ওয়েলসের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ওয়েলসের ইতিহাস শুরু, কয়েক হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে মানুষ-এর আগমন দিয়ে। হোমো সেপিয়েন্স-এর আবির্ভাব প্রায় ৩১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে[১] হলেও, কমপক্ষে ২,৩০,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা এখনকার ওয়েলস বা সাইমরুতে বাস করত।[২] তবে, আধুনিক মানুষের নিয়মিত বসবাস শুরু হয় প্রায় ৯০০০ খ্রিস্টপূর্বের শেষ বরফ যুগ-এর পরে এবং ওয়েলসের মধ্য প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ এবং ব্রোঞ্জ যুগ-এর অনেক অবশেষ রয়েছে। লৌহ যুগ-এর সময় এই অঞ্চলটি ফোর্থ (নদী) মোহানা-র দক্ষিণের সমগ্র ব্রিটেনের মতোই সেল্টিক ব্রিটোনস এবং ব্রিটোনিক ভাষার আধিপত্য ছিল। রোমানরা, ৪৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু করে ব্রিটেন জয়। ৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ডিসাঙ্গালি-এর বিরুদ্ধে এখনকার উত্তর-পূর্ব ওয়েলস, তারপর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে অরডোভিসেসকে পরাজিত করে সমগ্র এলাকার উপর তাদের দখল হাসিল করে। রোমানরা ৫ম শতাব্দীতে অ্যাংলো-স্যাকসন আক্রমণ-এর দ্বার উন্মুক্ত করে, ব্রিটেন ত্যাগ করে চলে যায়। এরপরে ব্রিটোনিক ভাষা ও সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে এবং বিভিন্ন স্বতন্ত্র দল গড়ে ওঠে। ওয়েলস জনগণ ছিল এই দলগুলির মধ্যে বৃহত্তম। একাদশ শতাব্দীর পরে সাধারণ টিকে থাকা অন্যান্য ব্রিটোনিক-ভাষী লোকেরা স্বাধীনভাবে পৃথক পৃথকভাবে আলোচিত হতে শুরু করে।

বর্তমান ওয়েলসে বেশ কয়েকটি রাজ্য গঠিত হয়েছিল রোমান উত্তর সময়কালের পরে। সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিলেন ব্রিটোনদের রাজা (পরবর্তী কালে টাইওয়সোগ সাইমরু: নেতা বা প্রিন্স অফ ওয়েলস) এবং কিছু শাসক তাদের ওয়েলশ অঞ্চলগুলিতে এবং পশ্চিম ইংল্যান্ডে তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে কেউই বেশি দিন ওয়েলসকে একত্রিত করতে সক্ষম হননি। আন্তঃ-সংগ্রাম এবং ইংরেজদের বাইরের চাপে এবং পরবর্তীকালের ইংল্যান্ডের নরম্যান বিজয়ীরা ওয়েলশ রাজ্যগুলিকে ধীরে ধীরে ইংরেজ মুকুটের আওতায় নিয়ে আসে। ১২৮২ সালে, লিওলিন এপ গ্রুফার্ড-এর মৃত্যুর ফলে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড প্রথম, প্রিন্সিপালিটি অফ ওয়েলস-এর জয় হাসিল করেন, এবং এর পরে ইংরেজ রাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশিত উত্তরাধিকারী "প্রিন্স অফ ওয়েলস" উপাধি লাভ করেন। ওয়েলশবাসী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ করেছিল। এর মধ্যে, শেষ উল্লেখযোগ্য হল ১৫ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ওয়েন গ্লাইনডর পরিচালিত বিদ্রোহটি। ষোড়শ শতাব্দীতে হেনরি অষ্টম, ওয়েন টিউডর-এর বড় নাতি হিসাবে ওয়েলশ আহরণে নিজে ওয়েলস অ্যাক্টস-এর আইন পাস করেছিলেন যাতে ওয়েলসকে পুরোপুরি ইংল্যান্ড রাজ্য-র অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ইংল্যান্ডের কর্তৃত্বাধীনে ওয়েলস ১৭০৭ সালে গ্রেট ব্রিটেন সাম্রাজ্য-র একটি অংশ এবং পরে ১৮০১ সালে যুক্তরাজ্যের অংশে পরিণত হয়। তবুও, প্রবল ইংরেজ আধিপত্য সত্ত্বেও ওয়েলসবাসী তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। ১৫৮৮ সালে উইলিয়াম মরগান কর্তৃক প্রথম সম্পূর্ণ বাইবেলের ওয়েলশ অনুবাদ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ওয়েলসের অবস্থান ব্যাপকভাব বৃদ্ধি পায়।[৩]

আঠারো শতকে দুটি পরিবর্তন, ওয়েলসকে প্রভাবিত করে। ওয়েলশ মেথোডিস্ট পুনর্জাগরণ-এর ফলে দেশটি ধর্মকে ক্রমবর্ধমানভাবে সংবিধানবাদী ও শিল্প বিপ্লব ঘটানোর পথে পরিচালিত করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর উত্থানের সময়, ১৯ শতাব্দীতে দক্ষিণপূর্ব ওয়েলসে, অভিজ্ঞ শিল্পায়ন এবং কয়লালৌহ শিল্প-র ফলে জনসংখ্যায় নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটে।[৪] প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওয়েলস একটি সম্পূর্ণ এবং ইচ্ছুক ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমাপ্তির সাথে সাথে ২০ শতাব্দীতে ওয়েলসের শিল্পগুলিও হ্রাস পেতে থাকে, যখন জাতীয়তাবাদী মনোভাব এবং স্ব-সিদ্ধান্তের প্রতি আগ্রহের উন্মেষ বাড়তে থাকে। ১৯২০ এর দশকে লেবার পার্টি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে, লিবারেল পার্টি-র স্থান দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়েলস, গ্রেট ব্রিটেন যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং মিত্র দেশগুলির পাশাপাশি যথেষ্ট বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তার জেরে এর শহরগুলিতে নাজি ব্লিজ ব্যাপকভাবে বোমা হামলা চালায়। জাতীয়তাবাদী দল প্লেইড সাইমরু ১৯৬০ এর দশক থেকে গতি অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে গণভোটে ওয়েলশ ভোটাররা সরকারী দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ-এর পক্ষে ওয়েলস জাতীয় সংসদ অনুমোদন করে (বর্তমানে সেনেড বা ওয়েলশ সংসদ) হিসাবে পরিচিত), যা ১৯৯৯ সালে প্রথম রূপ পায়।

প্রাগৈতিহাসিক ওয়েলস[সম্পাদনা]

আধুনিক ওয়েলসের সর্বাপেক্ষা পরিচিত প্রাচীন মানব অবশেষ হ'ল, একটি নিয়ান্ডারথাল চোয়াল। সেটি নর্থ ওয়েলস-এর এলউই নদী উপত্যকায় বোন্টনিউড প্যালিওলিথিক ক্ষেত্র-য় পাওয়া যায়। এর মালিক প্রায় ২,৩০,০০০ বছর আগে নিম্ন প্রস্তরযুগ-এ বাস করত।[৫] ১৮২৩ সালে সাউথ ওয়েলসের সাওয়ানসিয়া-য় গাওয়ার উপদ্বীপ-এর পাভিল্যান্ড চুনাপাথর-এর একটি গুহায় লাল গিরিমাটি রঞ্জিত একটি মানব কঙ্কাল, প্যাভিল্যান্ডের রেড লেডি আবিষ্কৃত হয়। এই নাম সত্ত্বেও, কঙ্কালটি আসলে এমন এক যুবকের, যে প্রায় ৩৩,০০০ বছর আগে উচ্চ প্রস্তরযুগ (পুরানো প্রস্তর যুগ)-এর শেষে বাস করত। [১] এটি পশ্চিম ইউরোপের প্রাচীনতম আনুষ্ঠানিক সমাধিস্থল হিসাবে বিবেচিত হয়। সঙ্গে পাওয়া গেছে, একটি ম্যামথ-এর খুলি সহ হাতির দাঁত এবং সামুদ্রিক ঝিনুক-এর তৈরি গয়না।

ব্রায়ান সেলি ডিডু, অ্যাঙ্গলেসে-এ শেষ নব্য প্রস্তর যুগের একটি সমাধি।

শেষ বরফযুগে প্রায় ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বে ওয়েলস মোটামুটি আজকের আকার লাভ করে এবং এখানের বাসিন্দা ছিল মধ্য প্রস্তরযুগ-এর শিকারী-সংগ্রহকারী মানুষ। এখন বিশ্বাস করা হয়, প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বে আদি কৃষক সম্প্রদায় এখানে নতুন প্রস্তরযুগ-এর সূচনা করে। এই সময়কালের অনেকগুলি প্রাগৈতিহাসিক সমাধি কক্ষ বিশেষত পাথরের টেবিল আর প্রস্তর সমাধিকক্ষ-র নির্মাণ চোখে পড়ে। এইসব প্রাগৈতিহাসিক সমাধিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে অ্যাঙ্গলেসের ব্রায়ান সেলি ডিডু এবং বারক্লোদিয়াদ ওয়াই গ্যাওয়্যাস,[৬] পামব্রোকশায়ারের পেন্ট্রে ইফান এবং গ্ল্যামারগান উপত্যকায় টিঙ্কিনসউড বুরিয়াল চেম্বার[৭]

ধাতব সরঞ্জামগুলি ওয়েলসে প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে আবির্ভূত হয়েছে, প্রথমে তামা, পরে ব্রোঞ্জপ্রাথমিক ব্রোঞ্জ যুগে-এর সময়কালে (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০–১৪০০) জলবায়ু বর্তমানের তুলনায় উষ্ণ ছিল বলে মনে করা হয়। কারণ এখনকার ভূখণ্ডে ঐ সময়ের অনেক অবশেষ রয়েগেছে। ব্রোঞ্জ যুগের শেষ পর্যায়ে (খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-৭৫০) আরও উন্নত ব্রোঞ্জ সরঞ্জামের বিকাশ দেখা যায়। ব্রোঞ্জ তৈরির জন্য বেশিরভাগ তামা সম্ভবত গ্রেট ওর্ম-এর তামা খনি থেকে এসেছিল। সেখানের প্রাগৈতিহাসিক খননটির বেশিরভাগ মধ্য ব্রোঞ্জ যুগের হয়ে থাকবে।[৮] রেডিওকার্বন ডেটিংও ওয়েলস গঠন-সংক্রান্ত সমর্থন দেখিয়েছে। ইতিহাসবিদ জন ডেভিস-এর ত্বত্ত বলে, খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ সালের পরে একটি ক্রমবর্ধমান জলবায়ুর কারণে (নিম্ন তাপমাত্রা এবং ভারী বৃষ্টিপাত) উত্পাদনশীল জমি রক্ষার প্রয়োজন হয়েছিল। [৯]

ওয়েলসে পাওয়া প্রথম লোহার প্রয়োগ হ'ল লিলিন ফওয়া-এর একটি তলোয়ার যার নেথ উপত্যকা মাথাটিকে অবলম্বন করে ধারণা করা হয়, এটি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ খ্রিস্টাব্দর।[১০] গিরিদূর্গ নির্মাণ ব্রিটিশ লৌহ যুগ-এও চালু ছিল। প্রায় ৬০০ গিরিদূর্গ ওয়েলসে রয়েছে, যা ব্রিটেনের থেকে ২০% এরও বেশি। উদাহরণ হিসাবে ল্যান উপদ্বীপ-এর অ্যাবারাইস্থ এবং ট্রে-র সেইরি-র কাছে পেন ডাইনাস[৯] এই সময়কালের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সন্ধান পাওয়া গেছে ১৯৪৩ সালে অ্যাংলেসের কাছে লয়ন সেরিগ বাচ-এ, যখন রয়্যাল এয়ার ফোর্স ঘাঁটি নির্মাণের জন্য মাটি প্রস্তুত করা হচ্ছিল। পাওয়া গেল অস্ত্র, ঢাল, রথ এবং সে সবের আনুসঙ্গ, এবং দাসদের শৃঙ্খল এবং আরও যন্ত্রপাতি, সাজ-সরঞ্জাম। সেগুলির অধিকাংশই ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয়। [১১]

অতিসম্প্রতি ওয়েলসের প্রাগ্-ইতিহাসকে একটি ধারাবাহিক অভিবাসন হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছিল।[৩] বর্তমান প্রবণতা হল জনসংখ্যার ধারাবাহিকতার খোঁজ নেওয়া। ওয়েলস বিশ্বকোষ থেকে জানা যায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বে ওয়েলস, মূল লোকসংখ্যার বৃহত্তর অংশই পেয়ে গিয়েছিল।[৩] সাম্প্রতিক জনসংখ্যার জেনেটিক্স-এর গবেষণাগুলি উচ্চ প্রস্তরযুগ, মধ্য বা নিম্ন প্রস্তরযুগ থেকে জিনগত ধারাবাহিকতার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে। [১২][১৩] ইতিহাসবিদ জন ডেভিসের মতে, অভিবাসনের থেকেও ব্রিটেন জুড়ে কথিত ব্রাইথোনিক ভাষাগুলি দেশীয় "ক্রমসঞ্চিত সেল্টিসিটি (cumulative Celticity)"-র ফলস্বরূপ এসেছিল।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Richards, MP; Trinkaus, E (সেপ্টেম্বর ২০০৯)। "Out of Africa: modern human origins special feature: isotopic evidence for the diets of European Neanderthals and early modern humans"Proc. Natl. Acad. Sci. U.S.A.106 (38): 16034–9। ডিওআই:10.1073/pnas.0903821106পিএমআইডি 19706482পিএমসি 2752538অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  2. Davies, J A History of Wales, pp. 3–4.
  3. Davies, John (Ed) (২০০৮)। The Welsh Academy Encyclopaedia of Wales। Cardiff: University of Wales Press। পৃষ্ঠা 572। আইএসবিএন 978-0-7083-1953-6 
  4. Williams G.A.When was Wales? p. 174
  5. Davies, J A History of Wales, p. 3.
  6. Lynch, F. Prehistoric Anglesey pp.34–42, 58
  7. "Tinkinswood" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে. www.valeofglamorgan.gov.uk. Accessed 3 August 2008
  8. Lynch, F. Gwynedd pp. 39–40
  9. Davies, J The Making of Wales p. 23
  10. Davies, J A history of Wales p. 19
  11. Lynch, F. Prehistoric Anglesey pp.249–77
  12. "Special report: 'Myths of British ancestry' by Stephen Oppenheimer | Prospect Magazine October 2006 issue 127"। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০২০ 
  13. Capelli; ও অন্যান্য (২০০৩)। "A Y Chromosome Census of the British Isles"। Current Biology13 (11): 979–984। ডিওআই:10.1016/s0960-9822(03)00373-7অবাধে প্রবেশযোগ্যপিএমআইডি 12781138