কফি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কফি
পিকোলো ল্যাটে এবং ফিল্টার করা কালো (ব্ল্যাক) কফি
প্রকারসাধারণত গরম তবে বরফ-ঠান্ডা হতে পারে
উৎপত্তির দেশআফ্রিকার শৃঙ্গ[১]ইয়েমেন[২]
প্রবর্তনপ্রায় ১৫ শতাব্দীতে (পানীয়)
রংগাঢ় বাদামী, হলদে বাদামী, কালো

কফি (ইংরেজি: Coffee) বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয় পানীয়।[৩] পানির সাথে ফুটিয়ে "কফি বীজ" নামে পরিচিত এক প্রকার বীজ পুড়িয়ে গুঁড়ো মিশিয়ে কফি তৈরি করা হয়। এই বীজ কফি চেরি নামক এক ধরনের ফলের বীজ। প্রায় ৭০টি দেশে এই ফলের গাছ জন্মে। সবুজ কফি বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত কৃষিপণ্যের মধ্যে একটি। কফিতে ক্যাফেইন নামক এক প্রকার উত্তেজক পদার্থ রয়েছে।[৪] ৮ আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।[৫] কফির উপাদান ক্যাফেইনের জন্যে কফি মানুষের উপর উত্তেজক প্রভাব ফেলে ও উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে কফি বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত গরম পানীয়।[৬]

কফিয়া গাছের ফল থেকে বীজ আলাদা করে তা থেকে সবুজ কফি বীজ তৈরি করা হয়। বীজগুলো ভাজা হয় এবং মিহি করে গুড়ো করা হয়। এরপর গরম পানিতে ফিল্টার করে এক কাপ কফি তৈরি করা হয়। কফি সাধারণত গরম গরম পরিবেশন করা হয়, তবে ঠাণ্ডা বা বরফযুক্ত কফিও সহজলভ্য। কফি বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত এবং পরিবেশন করা যায় (যেমন, এসপ্রেসো , ফ্রেঞ্চ প্রেস , ক্যাফে ল্যাটে অথবা পূর্ব প্রস্তুতকৃত টিনজাত কফি )। কফির তিক্ত স্বাদ কমাতে বা স্বাদ বাড়াতে প্রায়ই চিনি , কৃত্রিম মিষ্টিকারক ,দুধ এবং ক্রিম ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে কফি একটি বৈশ্বিক পণ্য হলেও, লোহিত সাগরের চারপাশের খাদ্য ঐতিহ্যের সাথে এর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । আধুনিক যুগের মতো পানীয় আকারে কফি পানের প্রথম বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আধুনিক ইয়েমেনের সুফি মাজারগুলোতে পাওয়া যায়। সেখানে ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কফি বীজকে বর্তমান পদ্ধতির মতো ভেজে কফি প্রস্তুত করা হতো। ইয়েমেনিরা উপকূলীয় সোমালি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইথিওপিয়ান পার্বত্য অঞ্চল থেকে কফি বীজ সংগ্রহ করে এবং কফি চাষ শুরু করে। ১৬ শতকের মধ্যে, পানীয়টি মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বাকি অংশে পৌঁছায় এবং পরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ২০ শতকে, কফি একটি বৈশ্বিক পণ্যে পরিণত হয় এবং বিশ্বজুড়ে অনেক কফি সংস্কৃতির জন্ম দেয়।

উৎপাদন ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

গ্রিন কফি আনরোস্টেড কফি বীন দিয়ে তৈরি করা হয়

কফি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিক্রিত পণ্য (জ্বালানী তেলের পরে) এবং বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি পানকৃত পানীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৮-২০০০ সালের মধ্যে ৬.৭ মিলিয়ন টন কফি উৎপন্ন হয়েছে। ২০১০ সাল নাগাদ কফির উৎপাদন বেড়ে ৭ মিলিয়ন টনে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।[৭]

বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রচলিত উত্তেজক পানীয় হিসেবে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ১৯৯৯ সালের হিসেব অনুযায়ী আমেরিকার নাগরিকগণ প্রতিদিন গড়ে ৩.৫ কাপ কফি পানীয়রূপে গ্রহণ করে থাকেন।[৮]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ নিয়মিত কফি পান করে থাকেন এবং তারা গড়ে প্রতিদিন ৩ কাপ কফি পান করেন।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

কিংবদন্তি কাহিনী[সম্পাদনা]

কফির উৎপত্তি নিয়ে একাধিক উপাখ্যানমূলক মূলক গল্প প্রচলিত রয়েছে যার কোনো প্রমাণ নেই। একটি বহুল প্রচলিত কিংবদন্তিতে কালদি নামক একজন ৯ম শতাব্দীর ইথিওপিয়ান ছাগলপালকের উল্লেখ রয়েছে, যিনি সর্বপ্রথম কফি গাছ পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার ছাগলের পালকে তা চাবাতে দেখেন।[৯] এই কিংবদন্তিটি ১৬৭১ সালের আগে দেখা যায় না। প্রাচ্য ভাষার একজন ম্যারোনাইট অধ্যাপক এবং কফি বিষয়ক প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থসমূহের একটির লেখক আন্তোইন ফস্টাস নাইরন তার বই ডি সালুবেররিমা পোটিওনে কাহুয়ে সেউ ক্যাফে নুনকুপাটা ডিসকার্স্কাসে (রোম, ১৬৭১) সর্বপ্রথম এ ঘটনার অবতারণা করেন। ধারণা করা হয় গল্পটি সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক।[১০][১১][৯] অপর একটি কিংবদন্তিতে শেখ ওমরকে কফি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়। মোখা শহর থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর অনাহারে থাকা ওমর একপ্রকার ফলের সন্ধান পান। সেগুলো চিবিয়ে এবং ভাজার চেষ্টা করার পর, ওমর সেগুলো সিদ্ধ করে একপ্রকার তরল তৈরি করেন। এটি তাকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং টিকে থাকার সামর্থ্য যোগায়।[১২]

ঐতিহাসিক রূপান্তর[সম্পাদনা]

কফি পানের উৎসটি অস্পষ্ট হলেও [১৩] কফি পান বা কফি গাছ সম্পর্কিত জ্ঞানের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে, যা ১৫ শতকের মাঝামাঝি ইয়েমেনের আহমেদ আল-গাফফারের বিবরণে দেখা যায়। [১৪] সম্ভবত ইয়েমেনে প্রথমবারের মতো কফি বীজ ভেজে বর্তমান সময়ের মতো করে কফি প্রস্তুত করা হতো। সুফিরা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে জন্য জাগ্রত থাকতে কফি ব্যবহার করতো। [১৫] ইয়েমেনে কফি আবির্ভাবের পূর্বে কফি গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত ছিল। ইথিওপিয়া থেকে, লোহিত সাগরের ওপারে বাণিজ্যের মাধ্যমে ইয়েমেনে কফি আনা যেত। [১৬] একটি কাহিনীতে আফ্রিকার উপকূল থেকে অ্যাডেনে কফি আনার জন্য মুহাম্মদ ইবনে সা'দকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। [১৭] অন্যান্য প্রাথমিক বিবরণ অনুযায়ী শাদিলি ধারার সুফি আলী বেন ওমরই প্রথমবারের মতো আরবে কফির প্রচলন করেছিলেন। [১৭] [১৮] আল শারদির মতে, আলী বেন ওমর ১৪০১ সালে আদল রাজা সাদাদিনের সঙ্গীদের সাথে থাকার সময় কফির সাথে পরিচিত হয়ে থাকতে পারেন।

১৬ শতকের বিখ্যাত ইসলামিক পন্ডিত ইবনে হাজার আল-হায়তামি তার লেখায় আফ্রিকার শৃঙ্গে অবস্থিত জেইলা অঞ্চলের একটি গাছ থেকে কাহওয়া নামক একটি পানীয় তৈরির কথা উল্লেখ করেছিলেন। [১৫] আধুনিক সোমালিল্যান্ডের বারবেরা এবং জেইলার সোমালি ব্যবসায়ীরা ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেনে প্রথমবারের মতো কফি রপ্তানি করেছিলেন। এই কফি হারার এবং আবিসিনিয়ার অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। অ্যাডেনের ঔপনিবেশিক প্রশাসক (১৮৩৯-১৮৫৪) ক্যাপ্টেন হেইন্সের মতে, ১৯ শতাব্দীতে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত অ্যাডেন কর্তৃক মোচার কফি বাণিজ্য দখল করার আগে মোচা ঐতিহাসিকভাবে তাদের কফির দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বারবেরা-ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমদানি করেছিল। এরপর, ইথিওপিয়ান কফির বেশিরভাগই বারবেরার হয়ে অ্যাডেনে রপ্তানি করা হয়েছিল। [১৯]

সেন্ট মাইকেল অ্যালি, লন্ডনে কফি বিক্রয়ের জন্য ১৬৫২ সালে তৈরি হ্যান্ডবিল বিজ্ঞাপন

১৬ শতকের মধ্যে, কফি বাকি মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, তুরস্ক এবং উত্তর আফ্রিকায় পৌঁছেছিল। [২০] সেই সময় সুফি বাবা বুদান ইয়েমেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে প্রথমবারের মতো ভারতে কফির বীজ পাচার করেছিলেন। তবে এর আগে, সমস্ত রপ্তানিকৃত কফি সিদ্ধ বা জীবাণুমুক্ত করা হয়েছিল। বাবা বুদানের প্রতিকৃতিতে তাকে সাতটি কফির বীজ বুকে বেঁধে পাচার করতে দেখা যায় । চোরাচালানের মাধ্যমে রপ্তানিকৃত বীজ থেকে জন্মানো প্রথম গাছগুলো মহীশূরে রোপণ করা হয়েছিল।

১৬০০ সালের মধ্যে কফি ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর ইউরোপের বাকি অংশ, ইন্দোনেশিয়া এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। [২১]

স্বাস্থ্যগুণ[সম্পাদনা]

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে কফি লিভারের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ক্যান্সার রোধ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এতে থাকা অধিক পরিমানে ক্যাফেইন নিম্ন রক্তচাপ জাতীয় সমস্যার জন্যে উপকারী।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটি অধিক পরিমাণে গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কফি দিবস[সম্পাদনা]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাৎসরিকভাবে ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতীয় কফি দিবস পালন করা হয়।[২২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Souza, Richard M. (2008) Plant-Parasitic Nematodes of Coffee. Springer. p. 3. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৪০২০-৮৭২০-২
  2. Weinberg, Bennett Alan; Bealer, Bonnie K. (২০০১)। The world of caffeine : the science and culture of the world's most popular drug। Internet Archive। New York : Routledge। আইএসবিএন 978-0-415-92723-9 
  3. University, Furman; Twitter, Twitter। "How Coffee Changed the World"Treehugger (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১৬ 
  4. Cappelletti, Simone; Piacentino, Daria; Aromatario, Gabriele Sani and Mariarosaria (২০১৪-১২-৩১)। "Caffeine: Cognitive and Physical Performance Enhancer or Psychoactive Drug?"Current Neuropharmacology (ইংরেজি ভাষায়)। ডিওআই:10.2174/1570159x13666141210215655পিএমআইডি 26074744পিএমসি 4462044অবাধে প্রবেশযোগ্য। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১৬ 
  5. "Caffeine Chart | Center for Science in the Public Interest"www.cspinet.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১৬ 
  6. "Coffee Report 2022"Statista (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  7. FAO document repository - medium-term prospects for agricultural commodities; projections to the year 2010. Rome, Food and Argiculture Organisation of the United Nations, 2003. আইএসবিএন ৯২-৫-১০৫০৭৭-৫.
  8. "Deutscher Kaffeeverband (2001-05-04). "Kaffee-Text 1/99" (in German) (PDF). Retrieved 2007-12-14" (পিডিএফ)। ২০০৮-০২-২৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৮-২৪ 
  9. Weinberg ও Bealer 2001, পৃ. 3–4
  10. Noted by H. F. Nicolai, Der Kaffee und seine Ersatzmittel: Volkshygienische Studie, (Brunswick, 1901) ch. 1 "Geschichtliches über den Kaffee" p. 4 note 1.
  11. Banesio, Fausto Naironio (১৬৭১)। De saluberrima potione cahue, seu cafe nuncupata discursus Fausti Naironi Banesii Maronitae, linguae Chaldaicae, seu Syriacae in almo vrbis archigymnasio lectoris ad eminentiss. ... D. Io. Nicolaum S.R.E. card. .. (Latin ভাষায়)। Typis Michaelis Herculis। 
  12. Ukers, William (১৯৩৫)। All About Coffeeবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। New York: Tea & Coffee Trade Journal Company। পৃষ্ঠা 9–10 
  13. Equity Capital From Ancient Partnerships to Modern Exchange Traded Funds By Geoffrey Poitras page 217
  14. Weinberg ও Bealer 2001
  15. First Encyclopedia of Islam 
  16. Souza 2008
  17. Hattox, Ralph S. (১৯৮৫)। Coffee and coffeehouses: The origins of a social beverage in the medieval Near East। University of Washington Press। পৃষ্ঠা 14। আইএসবিএন 978-0-295-96231-3। ২৭ মার্চ ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০২০ 
  18. Burton, Richard F. (১৮৫৬)। First footsteps in East Africa। Longman। পৃষ্ঠা 78 
  19. R. J., Gavin (১৯৭৫)। Aden Under British Rule, 1839–1967 (ইংরেজি ভাষায়)। C. Hurst & Co. Publishers। পৃষ্ঠা 53। 
  20. Wild, Antony (২০০৪)। Coffee: A Dark History। Fourth Estate। পৃষ্ঠা 52–53। আইএসবিএন 978-1-84115-649-1 
  21. Meyers, Hannah (৭ মার্চ ২০০৫)। "Suave Molecules of Mocha—Coffee, Chemistry, and Civilization"New Partisan। New Partisan। ২২ মার্চ ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  22. "Breakfast buffet: National coffee day – Eatocracy - CNN.com Blogs"। Eatocracy.cnn.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১০-২৬