মানি লন্ডারিং

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(অর্থশোধন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মুদ্রা পাচার সম্পর্কিত একটি ইলাস্ট্রেশন

মানি লন্ডারিং বা অর্থশোধন হল একটি অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে সেই সম্পদের আংশিক বা পূর্ণ অংশ রুপান্তর বা এমন কোন বৈধ জায়গায় বিনিয়োগ করা হয় যাতে করে সেই বিনিয়োগকৃত সম্পদ থেকে অর্জিত আয় বৈধ বলে মনে হয়, তাকে মানি লন্ডারিং বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের সক্রিয় সহায়তায় মানি লন্ডারিং কার্যক্রম চলে। মানি লন্ডারিং একটি ফৌজদারী অপরাধ[১]

সাধারণত, এক খাতের টাকা আরেক খাতে নিয়ে, সেই টাকা আবার আরেক খাতে নিতে নিতে বিষয়টি এমন দাড়ায় যে মূল উৎস খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। ফলে আইনের লোকজনের পক্ষে অবৈধ উৎসটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। এরকম করার কারণ হল এ অর্থের মালিক ঐ টাকা খরচ করতে পারে না। কারণ, সেক্ষেত্রে সে আইনের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারে। সাধারণত: মাদকদ্রব্য কারবারী, অসৎ রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী আমলারা এরকম পন্থার আশ্রয় নেয়।

সংজ্ঞা[সম্পাদনা]

"মানি লন্ডারিং বলা হয়, কেননা যে প্রক্রিয়ায় কালো টাকা অর্থ লেনদেনের একটি কাহিনীবৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করানো হয় তথা বিশোধিত করা হয়, যাতে তা অন্য প্রান্ত দিয়ে বৈধ অর্থ তথা সাদা টাকা হিসেবে বেরিয়ে আসে, তা পুরোপুরি বর্ণনা করে। অন্যভাবে বললে, বেআইনিভাবে প্রাপ্ত অর্থের উৎস পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর এবং লেনদেনের মাধ্যমে গোপন করা হয়, যাতে সেই একই অর্থ শেষ পর্যন্ত বৈধ আয় হিসেবে দেখানো যায়।"[২]

রবিনসন

অর্থশোধন (মানি লন্ডারিং) এবং অর্থ পাচার (মানি স্মাগলিং) দুটো এক বিষয় নয়। মানি লন্ডারিং শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে অর্থ পাচার উদ্ধৃত করা হলেও, তা মূলত পাচার হওয়া অর্থ অবৈধ উপায়ে বৈধ দেখানোর একটি প্রক্রিয়া। মানি লন্ডারিং এর শব্দগত অর্থ বের করতে গেলে খুব সহজ এর মানে দাঁড়ায় "অর্থ পরিষ্কার করা"। আরেকটু ভেঙে বললে, ইংরেজি 'মানি' শব্দের অর্থ টাকা, আর 'লন্ডারিং' শব্দের অর্থ পরিষ্কার করা। যদিও পারিভাষিক অর্থে এর একটা ভিন্ন মানে রয়েছে যা হল, কোন অপরাধমূলক কার্যক্রম হতে উপার্জিত অবৈধ টাকা বৈধ করার প্রক্রিয়ার আরেক নাম মানি লন্ডারিং। এই প্রক্রিয়ায় অবৈধ বা কালো অর্থের উৎস গোপন করে বেআইনি কোন লেনদেন চক্রের মাধ্যমে বৈধ করা বা স্বচ্ছতা দান করার একটি প্রক্রিয়া।

ভারতে প্রণীত প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ এর ধারা—২(p) তে মানি লন্ডারিং কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা উক্ত আইনের ধারা—৩ এ বর্ণিত মানি লন্ডারিং এর অপরাধে কারা সব্যস্ত হবে, তার মধ্যে প্রথিত আছে, সেখানে যা বলা হয়েছে তা হল[৩]

"যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে অপরাধের উপার্জনের কোন প্রক্রিয়া বা কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এটিকে অবিকৃত সম্পত্তি হিসেবে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে অথবা জেনেশুনে পক্ষ নেয় অথবা জেনেশুনে সহায়তা করে কলঙ্কমুক্ত সম্পত্তি হিসেবে উপস্থাপন করে, সে অর্থশোধনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে।"

মূলত মানি লন্ডারিং এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা কিংবা সম্পদকে বৈধ করে নেওয়া হয়। এই কারণেই মানি লন্ডারিংকে বলা হয়ে থাকে ‘ফাইনান্সিয়াল ডিটারজেন্ট’। মানি লন্ডারিং হয়ে যাওয়ার পরে এর প্রাথমিক উৎস খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের জন্য সে অবৈধ উপার্জনকারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই কর ফাঁকি দেওয়া ধনকুবের থেকে শুরু করে মাদক পাচারকারী সবার কাছেই এই মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয়।[৪]

মানি লন্ডারিং-এর উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

মানি লন্ডারিং-এর প্রধান উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত যদি অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আয় হয়ে থাকে তবে সে আয়ের উৎস গোপন করা। যেমন, চোরাচালানের মাধ্যমে উপার্জিত আয় তথা আয়ের সূত্র গোপন করা। দ্বিতীয়তঃ বৈধ অর্থনৈতক কার্যক্রমের মাধ্যমে উপার্জিত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়কর ফাঁকি দেয়া।

অর্থশোধন প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

মানি লন্ডারিং তথা অর্থশোধনের করার কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। তবে সাধারণত তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করা হয়ে থাকে।[৫]

মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়া

সংযোজন বা প্লেসমেন্ট[সম্পাদনা]

যখন কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হতে উপার্জিত অর্থ প্রথমবারের মত অর্থ ব্যাবস্থায় প্রবেশ করানো হয় তাকে সংযোজন বা প্লেসমেন্ট বলে। যেমন- চুরি, ডাকাতি, চোরাচালান বা ঘুষের অর্থ যখন একটি ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয় তখন তাকে সংযোজন বা প্লেসমেন্ট বলে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে জমি ক্রয়, বাড়ি বা গাড়ি ক্রয়, শেয়ার ক্রয় ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রথমবারের মত অবৈধ অর্থ, অর্থ ব্যাবস্থায় প্রবেশ করানো হয়।

স্তরিকরণ বা লেয়ারিং[সম্পাদনা]

এই প্রক্রিয়ায় সংযোজনকৃত অর্থ পর্যায়ক্রমে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে সরানো হয়। এই প্রক্রিয়া অর্থের উৎস গোপন করার কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর, বিদেশে অর্থ প্রেরণ, ট্রাভেলার্স চেকে রুপান্তর, একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অন্যান্য শাখায় বিভিন্ন নামে অর্থের স্থানান্তর বা জমা দেওয়া।

পূনর্বহাল বা ইন্টিগ্রেশন[সম্পাদনা]

স্তরিকরন সফল হলে পরবর্তীতে অবৈধ অর্থ এমনভাবে ব্যবহৃত হয় যাতে করে মনে হয় এটি বৈধ পন্থায় উপার্জিত। এভাবেই লন্ডারিংকৃত অর্থ অর্থনীতিতে পূনর্বহাল হয়। যেমন অবৈধ অর্থ দিয়ে ক্রয়কৃত জমি বিক্রয় করে পুনরায় সেই অর্থ দিয়ে জমি কেনা বা বাড়ি, গাড়ি, বীমা পলিসি ঘন ঘন বাতিল এবং পূনর্বহাল করা ইত্যাদি।

অর্থ পাচারের পদ্ধতি বা ধাপ সমূহ[সম্পাদনা]

মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হল যে অর্থ অবৈধভাবে উপার্জিত হয়েছে, তা অন্য কোন দেশে পাচার করে নিয়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথমে দেশ থেকে বিদেশে প্রথমে আইন বহির্ভূত পন্থা অবলম্বন করে অর্থ পাচার করা হয়, অতঃপর সেই পাচারকৃত অর্থ ভিনদেশী ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের মধ্যে সংযজন ও একীভূত করে বৈধ রূপ দান করা হয়। যে কাজগুলোকে অর্থপাচার হিসেবে অভিহিত করা যাবে সেগুলো আইনে বর্ণিত আছে। বাংলাদেশে প্রণীত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ধারা—২ এর উপধারা (ক)(১), (ক)(২) ও (ক)(৩) অনুসারে ‘‘অর্থ বা সম্পত্তি পাচার’’ বলতে বোঝায়[৬]

(১) দেশে বিদ্যমান আইনের ব্যত্যয় ঘটাইয়া দেশের বাহিরে অর্থ বা সম্পত্তি প্রেরণ বা রক্ষণ; বা

(২) দেশের বাহিরে যে অর্থ বা সম্পত্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রহিয়াছে যাহা বাংলাদেশে আনয়ন যোগ্য ছিল তাহা বাংলাদেশে আনয়ন হইতে বিরত থাকা; বা

(৩) বিদেশ হইতে প্রকৃত পাওনা দেশে আনয়ন না করা বা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত পরিশোধ করা;

অর্থ পাচার নানাভাবে হয়ে থাকে। তবে এর ধরন ও পদ্ধতি নিয়ে সরকারি কোনো গবেষণা বা প্রতিবেদন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম কবির হাসান এবং আইএফএ কনসালটেন্সির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম (সিএসএএ, বাহরাইন) এর যৌথভাবে লেখা একটি নিবন্ধে মানি লন্ডারিং করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন।[৭]

তাদের অনুসন্ধানে গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নানা বক্তব্য, সাক্ষাৎকার থেকে যেসব পদ্ধতি সামনে এসেছে সংক্ষেপে তা হলো—

১। বাণিজ্য কারসাজি[সম্পাদনা]

এটি অর্থ পাচারের বড় একটি মাধ্যম। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। এটি নানাভাবে হয়ে থাকে।

যথা—

ক. ওভার ইনভয়েসিং: ধরুন ১০০ ডলার মূল্যের একটি পণ্য আমদানি করেছে কেউ। মূল্য ১০০ ডলারের জায়গায় ২০০ ডলার লিখে দিল। অতিরিক্ত ১০০ ডলার রফতানিকারকের দেশে চলে যাবে। সেই রফতানিকারক হতে পারে তার আত্মীয়, বন্ধু। এমনটি নিজের কোম্পানিও হতে পারে। একে বলে ‘ওভার ইনভয়েসিং’। এমনও হয়, ১০০ ডলারের এলসি ছিল। কিন্তু এলসি ওপেন করা হয়েছে ২০ ডলারে। বাকি ৮০ ডলার চলে যাবে হুন্ডির মাধ্যমে।

খ. আন্ডার ইনভয়েসিং: রফতানিকারক ১০০ ডলারের জায়গায় ৫০ ডলার লিখে দিল। বাকি ৫০ ডলার থেকে যাবে আমদানিকারকের দেশে। এখানেও সেই আমদানিকারক হতে পারে তার আত্মীয়, বন্ধু। এমনকি নিজের কোম্পানিও হতে পারে। একে বলে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’।

গ. পণ্য রদবদল: কখনো এমন হয় যে পণ্যের বিপরীতে এলসি ওপেন করা হয়েছে, বাস্তবে সেই পণ্য আসেনি। যেমন ঘোষণা দেয়া হয়েছে কনটেইনারে মূলধনি যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু তল্লাশি করে দেখা গেল মূলধনি যন্ত্রপাতির পরিবর্তে আছে কেবল বালি ও ইট। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে কনটেইনারের মূল্য বাবদ প্রায় কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। অথচ যে পণ্য আসার কথা সেটি আসেনি। এখানে ইচ্ছা করে মোটা অংকের টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়েছে। শুধু ফাঁকি দেয়ার জন্য ইট-বালি আনা হয়েছে।

ঘ. ব্যাংকের সঙ্গে মিলে কারসাজি করা: কখনো দেখা যায়, ব্যাংকের কর্মকর্তার সঙ্গে কারসাজি করে, মোটা অংকের রফতানি বিল দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বাস্তবে এর বিপরীতে কোনো পণ্যই রফতানি হয়নি।

ঙ. রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা: রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি বাবদ ব্যয় করা।

চ. উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ কারসাজি: সাম্প্রতিক সময়ে চালু করা রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা। মোটকথা, এভাবে নানা উপায়ে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এসব কারসাজির সঙ্গে ব্যাংক, কাস্টমস নানা পক্ষ সম্পৃক্ত থাকে।

২। হুন্ডি[সম্পাদনা]

দেশীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় এমন অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি মূলত হুন্ডি নামে পরিচিত। এটি নানাভাবে হতে পারে।

যথা—

ক. দেশ থেকে অর্থ প্রেরণ: এর পদ্ধতি হলো দেশে কাউকে টাকা দেবেন, সে বিদেশে আপনাকে বা আপনার মনোনীত কাউকে ডলার পরিশোধ করবে। ধরুন কেউ বিদেশ যাবে। তার কাছে টাকা দিয়ে দিলেন। এর বিপরীতে বিদেশে আপনার ছেলেকে সে সমপরিমাণ ডলার পরিশোধ করে দেবে।

খ. বিদেশ থেকে দেশে অর্থ প্রেরণ: এর পদ্ধতি হলো বিদেশ ফেরত কাউকে আপনি ডলার দিয়ে দিলেন। সে দেশে এসে আপনার মনোনীত ব্যক্তিকে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করবে।

গ. রেমিট্যান্স গ্রহণ: এর পদ্ধতি হলো বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এ দেশে কোনো এজেন্টের মাধ্যমে টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। এ টাকা হতে পারে বৈধ পথে উপার্জিত, হতে পারে অবৈধ পথে। বর্তমানে একটি গ্রুপ এভাবে রেমিট্যান্স গ্রহণ করে বিদেশে অর্থ পাচারকাজে লিপ্ত।

এভাবে নানা উপায়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে। এসব পদ্ধতি হুন্ডি নামে পরিচিত। বর্তমান সময়ে (করোনা-পরবর্তী) রেমিট্যান্সের বৃহৎ অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আদান-প্রদান হচ্ছে। আমাদের রেমিট্যান্স হ্রাস হওয়ার পেছনে বর্তমানে এটি একটি বড় কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগরা।

৩। চোরাচালান:[সম্পাদনা]

অর্থ পাচারের এটিও একটি মাধ্যম। কর বা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বা স্বর্ণ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার করা হয়। কখনো তা বিমানের যাত্রীদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কখনো বর্ডার ক্রসিংয়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

এ তিনটি পদ্ধতির মাঝে প্রথমটি অর্থাৎ বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে মানি লন্ডারিং সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।[৮]

অঞ্চল অনুযায়ী মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

অধিকাংশ দেশ এবং অঞ্চলে মানি লন্ডারিং একটি ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এজন্য বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও অঞ্চল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে আইন প্রণয়নসহ নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তন করে যার নাম "মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ "। পরবর্তীতে, বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও অধ্যাদেশ রহিত করে "মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২" নামে নতুন একটি আইন পাশ হয়। যেহেতু মানি লন্ডারিং কার্যক্রমে মুদ্রা পাচার জড়িত এবং এতে ব্যাংকসমূহের সহায়তা প্রয়োজন, তাই এই আইন প্রয়োগের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে।[৯] উক্ত আইনে ২৮টি সম্পৃক্ত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন বা স্থানান্তরের উদ্দেশে উল্লেখিত সম্পৃক্ত অপরাধ সংগঠন বা এর সাথে জড়িত কার্যক্রম মানিলন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামে একটি পৃথক কেন্দ্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় যেটি বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয়।[১০] উক্ত আইনে, মানিলন্ডারিং অপরাধের শাস্তি রাখা হয়েছে; (১) ব্যক্তির ক্ষেত্রেঃ অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং অনধিক ১২ (বার) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুন মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ড এবং (২) প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেঃ অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদন্ড এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা।[১১]

ভারত[সম্পাদনা]

২০০৩ সালে ভারতীয় সংসদ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের জন্য "মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২" নামে একটি আইন পাশ করে। পরবর্তীতে, আইনটি ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১২ সালে সংশোধিত হয়।[১২][১৩]

ইউরোপীয় ইউনিয়ন[সম্পাদনা]

২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসবে "চতুর্থ অ্যান্টি মানি লন্ডারিংয়ের নির্দেশিকা বা এএমএলড IV)" প্রবর্তন করে।[১৪] ইউ ভুক্ত দেশসমূহ এই নির্দেশিকা অনুসরন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

যুক্তরাজ্য[সম্পাদনা]

যুক্তরাজ্যে মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসবাদী তহবিল প্রতিরোধের জন্য পাঁচটি প্রাথমিক আইন রয়েছে যেগুলো দ্বারা এই অপরাধের মামলা পরিচালিত এবং বিচার হয়।[১৫] আইনগুলো হচ্ছেঃ

  • সন্ত্রাসবাদ আইন ২০০০
  • সন্ত্রাস দমন, অপরাধ ও সুরক্ষা আইন ২০০১
  • প্রসিড'স অব ক্রাইম অ্যাক্ট ২০০২
  • গুরুতর সংগঠিত অপরাধ ও পুলিশ আইন ২০০৫
  • নিষেধাজ্ঞা এবং অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং আইন ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্র[সম্পাদনা]

যুক্তরাষ্ট্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের জন্য নেয়া ব্যবস্থাসমূহ সাধারণত দুটি ক্ষেত্রে বিভক্ত হয়: (১) প্রতিরোধমূলক (নিয়ন্ত্রণকারী) ব্যবস্থা এবং (২) অপরাধমূলক ব্যবস্থা।[১৬]

কালোটাকা বৈধকরণের সুযোগ[সম্পাদনা]

অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে উপার্জিত আয় বা কালোটাকা বৈধকরণের সুযোগও সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়। এ সুযোগের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ সুযোগের উদ্দেশ্য হলো গোপনে উপার্জ্জিত ও সংরক্ষিত কালোটাকাকে মূল অর্থনৈতিক প্রবাহে সংযুক্ত করা। এটিও একপ্রকার অর্থশোধন যার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বিতর্কিত। সাধারণত, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জরিমানা বা কর প্রদান করলে এরূপ আয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় না এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এই অর্থ বৈধ আয় হিসেবে নির্ভয়ে ব্যবহার (ব্যয়/বিনিয়োগ) করতে পারেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Chen, James। "Money Laundering"Investopedia (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  2. Vandana Ajay Kumar (২০১২)। Money Laundering: Concept, Significance and its Impact (পিডিএফ)। European Journal of Business and Management। পৃষ্ঠা ১১৪। আইএসএসএন 2222-1905 
  3. Prevention of Money Laundering Act, 2002 (পিডিএফ)। ভারত: ভারত সরকার। ২০০২। পৃষ্ঠা ২.৯, ২.১০। 
  4. টিম, বিশ্লেষণ সংকলন (২০২২-১২-০২)। "মানি লন্ডারিং কী এবং এর প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ ব্যবস্থা"বিশ্লেষণ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২৮ 
  5. "Methods and Stages in Money Laundering"people.exeter.ac.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  6. "মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২"bdlaws.minlaw.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২৮ 
  7. BonikBarta। "বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের নেপথ্যের কারণ কী?"বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের নেপথ্যের কারণ কী? (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-১২-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২১ 
  8. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হয়েছে: গভর্নর"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২১ 
  9. "www.bangladesh-bank.org" (পিডিএফ)। ১ জুন ২০১০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯ 
  10. "মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ | ২৪। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) প্রতিষ্ঠা"bdlaws.minlaw.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  11. "মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ | ৪। মানিলন্ডারিং অপরাধ ও দণ্ড"bdlaws.minlaw.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  12. "Prevention of Money Laundering Act, 2002 - Overview"web.archive.org। ২০০৮-০৬-১২। Archived from the original on ২০০৮-০৬-১২। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  13. "Anti-money laundering act kicks off"The Economic Times। ২০০৫-০৭-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  14. "Anti-money laundering and counter terrorist financing"European Commission - European Commission (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  15. Participation, Expert। "Terrorism Act 2000"www.legislation.gov.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 
  16. "History of Anti-Money Laundering Laws | FinCEN.gov"www.fincen.gov। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]