিল এবং একীভূত পলি এবং প্রচুর পরিমাণে সূক্ষ্ম দানাদার বেলেপাথর ও শেল। প্রতিক্রিয়া পদ্ধতিগুলিও, প্যান বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লবণ ছেড়ে বেরিয়ে আসায়, আবহাওয়া এবং ভবিষ্যতে উদ্ভিদ বৃদ্ধির কারণে, অবক্ষেপ বাধা পায়। এই ক্ষয়কারী প্রক্রিয়া এবং সঞ্চয়ণ প্রক্রিয়া, উভয়ই প্যানকে বেশ প্রভাবিত করে।[৭]

ইয়ারড্যাং

ইয়ারড্যাং[সম্পাদনা]

ইয়ারড্যাং লক্ষ্য করা যায়, মঙ্গলপৃথিবীর কক্ষপথ এবং বায়বীয় চিত্রগুলিতে (এরিয়াল ইমেজ)। ইয়ারড্যাং সাধারণত শুষ্ক অঞ্চলে, প্রধানত বায়ুর প্রক্রিয়ার বিকাশ লাভ করে। এদের সনাতন আকৃতিগুলি প্রবাহিত এবং প্রলম্বিত ঢালবিশিষ্ট হতে পারে। এদের শীর্ষ দেখতে হতে পারে চ্যাপ্টা অথবা দুমড়ানো ও সংক্ষিপ্ত। এদের দৈর্ঘ্য থেকে প্রস্থের অনুপাত ২:১ থেকে ১০:১ পর্যন্ত। এটি বাতাসের অভিমুখ, বাতাসের সংস্পর্শে শিলা-উপাদান থাকার সময়কালের ব্যাপ্তি দিয়ে নির্ধারিত হয়।[৭]

উল্টানো ভূসংস্থান[সম্পাদনা]

আগের স্বল্প উত্থিত স্থানে যেমন বিস্তারিত বিতরণ ব্যবস্থা এবং নদী ব্যবস্থায় উল্টানো ভূসংস্থান গঠিত হয়। বায়ুর ক্ষয় কার্যের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে এদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কারণে, এগুলি অক্ষত থেকে যায়। মিশর, ওমান, চীন এবং মঙ্গলগ্রহ-এর উচ্চ ইয়ারড্যাং ক্ষেত্রগুলিতে প্রায়ই উল্টানো ভূসংস্থান দেখা যায়। [৭]

References[সম্পাদনা]

  1. Thornthwaite, C. W. (১৯৪৮)। "An Approach toward a Rational Classification of Climate"Geographical Review38 (1): 55–94। আইএসএসএন 0016-7428জেস্টোর 210739ডিওআই:10.2307/210739 
  2. Cock, Ian (২০১১-১০-০৬)। "Encyclopedia of Life Support Systems (EOLSS)"। Pharmacognosy Communications1 (2): 50–52। আইএসএসএন 2249-0159ডিওআই:10.5530/pc.2011.2.10অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  3. "Art. 46 Abs. 1 EuGVVO; § 22 Abs. 2 und 3 AVAG; § 807 Abs. 1, § 900 Abs. 1 ZPO"। Internationales Handelsrecht6 (3)। ২০০৬-০১-২৪। আইএসএসএন 2193-9527ডিওআই:10.1515/ihr.2006.6.3.121 
  4. Costa, Giovanni (১৯৯৫), "Introduction", Behavioural Adaptations of Desert Animals, Adaptations of Desert Organisms, Springer Berlin Heidelberg, পৃষ্ঠা 1–3, আইএসবিএন 9783642793585, ডিওআই:10.1007/978-3-642-79356-1_1 
  5. Stronge, William B.; Diaz, Henry F.; Bokuniewicz, Henry; Inman, Douglas L.; Jenkins, Scott A.; Hsu, John R. C.; Kennish, Michael J.; Bird, Eric; Hesp, Patrick A. (২০০৫), "Eolian Processes", Schwartz, Maurice L., Encyclopedia of Coastal Science, Springer Netherlands, পৃষ্ঠা 428, আইএসবিএন 9781402019036, ডিওআই:10.1007/1-4020-3880-1_137 
  6. Parsons, Tony (১৯৯৪)। "Book reviews : Cooke, R.U., Warren, A. and Goudie, A.S. 1993: Desert geomorphology. London: UCL Press. viii + 526 pp. £75.00 cloth, £24.95 paper."। Progress in Physical Geography: Earth and Environment18 (3): 455–456। আইএসএসএন 0309-1333আইএসবিএন 1857280164ডিওআই:10.1177/030913339401800314 
  7. Parsons, Tony (১৯৯৪)। "Book reviews : Cooke, R.U., Warren, A. and Goudie, A.S. 1993: Desert geomorphology. London: UCL Press. viii + 526 pp. £75.00 cloth, £24.95 paper."। Progress in Physical Geography: Earth and Environment18 (3): 455–456। আইএসএসএন 0309-1333আইএসবিএন 1-857280164ডিওআই:10.1177/030913339401800314