পলিমার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
একটি আণবিক সিমুলেশন থেকে স্টাইরিন-বিউটাডাইন চেইনের গঠন।

অ্যালকাইন ও অন্যান্য প্রতিস্থাপিত অ্যালকিনসমূহ উচ্চচাপ, উচ্চতাপ ও অনুঘটকের উপস্থিতিতে এক অণু অপর অণুর সাথে পরপর যুক্ত হয়ে উচ্চ আণবিক ভর বিশিষ্ট যৌগ গঠন করে। এ উচ্চ আণবিক ভরবিশিষ্ট যৌগটি হল পলিমার এবং মূল মাতৃ যৌগটি হল মনোমার। পলিমার সৃষ্টির প্রক্রিয়াই পলিমারকরণ বিক্রিয়া

পলিমারের প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

পলিমার প্রধানত ৬

প্রকারের হয় এগুলো হল -

  • ঘনীভূত পলিমার (Condensed Polymer): ঘনীভবন পলিমারকরণ বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক পদার্থের মনোমার গুলো মিথস্ক্রিয়ার ফলে NH3, HCl ও H2O প্রভৃতি সরল অণু দূরীভূত হয়ে যে পলিমার উৎপন্ন হয় তাকে ঘনীভূত পলিমার বলে। উদাহরনঃ নাইলন
  • যুত পলিমার (Homo Polymer): একই ধরনের একাধিক মনোমারের সমন্বয়ে যে পলিমার গঠিত হয় তাকে যুত পলিমার বলে।
  • সহ পলিমার (Co-Polymer) : একটি একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল পলিমার বা কম পক্ষে দুটি মনোমার দ্বারা গঠিত এবং এরা অনিয়মিত উপায়ে একে অন্যের সাথে মুক্ত অবস্থায় থাকে তাকে সহ পলিমার বলে।
  • বিশৃংখল সহ পলিমার (Random Co-Polymer)  : যে সকল সহ-পলিমারে দুটি ভিন্ন পৌণঃ পুনিক একক বা মনোমার পলিমার শৃংখলে এলোমেলো ভাবে বা নিয়মহীন ভাবে বন্টিত অবস্থায় থাকে তাকে বিশৃংখল সহ পলিমার বলে।
  • ফাইবার পলিমারঃ দুই বা ততোধিক পলিমার যখন আন্তঃপলিমারিক বন্ধনে (Intrapolymer Bond) আবদ্ধ হয়ে নতুন পলিমার সৃষ্টি করে তাদের ফাইবার পলিমার বলে। এটি প্রধানত কার্বন এবং হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত এবং কার্বন ও হাইড্রোজেন ঊপস্থিত থেকে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে ফাইবার পলিমার গঠন করতে পারে।

● জৈব পলিমার : যে পলিমারের প্রধান শিকল কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত তাকে জৈব পলিমার বলে।

যুত বা সংযোজিত পলিমার[সম্পাদনা]

এ জাতীয় পলিমারকরণ বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে মনোমার অণুসমূহ কোন পদার্থের অপসারণ ব্যতীত পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়। একই কার্যকরী মূলক যুক্ত মনোমার যেমন, অ্যালকিন, প্রতিস্থাপিত অ্যালকিন, ভিনাইল যৌগ, অ্যালকাইন, অ্যালডিহাইড প্রভৃতি সংযোজন পলিমারকরণ বিক্রিয়া প্রদর্শন করে থাকে।

পলিথিন

ইথিন গ্যাসকে ১০০০-১২০০ atm চাপ প্রয়োগ করে তরলে পরিণত করে সামান্য অক্সিজেন এর উপস্থিতিতে ২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে ইথিনের ৬০০-১০০০ অণু [১] (মতান্তরে ৪০০-২০০০) [২] যুক্ত হয়ে পলিথিন গঠন করে। অধিক চাপ পদ্ধতিতে প্রভাবক হিসেবে অক্সিজেন অথবা জৈব পারঅক্সাইড যেমন বেনজোয়িল পারঅক্সাইড অর্থাৎ (C6H5CO)2O2 ব্যবহার হয়। স্বল্প চাপ পদ্ধতিতে ধাতব প্রভাবক ব্যবহার হয়। এগুলোকে Cr2O3 বা সিলিকা অ্যালুমিনা ধারকের উপর রাখা হয়। তাপমাত্রা থাকে ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং চাপ ৫-১০ atm থাকে। পলিথিন সাদা, অস্বচ্ছ ও নমনীয় কিন্তু শক্ত প্লাস্টিকএসিড, ক্ষার ও অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা আক্রান্ত হয় না। উত্তম তড়িৎ অন্তরক। বোতল, পানির ট্যাংক তৈরিতেও ব্যবহার হয়। পলিথিনের নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চ আপেক্ষিক গুরুত্বের তিন শ্রেণীর পলিমার আছে। আপেক্ষিক গুরুত্বের মান যথাক্রমে ০.৯২৫, ০.৯২৬ ও ০.৯৪।

পলিপ্রোপিলিন

জৈব দ্রাবক হেপ্টেন-এ প্রোপিন দ্রবীভূত করে ১৪০ বায়ুচাপে টাইটেনিয়াম ট্রাইক্লোরাইড (TiCl3) প্রভাবকের উপস্থিতিতে উত্তপ্ত করলে উচ্চ পলিপ্রোপিন বা পলিপ্রোপিলিন উৎপন্ন হয়। এটিও শক্ত প্লাস্টিক। পলিপ্রোপিলিন সবচেয়ে হালকা অথচ শক্ত পলিমার প্লাস্টিক। কৃত্রিম সুতা, মোটা রশ্মি, কার্পেট, উন্নত মানের কন্টেইনার তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়।

পলিভিনাইল ক্লোরাইড

প্রায় ১৬০ ডিগ্রী – ২৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত মারকিউরি ক্লোরাইড (Hg2Cl2) প্রভাবকের উপর দিয়ে অ্যাসিটিলিন ও শুষ্ক হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাসের মিশ্রণ চালনা করলে সংযোজন বিক্রিয়ার ফলে ভিনাইল ক্লোরাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন ভিনাইল ক্লোরাইডকে জৈব পারঅক্সাইড যেমন, বেনজোয়িল পারঅক্সাইড অথবা টারসিয়ারি বিউটাইল পারঅক্সাইড প্রভাবকের উপস্থিতিতে অধিক চাপ ও উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে পলিভিনাইল ক্লোরাইড উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন PVC-কে ৫২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ও ৯ atm চাপে হেপ্টেন দ্রাবকে রাখা হয়। কৃত্রিম চামড়া তৈরিতে, ঘরের মেঝের কার্পেটিং প্রস্তুতিতে, ঘরের ছাদ তৈরির জিনিসপত্র তৈরিতে, প্লাস্টিক সিরিঞ্জ, রেইন কোর্ট, গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরির জন্য ব্যবহার হয়।

পলিস্ট্যারিন

প্রথমে শুষ্ক অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড প্রভাবকের উপস্থিতিতে বেনজিন এর সাথে ইথিলিন এর বিক্রিয়ায় ইথাইল বেনজিন প্রস্তুত করা হয়। পরে ইথাইল বেনজিনকে ৬৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত ফেরিক অক্সাইড বা ক্রোমিয়াম অক্সাইড প্রভাবকের উপর দিয়ে চালনা করলে হাইড্রোজেন অপসারিত হয়ে স্ট্যারিন উৎপন্ন হয়। স্ট্যারিন থেকে যুত পলিমারকরণ প্রক্রিয়ায় পলিস্ট্যারিন প্রস্তুত করা হয়। খাবার পাত্র, কসমেটিকের পাত্র, প্লাস্টিক কাপ, খেলনা, বিভিন্ন প্লাস্টিক কেবিনেট, প্যাকেজিং সামগ্রী তৈরিতে এর ব্যবহার আছে।

টেফলন

ক্লোরোডাইফ্লোরো মিথেন ও হাইড্রোক্লোরিক গ্যাসের মিশ্রণকে প্রায় ৯০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে টেট্রাফ্লোরো ইথিলিন উৎপন্ন হয়। টেট্রাফ্লোরো ইথিলিন কে যুত পলিমারকরণ প্রক্রিয়ায় ফেনটন বিকারক অর্থাৎ ফেরাস সালফেটহাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর দ্রবণের উপস্থিতিতে উত্তপ্ত করলে টেফলন বা পলিটেট্রাফ্লোরো ইথিলিন (PTFE) প্রস্তুত হয়। টেফলন খুবই নিষ্ক্রিয়, অদাহ্য, এসিড, ক্ষার ও জারক পদার্থের সাথে ক্রিয়াহীন, বিদ্যুৎতাপ অপরিবাহী এবং অত্যন্ত শক্ত। এটি নন-স্টিকি প্লাস্টিক। রান্নার প্যানে টেফলন এর আঠালো ভাবহীন (নন-স্টিকিং) আবরণী দেয়া হয়। এছাড়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে অন্তরক হিসেবে, জাহাজের রজ্জু, বৈদ্যুতিক ভালভ প্রভৃতি তৈরিতে এর ব্যবহার আছে।

পারস্পেক্স,পেক্সিগ্লাস

এর মনোমার হল মিথাইল ২-মিথাইল প্রোপিনোয়েট। মনোমারকে ৮০ থেকে ৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, লঘু সাবান পানির উপস্থিতিতে পলিমারকরণ করে ভ পেক্সিগ্লাস তৈরি হয়। পেক্সিগ্লাস খুবই স্বচ্ছ। এটা গ্লাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়। লেন্স, প্রতিফলকরূপে এবং জানালার কাচ হিসেবে ব্যবহার হয়।

অরলন, এক্রিল্যান

এর মনোমার হল প্রোপিন নাইট্রাইল। অরলন থেকে এক্রাইলিক ফাইবার বা তন্তু তৈরি হয় যা দিয়ে কাপড়, কম্বল ও কার্পেট তৈরি হয়।

রাবার

উপযুক্ত প্রভাবকের (এসিড) উপস্থিতিতে n-আইসোবিউটিলিন থেকে রাবার তৈরি হয়।

প্যারালডিহাইড

সাধারণ তাপমাত্রায় গাড় সালফিউরিক এসিড প্রভাবকের উপস্থিতিতে তিন অণু ইথান্যাল পলিমারকরণের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ট্রাইইথান্যাল বা প্যারালডিহাইড উৎপন্ন হয়। [৩][৪]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. রসায়ন দ্বিতীয় পত্র-সঞ্জিত কুমার গুহ
  2. রসায়ন দ্বিতীয় পত্র- ডঃ সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী ও হারাধন নাগ
  3. উচ্চ মাধ্যমিক রসায়ন ২য় পত্র- ডঃ সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী হারাধন নাগ
  4. উচ্চ মাধ্যমিক রসায়ন ২য় পত্র- বিপ্লব কুমার দেব, প্রমোদ এলেন গমেজ