রাজশাহী মাদ্রাসা
পরবর্তী | হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী ১৯৬০ |
---|---|
সক্রিয় | ১৮৭৪ | –১৯৬০
অবস্থান | রাজশাহী কারাগারের পূর্বপাশে, রাজশাহী , |
রাজশাহী মাদ্রাসা[১][২] বা রাজশাহী হাই মাদ্রাসা ছিল রাজশাহী অঞ্চলের একটি সরকারি মাদ্রাসা।[৩][৪] এটি ১৮৭৪ সালে রাজশাহীতে মোহসিনীয়া মাদ্রাসা, রাজশাহী[৫] বা দারসে নিজামিয়া মাদ্রাসা রাজশাহী[৪] নামে একটি মাদ্রাসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে এটি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয় এবং রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসা[ক] নামধারণ করে।[৬] এটি ১৮৭৪ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে রাজশাহী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। পূর্ব বাংলায় ইসলামি শিক্ষা বিস্তারেমাদ্রাসা সংস্কার কমিটি নামক কমিটি ঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসা ও চট্টগ্রাম মোহসিনীয়া মাদ্রাসার ও এই মাদ্রাসা এই তিনটা সরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। সেই সময় এই মাদ্রাসায় উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য আলেমগন পড়শোনা করেছেন ও শিক্ষাদান করেছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী নামকরণ করা হয়। মাদ্রাসার প্রথম সুপারিটেনডেন্ট ছিলেন শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত মাওলানা আব্দুল কাদির ও এর তাৎক্ষনিক তত্বাবধায়নের দায়িত্বে ছিলো রাজশাহী কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।[১]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]১৮৭৪ সালে মাদ্রাসা সংস্কার কমিটি ও রাজশাহীর শিক্ষাবিদ, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ অত্র এলাকায় ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াস চালায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে এখানে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ যোগান দেন হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের মুহসিন ফান্ড।[৭]
মাদ্রাসাটি ১৮৭৪ সালে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সেটি উদ্ধার করা না গেলেও, ১৮৮৪ সালে রাজশাহী কলেজ চত্বরের দুটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিলো, সে ভবন এখনো বিদ্যমান রয়েছে (বর্তমানে এদের একটি ভবনের নাম হাজী মোহাম্মদ মহসীন ভবন দেওয়া হয়েছে)। এবং পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসাটিকে রাজশাহী কলেজ হতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব পাশে স্থানান্তর করা হয়।
মাদ্রাসাটি প্রাথমিক অবস্থায় দারসে নিজামি শিক্ষা পদ্ধতির অনুকরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, তবে ১৮৮৩ সালের দিকে মাদ্রাসায় ছাত্রসংখ্যা কমতে থাকে, এইজন্য মাদ্রাসাকে সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে জুনিয়র মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করা হয়।[৮] সেইসময় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও হুগলী মাদ্রাসা এরকম প্রধান মাদ্রাসা ব্যতিত সকল মাদ্রাসাতেই ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিলো। ১৯৩০ সালে শিক্ষার্থীদের পুনরায় আকর্ষণ করার জন্য ইংরেজি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ফলে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মাদ্রাসাটি আবার একটি হাই মাদ্রাসায় উন্নীত হয়।
মাদ্রাসাটি ১৯১৪ সালে নিউ স্কিম মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অধিভুক্ত হয়, ফলে এটি ধীরে ধীরে সাধারণ স্কুলের মত কার্যক্রম পরিচালনা হওয়া শুরু করে। এরফলে ১৯৬০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত ১৯৫৯ সালের শরীফ জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে অন্যান্য মাদ্রাসার সাথে এটিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করা হয়। তবে শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের নাম পরিবর্তন না করে রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা নামে কার্যক্রম চালাতে থাকে।
১৯০৯ সালে রাজশাহী কলেজ চত্বরে ফুলার মোহামেডান হোস্টেল নামে একটি মাদ্রাসা হোস্টেল নির্মাণ করা হয়। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারের ৭৫ হাজার টাকার অর্থায়নে এই হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয়, এইজন্য তার নামেই হোস্টেলটির নামকরণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলে রাবি ছাত্ররা, এছাড়াও রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী কলেজিয়েট ও রাজশাহী মাদ্রাসার মুসলমান ছাত্ররা এই ফুলার মোহামেডান হোস্টেলে থাকতো। এখন হোস্টেলটি রাজশাহী কলেজের একাডেমিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
নাম পরিবর্তন
[সম্পাদনা]২০১২ সালের সালের ডিসেম্বরে মাদ্রাসার একটি ডকুমেন্টারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মাদ্রাসার নামের পরিবর্তন:
সময় ব্যপ্তি | মাদ্রাসার নাম | মাদ্রাসার মান | পাঠ্য পদ্ধতি |
---|---|---|---|
১৮৭৪-১৮৮৩ | রাজশাহী মোহসিনীয়া মাদ্রাসা/দারসে নিজামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা | উচ্চ ক্লাসের মাদ্রাসা | দারসে নিজামি |
১৮৮৩-১৯১৪ | রাজশাহী জুনিয়র মাদ্রাসা | নিম্ন ক্লাসের মাদ্রাসা | দারসে নিজামি |
১৯১৪-১৯৩০ | রাজশাহী মাদ্রাসা | নিম্ন ক্লাসের সরকারি জুনিয়র মাদ্রাসা | দারসে নিজামি, ইংরেজি ভাষা |
১৯৩০-১৯৬০ | রাজশাহী হাই মাদ্রাসা | উচ্চ ক্লাসের সরকারি হাই মাদ্রাসা | দারসে নিজামি, ইংরেজি ভাষা |
১৯৬০-২০১৯ | রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসা | একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় | সাধারণ শিক্ষা |
২০১৯-বর্তমান | হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী | একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় | সাধারণ শিক্ষা |
১৮৭৪ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত, ৮৬ বছর প্রতিষ্ঠানটি একটি মাদ্রাসা হিসাবে পরিচালিত হয়েছিলো, ১৯৬০ সালের পর থেকে এটি একটি স্কুল হিসাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তখন থেকেই নামের শেষে মাদ্রাসা উল্লেখ থাকলেও, এটি মূলত মাদ্রাসা ছিলোনা, বরং এটি একটি মাধ্যমিক সরকারি বিদ্যালয়।[৯] এইজন্য শিক্ষকদের বক্তব্য অনুসারে সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হতো। তাই ২০১২ সালের ৭ই অক্টোবর জেলা প্রশাসক আব্দুল হান্নান প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন, এবং হাজি মুহাম্মাদ মুহসিনের স্মরণে নাম পরিবর্তন করে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী নামকরণ প্রস্তাব দেন।[১০][১১] প্রস্তাবটি গৃহীত হলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এর স্মারক নং-৮৪৮ অনুসারে স্কুলের নাম পরিবর্তন করা হয়।[১২]
শিক্ষা কার্যক্রম
[সম্পাদনা]এই মাদ্রাসাটি কলকাতা মাদ্রাসার জুনিয়র স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত পাঠদান করতো। সরকারি নথির হিসাব মতে, মাদ্রাসার বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণের মোট খরচ ছিল রুপি তৎকালীন ৩২১২ ভারতীয় রুপি।[১] তৎকালীন সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতি ছিলো, মাদ্রাসা ছাত্রদের তিনভাগে ভাগ করা। একদল ছাত্র যারা কেন্দ্রীয় পরিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতো, একদল ছাত্র শুধু বিভাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো আর একদল ছাত্র সরকারি বৃত্তি পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করতো।[১]
মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত মাওলানা আব্দুল কাদির। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই মূলত মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তিনি তৎকালীন সন্মানিত উপাধি শামসুল ওলামায়ে বাঙ্গালা উপাধি পেয়েছিলেন। হাজি মুহাম্মাদ মহসিনের আমলে মাদ্রাসার ছাত্রদের বেতন ছিলো ১ টাকা ৫ আনা।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি
[সম্পাদনা]উল্লেখযোগ্য শিক্ষক
[সম্পাদনা]- মাওলানা আব্দুল কাদির, মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ ও শিক্ষক।
- আইয়ুব আলী, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক (১৯৫৮-১৯৬৯)
- খান বাহাদুর জিয়াউল হক, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক (১৯৩০)
উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী
[সম্পাদনা]পাদ টীকা
[সম্পাদনা]- ↑ প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে মাদ্রাসা উল্লেখ থাকলেও, এটি আদতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলো। তবে প্রথমে ১৮৭৪ সালে এটি একটি মাদ্রাসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এটি একটি মাদ্রাসা হিসাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করে।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ General Report: Public Instruction in Bengali (1899-1900)। কলকাতা: বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস। ১৯০০। পৃষ্ঠা ১৫১।
- ↑ "Brailvi Books"। brailvi-books.amuslim.org। ১৭ নম্বর পাতার ৩৫ নম্বর কোটেশন। পৃষ্ঠা ১৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৮।
- ↑ মোহাম্মদ মিছের, কাজী (১৯৬৫)। রাজশাহীর ইতিহাস, প্রথম খণ্ড। রাজশাহী, বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ৯৯–১০২-- বইটি ৯ জুন ২০০৯ সালে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে, এবং বইটির মূল ফর্ম পাওয়া যাবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
- ↑ ক খ "রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা"। rajshahirkotha.webrajshahi.com। ২০২২-০৫-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ Ābadullāha, Muhāmmada (১৯৮৬)। Bāṃlādeśera khyātanāmā Ārabībida, 1801-1971। Isalāmika Phāuṇḍeśana Bāṃlādeśa। পৃষ্ঠা ৩৯।
- ↑ "রাজশাহী জেলা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "দুই শতাধিক বছর আগের 'দানবীর' হাজী মুহসীন সম্পর্কে যা জানা যায়"। বিবিসি বাংলা। ২০২১-০৯-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ ব্যুরো, রাজশাহী। "রাজশাহী সরকারি মাদরাসার নাম পরিবর্তন"। দৈনিক ইনকিলাব। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "'রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা'র নাম পরিবর্তন"। banglanews24.com। ২০১৯-০৯-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "রাজশাহী সরকারি মাদরাসা এখন 'হাজী মুহম্মদ মহসীন স্কুল' - দৈনিকশিক্ষা"। দৈনিক শিক্ষা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসার নাম পরিবর্তন"। অধিকার। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "'রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা'র নাম পাল্টে স্কুল"। rajshahipost.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।