উপেন্দ্রনাথ দাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

উপেন্দ্রনাথ দাস(জন্ম ১৮৪৮ - মৃত্যু ১৮৯৫) বাংলার পেশাদার থিয়েটারের যুগের একজন নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, মঞ্চমালিক, মঞ্চাধ্যক্ষ এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ডিরেক্টর। তার নাট্যজীবন দীর্ঘায়ু না হলেও বহুবিচিত্র ছিল। উনিশ শতকের সাতের দশকে বাংলা পেশাদার থিয়েটারে যে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়া সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বাংলা নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী নাটকের পথিকৃৎ বলা যায় তাঁকে। বস্তুত, উল্লেখযোগ্য নাট্যকার বা কুশলী নাট্যপরিচালক হিসেবে নয়, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবনা এবং প্রত্যক্ষ ও নির্ভীক ব্রিটিশ বিরোধী নাট্যচর্চার জন্যই তিনি বাংলা থিয়েটারে স্মরণীয় হয়ে আছেন।[১]

উপেন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন হাইকোর্টের উকিল শ্রীনাথ দাস। উপেন্দ্রনাথ সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী এবং বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন। প্রথম পত্নী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিবাহটি করেন একজন বিধবা মহিলাকে।[২] এই কারণে পিতার সঙ্গে তার মতান্তর ও বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি পৈতৃক বাড়ি ত্যাগ করে কাশীতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে অমৃতলাল বসুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর তিনি বৃহত্তর সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইন্ডিয়ান র‍্যাডিকাল লীগ স্থাপন করেন। বেশ কিছু সাময়িক পত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। নাটকের প্রতি আগ্রহও এই সময় থেকেই তার মনে অঙ্কুরিত হচ্ছিল।

১৮৭৫ সালে উপেন্দ্রনাথ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের 'লেসী' হন। সেই বছরেরই শেষ দিকে এই থিয়েটারে ডিরেক্টরও হন। ইতিমধ্যে একটি দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়ে তিনি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৭৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তার উদ্যোগে তার থিয়েটারের অভিনেত্রী সুকুমারী(গোলাপ)-র সঙ্গে অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের বিবাহ হয়। বাংলা থিয়েটারে সে সময় সবেমাত্র অভিনেত্রী গ্রহণ শুরু হয়েছে এবং যে নারীরা সে সময় অভিনয় করতেন তারা প্রত্যেকেই এসেছিলেন পতিতা- পল্লী থেকে। ফলে এই ঘটনায় সেদিনের রক্ষণশীল সমাজে কী পরিমাণ আলোড়ন দেখা দিয়েছিল, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ১৮৭৫ সালের ১৭ মার্চ The Indian Daily News পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায় -

হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তার The Indian Stage গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন -

নাট্যচর্চাতেও উপেন্দ্রনাথের এই কালাপাহাড়ি মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সর্বমোট পাঁচটি নাটক লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ১/ শরৎ - সরোজিনী (প্রকাশ হয় ১৮৭৪ সালে। প্রথম অভিনয় হয় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ২ জানুয়ারি, ১৮৭৫)। ২/ সুরেন্দ্র - বিনোদিনী (প্রকাশসাল ১৮৭৫, প্রথম অভিনয় দি নিউ এরিয়ান থিয়েটারে ১৪ আগস্ট , ১৮৭৫)। ৩/ গজদানন্দ ও যুবরাজ (প্রথম অভিনয় ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৬)। ৪/ দি পুলিশ অব পীগ অ্যান্ড শিপ (প্রথম অভিনয় ১ মার্চ, ১৮৭৬)। ৫/ দাদা ও আমি (প্রকাশসাল ১৮৮৮, প্রথম অভিনয় নিউ ন্যাশনাল থিয়েটারে ডিসেম্বর, ১৮৮৮)।

প্রথম দুটি নাটক 'দুর্গাদাস দাস' নামে প্রচারিত হয়েছিল। প্রণয়মুখ্য এই দুটি নাটক সিরিয়াস কমেডি এবং এগুলিতে সমাজ- ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তা অতি উগ্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্লট খুব সাধারণ মানের হলেও পরাধীনতার জ্বালা ও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা এই নাটক দুটিকে বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট জায়গা দিয়েছে। যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস- এর ভারত আগমনের ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা তীব্র ব্যঙ্গাত্মক নাটক 'গজদানন্দ ও যুবরাজ'। পুলিশ- প্রশাসনকে ব্যঙ্গ করে লেখা 'দি পুলিশ অব পীগ অ্যান্ড শিপ'। 'দাদা ও আমি' লঘু কমেডি। নাট্যরচয়িতা হিসেবে উপেন্দ্রনাথ খুব উঁচুদরের ছিলেন না। সমসাময়িক কিছু ঘটনা এবং বাস্তব জীবনকে অবলম্বন করে তিনি নাটকগুলি লিখেছিলেন।

ডিরেক্টর হিসেবে উপেন্দ্রনাথের সময়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে একের পর এক ব্রিটিশ - বিরোধী নাটক অভিনীত হতে থাকে। প্রথমেই অমৃতলাল বসুর লেখা 'হীরকচূর্ণ' নাটক। এই নাটকের বিষয় ছিল বরোদা রাজ্যের ইংরেজ রেসিডেন্টের বিষপানে মৃত্যু এবং সেই অছিলায় ইংরেজের বরোদার গায়কোয়ারের সিংহাসন কেড়ে নেওয়া। 'শরৎ - সরোজিনী' ও 'সুরেন্দ্র - বিনোদিনী'-র মধ্যেও ব্রিটিশ বিরোধিতার সুর ছিল চড়া। এরপর 'গজদানন্দ ও যুবরাজ' অভিনয় করে গ্রেট ন্যাশনাল ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে যায়। প্রধানত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার এবং বেঙ্গল থিয়েটারের পরপর ব্রিটিশ বিরোধী নাটক অভিনয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকার অভিনয়- নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করার পরিকল্পনা করে। ১৮৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি লর্ড নর্থব্রুক এই মর্মে এক অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরে ডিসেম্বর মাসে এটি আইন হিসেবে পাশ হয়। ৪ মার্চ 'সতী কি কলঙ্কিনী' নাটকের অভিনয় চলাকালীন পুলিশ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ঘিরে ফেলে এবং ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস, ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, অভিনেতা মতিলাল সুর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, মহেন্দ্রলাল বসু, শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গোপাল দাস এবং সঙ্গীতকার রামতারণ সান্যালকে গ্রেপ্তার করে। পরে মালিক ভুবনমোহন নিয়োগী আত্মসমর্পণ করেন। ৮ মার্চ বিচারের রায় বেরোয়। উপেন্দ্রনাথ এবং অমৃতলাল বসুর একমাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়, বাকিরা ছাড়া পান। আপীল করার পর ২০ মার্চ তারিখে তারা দুজনেও ছাড়া পান। এরপর উপেন্দ্রনাথ বিলেতে চলে যান। মামলা মোকদ্দমার হাত থেকে মুক্তি পাবার আগে থেকেই তিনি টি বি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর আর্থিক দুর্দশার মধ্যেও পড়তে হয়েছিল। ফলে তখনকার মতো থিয়েটারের পাট চুকিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বিধবা বিবাহ করায় বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যস্থতায় উপেন্দ্রনাথের পিতা শ্রীনাথ দাস উপেন্দ্রনাথকে ক্ষমা করেন এবং তারপর তাকে সুস্থ করে বিলেতে পাঠিয়ে দেন। তার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনও তথ্য জানা যায় না।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলার নট-নটী (প্রথম খণ্ড), দেবনারায়ণ গুপ্ত, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৩৬-৪১
  2. বাংলার নট-নটী (প্রথম খণ্ড), দেবনারায়ণ গুপ্ত, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৪০

১/ দর্শন চৌধুরী, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪২৯। ২/ অমিত মৈত্র, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ৩৫- ৩৬। ৩/ Hemendranath Dasgupta, The Indian Stage : Vol - 1, M.K. Dasgupta, 1938। ৪/ অমিত মৈত্র, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ৪১।