মেহেরপুর জেলা

স্থানাঙ্ক: ২৩°৪৫′ উত্তর ৮৮°৪২′ পূর্ব / ২৩.৭৫০° উত্তর ৮৮.৭০০° পূর্ব / 23.750; 88.700
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মেহেরপুর জেলা
জেলা
বাংলাদেশে মেহেরপুর জেলার অবস্থান
বাংলাদেশে মেহেরপুর জেলার অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩°৪৫′ উত্তর ৮৮°৪২′ পূর্ব / ২৩.৭৫০° উত্তর ৮৮.৭০০° পূর্ব / 23.750; 88.700 উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
দেশবাংলাদেশ
বিভাগখুলনা বিভাগ
জেলা হিসাবে স্বীকৃতি১৯৮৪
জাতীয় সংসদ আসন২টি । উপজেলা = ৩ টি
সরকার
 • জেলা প্রশাসকজনাব মোঃ শামীম হাসান
আয়তন[১]
 • মোট৭১৬.০৮ বর্গকিমি (২৭৬.৪৮ বর্গমাইল)
 গাংনী,মেহেরপুর,মুজিবনগর
জনসংখ্যা (২০১১)[২]
 • মোট৬,৫৫,৩৯২
 • জনঘনত্ব৯২০/বর্গকিমি (২,৪০০/বর্গমাইল)
সাক্ষরতার হার
 • মোট৫৩.৬%
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
পোস্ট কোড৭১০০ উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
প্রশাসনিক
বিভাগের কোড
৪০ ৫৭
ওয়েবসাইটদাপ্তরিক ওয়েবসাইট উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন

মেহেরপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুরে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত বেশ কিছু প্রাথমিক যুদ্ধের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে অস্থায়ী সরকার গঠন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে ।

২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়া থেকে পৃথক করে মেহেরপুরকে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়।[৩]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মেহেরপুর, একপ্রাচীন জনপদ। তবে ঠিক কোনসময়ে অবিভক্ত নদীয়ার এই প্রাচীন জনপদ গড়ে ওঠে তা জানা যায়নি। জনশ্রুতি আছে রাজা বিক্রমাদিত্যের সময় এখানে জনপদ গড়ে ওঠে। কিন্তু এসম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক কুমুদনাথ মল্লিকের মতে, "কেহ কেহ এই স্থানটিকে মিহির-খনার বাসস্থান বলিয়াও নির্দেশ করেন এবং মিহিরের নাম হইতে মিহিরপুর, অপভ্রংশে মেহেরপুর কল্পনা করেন।" নামকরন সম্পর্কিত এ ধারণাটি অনুমান ও কল্পনানির্ভর। নামকরণ নিয়ে আরো একটি মতামত রয়েছে। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে, ১৬শ শতাব্দীর একজন দরবেশ মেহের আলী শাহের নামে এ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্যসূত্র পাওয়া যায় না। জেলা পরিচয় প্রাপ্তির আগে প্রাচীন জনপদ মেহেরপুরের ছিল ভিন্ন পরিচয়। কখনো বাগোয়ান, কখনো রাজাপুর পরগণার অধীনে শাসিত হয়েছে মেহেরপুর। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের ফলে মেহেরপুরও চলে যায় কোম্পানি শাসনে। স্থানীয় জমিদারের মদদে সংঘটিত নীলবিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ১৮০৩ সালে গাংনী থানাকে নদীয়া জেলা থেকে অবমুক্ত করে যশোর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়।

খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীতে স্বনামধন্য ও খ্যাতিমান ভৌগালিক মিঃ টলেমির মানচিত্র গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চল বলে মনে করা হয়। গঙ্গা অথবা বৃহত্তম কোন জলাময় স্থানের বুকে তিল তিল করে জেগে উঠা এক উর্বর দ্বীপাঞ্চলে দক্ষিণ বঙ্গ থেকে পুন্ডা বা পোদ জাতি অথবা পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে বিভিন্ন ধর্মের বর্ণের জাতির কিছু কিছু লোক চাষাবাদ অথবা প্রচুর মাছ সংগ্রহের আশায় এ অঞ্চলে আগমন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে অনুমান করা যেতে পারে।

২য় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এবং ৪র্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পূর্ব বাংলার সমতট ও পশ্চিম বাংলায় পুস্কারণ রাজ্য অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসনামলে এ অঞ্চলের কোন উল্লেখযোগ্য ইতিহাস সম্পর্কে শত চেষ্টা করেও কিছুই জানা যায়নি। বাংলাদেশে সমতট, বঙ্গ ও গৌড় এই তিন রাজ্যের শাসনামলে মেহেরপুর অঞ্চল কোন সময়ে সমতট আবার কখনো গৌড়ের শাসনাধীন ছিল। তবে এই তিনটি রাজ্যের সঠিক পরিধি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ একমত হতে পারেননি বলে যদ্দুর জানা যায়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পযর্ন্ত মেহেরপুর কোন রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। ৬০৬ সালে রাজা শশাঙ্কর রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে ভ্রমণ করে যে বিবরণ দিয়ে গেছেন তা থেকে বিশেষভাবে অবহিত হওয়া যায় যে তৎকালীন বঙ্গ রাজ্য (১) কামরূপ (২) পুষ্পবর্দ্ধন (৩) কর্ণ সুবর্ণ (৪) সমতট ও (৫) তাম্র লিপি এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। মেহেরপুর অঞ্চল সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে অনুমান করা হয়।

এছাড়া অনুমান করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, শশাঙ্ক রাজ্যের রাজধানীর ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত মেহেরপুর জনপদ তার প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাজ্য অভ্যন্তরীণ কলহে ও বিবাদে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যের পর সম্ভবত ৬৪২ সালের দিকে মেহেরপুর কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর প্রায় একশত বছরকাল যাবৎ বাংলায় চরম অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। সেই সময় কোন রাজাধিরাজ কোন অঞ্চলে তাদের শাসনভার বজায় রেখেছিলেন তা আজও পুরোপুরি অমানিশায় আবৃত। অষ্টম শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সময় অনুমান করা হয় মেহেরপুর পাল রাজত্বের শাসনাধীন ছিল এবং পাল রাজত্বের অবসান কাল অর্থাৎ দশম শতাব্দীর শেষ পযর্ন্ত এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল।

লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে ১২০৩ মতান্তরে ১২০৪ সালে বিহার থেকে ঝাড়খণ্ডের পথে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামক একজন তুর্কী মুসলিম অসীম সাহসী সেনাপতি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া দখল করেছিলেন। বখতিয়ারের পিছনে যে বিরাট সেনাবাহিনী ছিল তাদের মধ্যে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী তার সঙ্গে দ্রুত আসতে সক্ষম হয়। অবশ্য বখতিয়ারের নদীয়া দখলের চল্লিশ বছর পর মিনহাজ-উস-সিরাজ রচিত ’’তবাকাত-ই-নাসিরী’’ গ্রন্থে উল্লেখ্ করা আছে যে, মাত্র আঠারো জন অশ্বারোহী সৈন্য নদীয়া নগরীতে প্রবেশ করলে তাদেরকে তুর্কী অশ্ব বিক্রেতা মনে করে কেউ বাধাদান করেনি। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় লক্ষণ সেন বার্ধক্যজনিত কারণে রাজকার্যে অবহেলা, অমাত্যবর্গ ও রাজমহিষীর নানা ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতিতে সম্ভবত রাস্টীয় কাঠামো দুর্বল করে ফেলে। যার দরুন তুর্কী আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ও সাহস লক্ষণ সেনের ছিল না।

খিলজী রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়েই আক্রমণ করেন। যে সময় ’রায় লছমণিয়া সকল কার্যাদি সমাপনে খাদ্য ভক্ষণে বসেছিলেন। তিনি যখন মুসলমান আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুত্র, মহিলা, ধনরত্ন ,সম্পদ, দাসদাসী ও অন্যান্য সকল কিছু পরিত্যাগ করে অন্তঃপুরের দুয়ার দিয়ে নৌকাপথে পলায়ন করেন। বখতিয়ার খিলজী নদীয়া দখল করে গৌড়ে গমন করেছিলেন। বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হিসাবে ধরলেও সেই সময় মুসলিম শাসন কোন স্থায়ীত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তার নদীয়া বিজয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর মুর্গীস উদ্দীন উজবুক পুনরায় নদীয়া দখল করেন। নদীয়ায় বাংলার প্রথম মুসলমান শাসনের যে সূত্রপাত হয় তাহা প্রায় ছয়শত বছর দীর্ঘস্থায়ী ছিল।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নরপতি হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বের পতনের পর তার রাজধানী নদীয়াতে যে সব মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল তারই ক্রমবিকাশ ঘটে সমগ্র বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস। ১২০৩ অথবা ১২০৪ সাল থেকে ১৭৬৫ সালের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ পর্যন্ত ৫৬১ বৎসরের মধ্যে মোট ৭৬ জন সুবাদার, নাজিম, রাজা ও নবাব বাংলা শাসন করে গেছেন। তাদের সকলের শাসনের সময় মেহেরপুর অন্তর্গত ছিল। এই শাসকদের এগার জন সুবাদার ঘোরী ও খিলজী মুসলিম সুলতানদের মনোনীত ছিল, ছাব্বিশ জন স্বাধীন শাসনকর্তা অবশ্য এদের মধ্যে শেরশাহের আমলের শাসকগণও ছিলেন। অবশিষ্ট চৌত্রিশ জন মোগল সম্রাটদের পছন্দমত। পাঁচজন স্বাধীন রাজার মধ্যে রাজা গণেশ, জালাল উদ্দিন (যদু), শামসদ্দীন আহমেদ শাহ রয়েছেন। এই পাঁচজন এবং রাজা তোডরমল ও রাজা মানসিংহ বাদে প্রায় সকলেই আফগান, তুর্কী, ইরানি ও মোগল বংশের ছিলেন। গৌড়ের রাজা গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের সময় ১৩৮৯ থেকে ১৪০৯ সাল গৌড়ের সকল প্রকার রাজত্ব ও শাসন ব্যবস্থার কর্মকর্তা ভাতুরিয়া পরগণার জমিদার রাজা কংস বা গণেশ গৌড় দখল করে স্বাধীন রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। গণেশের পরলোকগমনের পর তাঁহার পুত্র যদু যিনি মুসলিম নাম ধারণ করে মোঃ জালালউদ্দীন গৌড়ের সিংহাসন পরিচালনা করতে থাকেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলতান শামসউদ্দীন আহমদ শাহ উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার পান। মূলতঃ এই সময় থেকেই এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার কার্য ব্যাপকহারে শুরু হয়। শামসউদ্দীন আহমদ শাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে ইখতিয়ার শাহী বংশের নাসির উদ্দীন মহাম্মদ শাহ গৌড় সিংহাসন দখল করেন। সুলতানী আমলে মেহেরপুর একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল বলে জানা যায়। চৌদ্দ শতাব্দীতে মেহেরপুরে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বেশ কিছু আউলিয়া দরবেশ এখানে আগমন করেন।

মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার (তার বাল্য নাম দুর্গাদাশ সমাদ্দার) এক বিশাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ’’নদীয়া রাজবংশ নামে’’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নদীয়া রাজবংশ যে অঞ্চল নিয়ে জমিদারী কায়েম করে রাজ্য গড়ে তোলেন তা ’’নদীয়া’’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় নদীয়া রাজ্যের জমিদারী এলাকা ছিল ৩,১৫১ বর্গ মাইল। নদীয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার হুগলীর শাসনকর্তা শাহ ইসমাইল সাহেবের বদন্যতায় তিনি কানুনগো পদ লাভ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রতাপাদিত্যের সাথে যুদ্ধে মীরজা নাথান ও রাজা মানসিংহকে সাহায্য করার ফলশ্রুতিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট হতে ’’ভবানন্দ মজুমদার’’ উপাধি ও জায়গীর লাভ করতে সক্ষম হন। তার জমিদারীর রাজ্য ছিল লেপা, মহৎপুর, মারূপদহ, সুলতানপুর, কাসিমপুর, নদীয়া নিয়ে মোট ১৪টি পরগণা। দুর্গাদাস সমাদ্দার তার পিতৃ জমিদারী তার ভাই জগদীসকে কুড়ুলগাছি, হরিবলস্নভকে ফতেহপুর, টুবুদ্ধিকে পাটিক বাড়ি প্রদান করেন। তিনি নিজের দায়িত্বে রাখেন বল্লভপুর পরগণা। ভবান্দ মজুমদারের রাজ বংশের রাজা রাঘব রায় কৃষ্ণের উপাসক ছিলেন বলে জানা যায়। আর এই প্রসঙ্গ উল্লেখ্য, রাজা রাঘবের পুত্র মহারাজা রুদ্র এই স্থানটির নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। পরবর্তীতে এই কৃষ্ণনগর নদীয়া জেলার রাজধানীতে রূপলাভ করে।

১৭১০ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার গদীনসীন হন। এই নদীয়ার অন্যতম অঞ্চল ছিল মেহেরপুর এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনাধীনে মেহেরপুর দীর্ঘদিন শাসিত হয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যথাযথ সময়ে নদীয়ার প্রচলিত খাজনা পরিশোধ করতে না পারায় নবাব আলীবর্দী খান তাকে গ্রেফতার করেন। ১৭৫০ সালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মেহেরপুর শহর ষোড়শ শতাব্দীতে স্থাপিত হলেও তৎকালীন সময়েই এখানে জনবসতি গড়ে উঠেনি। কেননা ১৭৫০ সালে মোগল শাসনের অধীন নবাবদের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৫০ সালে বাংলার সুবাদার আলীবর্দী খাঁ মেহেরপুরের বাগোয়ান গ্রামে নদীপথে আসতেন শিকার করতে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ফলে তিনি পরিষদসহ রাজু গোঁসাই নামীয় জনৈকা এক অখ্যাত বিধবা গোয়ালা রমনীর আতিথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হন। নবাব আলীবর্দী খাঁ আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরস্থ সমগ্র বাগোয়ান মৌজা উক্ত মহিলাকে দান করেন মর্মে কথিত আছে। রাজু গোসাই মহিলার বহু গরু ছিল। আর এই কারণে গোচারণের জন্যই বাগোয়ানের সমগ্র এলাকা তথা মেহেরপুর প্রদান করেন। তাহলে দেখা যায় সপ্তদশ শতকেও মেহেরপুর গোচারণ ভূমি ছিল। এখানে তেমন জনপদ গড়ে ওঠেনি।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব পযর্ন্ত রাজা গোয়ালা চৌধুরী নদীয়া সদর কৃষ্ণনগর থেকে সরাসরি মেহেরপুর পযর্ন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। এই সড়ক নির্মাণেই মেহেরপুরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বর্গী দস্যূরা মেহেরপুর আক্রমণ করে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। বর্গীদের অত্যাচার থেকে আত্নরক্ষার জন্য গোয়ালা চৌধুরীর বংশধররা ভূগর্ভে ইট দিয়ে গোপন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেন ও সমগ্র এলাকাকে ঘিরে পরীখা খনন করেন। মেহেরপুর পৌরসভার দক্ষিণে সেই ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কক্ষে তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া গেছে। এর বিলীয়মান বেশ কিছু বৃহত্তর তেঁতুল বৃক্ষ ঐ স্থানে ছিল। যে গাছ থেকে বর্গীদের আক্রমণ লক্ষ করে জনসাধারণকে সতর্ক দেয়া হতো। রাজা গোয়ালা চৌধুরী শেষ পযর্ন্ত ইতিহাস কুখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুজী ভোসলার সাথে যুদ্ধে সপরিবাবে নির্মমভাবে নিহত হন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে সিরাজউদ্দৌল্লার সংগে ইংরেজদের যুদ্ধে মিরজাফরের বেইমানীতে রবার্ট ক্লাইভ জয়লাভ করায় বাংলার স্বাধীনতা অস্ত যায়। সেই প্রহসনের যুদ্ধে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ক্লাইভের পক্ষে সমর্থন করায় মিঃ ক্লাইভ যুদ্ধে জয়লাভ করে কৃষ্ণচন্দ্রকে রাজেন্দ্র বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে কৌশলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করতে সমর্থ হয়। এ সময় হতেই নদীয়া তথা মেহেরপুর ইংরেজদের শাসনাধীনে চলে যায়। ১৭৯৬ সালে নদীয়া ও যশোরের সীমানা নির্দিষ্ট হলেও পরবর্তীতে তা কয়েকবার পরিবর্তন হয়। যশোরের সংগে নদীয়া তথা কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৮৫৪ অথবা ১৮৫৭ সালে মেহেরপুর মহাকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত নদীয়ার মহাকুমা ছিল পাঁচটি যথা- কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাংগা ও মেহেরপুর। মহাকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর মেহেরপুরে ৫ টি থানা অন্তভূর্ক্ত হয় যথা-করিমপুর, গাংনী, তেহট্ট, চাপড়া ও মেহেরপুর সদর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে করিমপুর,তেহট্ট ও চাপড়া ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়, শুধুমাত্র গাংনী ও মেহেরপুর সদর নিয়ে মেহেরপুর মহাকুমা গঠিত হয়।

১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা লাভ করেন। ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর সদর উপজেলা বিভক্ত হয়ে মুজিবনগর উপজেলার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে মেহেরপুর জেলায় তিনটি উপজেলা রয়েছে।

নামকরণ[সম্পাদনা]

মেহেরপুর নামকরণ সম্পর্কে এ পর্যন্ত দুটি অনুমানসিদ্ধ তথ্য আমরা জানা যায়। একটি হচ্ছে ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী নামীয় জনৈক ব্যক্তির নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ষোড়শ শতকের অথরা তার কিছুকাল পরে মেহেরপুর নামকরণের সৃষ্টি হয়েছে।এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হতেই ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বারোবাজার, চুয়াডাঙ্গামেহেরপুর সহ প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন হযরত খাঁন জাহান আলী (রাঃ)। পীর খান জাহান আলী গৌড় থেকে ভৈরব নদ পথে মেহেরপুর হয়ে বারোবাজার গিয়ে বাগেরহাট গিয়েছিলেন। তার সাথে সেই সময়ে ৩৬০ জন দরবেশ ও ৬০ হাজার সৈন্য ছিল বলে কথিত আছে। তিনি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চরে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলন করে জনবসতি ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ অঞ্চলে ঐ একই সময়েই বেশ কয়েকজন ইসলামের ঝান্ডাবাহক আল্লাহর পরম আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে। শাহ ভালাই, শাহ আলাই ও এনায়েত উল্লাহর নাম উল্লেখযোগ্য। পুণ্য আত্না ইসলামের ঝান্ডাবাহক দরবেশ মেহের আলী শাহ-এর নামের সাথে সঙ্গতি রেখে মেহেরপুর নামকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।যতদূর জানা যায় তাতে মেহের আলী অত্যন্ত প্রভাবশালী খ্যাতিমান আধ্যাত্নিক ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। যার ফলে তাঁর নামের প্রাধান্য পেয়ে যায়।মেহেরপুর নামকরণের উৎপত্তি সম্পর্কে দ্বিতীয় দিকটি এখানে উল্লেখ্য, পূর্ববঙ্গ রেলওয়ের বাংলায় ভ্রমণ গ্রন্থে বিখ্যাত বচনকার মিহির ও তাঁর নিজের পুত্রবধু খনা (খনার বচন বিখ্যাত) ভৈরব নদীর তীরস্থ এ অঞ্চলে বাস করতেন। তার নামানুসারে প্রথমে মিহিরপুর এবং পরবর্তীতে অপভ্রংশে মেহেরপুর নামকরণ হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।[২]

অবস্থান ও আয়তন[সম্পাদনা]

মেহেরপুর জেলা ২৩.৪৪° থেকে ২৩.৫৯° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৪° থেকে ৮৮.৫৩° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের সীমান্তবর্তী জেলা। এ জেলার উত্তরে কুষ্টিয়া জেলাভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা জেলাভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে চুয়াডাঙ্গা জেলাকুষ্টিয়া জেলা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ

মেহেরপুর জেলার ম্যাপ

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ[সম্পাদনা]

বর্তমানে এ জেলায় ০৩টি উপজেলা, ০৩টি থানা, ০২টি পৌরসভা (১টি ‌‍'ক' শ্রেণীর, ১টি 'খ' শ্রেণীর), ১৮টি ইউনিয়ন, ১৯৯টি মৌজা, ২৫৯টি গ্রাম রয়েছে।[২]

উপজেলা[সম্পাদনা]

পৌরসভা[সম্পাদনা]

মেহেরপুর পৌরসভা সংলগ্ন

যোগাযোগ ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

পূর্বে নদীপথে চলাচল থাকলেও বর্তমানে নদীগুলোর মৃতাবস্থায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে সড়কপথে সারাদেশের সাথে সংযুক্ত। পাকা সড়ক প্রায় ১৪২.২৫ কিলোমিটার, কাঁচা সড়ক ৭৮৫৮ কিলোমিটার, রেলপথ ১৫৯ কিলোমিটার ও নদী পথ ২২৩ কিলোমিটার।[২] রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গাকুষ্টিয়ার সাথে পাকা সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। মেহেরপুরে রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। সড়ক পথে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার পর চুয়াডাঙ্গা থেকে রেলপথে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া যায়।

পোষ্টাল সুবিধা

ডাকঘর ৩৫টি, পোষ্টাল কোড- মেহেরপুর সদর-৭১০০, গাংনী-৭১১০, আমঝুপী-৭১০১, মুজিবনগর-৭১০২।

টেলিযোগাযোগ

ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ০৩ টি, টেলিফোন কোড- মেহেরপুর সদর ০৭৯১, মুজিবনগর ০৭৯২৩, গাংনী ০৭৯২২।

অর্থনীতি[সম্পাদনা]

কৃষি নির্ভর

কৃষি[সম্পাদনা]

এসব জমিতে ধান, গম, পাট, ভুট্টা,তামাক, পিঁঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ডাল, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপন্ন হয়ে থাকে। এ জেলায় বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন আম, কলা, কাঁঠাল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়ে থাকে। এ জেলার সুস্বাদু আমের সুনাম রয়েছে।

কৃষিজমি[সম্পাদনা]

মোট কৃষি জমি ৬০,১৮৩ হেক্টর, নীট ফসলী জমি ৬০,০২৪ হেক্টর। এক ফসলী জমি ৩,১৫৩হেক্টর, দুই ফসলী জমি ৩০,৯১৩ হেক্টর, তিন ফসলী জমি ২৫,৮৩৮ হেক্টর, তিনের অধিক ৩২০ হেক্টর। মোট ফসলী জমি ১,৪৩,১৭২ হেক্টর, ফসলের নিবিড়তা ২৩৮.৫২%।কৃষি ব্লকের সংখ্যা ৫৬টি, কৃষি বিষয়ক পরামর্শ কেন্দ্র ৫৬টি, সয়েলমিনিল্যাব ১৪টি, বিএডিসি বীজ ডিলার ২৩ জন, বিসিআইসি সার ডিলার ৩০ জন, কোল্ড ষ্টোর ০৩টি। নাসারী সংখ্যা সরকারি ০২ টি বেসরকারী ২২০টি।

সেচ সুবিধা[সম্পাদনা]

সেচাধীনজমি ৫৯,৮৫৯ হেক্টর। গভীর নলকুপ মোট ৯৩টি (বিদ্যুৎ চালিত ৯১টি, ডিজেলচালিত ০২টি), অগভীর নলকুপ মোট ৩০,০২২টি (বিদ্যুৎ চালিত ১,৭১৫টি, ডিজেল চালিত২৮,৩০৭টি), পাওয়ার পাম্প মোট ১০টি (বিদ্যুৎ চালিত ০৪টি, ডিজেল চালিত০৬টি)।

খাদ্যশস্য[সম্পাদনা]

পরিস্থিতিখাদ্যশস্যেরবাৎসরিক চাহিদা ১,৪৪,৩৫০ মেট্রিক টন, উৎপাদন ২,২৫,৭৮৩ মেট্রিক টন (দানাদার), উদ্বৃত্ত ৮১,৪৮৩ মেট্রিক টন। প্রধানত ধান, পাট, গম, আলু, কচু, মসুর, ভুট্টা, সরিষা, পান, কলা, আনারস, কাঁঠাল ও শীতকালীন শাকসব্জী উৎপন্ন হয়।

প্রাণিসম্পদ[সম্পাদনা]

দপ্তরজেলাপশু হাসপাতাল ০১টি, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ০৩টি, পশু চিকিৎসালয় ০১টি, জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র নাই, কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র ০৩টি, কৃত্রিম প্রজনন পয়েন্ট ১২টি।গবাদি পশুর খামার ১৬৫৬টি, ছাগলের খামার ১৩২টি, ভেড়ার খামার ১৬৯টি, মুরগী খামার ৪৮৭টি (লেয়ার ১০৬টি, ব্রয়লার ৩৮১টি) । গরু ১১,৪৭,৭৮৯টি, মহিষ ২০,৭৮৩টি, ছাগল ২২,৬,২৯৮টি, ভেড়া ১০,৮৮০টি, ঘোড়া ৭৯০টি।পশু সম্পদ কার্যক্রম সংশ্লিষ্টএনজিও- ওয়ার্ল্ড ভিশন, সোসিও ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন।[২]

শিল্প ও বাণিজ্য[সম্পাদনা]

অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুর অঞ্চল ছিল নীল চাষের অত্যন্ত উপযোগী। চল্লি­শ দশক ধরে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত মেহেরপুর প্রায় সমস্ত অঞ্চল নীল চাষই ছিল একমাত্র অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মেহেরপুর থেকে রপ্তানীযোগ্য কৃষিপণ্য হিসেবে নীল ছিল একমাত্র সম্পদ।

মেহেরপুর কৃষি প্রধান এলাকা। মেহেরপুর অঞ্চলে তেমন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। নেহাৎ প্রয়োজনের তাগিদে মেহেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। মেহেরপুরের ব্যবসা বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ হাট বাজারের সাথে জড়িত।

কুটির শিল্প[সম্পাদনা]

কুটির শিল্পে মেহেরপুর এক সময় বিখ্যাত ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কুটির শিল্পের উপর হাজার হাজার পরিবার নির্ভর করত। সেই শিল্পের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে হাতে তৈরী কাঁথা, খেজুরের পাটি, বাঁশ ও বেতের তৈরী ধামা,কুলা, কাঠা ইত্যাদি চোখে পড়ে।

মৃৎ শিল্প[সম্পাদনা]

কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম আবির্ভাবের পূর্বে মেহেরপুর অঞ্চলে মৃৎ শিল্পে ব্যাপক বিকাশ ঘটে। মাটির তৈরী হাড়ি, থালা, গামলা,মালসা , কলসি সর্বশ্রেণীর গৃহে ব্যবহার হতো। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। তবে, কুমাররা মেহেরপুরের চাঁদবিল ও গাংনীর বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী আজও উৎপাদন করে।

শিল্প কারখানা[সম্পাদনা]

কোন অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের জন্য শিল্প কল-কারখারার অবদান অনস্বীকার্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মেহেরপুর আধুনিক প্রযুক্তিতে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকাল শহর অঞ্চলে কিছু কিছু স-মিল, রাইসমিল গড়ে উঠে এবং বিদ্যুতের বিস্তার লাভের কারনে গ্রামে কিছু রাইস সিল স্থাপিত হয়। বর্তমানে ইট প্রস্ত্তত কারখানা, কিছু কোল্ড ষ্টোরেজ, আইসক্রীম তৈরীর কারখানা ব্যক্তি মালিকানার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। এই সমস্ত কারখানায় প্রস্ত্ততকৃত দ্রব্যাদি ব্যাপকভাবে কেনা-বেচা হওয়ায় মেহেরপুরের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।[৪]

কৃষি শিল্পের সম্ভাবনা[সম্পাদনা]

মেহেরপুরের পলল মিশ্রিত মাটি কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। এখানে কৃষি-সম্প্রসারন বিভাগের অধীনে মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের বারাদী নামক স্থানে এবং গাংনীর বাঁশবাড়ীয়ার চিৎলা কৃষি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা ফসলের বীজ উৎপাদনে এখনো ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। মেহেরপুরের সবজী সারাদেশে বিখ্যাত।

মেহেরপুরে কলা,আম প্রচুর পরিমানে উৎপাদন হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, খিরসাপাতি, আম্রপালী বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়।

জলবায়ু[সম্পাদনা]

এ জেলার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭.১° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১.২° সেলসিয়াস। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৪৬৭ মি.মি। ‌‌‌[৫]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

মেহেরপুর জেলার স্বাক্ষরতার হার ৫৩.৬ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫১ শতাংশ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫৬.২ শতাংশ। মেহেরপুরে সরকারি কলেজ রয়েছে ৪টি, বেসরকারি কলেজ ১২টি, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র ৬টি, কলেজিয়েট স্কুল ৫টি, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৩টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১৪টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৬টি, নন-রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭টি এবং মাদ্রাসার সংখ্যা ৬০টি। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেঃ মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রী কলেজ, গাংনী সরকারি কলেজ, মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মুজিবনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপজেলার নাম মেহেরপুর সদর গাংনী মুজিবনগর সর্বমোট
কলেজ সরকারি 2 1 1 4
বেসরকারি এমপিও 2 1 3
নন-এমপিও
স্কুল সরকারি 2 1 1 4
বেসরকারি এমপিও 31 46 11 88
নন-এমপিও 6 19 4 29
মাদ্রাসা সরকারি
বেসরকারি এমপিও 7 5 2 14
নন-এমপিও 4 5 2 11
বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজ বেসরকারি এমপিও 3
নন-এমপিও
টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ সরকারি 1 1
বেসরকারি এমপিও 2 2
নন-এমপিও
বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজ                       এমপিও 3 3
                      নন-এমপিও

নদ-নদী ও খাল-বিল সমূহ[সম্পাদনা]

নদ-নদীর

নদ-নদীর সংখ্যা ০৪টি, আয়তন ১১৪৪৫.২০ হেক্টর।

ভৈরব নদ
কাজলা নদী
  • ছেউটিয়া

[৬][৭]

জলাশয়সমূহ[সম্পাদনা]

বিল ও প্রধান প্লাবনভূমির সংখ্যা ১১৪০টি, আয়তন ৩০৭৬২.০০ হেক্টর। এ জেলার প্রধান বিলগুলো হল - ধলার বিল,ইসামতি বিল (কালিদাহ), চাঁদবিল, পাটাপুকুর বিল, গোপালপুর বিল, বামন্দী বিল, শালিকা বিল, বিজনবিল(তেরঘরিয়া), এলাঙ্গী বিল

ঐতিহাসিক, প্রাচীন ও চিত্তাকর্ষক স্থানসমূহ[সম্পাদনা]

  • করমদী গোসাঁইডুবি মসজিদ
  • শিব মন্দির , বল্লভপুর
  • বরকত বিবির মাজার
  • বাঘুয়াল পীরের দরগা
  • ভবানীপুর মন্দির
  • মুজিবনগর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী
বাংলাদেশের মানচিত্র
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
  • পৌর ঈদগাহ
  • মেহেরপুর শহীদ স্মৃতিসৌধ
  • আমদহ গ্রামের স্থাপত্য নিদর্শন
  • সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির
  • আমঝুপি নীলকুঠি
আমঝুপি নীলকুঠি
ভাটপাড়া নীলকুঠি
  • ভবানন্দপুর মন্দির
  • কালাচা‍ঁদপুর শাাহ ভালাই এর দরগা
  • বল্লভপুর চার্চ
  • ভবরপাড়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ
  • নায়েব বাড়ি মন্দির
  • স্বামী নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রম

বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব[সম্পাদনা]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. District Statistics 2011,Published in December, 2013 Published by : Bangladesh Bureau Of Statistics
  2. "এক নজরে জেলা - মেহেরপুর জেলা"meherpur.gov.bd। ১৬ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০২১ 
  3. "বাংলাদেশ এর প্রথম অস্থায়ী রাজধানী ঐতিহাসিক মেহেরপুর-মুজিবনগর"দি ঢাকা টাইমস। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১৭ 
  4. মেহেরপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য (২০১৯)। তোজাম্মেল আযম। বাংলা বজার, ঢাকা: গতিধারা। আইএসবিএন 9789848948163 
  5. "ভৌগোলিক পরিচিতি - মেহেরপুর জেলা"meherpur.gov.bd। ১৭ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০২২ 
  6. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৩৮৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৮৪-৮৯৪৫-১৭-৯
  7. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৬১২। আইএসবিএন 984-70120-0436-4 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]