আনজা (ইসলামি স্থাপত্য)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ফেজের কারাওয়াইন মসজিদের আনজা, যা ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি।

অনাযা (আরবি: عنزة) বা আনযা (অন্যভাবে 'আনজা' বা 'আনজাহ' বানানেও লেখা হয়) হলো এক ধরণের ছোট্ট বর্শা বা লাঠি যা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ধর্মীয় রীতিনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ যখন প্রার্থনার দিক (কিবলা) নির্দেশ করার জন্য মাটিতে তার বর্শা গেঁথেছিলেন তখন থেকে এই শব্দটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কালক্রমে, "আনজা" একটি স্থাপত্য শব্দে পরিণত হয় যা মসজিদের বাইরের মিহরাবকে বোঝায়, বিশেষ করে মাগরেব অঞ্চলে

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

'আনাজা' ছিল নবী মুহাম্মাদ এর বর্শা[১] (যাকে 'হারবা' নামেও ডাকা হত)। ইতিহাসে এর প্রথম আবির্ভাব ঘটে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে (২ হিজরি), যখন নবী মুহাম্মাদ প্রথম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করেন।[২] তিনি এবং অন্যান্য মুসলিমরা যখন মুসাল্লায় (খোলা জায়গায় নামাজের স্থান) পৌঁছালেন, তখন তিনি বর্শাটি মাটিতে গেঁড়ে নামাজের দিক (কিবলা) নির্দেশ করলেন। এই প্রথাটি মসজিদগুলোতে মিহরাবের উদ্ভবের আগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। সেই বছরেরই ঈদ-উল-আযহায় আবার‌ও একইভাবে এই বর্শা ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তী খলিফারা এই প্রথাকে আরও বিস্তৃত করেন এবং মিম্বরে (মসজিদে ইমামের বক্তৃতার স্থান) আরোহণের সময় একটি লাঠি, তলোয়ার বা ধনুক সঙ্গে রাখার রীতি চালু করেন, যা কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে কাজ করতো।[১] কিছু প্রাথমিক উমাইয়া মুদ্রায়ও একটি মিহরাব কাঠামোর সামনে একটি আনাজা গাঁথার চিত্র পাওয়া যায়।[১]

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

প্রাথমিক কিবলা নির্দেশক হিসাবে এর প্রতীকী ব্যবহারের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্কের কারণে, "আনাজা" শব্দটি পরবর্তীতে পশ্চিম মাগরেব এবং মরক্কোর অনেক মসজিদে পাওয়া একটি স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। স্থাপত্যের এই উপাদানটি একটি "বাইরের" বা "গ্রীষ্মকালীন" মিহরাব নির্ধারণ করেছিল। প্রায়শই এটি একটি অলঙ্কৃত কাঠের পর্দার রূপ ধারণ করতো, যা মসজিদের সাহান (চত্বর/অঙ্গন) এবং অভ্যন্তরীণ প্রার্থনা হলের মধ্যবর্তী সীমানায় অবস্থিত ছিল। এটি সাধারণত মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাব অক্ষের সাথে সারিবদ্ধ করা হত। এই আনাজার কাজ ছিল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত নামাজের জন্য মিহরাব হিসাবে কাজ করা।[৩]:২৯৬ কাঠের পর্দাটি প্রায়শই একটি স্টাইলাইজড মিহরাব মোটিফ এবং অন্যান্য শিলালিপি চিত্রিত জটিল খোদাই ও চিত্র দিয়ে সজ্জিত করা হত। বিকল্পভাবে, আনাজাটি প্রার্থনা হলের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের ঠিক আগে প্রাঙ্গণের মাটিতে বা মেঝেতে একটি সাধারণ চিহ্নও হতে পারে, যেমন প্রবেশদ্বারে নিয়ে যাওয়া সিঁড়ির মাঝখানে একটি অর্ধ-বৃত্তাকার খাঁজ বা খাঁজ।[৩][৪]

মরক্কো ও মাগরেব জুড়ে মসজিদে কাঠের আনাজা নির্মিত হয়েছিল। মরক্কোতে বিশেষভাবে "গ্র্যান্ড মসজিদ" বা শুক্রবারের মসজিদের একটি আদর্শ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।[৪]:৫৪ সবচেয়ে পুরনো জীবিত নমুনাটি হল ফেজ-এর আল-আন্দালুসিয়ান মসজিদের আনাজা, যার নির্মাণকাল ১২০৯ খ্রিস্টাব্দ (আলমোহাদ যুগ থেকে)।[৪]:১৩৩ ঐতিহাসিক সূত্রগুলো ফেজের কারাওইন মসজিদে আরও পুরানো একটি আনাজার কথাও উল্লেখ করে, যা ১১২৯ খ্রিস্টাব্দের (আলমোরাভিদ যুগের সময়)।[৫] কিন্তু আজ তা আর নেই এবং বর্তমান মারিনিদ-যুগের আনাজা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে যা ১২৮৮ এবং ১২৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল।[৬][৪]:১৩৩ ফেস এল-জেডিদের গ্র্যান্ড মসজিদের আনাজা, যা সম্ভবত মসজিদটির নির্মাণকাল ১২৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রয়েছে। এটি অনেকটাই একইরকম দেখতে এবং হয়তো এটিই সবচেয়ে পুরানো মারিনিদ আনাজা। একটি অনুরূপ উদাহরণ মেকনেসের গ্র্যান্ড মসজিদেও পাওয়া যায় কিন্তু এটি অনেক পরে ১৭১৫ সালে (আলাউইত সুলতান মৌলে ইসমাইলের শাসনামলে) নির্মিত হয়েছিল।[৭] কিছু অন্যান্য মারিনিদ-পরবর্তী উদাহরণের মধ্যে রয়েছে মারাকেশের ষোড়শ শতাব্দীর মুয়াসিন মসজিদের আনাজা (সাদিয়ান যুগ থেকে)।[৮][৩] অন্যদিকে মারাকেশের প্রায় সমসাময়িক বাব দুক্কালা মসজিদের আনাজা হল আসলটির একটি আধুনিক প্রতিস্থাপন।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Treadwell, Luke (২০০৫)। ""Mihrab and ʿAnaza" or "Sacrum and Spear"? A Reconsideration of an Early Marwanid Silver Drachm"। Muqarnas22: 1–28। জেস্টোর 25482421 
  2. Miles, C.G. (২০১২)। "'Anaza"। Encyclopaedia of Islam, Second Edition। Brill। 
  3. Almela, Iñigo (২০১৯)। "Religious Architecture as an Instrument for Urban Renewal: Two Religious Complexes from the Saadian Period in Marrakesh"। Al-Masāq31 (3): 272–302। hdl:10261/212691অবাধে প্রবেশযোগ্যএসটুসিআইডি 167107436ডিওআই:10.1080/09503110.2019.1589973 
  4. El Khammar, Abdeltif (২০০৫)। Mosquées et oratoires de Meknès (IXe-XVIIIe siècle): géographie religieuse, architecture et problème de la Qibla। Université Lumière-Lyon 2। 
  5. Terrasse, Henri (১৯৬৮)। La Mosquée al-Qaraouiyin à Fès; avec une étude de Gaston Deverdun sur les inscriptions historiques de la mosquée। Paris: Librairie C. Klincksieck। 
  6. Maslow, Boris (১৯৩৭)। Les mosquées de Fès et du nord du Maroc। Paris: Éditions d'art et d'histoire। পৃষ্ঠা 38–53। 
  7. Touri, Abdelaziz; Benaboud, Mhammad; Boujibar El-Khatib, Naïma; Lakhdar, Kamal; Mezzine, Mohamed (২০১০)। Le Maroc andalou : à la découverte d'un art de vivre (2 সংস্করণ)। Ministère des Affaires Culturelles du Royaume du Maroc & Museum With No Frontiers। আইএসবিএন 978-3902782311 
  8. Salmon, Xavier (২০১৬)। Marrakech: Splendeurs saadiennes: 1550-1650। Paris: LienArt। আইএসবিএন 9782359061826