প্রথম কামিল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নাসিরুদ্দীন মুহাম্মাদ
মালিকুল কামিল
দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (বামে) কামিলের (ডানে) সাথে দেখা করছেন।
মিশরের সুলতান
রাজত্ব১২১৮– ৬ মার্চ ১২৩৮
পূর্বসূরিপ্রথম আদিল
উত্তরসূরিদ্বিতীয় আল আদিল
জন্মআনু. ১১৭৭
কায়রো, মিশরের সালতানাত
মৃত্যু৬ মার্চ ১২৩৮ (৬১-৬২ বছর বয়স)
দামেস্ক, দামেস্কের সালতানাত
বংশধরআস সালিহ আইয়ুব
দ্বিতীয় আল আদিল
পূর্ণ নাম
মালিকুল কামিল নাসিরুদ্দীন আবুল মাআলি মুহাম্মাদ
সালতানাতআইয়ুবীয়
পিতাপ্রথম আদিল
ধর্মসুন্নি ইসলাম

কামিল (আরবি: الكامل; পুরো নাম: মালিকুল কামিল নাসিরুদ্দীন আবুল মাআলি মুহাম্মাদ; জন্ম: আনু. ১১৭৭ – মৃত্যু: ৬ই মার্চ ১২৩৮) ছিলেন একজন মুসলিম শাসক এবং মিশরের চতুর্থ আইয়ুবীয় সুলতান। সুলতান হিসেবে তার শাসনামলে, আইয়ুবীয়রা পঞ্চম ক্রুসেডকে পরাজিত করে। তিনি ফ্রাঙ্কিশ ক্রুসেডারদের কাছে মেলেডিন নামে পরিচিত ছিলেন। এই নাম দ্বারা এখনও কিছু পুরাতন পশ্চিমা উৎসে তাকে উল্লেখ করা হয়। ষষ্ঠ ক্রুসেডের ফলস্বরূপ, তিনি জেরুসালেমকে খ্রিস্টানদের হস্তান্তর করেছিলেন এবং সেন্ট ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করেছিলেন বলে জানা যায়।[১]

জীবনী[সম্পাদনা]

জাজিরা অভিযান[সম্পাদনা]

কামিল ছিলেন সালাহউদ্দিনের ভাই সুলতান আদিলের পুত্র। কামিলের বাবা ১১৯৯ সালে মারদিন (আধুনিক তুরস্কে) শহর অবরোধ করছিলেন যখন তাকে দামেস্কে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করার জন্য জরুরিভাবে ডাকা হয়েছিল। আদিল অবরোধ অব্যাহত রেখে মারদিনের চারপাশে বাহিনীকে কমান্ড করার জন্য কামিলকে ছেড়ে যান।[২] সুলতানের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মসুল, সিনজার এবং জাযিরাত ইবনে উমরের সম্মিলিত বাহিনী যখন আত্মসমর্পণের পর্যায়ে ছিল তখন মারদিনে উপস্থিত হয় এবং কামিলকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে। তিনি কঠিনভাবে পরাজিত হন এবং মাইয়াফারিকীনের কাছে পশ্চাদপসরণ করেন।[৩] তবে তার বিরোধীদের মধ্যে ভিন্নমত এবং দুর্বলতার কারণে কামিল হাররান (আধুনিক তুরস্কে) দখল করে জাজিরা অঞ্চলে আইয়ুবীয়দের শাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[৪][৫]

মিশরের রাজপ্রতিনিধি[সম্পাদনা]

১২০০ সালে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করার পর আদিল কামিলকে পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল থেকে মিশরে তার রাজপ্রতিনিধি (নায়েব) হিসাবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আদিলের দ্বিতীয় পুত্র মুয়াযযাম ঈসা ইতিমধ্যেই ১১৯৮ সালে দামেস্কের যুবরাজ হয়েছিলেন।[৬] দেখা যাচ্ছে যে আদিল কামিলকে মোটামুটি উচ্চ মাত্রার কর্তৃত্বের অনুমতি দিয়েছিলেন, যেহেতু তিনি কায়রো দুর্গের বেশিরভাগ কাজ তদারকি করেছিলেন, তার নিজের নামে ডিক্রি জারি করেছিলেন এবং এমনকি শক্তিশালী মন্ত্রী ইবনে শুকরকে বরখাস্ত করার জন্য তার পিতাকে রাজি করাতে সক্ষম হন।[৭] কামিল ১২১৮ সালে তার পিতার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজপ্রতিনিধি ছিলেন। এরপর তিনি নিজেই সুলতান হন।

পঞ্চম ক্রুসেড[সম্পাদনা]

১২১৮ সালে যখন আদিল মারা যান, তখন আইয়ুবীয়দের অঞ্চল তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়। যার মধ্যে কামিল মিশর, তার ভাই মুয়াযযাম ঈসা ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্ডানে এবং তৃতীয় ভাই আশরাফ মুসা সিরিয়া ও জাজিরায় শাসন করেন। নামমাত্র অন্য দুজন কামিলের আধিপত্যকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আইয়ুবীয়দের উত্তরাধিকারের জন্য এই সময়ে ভাইদের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট মতবিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। এর একটি কারণ হচ্ছে, আদিলের মৃত্যুর ঠিক আগে মিশর পঞ্চম ক্রুসেডের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।[৮]

কামিল সেই বাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেছিল যারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে দমইয়াত রক্ষা করেছিল। ১২১৯ সালে হাক্কারি কুর্দি রেজিমেন্টের কমান্ডার আমির ইমাদুদ্দিন ইবন মাশতুবের নেতৃত্বে একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে প্রায় উৎখাত করা হচ্ছিল। তার ছোট ভাই ফাইয ইব্রাহিমকে তার স্থানে বসানোর জন্য এই ষড়যন্ত্র হয়েছিল, যে কিনা অনেকটাই নমনীয় ছিল। ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক হয়ে কামিল শিবির থেকে নিরাপদে পলায়ন করেন। পরবর্তী বিভ্রান্তিতে ক্রুসেডাররা দমইয়াতের উপর তাদের দখল শক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। কামিল ইয়েমেনে পালিয়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করেছিলেন, যেটি তার পুত্র মাসুদ ইউসুফ শাসন করছিলেন। কিন্তু সিরিয়া থেকে তার ভাই মুয়াযযামের সেনাবহরের সাথে যথাসময়ে আগমন ষড়যন্ত্রের দ্রুত অবসান ঘটায়।[৯]

কামিল ক্রুসেডারদের কাছে অনেকবার শান্তির প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন। তবে তারা সেগুলো উত্তরাধিকার পোপ পেলাগিয়াসের প্রভাবের কারণে প্রত্যাখ্যান হয়েছিল। তিনি জেরুসালেম ফিরিয়ে দেয়ার ও তার প্রাচীর পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব দেন। প্রাচীরটি তার ভাই বছরের শুরুতে ভেঙ্গে ফেলেছিল। এছাড়া সলিবে হাকিকি বা ট্রু ক্রস তাদেরকে প্রত্যার্পণ করার প্রস্তাবও পেশ করেন। ধারণ করা হয়, সেটি তার কাছে ছিল না। একপর্যায়ে তিনি ক্রুসেডার বাহিনীর সাথে আসা অ্যাসিসির ফ্যান্সিসের সাথেও দেখা করেন। কিন্তু তাদের আলোচনা জোত্তো, টাদ্দেয়ো গাদ্দি, টাদ্দেয়ো দি বারটোলোর মত চিত্রশিল্পীর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে।[১০]

নীলনদের বন্যার ফলে দুর্ভিক্ষ এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কামিল দমইয়াত রক্ষ করে ব্যর্থ হন। আর এটি ১২১৯ সালের নভেম্বরে দখল করা হয়।[১১] সুলতান নীল নদের আরও উপরে অবস্থিত একটি দুর্গ মনসুরাতে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর ১২২১ সাল পর্যন্ত সামান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যখন কামিল পুনরায় শান্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ট্রান্সজর্ডান ছাড়া জেরুসালেম রাজ্যের সমগ্র অঞ্চল আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করেছিলেন, ক্রুসেডারদের মিশরকে সরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে[১১] কিন্তু আবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। ক্রুসেডাররা কায়রোর দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু কামিল কেবল বাঁধগুলো খুলে দিয়ে নীল নদের বন্যা হতে দেন। যদ্দরুণ অবশেষে ক্রুসেডাররা আট বছরের শান্তি মেনে নেয়। সেপ্টেম্বরে তিনি দমইয়াত পুনরায় দখল করে নেন।

১৫শ শতকে বেনোজ্জো গজ্জলি দ্বারা অঙ্কিত আসিসির ফ্রান্সিস এবং সুলতান কামিলের সাথে আর্সের ইলুমিনাটাস।

ক্ষমতার লড়াই এবং ১২২৯ সালের চুক্তি[সম্পাদনা]

পরবর্তী বছরগুলো তার ভাই মুয়াযযামে সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হন। কামিল সিসিলির সম্রাট রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের সাথে শান্তি চুক্তি করতে আগ্রহী ছিলেন। সে ষষ্ঠ ক্রুসেডের পরিকল্পনা করেছিল। মুয়াযযাম ১২২৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু শান্তিচুক্তির প্রয়োজনীয়তা দূর করে দেয়, কিন্তু রাজা ফ্রেডরিক ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। মুয়াযযামের মৃত্যুর পর কামিল এবং তার আরেক ভাই আশরাফ একটি চুক্তি করেন। যাতে সমস্ত ফিলিস্তিন (ট্রান্সজর্ডানসহ) কামিল এবং সিরিয়া আশরাফ ভাগ করে নেন। ১২২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কামিল ফ্রেডরিকের সাথে দশ বছরের শান্তিচুক্তি করেন। চুক্তিমতে জেরুসালেম ও অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলো ক্রুসেডারদের শাসনে ফিরিয়ে দেন।[১২] ১২১৯ সালের এই চুক্তি ক্রুসেডের ইতিহাসে অনন্য। একক কূটনীতির মাধ্যমে বড় ধরনের কোনো সামরিক সংঘর্ষ ছাড়াই জেরুসালেম, বেথলেহেম এবং সমুদ্রের তীরবর্তী একটি করিডোর জেরুসালেম রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তবে টেম্পল এলাকা, কুব্বাতুস সাখরা আর আকসা মসজিদের জন্য ব্যতিক্রম শর্ত ছিল। সেগুলো মুসলিমদের দখলেই ছিল। আর শহরে থাকা মুসলিম বাসিন্দাদের বাড়িঘর ও সম্পত্তির উপর পূর্ণ অধিকার ছিল। এমনকি তাদের পৃথক বিচার ব্যবস্থা ও ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের নিজস্ব কর্মকর্তা বিদ্যমান ছিল। জেরুসালেমের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেয়াল পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এই শান্তিচুক্তি ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল।[১৩] যদিও ক্রুসেডারদের সাথে শান্তিচুক্তি বজায় ছিল, কামিলকে ১২৩৮ সালে মারা যাওয়ার আগে সেলজুক এবং খওয়ারেজমীয়দের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল।

উত্তরসূরি[সম্পাদনা]

তার পুত্র সালিহ আইয়ুব এবং আদিল দ্বিতীয় যথাক্রমে সিরিয়া এবং মিশরে তার স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু আইয়ুবী সাম্রাজ্যে কিছুদিন পরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আবার ১২৩৯ সালে ফ্রেডরিকের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় এবং জেরুসালেম আইয়ুবীয়দের নিয়ন্ত্রণে আসে।

ব্যক্তিত্ব[সম্পাদনা]

কামিল যুদ্ধে ইসলামি আইনের উদাহরণ দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্রুসেডের সময় কামিল ফ্রাঙ্কদের পরাজিত করার পর তিনি ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনীকে খাবার সরবরাহ করেন। সে ব্যাপারে অলিভারাস স্কলাস্টিকাস তার প্রশংসা করে মন্তব্য করেছিলেন:[১৪]

কে সন্দেহ করতে পারে যে এই ধরনের মঙ্গল, বন্ধুত্ব এবং দাতব্য ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে? যাদের পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, আমাদের হাতে যন্ত্রণায় মারা গিয়েছিল; যাদের জমি আমরা কেড়ে নিয়েছি; যাদের বাড়িঘর থেকে উলঙ্গ করে তাড়িয়ে দিয়েছি; ক্ষুধায় কষ্টে পড়ার সময় তারা নিজেদের খাবার দিয়ে আমাদের জীবনদান করেছেন এবং দয়ার বর্ষণ করেছেন। এমনকি যখন আমরা তাদের ক্ষমতায় ছিলাম...

— অলিভারাস স্কলাস্টিকাস, [১৫]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Saint Francis and the Sultan: The Curious History of a Christian-Muslim Encounter, John V. Tolan OUP 2009
  2. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.112
  3. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.114
  4. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.115
  5. The chronicle of Ibn al-Athir for the Crusading period from al-Kamil fi'l-Tarikh, Part 3, edited by D. S. Richards Ashgate Publishing Ltd, Farnham 2008, p.46
  6. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.125
  7. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.145
  8. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.161
  9. Humphreys, R. Stephen, From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus 1193-1260, p.163
  10. Galletti , Mirella (২০১৮-০১-১৮), Bozarslan, Hamit; Scalbert-Yücel, Clémence, সম্পাদকগণ, "Traces of the Kurds and Kurdistan in Italy and Rome", Joyce Blau l'éternelle chez les Kurdes, Bibliothèque (électronique) de l’IFEA, İstanbul: Institut français d’études anatoliennes, পৃষ্ঠা 63–79, আইএসবিএন 978-2-36245-068-6, সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-২৭ 
  11. Riley-Smith, Jonathan (ed.), The Atlas of the Crusades,Times Books 1990, p.94
  12. The New Cambridge Medieval History: Volume 5, C.1198-c.1300 edited by David Abulafia, CUP 1999 p.576
  13. "Crusades - Britannica Online Encyclopedia"। Britannica.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৯-২৫ 
  14. Judge Weeramantry, Christopher G. (১৯৯৭), Justice Without Frontiers, Brill Publishers, পৃষ্ঠা 136, আইএসবিএন 90-411-0241-8 
  15. Judge Weeramantry, Christopher G. (১৯৯৭), Justice Without Frontiers, Brill Publishers, পৃষ্ঠা 136–7, আইএসবিএন 90-411-0241-8 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

প্রথম কামিল
জন্ম: ১১৭৭ মৃত্যু: ৬ মার্চ ১২৩৮
পূর্বসূরী
প্রথম আদিল
মিশরের সুলতান
১২১৮ – ৬ মার্চ ১২৩৮
উত্তরসূরী
দ্বিতীয় আল আদিল
পূর্বসূরী
সালিহ ইসমাইল
দামেস্কের সুলতান
১২৩৮