ভাজক কলা
ভাজক কলা হচ্ছে উদ্ভিদদেহে বিরাজমান এক ধরনের কলা বা টিস্যু। ভাজক কলায় অপরিবর্তিত কোষ (মেরিস্টেম্যাটিক কোষ) থাকে যেগুলো কোষ বিভাজনে সক্ষম। ভাজক কলার কোষগুলো উদ্ভিদ দেহের অন্যান্য যেকোনো টিস্যু বা অঙ্গে রূপান্তরিত হতে পারে। এ কোষগুলো পরিবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভাজিত হতে থাকে। তবে পরিবর্তিত হয়ে গেলে এ কোষগুলো বিভাজনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
পরিবর্তিত উদ্ভিদকোষ সাধারণত বিভাজিত হতে পারে না, অথবা অন্য কোনো কোষ সৃষ্টি করতে পারে না। মেরিস্টেম্যাটিক কোষ অপরিবর্তিত কিংবা অসম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত থাকে এবং এ কোষগুলো টটিপটেন্ট ও বিভাজনে সক্ষম। মেরিস্টেম্যাটিক কোষের বিভাজনের ফলে টিস্যুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও নতুন অঙ্গ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় নতুন কোষ সৃষ্টি হয়। ফলে উদ্ভিদদেহ তৈরির মৌলিক কাঠামো গঠিত হয়। এ কোষগুলো আকারে ছোট। এসব কোষে কোষ গহবর থাকে না, অথবা ছোট কোষ গহবর থাকে। প্রোটোপ্লাজম দ্বারা মেরিস্টেম্যাটিক কোষ পূর্ণ থাকে। এসব কোষে প্লাস্টিড (ক্লোরোপ্লাস্ট অথবা ক্রোমোপ্লাস্ট) অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে, তবে প্লাস্টিডগুলো মূলত অপরিপক্ব রূপে (প্রোপ্লাস্টিড) বিরাজ করে। মেরিস্টেম্যাটিক কোষগুলো আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থান ছাড়াই খুব ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় থাকে। এদের কোষ প্রাচীর মূলত অত্যন্ত পাতলা প্রাথমিক কোষ প্রাচীর।
ভাজক টিস্যুর বৈশিষ্ট্য সমূহ:-
কোষগুলো জীবিত অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সমব্যাসীয়,,ভাজক টিস্যুর কোষগুলো সর্বদাই বিভাজন ক্ষমতা সম্পন্ন। ভাজক কলার কোষগুলো সাধারণত আয়তাকার, ডিম্বাকার, পঞ্চভূজাকার হয়ে থাকে। এই কোষগুলো সাধারণত সেলুলোজ নির্মিত পাতলা কোষ প্রাচীর বিশিষ্ট হয়।এছাড়া এই কোষগুলোতে বিপাকীয় হার অনেক বেশি এবং সর্বদাই সক্রিয় বিপাকীয় অবস্থায় থাকে।অধিকন্তু এর প্লাস্টিক গুলো প্রোপ্লাস্টিড অবস্থায় থাকে এর কোষগুলো আকারে সাধারণত ছোট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান হয়ে থাকে।
ভাজক টিস্যুর কাজঃ-
শীর্ষস্থ ভাজক টিস্যুর কোষ বিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদের দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। পার্শ্বীয় ভাজক টিস্যুর কোষ বিভাজনের ফলে উদ্ভিদের ব্যাস বৃদ্ধি পায়। এবং এ ধরনের বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষতস্থান পূরণ হয়।
প্রকারভেদ[সম্পাদনা]
পরিস্ফুরণের দশা অনুসারে[সম্পাদনা]
- পুঞ্জীভূত ভাজক কলা
পরিস্ফুরণের পূর্ব দশায় ভ্রূণে অবস্থান করে।
- আদি ভাজক কলা
এগুলি ভ্রূণ অবস্থা থেকেই উদ্ভিদের কাণ্ড ও মূলের শীর্ষে অবস্থান করে। এই ভাজক কলা থেকেই অন্য সকল ভাজক কলার উৎপত্তি হয়।
উৎপত্তি অনুসারে[সম্পাদনা]
প্রাথমিক ভাজক কলা[সম্পাদনা]
আদি ভাজক কলা থেকে সৃষ্ট যে কলা বিভাজিত হয়ে উদ্ভিদের প্রাথমিক দেহ গঠন করে এবং পরবর্তীকালে বিভাজিত হয়ে প্রাথমিক স্থায়ী কলা সৃষ্টি করে তাকে প্রাথমিক ভাজক কলা বলে।
- বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- এই কোষগুলি উদ্ভিদের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিভাজনে সক্ষম থাকে।
- প্রাথমিকভাবে কলা থেকে অগ্রস্থ ভাজক কলা ও নিবেশিত ভাজক কলা সৃষ্টি হয়।
- এই কলার কোষগুলি একই ব্যাস যুক্ত এবং বড় গহ্বর অনুপস্থিত।
- এই কলার কোষগুলি উদ্ভিদের দৈহিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
গৌণ ভাজক কলা[সম্পাদনা]
প্রাথমিক স্থায়ী কলা থেকে উৎপন্ন বিভাজনে সক্ষম কলাকে গৌণ ভাজক কলা বলে।
- উদাহরণসমূহ:
- কর্ক ক্যাম্বিয়াম বা ফেলোজেন (কাণ্ডের বৃদ্ধির সাথে সাথে গৌণ কর্টেক্স গঠনে সাহায্য করে)
- ইন্টারফ্যাসিকুলার ক্যাম্বিয়াম (প্রাথমিক মজ্জারশ্মি থেকে উদ্ভূত এই কলা, গৌণ জাইলেম ও গৌণ ফ্লোয়েম গঠনে সাহায্য করে)
- রুট ভাস্কুলার ক্যাম্বিয়াম (দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের মূলের যোজক প্যারেনকাইমা থেকে উদ্ভূত হয় এবং মূলের গৌণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে)
- উন্ড ক্যাম্বিয়াম (আঘাতপ্রাপ্ত স্থানকে পুনরায় উদ্ভূত করতে এবং নিরাময় করতে সাহায্য করে)
অবস্থান অনুসারে[সম্পাদনা]
- অগ্রস্থ ভাজক কলা (Apical meristem)
উদ্ভিদের কান্ড মূল শাখা প্রশাখার অগ্রভাগে অর্থাৎ বর্ধিষ্ণু অংশের শীর্ষে যে ভাজক কলা থাকে তাকে অগ্রস্থ ভাজক কলা বলে।
- বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- উদ্ভিদের প্রাথমিক দেহ গঠনকারী প্রাথমিক স্থায়ী কলার উৎপত্তি অগ্রস্থ ভাজক কলা থেকেই হয়।
- উচ্চ শ্রেণীর উদ্ভিদের অগ্রস্থ ভাজক কলা একটি কোষগুচ্ছ নিয়ে গঠিত এবং এই কোষগুলি ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে উদ্ভিদ দেহের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটায়।
- নিবেশিত ভাজক কলা (Intercalary meristem)
উদ্ভিদ অঙ্গের বৃদ্ধি কালে অগ্রস্থ ভাজক কলার অংশ যখন পৃথক হয়ে দুটি স্থায়ী কলা স্তরের মধ্যে অবস্থান করে তাকে নিবেশিত ভাজক কলা বলে।
- বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- নিবেশিত ভাজক কলা স্বল্প স্থায়ী হয় কারণ এটি দ্রুত স্থায়ী কলায় পরিণত হয়।
- এই কলার কোষগুলি মূলত একটি তলে বিভাজিত হয়।
- এগুলি পর্বমধ্য ও পত্রমূলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে। এছাড়া তৃণভোজী প্রাণীরা উদ্ভিদের উপরের অংশ খেয়ে নিলে, সেই উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে এই কলা সাহায্য করে (যেমন — ঘাস)।
- পার্শ্বস্থ ভাজক কলা (Lateral meristem)
উদ্ভিদের কান্ড ও মূলের পার্শ্বদেশে লম্বালম্বি ভাবে যে ভাজক কলা অবস্থান করে তাকে পার্শ্বস্থ ভাজক কলা বলে।
- বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের এটি প্রস্থের বৃদ্ধি ঘটায়। একবীজপত্রী উদ্ভিদে অনুপস্থিত।
- কোষগুলি পেরিক্লিনাল তলে বিভাজিত হয়।
- নালিকা বান্ডিলের অন্তর্গত ক্যাম্বিয়াম এবং কর্ক ক্যাম্বিয়াম এই কলার উদাহরণ।
কাজ অনুসারে[সম্পাদনা]
- প্রোটোডার্ম
যে অগ্রস্থ ভাজক কলা দ্বারা ত্বক কলাতন্ত্র গঠিত হয় তাকে প্রোটোডার্ম বলে। এটিতে কোষগুলি অরীয়ভাবে বিভাজিত হয় এবং উদ্ভিদের ত্বক গঠন করে (মূলে এপিব্লেমা/মূলত্বক এবং কাণ্ডে এপিডারমিস/কাণ্ডত্বক)।
- প্রোক্যাম্বিয়াম
অগ্রস্থ ভাজক কলার যে অংশ পরিবর্তিত হয়ে উদ্ভিদের সংবহন কলা বা নালিকা বান্ডিল গঠন করে তাকে প্রোক্যাম্বিয়াম বলে।
দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের কাণ্ডে প্রোক্যাম্বিয়াম বলয় সমাবেশ পৃথক পৃথক খন্ডে এবং একবীজপত্রী উদ্ভিদের কাণ্ডে বিক্ষিপ্তভাবে বিন্যস্ত থাকে, এই কলা পরিবর্তিত হয়ে উদ্ভিদের সংবহন কলা অর্থাৎ কেন্দ্রের দিকে প্রাথমিক জাইলেম এবং পরিধির দিকে প্রাথমিক ফ্লোয়েম গঠন করে।
- ভূমি ভাজক কলা
অগ্রস্থ ভাজক কলার যে অংশ থেকে বহিঃস্তর মজ্জা ইত্যাদি গঠিত হয় তাকে ভূমি ভাজক কলা বলে।
এই কলা থেকে অধঃস্ত্বক (হাইপোডারমিস), অন্তঃস্ত্বক (এন্ডোডারমিস), বহিঃস্ত্বক (কর্টেক্স), পরিচক্র, মজ্জা ও মজ্জারশ্মি তৈরী হয়।
কোষ বিভাজনের তল অনুসারে[সম্পাদনা]
- পুঞ্জীভূত ভাজক কলা (Mass meristem)
এই কোষগুলি যেকোনো তলে বা সব রকম তলে বিভাজিত হতে পারে। ফলে অনিয়তভাবে বিন্যস্ত কোষপুঞ্জ গঠিত হয়।
বর্ধনশীল ভ্রুণ, সস্য, রেণুস্থলী, মজ্জা ইত্যাদি কলা বিন্যাসে দেখা যায়।
- পাত ভাজক কলা (Plate meristem)
কোষগুলো নির্দিষ্ট দুটো তলে বিভাজিত হয়ে এক স্তরবিশিষ্ট পাতের মতো আকার ধারণ করে।
অ্যান্টিক্লিনাল প্রকৃতির বিভাজন দেখা যায়।
- পর্শুকা ভাজক কলা (Rib meristem)
একটি নির্দিষ্টতলে ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে বহু সংখ্যক কোষ সমন্বিত সারি তৈরি করে।
অ্যান্টিক্লিনাল প্রকৃতির বিভাজন দেখা যায়।
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- Plant Anatomy Laboratory from University of Texas; the lab of JD Mauseth. Micrographs of plant cells and tissues, with explanatory text.
- Schoof, Heiko; Lenhard, M; Haecker, A; Mayer, KF; Jürgens, G; Laux, T (২০০০)। "Arabidopsis shoot meristems is maintained by a regulatory loop between Clavata and Wuschel genes"। Cell। 100 (6): 635–644। এসটুসিআইডি 8963007। ডিওআই:10.1016/S0092-8674(00)80700-X । পিএমআইডি 10761929।
- Scofield and Murray (2006). The evolving concept of the meristem. Plant Molecular Biology 60:v–vii.