বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Hasan.zamil (আলোচনা | অবদান)
Hasan.zamil (আলোচনা | অবদান)
১০ নং লাইন: ১০ নং লাইন:
নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে।
নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে।



১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ থেকে অস্থায়ী ভারত সচিবকে লেখা এক পত্রে উল্লেখ করেছেন 'বাঙ্গালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে এবং এক বাঙ্গালি বাবুকে লাট সাহেবের গদীতে বসাতে চায়..... বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তাদের এই স্বপ্নের সফল রূপায়ণে বাঁধা দেবে। আমরা যদি তাদের আপত্তির কাছে নতিস্বীকার করি তবে ভবিষ্যতে কোনদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না এবং আপনারা ভারতের পূর্বপাশ্র্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনি প্রবল এবং ভবিষ্যতে বর্ধমান বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে।' কার্জন ইতিপূর্বে গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে দার্জিলিং বাদে মালদাহসহ পুরো রাজশাহী বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বাকি জেলাগুলো আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার পস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে বৃটিশ আমলা রিজলি মন্তব্য করেছেন, সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী, বিভক্ত বাংলা বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। কংগ্রেস নেতারা এ ভয় করছেন। তাঁদের আশঙ্কা নির্ভুল এবং সেটাই এই প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় গুণ। আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বৃটিশ রাজত্বের বিরোধী একটি সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।' ঢাকায় লর্ড কার্জন এক ভাষণে ঘোষণা করেন মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ রচনাই তার লক্ষ্য। ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলায় ইতোমধ্যে তৎপর চরমপন্থীদের নতুন প্রদেশে দমন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।
১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ থেকে অস্থায়ী ভারত সচিবকে লেখা এক পত্রে উল্লেখ করেছেন 'বাঙ্গালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে এবং এক বাঙ্গালি বাবুকে লাট সাহেবের গদীতে বসাতে চায়..... বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তাদের এই স্বপ্নের সফল রূপায়ণে বাঁধা দেবে। আমরা যদি তাদের আপত্তির কাছে নতিস্বীকার করি তবে ভবিষ্যতে কোনদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না এবং আপনারা ভারতের পূর্বপাশ্র্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনি প্রবল এবং ভবিষ্যতে বর্ধমান বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে।' <ref> সুমিত সরকার,The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908, নয়া দিল্লী ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৯. “The Bengalis, who like to think themselves a nation, and who dream of a future when the English will have been turned out, and a Bengali Babu will be installed in Government House, Calcutta, of course bitterly resent any disruption that will be likely to interfere with the realisation of this dream. If we are weak enough to yield to their clamour now, we shall not be able to disseminate or reduce Bengal again; and you will be cementing and solidifying on the eastern flank of India, a force already formidable and certain to be a source of increasing trouble in the future.”</ref>

কার্জন ইতিপূর্বে গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে দার্জিলিং বাদে মালদাহসহ পুরো রাজশাহী বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বাকি জেলাগুলো আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার পস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে বৃটিশ আমলা রিজলি মন্তব্য করেছেন, সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী, বিভক্ত বাংলা বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। কংগ্রেস নেতারা এ ভয় করছেন। তাঁদের আশঙ্কা নির্ভুল এবং সেটাই এই প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় গুণ। আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বৃটিশ রাজত্বের বিরোধী একটি সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।' ঢাকায় লর্ড কার্জন এক ভাষণে ঘোষণা করেন মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ রচনাই তার লক্ষ্য। ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলায় ইতোমধ্যে তৎপর চরমপন্থীদের নতুন প্রদেশে দমন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।


==আন্দোলনের সূত্রপাত==
==আন্দোলনের সূত্রপাত==

০৮:২৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যে আন্দোলন হয়েছিল তাই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে তৎকালীন বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং বৃটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই।কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই পূর্ববঙ্গই পরবর্তীতে পাকিস্তানের কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।

সূচনা

বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ছিল ৭৮.৫ মিলিয়ন। বঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের অধিনে ন্যস্ত করা হয় এবং ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট সহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ-কমিশনারশীপ গঠন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারী সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।

পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু ও ৯ মিলিয়ন মুসলিম।

নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে।


১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ থেকে অস্থায়ী ভারত সচিবকে লেখা এক পত্রে উল্লেখ করেছেন 'বাঙ্গালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে এবং এক বাঙ্গালি বাবুকে লাট সাহেবের গদীতে বসাতে চায়..... বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তাদের এই স্বপ্নের সফল রূপায়ণে বাঁধা দেবে। আমরা যদি তাদের আপত্তির কাছে নতিস্বীকার করি তবে ভবিষ্যতে কোনদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না এবং আপনারা ভারতের পূর্বপাশ্র্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনি প্রবল এবং ভবিষ্যতে বর্ধমান বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে।' [১]

কার্জন ইতিপূর্বে গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে দার্জিলিং বাদে মালদাহসহ পুরো রাজশাহী বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বাকি জেলাগুলো আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার পস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে বৃটিশ আমলা রিজলি মন্তব্য করেছেন, সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী, বিভক্ত বাংলা বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। কংগ্রেস নেতারা এ ভয় করছেন। তাঁদের আশঙ্কা নির্ভুল এবং সেটাই এই প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় গুণ। আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বৃটিশ রাজত্বের বিরোধী একটি সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।' ঢাকায় লর্ড কার্জন এক ভাষণে ঘোষণা করেন মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ রচনাই তার লক্ষ্য। ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলায় ইতোমধ্যে তৎপর চরমপন্থীদের নতুন প্রদেশে দমন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।

আন্দোলনের সূত্রপাত

এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারল না এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান আমার সোনার বাংলা লেখেন, যা অনেক পরে, ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়।[২]এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বৃহৎ বঙ্গের অধিবাসী বাঙালি হিন্দু মুসলমানের চেতনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টির জন্যই কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও চারণ কবিদের যত মিছিলে মিছিলে সেসব সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হওয়ার কথা। সুতরাং ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করা হয়।[৩] সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব।[৪][৫]

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে 'স্বরাজ' শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট। নরমপন্থীরা কয়েকটি সীমিত পণ্যের ব্যাপারে তার প্রয়োগ চাইলো। স্বদেশীদের ব্যাপারে নরমপন্থীদের বয়ান ছিল, 'এমন কি স্বার্থত্যাগের দরকার হলেও। আর চরমপন্থীদের বয়ান ছিল 'যে কোন ত্যাগে স্বদেশী'।

ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় বিদেশী বর্জনের ডাক ওঠে। শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলনের।

দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তাদের স্বেচ্ছাসেবী দল মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় বাড়ি বাড়ি ফেরি করতো। আদর্শবাদের কমতি না থাকলেও বিলাতী ব্যবসায়ীদের গায়ে তা প্রবল বা দীর্ঘস্থায়ী আঘাত হানতে পারেনি।

তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। এরা ছিল দলে ভারী। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে 'স্বদেশ বান্ধব', ময়মনসিংহে 'সুহৃদ' ও 'সাধনা', ফরিদপুরে 'ব্রতী' আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার 'অনুশীলন' সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়। অনুশীলন সমিতির পূর্ববঙ্গ ও আসামে পাঁচশ শাখা এবং সদস্য সংখ্যা গোড়াতে ছিল তিন হাজারের মতো। কলকাতায় গড়ে ওঠে 'যুগান্তর' নামে আরেক সংগঠন।[৬] এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।

এই অরবিন্দ ঘোষ নরমপন্থীদের হাত থেকে কংগ্রেসের কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে ছিলেন তৎপর। ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, 'প্রকাশ্যে কংগ্রেসের মাধ্যমে এবং গোপনে বিপ্লবীদের মাধ্যমে অরবিন্দ যুগপৎ আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তার অনুসারীরা পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকে পড়ে।' ১৯০৭ সালে সুরাটে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে লাঠালাঠি, চেয়ার ভাঙ্গাভাঙ্গি, মাথা ফাটানোর ঘটনা ঘটে। বৃটিশ সাংবাদিক নেভিনসন এই ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা রেখে গেছেন। অরবিন্দ ঘোষ পরবর্তীতে লিখেছেন, 'আমি তিলকের (কংগ্রেস নেতা বালগঙ্গাধর তিলক) সঙ্গে পরামর্শ না করেই হুকুম দিয়েছিলাম কংগ্রেস অধিবেশন ভেঙ্গে দিতে।'উনবিংশ শতকের শেষে ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের মূল হাতিয়ার ছিল পিস্তল, রিভলবার। আর এসময় বোমার অনুপ্রবেশ ঘটায় বাঙ্গালিরা। নেতৃত্ব ছিলেন এই অরবিন্দ ঘোষ। বারীণ ঘোষ 'যুগান্তর' নামে একটি উপদল গঠন করেন ১৯০৫ সালে অনুশীলন সমিতির কলকাতা শাখা ভেঙে। এই সমিতি বোমা তৈরি শেখার জন্য হেমচন্দ্র কানুণগো নামে একজন বিপ্লবীকে প্যারিসে পাঠায়। এর আগে কলকাতার আত্মোন্নতি সমিতির সদস্য বিভূতি চক্রবর্তী বোমা বানানো শুরু করেন। কিন্তু এই বোমার ক্ষমতা তেমন মারাত্মক ছিল না। এই বোমায় রেললাইন বা সেতু উড়ানো যেতো না। অন্য বিপ্লবীরাও বোমা বানাতে শুরু করেছিল। সেসব বোমা ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজারকে আঘাত এবং বড়লাট হার্ডিঞ্জকে রক্তাক্ত করেছিল। উন্নতমানের বিস্ফোরক তৈরি শিখতে হেমচন্দ্র সুইজারল্যান্ড ও প্যারিসে গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে চলে যান লন্ডনে। কিন্তু সেখানেও সুযোগ না পেয়ে ফিরে যান প্যারিসে। ফরাসি সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে এবং বিস্ফোরক রসায়ন ও বিস্ফোরক ঘটাবার কায়দা কানুন শিখে নেন। রুশ সন্ত্রাসবাদী দলের বিপ্লবী নিকোলাস সাফ্রানস্কির কাছে প্রশিক্ষিত হয়ে হেমচন্দ্র কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে। হেমচন্দ্র নির্মিত প্রথম বোমাটি কিংসফোর্ডকে ১০৭৫ পৃষ্ঠার বইয়ের ভেতরে করে পাঠানো হয়েছিল, যা বিস্ফোরিত হয়নি।[৭]মার্চ মাসে হেমচন্দ্র বোমা তৈরির স্কুল খোলেন পাঁচ ছাত্রকে নিয়ে। তার তৈরি বোমাটিই নিক্ষেপ করেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু।[৮] ক্ষুদিরামের এই ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্নস্থানে হানা দিয়ে ৩৪ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার এবং বোমা বানানো বিষয়ক বইপত্র ও সরঞ্জাম আটক করে। এই বিপ্লবীদের ফাঁসি, দ্বীপান্তর হলেও বোমার শব্দ পরবর্তীতেও থামেনি। মাষ্টারদা সূর্যসেন হয়ে তা একুশ শতকে পাড়ি দিয়েছে। [৯]

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে একটি বোমা প্রস্তুতের কারখানা আবিষ্কৃত হয়। এ ব্যাপারে অরবিন্দ ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্ত, কানাই লালসহ ৪৭ জন চরমপন্থী ধরা পড়েন।[১০]

সে যুগে আচার্য প্রফল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিজ্ঞানীরা গোপনে বোমা তৈরির রসায়ন শেখাতেন ছাত্রদের।[১১] বিপ্লবী ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, '১৯০৩-০৪ সালে বাংলায় একটি প্রচার হয়েছিল, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে বিপ্লব হবে। অন্যসব প্রদেশ তৈরি কিন্তু 'কাপুরুষ' বাঙ্গালি কিছু করছে না। বাঙ্গালির মনে হয়েছিল, 'কাপুরুষ' এই অপবাদটি স্খলন করা দরকার। তাই ঝোঁক হলো লাঠি খেলা। রসায়ন চর্চার। ... বঙ্গদেশে বোমা আবির্ভাবের দুটো মূল কারণ-প্রথমত. বাঙ্গালি ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয় জাতি। সেই সময়ে বাঙ্গালি ছাত্রদের অনেকেই ম্যাটিসিনি, গ্যারিবল্ডির জীবনী পড়ে ফেলেছেন। রুশ নিহিলিস্টদের কাজকর্ম খেয়াল রাখছেন। এদের কাজকর্মের সঙ্গে বোমার সংযোগ ছিল। য়ুরোপীয় বিপ্লবীদের কাজকর্মের ধারা, সন্ত্রাসবাদী চিন্তা সেই সময়ের বাঙ্গালি বিপ্লবীদের নিশ্চয়ই প্রভাবিত করেছিল। ... ভারতে বোমার আবির্ভাব বাঙ্গালির মানসিক ক্রমবিকাশের ফল।... যদি বাঙ্গালার ধর্ম ও সামাজিক পরিবেশে চরমপন্থার অভ্যুদয় না হইত, তবে হয়তো বাঙ্গালায় বোমারও আবির্ভাব হইত না।' অরবিন্দ ঘোষের গ্রেফতারের পর চরমপন্থী ধারা অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়ে।

এই সকল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমি অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

বৃটিশ প্রতিক্রিয়া

বদরুদ্দীন উমরের ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন-থেকে জানা যায়-

"বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী যে আন্দোলন ১৯০৫ সালের প দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে সেটা প্রধাণত মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এজন্য এই শ্রেণীর ইপরই সরকারের নির্যাতন সবথেকে বেশি হয়। পূর্ব বঙ্গ ও আসামের লেফটেনান্ট গভর্নর ব্যাম্পফিল্ড ফুলার বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করেন এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন সাম্প্রদায়িকতা। তিনি ঘোষণা করেন যে তাঁর দুই স্ত্রী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মুসলমানই হলেঅ প্রিয়পাত্রী। এই সময় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বঙ্কিম রচিত 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীতের পর্যায়ে নিয়ে যান ও তার ব্যাপক প্রচার করেন। ফুলার বরিশালে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্সের অধিবেশনে 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীত গীত হলে পুলিশ দ্বিতীয় দিনে লাঠি চার্জ করে সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পুলিশী নির্যাতন সত্ত্বেও আবদুর রসুলের সভাপতিত্বে বরিশালের এই অধিবেশনে সরকারের সঙ্গে অসহযোগীতা, বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা, বৃটিশ পণ্য বর্জন ইত্যাদি সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।"

তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার,The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908, নয়া দিল্লী ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৯. “The Bengalis, who like to think themselves a nation, and who dream of a future when the English will have been turned out, and a Bengali Babu will be installed in Government House, Calcutta, of course bitterly resent any disruption that will be likely to interfere with the realisation of this dream. If we are weak enough to yield to their clamour now, we shall not be able to disseminate or reduce Bengal again; and you will be cementing and solidifying on the eastern flank of India, a force already formidable and certain to be a source of increasing trouble in the future.”
  2. http://www.thedailystar.net/story.php?nid=78124
  3. http://www.storyofpakistan.com/articletext.asp?artid=A029&Pg=2
  4. http://www.thedailysangbad.com/print_news.php?news_id=5092&pub_no=57
  5. http://www.natun-diganta.com/archieves/3rd%20year/4th%20edition/jatiotabad.html জাতীয়তাবাদ, সামপ্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি -সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  6. http://www.dailysangram.net/archive/news_details.php?news_id=4604&publication_date=2009-04-09
  7. http://www.dhakanews24.com/bangladesh-memorial/3064.html
  8. http://bn.girgit.chitthajagat.in/azadlub.blogspot.com/2008/04/blog-post_26.html
  9. http://www.thedailysangbad.com/details.php?news=41&action=main&option=single&news_id=8919&pub_no=96
  10. http://www.dailysangram.net/archive/news_details.php?news_id=4604&publication_date=2009-04-09
  11. http://www.dailysangram.net/archive/news_details.php?news_id=4604&publication_date=2009-04-09