ভারতীয় ভাষা পরিষদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Bharatiya Bhasa Parishad, kolkata with then President of India, 1989

ভারতীয় ভাষা পরিষদ, কলকাতা ভিত্তিক একটা সাহিত্য সংঘঠন। ১৯৭৫ সালে সীতারাম সাক্সেরিয়া সহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিকদের উদ্যোগ ৩৬ নং সেক্সপীয়র সরণিতে, কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই সংস্থা স্থাপন করা হয় ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাভাষীদের সাংস্কৃতিক মিলন ক্ষেত্র হিসেবে। একটা ভারতীয় ভাষার সাহিত্যকে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাবনার আদান-প্রদান এবং এই সংক্রান্ত গবেষণার কাজই এই পরিষদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু বছর ধরে এটাকে একটা ব্যক্তিগত লাভের ব্যবসার উপায় বানিয়ে ফেলেছে।

যেমন, ২০০৪ সালে এই সংস্থার দুই সম্পাদকের একজন শ্রীমতি কুসুম খেমানি এখানে একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল খুলে তার প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। যারা বিদেশে পড়তে যাবে তাদের সুবিধার জন্য খোলা হয়েছিল এই স্কুল। ভারতীয় ভাষা পরিষদের বিশাল একটা অংশ, বড়ো হলঘর এবং অডিটোরিয়াম সহ কুসুম খেমানি ওই স্কুলকে মাসিক ৮০০০ টাকায় ভাড়া দিয়ে দেন। সেখানে প্রকৃত ভাড়া ছিল মাসিক প্রায় ৭৫০০০ টাকা। এইভাবে আটমাস এই স্কুল চালানোর পর এখানকার বিভিন্ন হিন্দি লেখকদের প্রতিবাদে কুসুম খেমানি ওই স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

এখান থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ওয়াগত-এর সম্পাদনা করেন একান্ত শ্রীবাস্তব নামক একজন সরকারি চাকুরে। তিনি সপ্তাহে তিনদিন এসে মাসে ১৫০০০ টাকা সাম্মানিক নিয়ে যান (কারণ আইনত সরকারি চাকুরে দুটো সংস্থায় মাইনে নিতে পারে না)। এরকম বহু দুর্নীতি, অনাচার ও অপব্যয় নিয়ে এখানকার কর্মচারীদের মধ্যে অনেকদিন ধরে ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল বর্তমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অনেক সময়ে কর্মচারীদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কুসুম খেমানি তাদেরকে দিয়ে তাঁর বাড়ির কাজও করিয়ে নিতেন। কিন্তু কর্মচারীদের মাইনে আর কিছুতেই এমন পরিমাণ বাড়ানো হয় না যাতে তাদের সংসারটা একটু সহজে চলে। এই সমস্ত কারণে এখানকার কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চালানো হচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় ভাষা পরিষদের কর্তৃপক্ষ, কর্মচারীদের মনোবল ভাঙ্গতে গত ১২ই জুলাই রাতে সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক-এর নোটিস টাঙ্গিয়ে দেয়।

ভারতীয় ভাষা পরিষদের কর্মচারীরা যে সব দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিল তার মধ্যে প্রধান হল বেতনবৃদ্ধির দাবি। কেন, তা তাদের বর্তমান বেতন কাঠামোতেই পরিষ্কার। এই সংস্থার ১৮জন কর্মচারীর মাইনে মাসে ২০০০ থেকে ৮০০০-৮৫০০ টাকার মধ্যে। অথচ এখানে অনেক কর্মচারী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে। একজন কর্মচারী ৩২ বছর কাজ করে পিওন থেকে লাইব্রেরিয়ান হয়েছেন, তিনি পান ৮০০০ টাকা, পি.এফ. ইত্যাদি কেটে মাসে তাঁর হাতে আসে ৬৫০০ টাকা। একজন আকাউন্ট্যান্ট ৩৬ বছর কাজ করে মাসে ৮৫০০ টাকা পান, আরেকজন কর্মচারী ২৭ বছর কাজ করে ৫৫০০ টাকা এবং একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ৫-৬ বছর কাজ করে ২০০০ টাকা পান। এই সংস্থায় সরকারি ন্যুনতম বেতন আইনও মানা হয় না। অথচ বাজারে জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে।

খুব সঙ্গতভাবেই ২০১৯ এ কর্মচারীরা ৩ বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পরে ৫০% মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছিল। এখানকার কর্মচারীরা যে 'ট্রাস্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ান'-এর মধ্যে আছে (সঙ্গীত-কলামন্দিরের কর্মচারীরাও এই ইউনিয়ানের অন্তর্ভুক্ত) তা সিআইটিইউ অর্থাৎ সিপিএম প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের সাথে যুক্ত। কিন্তু ইউনিয়ন কোনো জোরদার আন্দোলনের পথে যাচ্ছিল না। কর্মচারীরা নিয়মমাফিক লাঞ্চটাইমে কিছুক্ষণ ও অফিসের পরে আধঘণ্টা শ্লোগান দিয়ে তাদের দাবি জানাত। কিন্তু এতে কর্তৃপক্ষের কানে জল না ঢোকায় ১৫ মে ২০১৯ এ কর্মচারীরা চিঠি দিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানায়, এভাবে চললে তারা কাজকর্ম চালাতে পারবে না। এই চিঠিতে ইউনিয়নের সেক্রেটারি সই করতে অস্বীকার করে এবং কর্তৃপক্ষ এই চিঠিটাকে অজুহাত করে ১২ জুলাই সংস্থার গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু কর্মচারীরা তাতে না গলে ১৩ তারিখ থেকে ধরনা দিতে বসে যায়। রোজ সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৭টা অবধি এই ধরনায় অনেক হিন্দি ও বাংলা সাহিত্যিক এসে এখানকার কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন জানাতে থাকে। মহাশ্বেতা দেবী আসেন এবং এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে কর্মচারীদের জানান। কর্মচারীরা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর সাথে দেখা করে। ললিতকলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান অশোক বাজপেয়ী উদ্যোগ নিয়ে এখানকার এক ট্রাস্টির সঙ্গে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের মাইনে ৪৫% বাড়াতে রাজি হয় এবং ২০ তারিখে 'সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক' তুলে নেয়।