মেরু অঞ্চলে রোজা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ইসলামে মেরু অঞ্চলসমূহে রোজা রাখা সম্পর্কে সরাসরি কিছুই বলা হয় নি। তবে সৌদি আরব রাজ্যের উর্ধতন বিশেষজ্ঞ পরিষদের মতামত অনুযায়ী, দজ্জাল সম্পর্কে একটি হাদিস রয়েছে[১], যেখানে প্রমাণিত হয় যে প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোজা এবং একই সঙ্গে নামাজ উপক্রম করতে হবে।[২]

এই সমস্যার কারণ হলো গ্রীষ্মকালে মেরু অক্ষাংশে নিশীথ সূর্য এবং শীতকালে মেরু নিশি দেখা যায়। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি সংঘটিত হয় কারণ গ্রীষ্মকালে পৃথিবীর অক্ষাংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে এবং শীতকালে সূর্য থেকে দূরে সরে যায়, এই কারণে মেরু অঞ্চলসমূহে প্রতি ছয়-মাস যাবৎ টানা সূর্যের আলো দেখা যায়। ইসলামের প্রাথমিক যুগের আদি মুসলমানরা মেরু অঞ্চলে বসবাস করতেন না, তারা উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বসবাস করতেন যেখানে সূর্য দিনের বেলায় সরাসরি উপরিভাগে থাকে এবং রাতে অস্ত যায়। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এই ঘটনাগুলির অভিজ্ঞতা হয় নি।

বিতর্ক[সম্পাদনা]

কুরআনের সমালোচকদের মতে, কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা রচিত হয়েছিল আরবি ভাষায় কেবল আরবদেশের মানুষ দের জন্য কেবল সপ্তম শতাব্দীর জন্য। যে সকল বক্তা দাবি করেন, কুরআন এসেছে সমগ্র বিশ্বের মানুষদের জন্য, তাদের সমালোচনা করে তারা বলেন, কুরআন যদি সারা বিশ্বের মানুষদের জন্য পালনীয় বলে দাবি করে, তাহলে সেখানে এমন কোন বিধান থাকা উচিৎ নয়, যা আদৌ পালনযোগ্য নয়।

ইসলামের হুকুম অনুযায়ী, ইসলামে বিশ্বাসীগণকে দৈনিক পাঁচ বার সালাত বা নামায আদায় করতে হয়। এ পঞ্চোপাসনা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে অস্বীকার করলে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হয়ে যায়। রোজার ক্ষেত্রেও তাই দিনের কোন অংশে, কখন নামায আদায় করতে হবে তার নির্দেশনা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও হাদিসে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ সময়গুলো বলা হয়েছে, দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। যেমনঃ ভোরবেলার ফজরের নামাযের সময়সীমা সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত, মাগরিবের নামাযের সময় শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে ইত্যাদি।

ভূগোল শাস্ত্র বলে যে, পৃথিবীর উত্তর মেরুতে বছরের অর্ধেক সময় যাবত ছয় মাস ব্যাপী দিন বিরাজ করে। এ সময় অপর মেরুতে অর্থাৎ দক্ষিণ মেরুতে রাত বিরাজ করে ক্রমাগত ছয় মাস। আবার, বছরের বাকি অর্ধেক সময়, উত্তর মেরুতে ছয় মাস ব্যাপী রাত ও দক্ষিণ গোলার্ধে ছয় মাস ব্যাপী দিন বিরাজ করে। তাই, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মত ২৪ ঘণ্টার দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থান দেখে যেভাবে সময় নির্ধারণ করা যায়, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সেভাবে করা যায় না। তাই, ওই সব স্থানে নামায আদায় করার জন্য নির্ধারিত সময় নির্ণয় করা অসম্ভব। অথচ, নামাজ ব্যতিরেকে মুসলিম ব্যক্তি গুরুতর পাপের অংশীদার বিবেচিত হবেন।

কুরআন প্রচারিত হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। সেখানকার মানুষ উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর এই দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ রজনী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল না। তাই, কুরআনে এমন পরস্পর বিরোধী উপাসনার আদেশ দেখতে পাওয়া যায়, যেসব উপাসনা মেরু অঞ্চলের কোন বাসিন্দাদের জন্য পালন করা অসম্ভবপর।

মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোজা পালন সম্ভবপর। নরওয়ের মত দীর্ঘ সময়ব্যাপী দিন বিরাজ করে যে সব দেশে, সে সব দেশের জন্য রোজা পালন অতীব কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয় বা তাতে প্রাণ হানির শংকা থাকে না।

কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে রমজান মাসের রোজা পালন অসম্ভব একটি বিষয়। কারণ,

ক) মেরু অঞ্চলে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত একাধারে বিরাজ করায় ইসলামি বর্ষপঞ্জির নিয়মানুযায়ী মাস সংখ্যা হিসেব করা অসম্ভব। তাই, রমজান মাস নিরূপণ করাও অসম্ভব।

খ) উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে একাধারে ছয়মাস ব্যাপী দিন থাকায় এ অঞ্চলের রোজাদার বাসিন্দাকে ক্রমাগত ছয় মাস পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে এই উপাসনা তার মৃত্যুর কারণ হবে। অথচ, কুরআন দাবি করেছে যে, রোজার বিধান মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।

ইসলামি আইন[সম্পাদনা]

উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সৃষ্ট এ জটিলতা নিরসনে মুসলিম আলিমগণ কুরআন ও হাদিসের আলোকে যথার্থ বিধান দিয়েছেন, যে বিধান অনুযায়ী এ অঞ্চলের কোন বাসিন্দা রোজাব্রত পালন করলেও প্রাণ সংশয়ে পড়বেন না। তাই, উপর্যুক্ত অভিযোগের সত্যতা ভিত্তিহীন বলে মুসলিম ভাষ্যকারগণ দাবি করেন।

উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে মুসলিম উলামাবৃন্দ তাদের সুস্পষ্ট গবেষণা ও ফতওয়া প্রদান করেছেন । এসকল গবেষণা ও ফতওয়া কুরআন ও হাদিসের সার নির্যাস থেকে গৃহীত। উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে কীভাবে নামাজের সময় নিরূপণ করা হবে, তা 'ইজতিহাদ' এর মাধ্যমে আলিমগণ সমাধা করেছেন। তাই, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে নির্ধারিত সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করা অসম্ভব - এমন বক্তব্যকে মুসলিম ভাষ্যকারগণ নাকচ করে দিয়েছেন।

এছাড়া, ক্রমাগত ছয় মাস যাবৎ কোন ব্যক্তির পক্ষে রোজা রাখা তার সাধ্যাতীত। আর কুরআনের মূলনীতি হচ্ছে, আল্লাহ্‌ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজ বাধ্যবাধক করেন না। কুরআনে এসেছে,

"[রমজানের সময়] খাওয়া-দাওয়া করুন, যতক্ষণ না আপনার নিকট ভোরের সাদা সুতা এর কালো সুতা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়।[কুরআন ২:১৮৭]...... আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে।"[কুরআন ২:২৮৬]

তাই, সে দিক বিবেচনায়, ইসলামি মনীষীগণ বলেন, কুরআন ব্যক্তিকে রোজা পালনে শৈথিল্যের সুযোগ দিয়েছে। তারা বলেন, সামগ্রিকভাবে কুরআনে কোন অবৈজ্ঞানিক বা ভুল বা অসম্পূর্ণ বিধান জারি করা হয় নি।

অর্থাৎ রোজা মুসলমানদের উপর শুধু তখনই ফরজ হবে, যখন দিন-রাত্রির সমাগম ঘটে, অন্যথায় রোজা রাখবার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সালভার্ডের (সুমেরীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানদের উদাহরণ হিসাবে) মুসলমানদের কেবল তখনই রোজা রাখতে হবে, যখন দিন ও রাত সূর্য দ্বারা বিশিষ্ট হয়। যদি রমজান জুন/ডিসেম্বর মাসে আসে (যখন সালভার্ডে দিন-রাত নির্দিষ্ট হয় না), তাহলে তারা রোজা ছেড়ে দিতে পারেন। আর যদি রমজান মার্চ/সেপ্টেম্বরে আসে (যখন সালভার্ডে দিন-রাত নির্দিষ্ট হয়), তাহলে তারা তাদের রোজা সম্পন্ন করতে পারেন। এই নিয়মটিকে বলা হয় "কাযা"। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-

" আল্লাহ আপনার জন্য সকল সুযোগ সুবিধা পরিকল্পনা করে রেখেছেন। [তিনি চান] আপনি নির্দিষ্ট সময়সীমা পূর্ণ করুন, এবং তিনি আপনাকে যে পথনির্দেশ করেছেন তা অনুসরণ করুন; এবং তার অনুগ্রহ গ্রহণ করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন"। [কুরআন ২:১৮৪]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "SahihMuslim.Com"www.sahihmuslim.com। ৫ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০২১ 
  2. "How to pray and fast in countries where the day or night is continuous - Islam Question & Answer"