অ্যানাস মিরাবিলিস গবেষণাপত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আলবার্ট আইস্টাইন, ১৯২১ সালের ছবি
আলবার্ট আইনস্টাইন, ১৯২১ সালের ছবি

অ্যানাস মিরাবিলিস পেপারগুলি (উৎপত্তি ল্যাটিন annus mīrābilis থেকে, যার অর্থ "অলৌকিক বছর") হল চারটি গবেষণাপত্র যা আলবার্ট আইনস্টাইন 1905 সালে একটি বৈজ্ঞানিক জার্নাল Annalen der Physik (Annals of Physics)-এ প্রকাশ করেছিলেন। এই চারটি গবেষণাপত্র ছিল আধুনিক পদার্থবিদ্যার ভিত্তি। এই গবেষণাপত্রগুলো স্থান, সময়, ভর এবং শক্তির মৌলিক ধারণা সম্পর্কে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আইনস্টাইন এই অসাধারণ গবেষণাপত্রগুলি একই বছরে (১৯০৫ এ) প্রকাশ করেছিলেন, ১৯০৫ কে তার অ্যানাস মিরাবিলিস (ইংরেজিতে অলৌকিক বছর) বলা হয়।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

আইনস্টাইন ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯০১ সালেই তিনি সুইজারলেন্ডের নাগরিকত্ব অর্জন করেন। তখনো পর্যন্ত তিনি কোনো চাকরি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ১৯০২ সালে তিনি তার বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান এর পিতার সৌজন্যে সুইজ পেটেন্ট অফিসে সহকারি পরীক্ষকের অস্থায়ী পদে যোগদান করেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রের পেটেন্ট পরীক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তী বছরেই তার চাকরি স্থায়ী হয়ে যায়।

১৯০৫ সালের ৩০ এপ্রিল আইনস্টাইন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলফ্রেড ক্লাইনারের তত্ত্বাবধানে তার থিসিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে আইনস্টাইন তার "A New Determination of Molecular Dimensions" প্রবন্ধের জন্য জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। একই বছর তিনি Annalen der Physik নামক জার্মান জার্নালে চারটি যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত গবেষণাপত্র সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

গবেষণাপত্রগুলোর প্রথমটি ছিল আলোক তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কে, যার ব্যাখ্যা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক-এর কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করে। এ কাজের জন্য তিনি ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। পরবর্তী গবেষণাপত্রটি ছিল ব্রাউনীয় গতির উপর, যা ১৮২৭ সালে রবার্ট ব্রাউন বর্ণনা করেছিলেন। অন্যদুটি গবেষণাপত্র হলো যথাক্রমে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং ভর-শক্তি সমতা, যেগুলো পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই তত্ত্বগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি, এবং অনেক সমালোচনার সম্মুখিন হয়।


গবেষণাপত্রসমূহ[সম্পাদনা]

আলোক তড়িত ক্রিয়া
উচ্চশক্তির ফোটন নিক্ষেপের মাধ্যমে কোনো বস্তুর উপরিতল থেকে ইলেকট্রন অপসারণ করা সম্ভব

আলোক তড়িৎ ক্রিয়া[সম্পাদনা]

বিস্তারিতঃ আলোক তড়িৎ ক্রিয়া

আলোক তড়িৎ ক্রিয়া কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোন বস্তুর ওপর রঞ্জন রশ্মি বা দৃশ্যমান আলো পড়লে তা থেকে শক্তি শোষন করে ইলেক্ট্রনের নির্গমনকে ব্যাখ্যা করা হয়। নির্গত ইলেকট্রনকে বলা হয় আলোক-ইলেকট্রন । এর আবিষ্কারক হেনরিখ হার্টজের নামানুসারে এই ক্রিয়াকে বলা হয় হার্টজ ক্রিয়া, যদিও এই নামের ব্যবহার অনেক কম। আলোক তড়িৎ ক্রিয়া আলোর কোয়ান্টাম আচরণ বোঝার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ। আলোর এই ধর্ম থেকে তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা ধারণার সূত্রপাত ঘটেছে।

ব্রাউনীয় গতি
ব্রাউনীয় গতির নমুনা

ব্রাউনীয় গতির ব্যাখ্যা[সম্পাদনা]

বিস্তারিতঃ ব্রাউনীয় গতি

ব্রাউনীয় গতি বা পেডিসিস (প্রাচীন গ্রিক: πήδησις /pɛ̌ːdɛːsis/ "লাফানো") হলো কোনো মাধ্যমের (তরল বা গ্যাসীয়) কণাসমূহের এলোমেলো গতি।

সাধারণত প্রবাহীর সাব-ডোমেনের ভিতরে কণাসমূহের এলোমেলো চলাচলের ফলে গতির এই প্যাটার্ন হয়ে থাকে যা পরে অন্য সাব-ডোমেনে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে প্রতিটি স্থানান্তরের ফলে নতুন বদ্ধ আয়তনে কণাগুলো আরও অধিক ওঠানামা করতে থাকে। এই প্যাটার্ন কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় প্রবাহীর তাপীয় সাম্যাবস্থা প্রকাশ করে। এই জাতীয় প্রবাহীর মধ্যে, প্রবাহের কোনও নির্দিষ্ট দিক নেই। আরও সুনির্দিষ্টভাবে, প্রবাহীর সামগ্রিক রৈখিক এবং কৌণিক ভরবেগ সময়ের সাথে সাথে শূন্য থাকে। কণাসমূহের আণবিক ব্রাউনীয় গতির সাথে আণবিক ঘূর্ণন ও কম্পনের গতিশক্তি, প্রবাহীর মোট অভ্যন্তরীণ শক্তির সমান।

স্থান-কালের ত্রিমাত্রিক প্রদর্শন
স্থান-কালের ত্রিমাত্রিক প্রদর্শন

সাধারণ আপেক্ষিকতা[সম্পাদনা]

বিস্তারিতঃ সাধারণ আপেক্ষিকতা

সাধারণ আপেক্ষিকতা বা আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব (ইংরেজিতে General Theory of Relativity তথা GTR নামে পরিচিত) বলতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন কর্তৃক ১৯১৫-১৯১৬ সালে আবিষ্কৃত মহাকার্ষের জ্যামিতিক তত্ত্বকে বোঝায়। এটি বিশেষ আপেক্ষিকতা এবং নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে একীভূত করার মাধ্যমে একটি বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির জন্ম দিয়েছে। অন্তর্দৃষ্টিলব্ধ বিষয়টি হচ্ছে, স্থান এবং কালের বক্রতার মাধ্যমে মহাকর্ষীয় ত্বরণকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তিনি এই ফর্মুলার মাধ্যমে স্থান ও কালের মধ্যে সংযোগ সেতু স্থাপন করেছেন যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বড় ভূমিকা পালন করে। স্থান-কালের মধ্যস্থিত পদার্থের ভর-শক্তি এবং ভরবেগের কারণেই এই বক্রতার উৎপত্তি ঘটে। ভবিষ্যতে এই তত্ত্ব "টাইম মেশিন" বা সময় যন্ত্রের ধাঁধা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন।

ভর-শক্তির সমতা নীতি
ভর ও শক্তি পরস্পর রূপান্তরযোগ্য, যা পীথাগোরাসের উপপাদ্য দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব

ভর-শক্তি সমতা[সম্পাদনা]

বিস্তারিতঃ ভর-শক্তি সমতা

এটি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত একটি সমীকরণ যা ভরের সাথে বস্তুর ভর এবং শক্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রকাশ করে। সমীকরণটি হল E = mc2, যেখানে E হল জুলে বস্তুর শক্তি, m হল এর আপেক্ষিক ভর কিলোগ্রামে, এবং c হল আলোর গতি (প্রায় 3 X 108 মিটার প্রতি সেকেন্ডে)। ভর-শক্তির সমতা মানে একটি সিস্টেমের মোট ভর পরিবর্তিত হতে পারে, যদিও মোট শক্তি এবং ভরবেগ স্থির থাকে; উদাহরণস্বরূপ, একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি প্রোটনের সংঘর্ষ উভয় কণার ভরকে ধ্বংস করে, কিন্তু ফোটনের আকারে শক্তি তৈরি করে। পারমাণবিক বিভাজন এবং ফিউশন বিক্রিয়ার তত্ত্বগুলির বিকাশের জন্য ভর-শক্তি সমতুল্যতার আবিষ্কার অপরিহার্য ছিল।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Mass Energy Equivalence"Study Smarter