অনুপ্রাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

'অনু' শব্দের অর্থ 'পরে' বা 'পিছনে', এবং 'প্রাস' শব্দের অর্থ 'বিন্যাস', 'প্রয়োগ' বা 'নিক্ষেপ'। একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তার নাম অনুপ্রাস। অনুপ্রাস নানাভাবে তৈরি হয়। সাধারণত শব্দের আদি, মধ্য ও অন্তে (শেষে) অনুপ্রাস থাকে।

সাহিত্য[সম্পাদনা]

অনুপ্রাসক মনোরঞ্জন রায় (তিনি বিশ্বসাহিত্যে প্রথম অনুপ্রাস সনেট রচয়িতা) এর "শব্দচড়ুই ও দিগন্তদুপুর" গাণিতিকধারার কাব্যগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত দুটি আদি অনুপ্রাস সনেট এবং প্রান্তীয় অনুপ্রাস সনেট যথাক্রমে "প্রহসন" এবং "প্রতিদান"।

বাক্যের প্রতিটি শব্দে একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করাকে বলা হয় অনুপ্রাস। তিনি অনুপ্রাসকে দুভাবে সজ্জিত করেন পূর্বভাগ (আদি) এবং উত্তরভাগ (প্রান্তীয়)। আদি অনুপ্রাসে অবশ্যই আদিতে/প্রথমে অভিন্ন ধ্বনি/ধ্বনিগুচ্ছ হতে হবে আর প্রান্তীয় অনুপ্রাসে আদি/শুরুর স্থান ছাড়াও প্রতিটি শব্দের যেকোন জায়গায় অভিন্ন ধ্বনি/ধ্বনিগুচ্ছ হতে হবে। অনুপ্রাস অভিন্ন বর্ণের ওপর নির্ভর করে আবার নাও করতে পারে। যেমন "ইমনের স্কুল স্টেশনে" একটি অনুপ্রাস বাক্য, টটোগ্রাম নয় কেননা "স্কুল" ও "স্টেশন" এর উচ্চারণ ইস্কুল ও ইস্টিশন হয়। আবার "নিরাশায় নির্বাক নয়ন" একই সাথে টটোগ্রাম ও অনুপ্রাস বাক্য কেননা বাক্যের শব্দের আদি বর্ণ ও আদি ধ্বনি একই রকম। আদি অনুপ্রাসকে ক্রম অনুপ্রাসও বলা যায় কেননা অভিন্ন ধ্বনিটি সবসময় প্রথমেই হবে। আর প্রান্তীয় অনুপ্রাসকে অক্রম অনুপ্রাসও বলা যায় কেননা অভিন্ন ধ্বনি/ধ্বনিগুচ্ছ প্রথম স্থান ছাড়াও শব্দের যেকোন অবস্থানে থাকতে পারে।

প্রহসন (বর্ণ প)

পার্থিব পথপথিক প্রেমে পরাজিত

পরাহত প্রতিকূলে পূর্ণ পরিতাপ

প্রত্যাশার পদে পদে পতিত পীড়িত

প্রাণ প্রদেশে পুঞ্জিত পাললিক পাপ।

প্রেমের পীড়নে পুড়ি পাতাল পুরীতে

পাপের পৃথিবী পঁচে প্রহরে প্রহরে।

প্রদীপ্ত প্রেম প্রদেশে পারি না পশিতে

প্রত্যাশার প্রবঞ্চনা প্রমূর্ত প্রান্তরে।

প্রেম প্রতিদানে প্রাণে প্রমত্ত প্রণয়

প্রতীক্ষার প্রতিপদে প্রশ্ন প্রহসন।

পৈশাচিক প্রহরণে পতঙ্গ পতন

প্রাকৃত পাপ প্রলাপে পাংশুল প্রত্যয়।

প্রমত্ত পদ্যের পঙক্তি পল্লবে পবনে,

প্রত্যহ প্রমোদ পশে প্রাক্তন প্রাঙ্গণে।


পরিণতি (বর্ণ ত)

অতৃপ্ত অন্তরে তিক্ত স্মৃতির তিমির

অব্যক্ত তৃষ্ণায় কত নিস্তব্ধ অতীত

রক্তে নিভৃতে ধ্বনিত বিষাদিত গীত

আঘাতে খণ্ডিত শত প্রত্যাশার তীর।

স্মৃতিতে রঞ্জিত তব পুরাতন ক্ষত

শূন্যতায় মুখরিত আহত চেতনা

মূর্ত হতাশার চিত্তে বিক্ষিপ্ত যাতনা

নক্ষত্রের অন্তরীক্ষে মৃত্যুর দিগন্ত।

কত শত প্রত্যাঘাত চিত্তের পাতায়

সন্তপ্ত অন্তরে কত প্রাপ্তির পতন

বিচিত্র তপ্ত সন্তাপ পীড়িত তৃষ্ণায়

প্রাক্তন প্রত্যাশা মর্ত্যে মৃত্যুর মতন।

সর্বস্বান্ত চেতনায় স্মৃতিসিক্ত মতি,

আঘাতে বিক্ষত, মৃত্যু তার পরিণতি।

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  • এতে একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
  • একাধিকবার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
  • এর ফলে সৃষ্টি হবে একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের।

যেমন-

  1. কুশল কামনা কর কুসঙ্গ করিয়া (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)

– এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।

  1. কুলায় কাপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে

এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।

  1. গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে (রবীন্দ্রনাথ)

এখানে ‘গ’ ধ্বনি আটবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

বাংলায় অনুপ্রাস বিভিন্ন ধরনের হয় । অন্ত্যানুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাস, আদ্যানুপ্রাস, বৃত্ত্যনুপ্রাস, ছেকানুপ্রাস, শ্রুত্যনুপ্রাস ইত্যাদি।


অন্ত্যানুপ্রাস[সম্পাদনা]

কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃত্তিতে যে অনুপ্রাস অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে। যেমন: দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে, আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – এখানে ‘ডোবে’ আর ‘লোভে’র অন্ত্যমিল তাই এটি অলঙ্কার অন্ত্যানুপ্রাস।

গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা ‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি মা’ …নজরুল

উচ্চ কন্ঠে উঠিল হাসিয়া তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া …রবীন্দ্রনাথ


মধ্যানুপ্রাস[সম্পাদনা]

কাব্যের একই চরণের মধ্যে যে ধ্বনিগুচ্ছের যে মিল থাকে তাকেই মধ্যানুপ্রাস বলে।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। (জীবনানন্দ দাশ)

এখানে 'তার', কবে'কার', অন্ধ'কার', বিদি'শার' মধ্যানুপ্রাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।


আদ্যানুপ্রাস[সম্পাদনা]

কবিতার দুই চরণের আদিতে যে মিল, তাই আদ্যানুপ্রাস।

বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে। (কাজী নজরুল ইসলাম)

এখানে 'বাবুদের' এবং 'হাবুদের' যে মিল সেটাই আদ্যানুপ্রাস।


বৃত্ত্যনুপ্রাস[সম্পাদনা]

একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস। যেমন: সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।

মানুষের মনীষার মঞ্জুষার, মুগ্ধতার মহিমার- মৌনতাবাহক (আবুল হাসান (‘ম’ ৭ বার আবৃত্ত)

হবে সে সূর্যের সেবাদাসী (শামসুর রাহমান)

বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী (আল মাহমুদ)


ছেকানুপ্রাস[সম্পাদনা]

দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস। একে শ্রুত্যনুপ্রাস, লাটানুপ্রাস, মালানুপ্রাস, গুচ্ছানুপ্রাস, আদ্যানুপ্রাস বা সর্বানুপ্রাস হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। মনে রাখা দরকার যে একক ব্যঞ্জনে কোন ক্রমেই ছেকানুপ্রাস হয় না। উল্লেখ্য যে, এ ধরনের অনুপ্রাসের বাস্তব ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দেখা যায় না। যেমন: করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি অলংকার ছেকানুপ্রাস।

আরও কিছু উদাহরণ: অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? (সুধীনদত্ত)

একমাত্র গোধূলীবেলায় সবকিছু বারাঙ্গনার মত রাঙ্গা হয়ে যায় (শহীদ কাদরী)

নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান (নজরুল)

সাপের অঙ্গের মতো ভঙ্গি ধরে টান মারে মিছিলে রাস্তায় (আলা মাহমুদ)


শ্রুত্যনুপ্রাস[সম্পাদনা]

বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে উচ্চারিত যে সব ব্যঞ্জনধ্বনি শ্রুতিমধুর অনুপ্রাস সৃষ্টি করে তাকে শ্রুত্যনুপ্রাস বলে।

চিরদিন বাজে অন্তর মাঝে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এখানে 'বাজে' এবং 'মাঝে' মিলে শ্রুত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি করেছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]