আমিষ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি প্রোটিনের গাঠনিক একক
অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এগুলি প্রতিটি দেহকোষে বিরাজ করে এবং এগুলি থেকে নিউক্লিয়িক অ্যাসিড, সহ-উৎসেচক, প্রাণরস বা উদ্বোধক গ্রন্থিরস (হরমোন), অনাক্রম্য প্রত্যুত্তর, মেরামতি ও জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক অন্যান্য অণুসমূহ সৃষ্টি হয়।

আমিষ মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান[১] এটি দেহকলার গাঠনিক উপাদানগুলোর একটি এবং জ্বালানির উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। জ্বালানি হিসেবে আমিষ শর্করার সমপরিমাণ শক্তি ঘনত্ব প্রদান করে: প্রতি গ্রামে ৪ কিলোক্যালরি (১৭ কিলোজুল)। এর বিপরীতে স্নেহপদার্থ বা চর্বি প্রতি গ্রামে ৯ কিলোক্যালরি বা ৩৭ কিলোজুল শক্তি প্রদান করে। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সংজ্ঞাসূচক বৈশিষ্ট্য হল এর ভেতরে অ্যামিনো অ্যাসিডসমূহের সংযুক্তি।[২]

আণবিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষ বা প্রোটিন হল পেপটাইড বন্ধনসমূহ দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার শৃঙ্খল। মানব পরিপাকের সময় পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডপ্রোটিয়েজ নামক উৎসেচকের ক্রিয়ার ফলে আমিষ অণুগুলো ভেঙে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে পরিণত হয়। মানবদেহ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো জৈবসংশ্লেষ করতে পারে না, তাই খাদ্য হিসেবে গৃহীত আমিষে অবস্থিত এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো শোষণ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।[৩]

মানুষকে তাদের খাদ্য থেকে অবশ্যই নয়টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আহরণ করতে হয়, যাতে প্রোটিন-শক্তি অপুষ্টি এর পরিণামে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। এই নয়টি অ্যামিনো অ্যাসিড হল ফিনাইল-অ্যাালানিন, ভ্যালিন, থ্রিওনিন, ট্রিপ্টোফ্যান, মেথিওনিন, লিউসিন, আইসোলিউসিন, লাইসিন এবং হিস্টিডিন[২][৪] অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডের সংখ্যা ৮ নাকি ৯, এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।[৫] বর্তমানে আপাতদৃষ্টিতে ঐকমত্য ৯টি অ্যামিনো অ্যাসিডের পক্ষে, কেননা হিস্টিডিন প্রাপ্তবয়স্ক মানবদেহে সংশ্লেষিত (তৈরি) হয় না।[৬] অন্যদিকে, মানবদেহ পাঁচটি অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষণ করতে সক্ষম। এগুলি হল অ্যালানিন, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড, অ্যাস্পারাজিন, গ্লুটামিক অ্যাসিড এবং সেরিন। এছাড়া ছয়টি শর্তসাপেক্ষ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আছে, যেগুলির সংশ্লেষণ বিশেষ রোগ-শারীরবৈজ্ঞানিক অবস্থায় সীমিত হতে পারে, যেমন নবজাতকের প্রাক-পরিপক্কতা কিংবা গুরুতর অপচিতিমূলক সংকটাবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিসমূহের দেহে। এই ছয়টি অ্যামিনো অ্যাসিড হল আর্জিনিন, সিস্টেইন, গ্লাইসিন, গ্লুটামিন, প্রোলিন এবং টাইরোসিন[২] আমিষের খাদ্য উৎসগুলির মধ্যে আছে মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি, মাছ, ডিম, শস্যদানা, শিমশুঁটিজাতীয় উদ্ভিদ, বাদাম[৭] এবং ভক্ষণযোগ্য কীটপতঙ্গ

শ্রেণিবিভাগ[সম্পাদনা]

উৎসগত দিক দিয়ে আমিষের শ্রেণিবিভাগ[সম্পাদনা]

উৎস অনুযায়ী আমিষকেকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

  • প্রাণিজ আমিষ: যে আমিষগুলো প্রাণিজগৎ থেকে পাওয়া যায় তাদেরকে প্রাণিজ আমিষ বলে। যেমন: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি। এই প্রোটিনকে প্রথম শ্রেণির প্রোটিন বলে।
  • উদ্ভিজ্জ আমিষ: উদ্ভিদ জগৎ থেকে প্রাপ্ত আমিষকে উদ্ভিজ্জ আমিষ বলে। যেমন: ডাল, বাদাম, সয়াবিন, শিমের বিচি ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ আমিষকে দ্বিতীয় শ্রেণির আমিষ বলে।

১ গ্রাম আমিষ থেকে চার কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ২০-২৫ ভাগ আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিন খাবারে উদ্ভিজ্জ আমিষের পাশাপাশি কিছু প্রাণিজ আমিষও গ্রহণ করতে হবে।

আমিষের কার্যকারিতা[সম্পাদনা]

আমাদের দেহের অস্থি, পেশী, বিভিন্ন দেহযন্ত্র, রক্ত কণিকা থেকে শুরু করে দাঁত, চুল, নখ পর্যন্ত প্রোটিন দিয়ে গঠিত। আমিষ শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি সাধন ও দেহ গঠন করে। আমাদের দেহের কোষগুলো প্রতিনিয়তই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয়প্রাপ্ত স্থানে নতুন কোষগুলো গঠন করে ক্ষয়পূরণ করতে ও কোনো ক্ষতস্থান সারাতে প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। যখন দেহে চর্বি ও শর্করার অভাব দেখা যায় তখন প্রোটিন তাপশক্তি উৎপাদনের কাজ করে। রোগ সৃষ্টিকারী রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের দেহে তাদের প্রতিরোধী পদার্থ বা অ্যান্টিবডি তৈরী করা আমিষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মানসিক বিকাশ বা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য আমিষ অপরিহার্য।

দেহে আমিষেরর অভাব হলে বর্ধনরত বয়সের শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যে আমিষের ঘাটতি থাকলে কোয়াশিয়রকর রোগ হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মেধা ও বুদ্ধি কমে যায়। তাই আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Hermann, Janice R.। "Protein and the Body" (পিডিএফ)Oklahoma Cooperative Extension Service, Division of Agricultural Sciences and Natural Resources • Oklahoma State University: T–3163–1 – T–3163–4। ২৩ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  2. Dietary Reference Intakes for Energy, Carbohydrate, Fiber, Fat, Fatty Acids, Cholesterol, Protein and Amino Acids, Institute of Medicine. National Academy Press, ২০০৫ 
  3. Genton L, Melzer K, Pichard C (আগস্ট ২০১০)। "Energy and macronutrient requirements for physical fitness in exercising subjects"। Clinical Nutrition29 (4): 413–23। ডিওআই:10.1016/j.clnu.2010.02.002পিএমআইডি 20189694 
  4. Young VR (আগস্ট ১৯৯৪)। "Adult amino acid requirements: the case for a major revision in current recommendations" (পিডিএফ)The Journal of Nutrition124 (8 Suppl): 1517S–1523S। ডিওআই:10.1093/jn/124.suppl_8.1517Sপিএমআইডি 8064412 
  5. Rosane Oliveira, "The Essentials–Part One" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে, UC Davis Integrative Medicine, Feb 4, 2016. July 12, 2017.
  6. Kopple JD, Swendseid ME (মে ১৯৭৫)। "Evidence that histidine is an essential amino acid in normal and chronically uremic man"The Journal of Clinical Investigation55 (5): 881–91। ডিওআই:10.1172/jci108016পিএমআইডি 1123426পিএমসি 301830অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  7. "Protein in diet"। United States National Library of Medicine, National Institutes of Health। ২০০৯। 

গ্রন্থ ও রচনাপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • Branden C, Tooze J (১৯৯৯)। Introduction to Protein Structure। New York: Garland Pub। আইএসবিএন 0-8153-2305-0 
  • Murray RF, Harper HW, Granner DK, Mayes PA, Rodwell VW (২০০৬)। Harper's Illustrated Biochemistry। New York: Lange Medical Books/McGraw-Hill। আইএসবিএন 0-07-146197-3 
  • Van Holde KE, Mathews CK (১৯৯৬)। Biochemistry। Menlo Park, California: Benjamin/Cummings Pub. Co., Inc। আইএসবিএন 0-8053-3931-0 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

উপাত্তাধার ও প্রকল্পসমূহ[সম্পাদনা]

হাতেখড়ি এবং শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট[সম্পাদনা]