বৌদ্ধ ধ্যান: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Janilin.bappi (আলোচনা | অবদান)
→‎ভারতীয় মহাযান: অনুবাদ, সম্প্রসারণ
Janilin.bappi (আলোচনা | অবদান)
→‎পূর্ব এশীয় মহাযান: অনুবাদ, সম্প্রসারণ, তথ্যসূত্র যোগ/সংশোধন
৪৩১ নং লাইন: ৪৩১ নং লাইন:


= পূর্ব এশীয় মহাযান =
= পূর্ব এশীয় মহাযান =
চৈনিক বৌদ্ধ ধর্মের ভাবধারাটি মধ্য এশীয় অঞ্চল থেকে বিকাশিত হলেও তা ভারতীয় মহাযান পন্থা থেকে খুব একটা আলাদা নয়। প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক, ’’আন শিগাও’’ দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসকে কেন্দ্র করে যে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়, তার অনুবাদ করেন যা চৈনিক বৌদ্ধ ধর্ম ধারায় ধ্যানের জন্য ব্যাবহৃত হয়ে এসেছে।<ref>Bhante Dhammadipa, KUMĀRAJĪVA’S MEDITATIVE LEGACY IN CHINA, ২০১৫</ref> আরেক প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক এবং শিক্ষাবিদ, ’’কুমারাজিভা’’ চতুর্থ শতাব্দীর দিকে ধ্যান সংক্রান্তিয় বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করেন এবং তা ’’বসে থেকে সমাধি অনুশীলনের সূত্রবলী’’ নামে গ্রন্থিত হয়, যা সর্বাস্তিবাদদের ধ্যানধারার সরাসরি প্রতিফলন। তাঁরা এই সকল সূত্রাবলীকে ধ্যান সূত্র বলে থাকে।<ref>Deleanu, Florin (১৯৯২); Mindfulness of Breathing in the Dhyāna Sūtras. Transactions of the International Conference of Orientalists in Japan (TICOJ) ৩৭, ৪২-৫৭</ref> এই ধারায় সর্বাস্তিবাদের সৌত্রান্তিক ধারা এবং মহাযান ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।<ref>Thich Hang Dat, A REAPPRAISAL OF KUMĀRAJĪVA’S ROLE IN MEDIEVAL CHINESE BUDDHISM: AN EXAMINATION OF KUMĀRAJĪVA’S TRANSLATION TEXT ON “THE ESSENTIAL EXPLANATION OF THE METHOD OF DHYANA”</ref>

=== পূর্ব এশিয়ার যোগাচার পদ্ধতি ===
পূর্ব এশিয়ায় যোগাচার ধারা বা ''ওয়েইশি ঝং'' চৈনিক বৌদ্ধ ধারার মাধ্যমে প্রভাবিত, যা [[জাপান|জাপানে]] ''হাস্‌সো'' ধারা বলে পরিচিত। এই ধারায় বেশ কয়েক ধরণের ধ্যান বা ভাবনার অনুশীলন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ধারার ধ্যানীগণ এক শ্রেণীর চিত্র মনস্থ করে ধ্যান অনুশীলন করে থাকে, যার মধ্যে মৈত্রেয় বুদ্ধের বোধিসত্ত্বকে কেন্দ্র করে চর্চা করা হয়। যোগাচার সিদ্ধ, ঝুয়াংজ্যাং, এই ধরণের ধ্যানের কথা তাঁর জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই ধারার ধ্যানের মূল উদ্দ্যেশ্য হল পুনর্জন্ম লাভ করে মৈত্রেয় বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করা এবং তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করা।

চৈনিক ধ্যান ধারার আরেকটি রূপ হল '’বিজ্ঞাপ্তি মন্ত্র'’ জপের মাধ্যমে অনুশীলন করা, যা ঝুয়াংজ্যাং এর শিষ্য কুইজি প্রচলন ঘটান এবং এর প্রসার করেন। যোগাচার ধারার মধ্যে এর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারায় পাঁচটি স্তর রয়েছে:<ref>Gregory, Peter N. (সম্পাদক), ''Traditions of Meditation in Chinese Buddhism,'' ইঊনিভার্সিটি অফ হাওয়াই প্রেস, ১৯৮৬, পৃ. ৩২-৩৪.</ref>

১) মিথ্যার অবদমন এবং সত্যের উন্মোচন,

২) পাপের মোচন এবং পুণ্যের সঞ্চয়,

৩) মূল উৎসে ফিরে যাওয়া,

৪) অধীনতা থেকে মুক্তি, এবং

৫) সকল কিছুর বাস্তব রূপ উপলব্ধি করা।


=== তিয়ানতাই সমথ-বিপাসনা ===
[[চায়না|চায়নাতে]] নিয়মতান্ত্রিক ও বোধগম্য ধ্যান, ''তিয়ানতাই'’ ধারাতে দেখা যায়। ভারতীয় বৌদ্ধ ধ্যান সংক্রান্তিয় নির্দেশিকা পুস্তক ছাড়াও এই ধারায় তাঁদের নিজেদের প্রবর্তিত কিছু ধ্যান অনুশীলন দেখা যায়, যা শমথ ও বিদর্শন ধ্যানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ঝিয়ি-এর সামাথাবিপাসানা, ঝিগুয়াং-এর মাহাসামাথাবিপাসানা, এবং ছয় সূক্ষ্ম ধর্ম দ্বার গ্রন্থ সমূহ, এই ধারার ধ্যানের জন্য বিশদভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে। ঝিয়ি তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, "শমথ ও বিদর্শন অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বান অর্জন করা সম্ভব। সকল বন্ধন একত্রিত করার প্রথম ধাপ হল শমথ, এবং বিদর্শন জাগতিক ভ্রান্তি দূর করার জন্য অপরিহার্য। শমথ ধ্যান মনের খোরাক মেটায়, এবং বিদর্শন আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। শমথ ধ্যানের মাধ্যমে অনুপম সমাধির উৎপন্ন হয়, এবং বিদর্শন প্রজ্ঞা আনে।"

তিয়ানতাই ধারার ধ্যানে আনাপানা স্মৃতির প্রাধান্য দেখা যায়। ঝিয়ি শ্বাসকে চার ভাবে ভাগ : হাঁপানো, সাধারণ শ্বাস, নিঃশব্দের গভীর শ্বাস, এবং স্থবিরতা/বিশ্রাম। ঝিয়ির মতে, প্রথম তিন প্রকারের শ্বাস শুদ্ধ নয়, শুধুমাত্র চতুর্থ প্রকারের শ্বাসই শুদ্ধ। ঝিয়ি, চার রকমের সমাধি এবং দশ ধরণের বিদর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।


=== জাপানি তেন্দাই ===
এন্‌নিন (জিকাকু দাইশি), জাপানই তেন্দাই ধারায় মিক্‌ক্যো বা নিদর্শন ধারার প্রচলন আনেন, যা পরবর্তীতে তামিৎসু বলে পরিচিতি লাভ করে। তেন্দাই তামিৎসু মতবাদ অনুযায়ী পদ্ম সূত্রের পাশাপাশি বিদর্শন ধ্যানও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে, মন্ত্র জপ করে, নির্দিষ্ট মুদ্রাতে(ধ্যান আসন), বিদর্শন ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বান লাভ করা সম্ভব। তিমিৎসু ধারার উৎপত্তি চীন থেকে, এবং কুকাই ধারা থেকে এর ব্যপ্তি ঘটে।<ref>Ryūichi Abe (২০১৩), '' The Weaving of Mantra: Kūkai and the Construction of Esoteric Buddhist Discourse'', কলাম্বিয়া ইঊনিভার্সিটি প্রেস, পৃ. ৪৫ </ref>


=== হুয়াইয়ান ধ্যান তত্ত্ব ===


=== শুদ্ধ ভূমি বুদ্ধবাদ ===


=== চেন ===


= বজ্রযান =
= বজ্রযান =

১৯:৪৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

পদ্মাসনে ধ্যানে নিমগ্ন গৌতম বুদ্ধ

বৌদ্ধ ধ্যান মূলত বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যান চর্চাকে বোঝানো হয়। বৌদ্ধ ধর্ম তত্ত্বে এর উল্লেখ ভাবনা (মানসিক উন্নয়ন) এবং ধ্যান (মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আলোকিত চিত্ত) বলে রয়েছে।[১]

বৌদ্ধ ধর্মে মুক্তির পথ, নির্বাণ অর্জনের জন্য এর প্রয়োজন অপরিহার্য। অশুভ ভাবনা,[note ১] প্রতিত্যসমুত্‌পাদ,[note ২] স্মৃতি ও অনুস্মৃতি,[note ৩] আনাপানস্মৃতি,[note ৪] ব্রহ্ম-বিহার [note ৫]সহ ধ্যানের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরন করে নির্বাণ লাভ করা যায়। ধ্যানের এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে স্মৃতি, সমাধি, শমথ এবং বিপাসনার উন্নয়ন সাধন করা যায়। এই পদ্ধতি সমূহের নিয়মিত অনুশীলন চিত্ত বা মন প্রশান্ত হয়।[১]

সব ধরনের বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্ঘে ধ্যানের এই প্রকারের অনুশীলনের প্রচলন থাকলেও কিছু কিছু তফাত রয়েছে। থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে শমথ ও বিপাসনার প্রচলন দেখা যায়। চৈনিক ও জাপানি বৌদ্ধ ধর্মে সর্বস্তিবাদ এর চল বেশী দেখা যায়। আবার, তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে দেবতা-যোগ এর প্রচলন দেখা যায়, যা শূন্যতা উপলব্ধি বা নির্বাণ লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়।[২]

ব্যুৎপত্তি

ধ্যান বা মেডিটেশনের কাছাকাছি বৌদ্ধ ধর্মে যা রয়েছে তা হলো ভাবনা বা ধ্যানা।[৩] আবার, তিব্বতি, চৈনিক ও জাপানি ভাষায় একে ঝ্যান বা ঝ্যাং বা জেন ও বলা হয়ে থাকে।[৪]

ধ্যানের প্রস্তুতি

প্রাথমিক পর্যায়ে, একজন অনভিজ্ঞ ধ্যানীর জন্য ধ্যানের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অভিজ্ঞ ধ্যানী, যেকোন অবস্থায়, যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন ভাবে ধ্যান করতে সক্ষম। তবে অনভিজ্ঞ ধ্যানীর বেলায় ধ্যানীর মনোযোগ সহজেই বিচ্যুত হয় যার জন্য তাকে বেশ কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় যাতে করে ধ্যান করার সময় মনোনিবেশে কোন অসুবিধা না ঘটে।

সদাচার পালন

ধ্যান শুরু করার পূর্বে সাধককে কিছু ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হয় যা অনেকে শীল বলেও জেনে থাকেন। [৫] অন্তত ৫টি বিষয়ে সাধককে ব্রত থাকতে হয়,[note ৬] যা পঞ্চশীল নামে পরিচিত।[৫]

ধ্যানের উপযুক্ত স্থান

ধ্যান মূলত যেকোন জায়গায়, যেকোন ভাবে, যেকোন অবস্থায় (যেমন বিদর্শন ধ্যান) করা সম্ভব।[৬] তবে বিশেষ কিছু জায়গা ধ্যানের ব্যাঘাত বা অনুকূল পরিবেশরূপে কাজ করে। অনুকূল পরিবেশ হল-

  • দিনে লোকজনের তেমন সমাগম নেই এবং রাতে নির্জন,
  • পোকা-মাকড়, মশা-মাছি, সরীসৃপ ইত্যাদির উপদ্রব নেই,
  • খাবার যোগাড় করা সহজ,
  • ধ্যানে অভিজ্ঞ, এমন কারো সান্নিধ্যে, এবং
  • লোকালয় থেকে দূরেও নয়-কাছেও নয় এমন স্থান।[৫]

সাধারণত ১৮ রকমের জায়গা ধ্যানের অন্তরায় বলে গণ্য হয়।[৫] যেগুলো হলে- ১) জনবহুল আবাস, ২) নতুন ঘর, ৩) পুরানো-জীর্ণ ঘর, ৪) পথের পাশে, ৫) পানীয় জলাশয়ের পাশে, ৬) ক্ষেতের মাঝখানে, ৭) ফুল বাগানের মাঝখানে, ৮) ফল বাগানের মাঝখানে, ৯) শহরের মাঝখানে, ১০) কাঠের ঘর, ১১) ক্ষেতের পাশে, ১২) স্টেশন বা খেয়া ঘাটের পাশে, ১৩) পরিত্যাক্ত বাসা, ১৪) প্রত্যন্ত অঞ্চল, ১৫) সীমান্তবর্তী এলাকা, ১৬) পাপাচারে লিপ্ত এমন কারো সান্নিধ্য, ১৭) অমনুষ্য পরিবৃত আবাস, এবং ১৮) কল্যাণ মিত্রবিহীন আবাস।[৫]

ধ্যানের আসন

সাধকের বা ধ্যানীর জন্য অনুকূল, এমন কোন আসন তথা বসার ভঙ্গি নির্বাচন করা প্রয়োজন। ধ্যানী চাইলে বসবার জন্য মেঝেতে বা ঐ স্থানে অনধিক চার আঙ্গুল পুরু তোষক ব্যাবহার করতে পারে।[৫] দুই পা পরস্পর বিপরীতমুখী ভাজ করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসাটাই অনুকূল।[৫] সেক্ষেত্রে পদ্মাসন[১], ভদ্রাসন[২], সুখাসন[৩] ও উতকুটিক আসন উত্তম হিসেবে গণ্য হয়।[৫]

পদ্মাসনে ধ্যানী ভিক্ষু

পরিত্যাজ্য বিষয়

ধ্যানে বসার আগে কিছু কাজ ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটায়, যা হল[৭]-

  • বাসার কাজকর্ম ও তদারকি করা,
  • কারো সাথে খোশগল্প করা,
  • কোন বস্তু লাভের আশা,
  • লোকজনের সাথে সংশ্লিষ্টতা,
  • কর্মব্যাস্ততা,
  • দূর যাত্রা করা,
  • বংশ বা কূল প্রীতি,
  • রোগব্যধি,
  • বই পড়া,
  • লৌকিক ঋদ্ধি বা মন্ত্র তন্ত্র কবচাদি।[৭]

ধ্যানের বিষয়বস্তু নির্বাচন

শমথ ধ্যানের ক্ষেত্রে, সাধক বা ধ্যানীকে আচার্য বা শিক্ষকের নির্দেশ মত একটি ধ্যান নির্বাচন করে দিয়ে থাকেন। আচার্য, ধ্যানীর চারিত্রিক বিশিষ্ট অনুযায়ী বষয়বস্তু নির্ধারন করে দিয়ে থাকেন।[৭] যেমন-

  • রাগ চরিত্র- রাগী ব্যক্তির জন্য দশ প্রকার অশুভ (মানুষের মৃত্যুর পর দৈহিক বিকৃতির বিভিন্ন অবস্থান) ও কায়াগত[note ৭] স্মৃতি ধ্যান।[৫]
  • দ্বেষ/হিংসা চরিত্র- এই চরিত্রের ব্যক্তিদের জন্য চার প্রকারের ব্রহ্ম বিহার[note ৮] ধ্যান এবং, লাল, সাদা, নীল ও হলুদ বর্ণের কসিন ধ্যান।[৫]
  • মোহ চরিত্র- এই ধরণের ব্যক্তিদের আনাপানা (শ্বাস-প্রশ্বাস) ধ্যান।[৫]
  • শ্রদ্ধা চরিত্র- এদের জন্য ৬ প্রকার অনুস্মৃতি[note ৯] ধ্যান বা ভাবনা। [৫]
  • বুদ্ধি চরিত্র- এই ধরণের লোকদের জন্য মরণানুস্মৃতি (মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ধ্যান), উপশমানুস্মৃতি (নির্বাণই শান্তি), সংজ্ঞা (যে বিষয় যেমন, তাকে তেমনই দেখা) ও ব্যবস্থান ধ্যান।[৫]
  • বিতর্ক চরিত্র- এ চরিত্রধারীদের জন্য আনাপানা স্মৃতি ধ্যান।[৫]

৫ ধরনের ব্যপারে সতর্কতা (পঞ্চনীবরণ)

পঞ্চনিবারণ বা ৫ ধরনের বিষয় ধ্যানে বাঁধা বা প্রতিবন্ধক রূপে কাজ করে। সেগুলো হলে

১) কামছন্দ: পঞ্চকামগুন বা রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ-এর প্রতি যে আসক্তি তাই কামছন্দ। এটি ধ্যানের একাগ্রতাকে বাঁধা দেয়। ধ্যানে একাগ্রতা আনয়নের মাধ্যমে এর প্রতিহত করা যায়।[৫]

২) ব্যাপদ: ক্রোধ, ইর্ষা, হিংসা ও ঘৃণার বশবর্তী হয়ে অন্যের ক্ষতি করা বা করার ইচ্ছাই ব্যাপদ। সৎ কর্মতে অনীহা ব্যাপদের লক্ষণ।[৫]

৩) স্থিনমিদ্ধ: চিত্তের অলসতা, সংকোচতা, অস্পষ্টতা, অকর্মণ্যতা, অনুৎসাহ, অবসাদ ইত্যাদিকে স্থিনমিদ্ধ বলে। কুশল চিত্ত গ্রহণ করতে এটি অক্ষম ও অপারগ। মনে জোরকে দুর্বল বা নষ্ট করেই এর কাজ।[৫]

৪) ঔদ্ধত্য কৌকৃত্য: অস্থির চিত্তকেই ঔদ্ধত্য বলা হয়। ধ্যনের একাগ্রতা তথা অবলম্বন থেকে এটি বিচ্যুতি ঘটায়। এটা মনে অশান্তি আনে। আর, কৌকৃত্য হল মনের অনুশোচনা, আক্ষেপ, অনুতাপ ও উৎকণ্ঠাকে বোঝাঁ হয়। এর প্রতিপক্ষ হলে সুখ।[৫]

৫) বিচিকিচ্ছা: এর অপর নাম সন্দেহ। ধ্যানীর মনে যখন সন্দেহের জন্ম হয় তখন তাকে বিচিকিচ্ছার সৃষ্টি হয়, এবং এর ফলে ধ্যান বা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ণইতে পারে না। এর পরিণাম অনিশ্চয়তা। বিচার এর প্রতিপক্ষ।[৫]

ধ্যানের নিমিত্ত

মনকে শান্ত করার জন্য শমথ ধ্যানে ৪০ ধ্যেয় বা কর্মস্থান[note ১০] (যাকে অবলম্বন করে ধ্যান করা হয়) নির্বাচন করা হয়েছে। নিজের চরিত্র অনুযায়ী সাধক নিজে বা তার শিক্ষক এর বাছাই করেন।[৭] নিমিত্ত মূলত দেখা যায় এমন কোন বস্তু, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ আছে এমন রস, স্পর্শ করা যায় এমন ও মনে ভাবনা করা যায় এমন হয়ে থাকে। অর্থাৎ ৬ টি ইন্দ্রিয়ের যেকোনোটি দিয়ে অনুভব করা যায়।[৫] এই নিমিত্ত আবার ৩ রকমের হতে পারে।[৫]

পরিকর্ম নিমিত্ত

ধ্যানী যখন উল্লিখিত ৪০ টি ধ্যেয়[note ১০] থেকে যে বিষয়টি তার ধ্যানের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সেটি বা সেই অবলম্বনটিই পরিকর্ম নিমিত্ত, যা ধ্যানের প্রাথমিক অবলম্বন।[৫]

উদগ্রহ নিমিত্ত

ধ্যানী যখন ধ্যানের সেই পর্যায়ে পৌঁছে যান, যখন চোখ বন্ধ করলেও তিনি চোখ খোলা অবস্থায় পরিকর্ম নিমিত্ত যেমন দেখেন, ঠিক তেমনি দেখতে পান, তখন এই দর্শন শক্তিকে (মন দিয়ে যা দেখেন) উদগ্রহ নিমিত্ত বলা হয়ে থাকে। [৫]

প্রতিভাগ নিমিত্ত

উদগ্রহ নিমিত্ত চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখতে সম্ভব হলেও তার মাঝে উজ্জ্বল-স্বচ্ছ ভাব থাকেনা।[৫] কিন্তু ধ্যানী, ধ্যানের গভীর স্তরে প্রবেশের মাধ্যমে, অবিচ্ছিন্নভাবে তাকে বিরামহীন ভাবে ধরে রাখতে পারলে, সেই নিমিত্তটি আরও স্পষ্ট হতে থাকে এবং একাগ্রতার সাথে ধ্যানের মাধ্যমে তা উজ্জ্বল হতে থাকে এবং আলোর মত জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে, তখন তাকে প্রতিভাগ নিমিত্ত বলা হয়।[৫] উল্লেখ্য, প্রতিভা নিমিত্ত শুধুমাত্র ১০ প্রকার কসিন, ১০ প্রকার অশুভ, কায়াগতানুস্মৃতি ও আনাপানা স্মৃতি ধ্যানেই লাভ হয়ে থাকে, বাকী ১৮ প্রকারে তা আসে না।[৫]

ধ্যানের জ্ঞান পর্যায়

ধ্যান তপস্যার মাধ্যমে শমথ ধ্যানী লৌকিক জ্ঞানের ৩টি সমাধি লাভে সক্ষম হয়, যেগুলো হলে পরিকর্ম সমাধি, উপাচার সমাধি ও অপর্ণা সমাধি। [৫]

পরিকর্ম সমাধি

ধ্যানী যে নিমিত্ত নিয়ে ধ্যান শুরু করে, তা যতক্ষণ না পর্যন্ত মনে গেঁথে যাচ্ছে, ততক্ষণ মনেমনে, অর্থাৎ ঠোঁট বা জিহ্বা না নেড়ে মনস্থ করার চেষ্টা চালিয়া যাবেন।[৫] এই প্রচেষ্টার ধাপটিই পরিকর্ম সমাধি।[৫]

উপাচার সমাধি

এই ধাপে ধ্যানী চোখের সামনে না থাকলেও সে নিমিত্ত দেখতে পান।[৫] উদগ্রহ নিমিত্তে তার আকার ও রঙ থাকে যা এখানে লোপ পায় এবং বজায় থাকে উপলব্ধিজাত একপ্রকার ধ্যান প্রতিকৃতি।[৫] নিয়মিত প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোনিবেশ অব্যাহত রাখলে উপাচার্য সমাধি লাভ হয়। এর লাভ হলে, পঞ্ছনীবরণ প্রতিবন্ধকতা লোপ পায়।[৫]

অপর্ণা সমাধি

এই স্তরে ধ্যানীর মনে সেই নিমিত্তটি প্রবলভাবে দৃঢ় হয় এবং স্থায়ীভাবে স্থিরতা লাভ করে।[৫] তখন ধ্যানীর কাছে লৌকিক নয় এমন কাজ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।[৫] সাধনার এই ধ্যান স্তরের নামই অপর্ণা সমাধি। এটিই মূলত ধ্যানের দৃঢ়তার শেষ ধাপ।[৫]

ধ্যান উৎপত্তি কৌশল

পঞ্চনীবরণ বাধাগুলো পেরিয়ে, ধ্যানের মাধ্যমে মন বা চিত্তকে উপাচার সমাধিতে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন কাজ বলে, ধ্যানী যখন উপাচার সমাধিতে পৌঁছে যান, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধ্যানের নিমিত্ত বৃদ্ধি করে তাকে অপর্ণা সমাধিতে প্রতিষ্ঠিত করার আধ পর্যন্ত ধ্যান করে যাওয়া উচিত।[৭]

সাতটি বিষয়ে ধ্যানানুকুলতা

যেক্ষেত্র উপাচার সমাধি উৎপন্ন হওয়ার পরও তাকে ধরে রাখা যায় না, তখন ৭ (সাত) টি বিষয় রয়েছে, যার অনুকূল লাভ করে উপাচার থেকে অপর্ণা ধ্যানে উন্নীত হওয়া যায়।[৭]সেগুলো হলঃ আবাস অনুকূলতা,[note ১১] গোচর অনুকূলতা,[note ১২] ভাষ্য অনুকূলতা[note ১৩] পূদগল অনুকূলতা,[note ১৪] ঋতু অনুকূলতা,[note ১৫] ইর্যাপথ অনুকূলতা,[note ১৬] এবং ভোজন অনুকূলতা।[note ১৭][৭]

দশবিধ অপর্ণা কৌশল

সপ্ত অনুকূলতা লাভ করার পরেও ধ্যানী যদি অপর্ণা সমাধি লাভে সক্ষম না হলে তখন দশবিধ অপর্ণা কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা হলঃ বস্তু বিশোধন,[note ১৮] ইন্দ্রিয় সমতা বিধান,[note ১৯] নিমিত্ত কুশলতা,[note ২০] চিত্ত প্রগ্রহ,[note ২১] সাত প্রকার ধর্ম বিচয়,[note ২২] এগার প্রকারে বীর্য উৎপন্ন করা,[note ২৩] এগার প্রকারে প্রীতি উৎপন্ন,[note ২৪] সময়ে চিত্তকে নিগ্রহ,[note ২৫] সাত প্রকার প্রশ্রদ্ধি উৎপন্ন,[note ২৬] এগার প্রকার সমাধি উৎপন্ন,[note ২৭], পাঁচ প্রকার উপেক্ষা উৎপন্ন,[note ২৮] সময়ে চিত্তকে সম্প্রহর্ষিত,[note ২৯] সময়ে চিত্তকে অধ্যুপেক্ষা করা,[note ৩০] অসমাধিস্থ ব্যক্তি বর্জন[note ৩১] সমাধিস্থ ব্যক্তির সেবা করা,[note ৩২] এবং তদধিমুক্ততা[note ৩৩][৫]

ধ্যানাঙ্গ সমূহ

ধ্যান অনুশীলনে ৬টি বিষয়: বিতর্ক, বিচার, প্রীত, সুখ, উপেক্ষা ও একাগ্রতা ধ্যানের অঙ্গ বলে পরিচিত।[৫]

  • বিতর্ক: বিতর্ক বলতে আভিধানিক অর্থে যা বুঝানো হয় এখানে তার অর্থ এক নয়। বৌদ্ধ ধ্যানে বিতর্ক বলতে কোন কিছুর বার বার চিন্তা বা জপ করাকে বুঝানেও হয়েছে। ধ্যান বা ভাবনা করার প্রথম দিকে বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঙ্গটি ধ্যানে মনোযোগ বসাতে সাহায্য করে। মনকে এটা কিছুক্ষণের জন্য আলস্য থেকে দূরে রাখে।[৫]
  • বিচার: আভিধানিক অর্থে বিচারের যে ধারনা রয়েছে তা ধ্যানে বিচার অর্থ থেকে আলাদা। এখানে বিচার বলতে বুঝায়, ধ্যান অবলম্বন বা যে বিষয়কে কেন্দ্র করে ধ্যান করা হচ্ছে, তাকে পরীক্ষা করে বারবার সেখানে মনোসংযোগ ঘটানো। মনকে এটা কিছুক্ষণের জন্য বিচিকিচ্ছা বা সংশয় থেকে দূরে রাখে। [৫]
  • প্রীতি: ধ্যানে প্রীতি বলতে বুঝায় মনের সুখ ও সৌহার্দ্য। মনকে এটা কিছুক্ষণের জন্য ব্যাপদ বা হিংসা থেকে দূরে রাখে। প্রীতি পাঁচ প্রকার হয়ে থাকে: ১) ক্ষুদ্রিকা প্রীতি, যেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য থাকে, ২) ক্ষণিকা প্রীতি, যেটা বিদ্যুতের মত প্রবাহিত হয়, ৩) অবক্রান্তিকা প্রীতি, যেটা অনেক্ষণ স্থায়ী হয়, ৪) উদ্বেগা প্রীতি যা উদ্বেগ উৎপন্ন করে, ও ৫) স্ফুরণা প্রীতি যা দেহকে বেলুনের মত স্ফীত, দীপ্ত ও কম্পিত করে। তৃতীয় ধ্যানে প্রীতির এই ৫টির মধ্যে যেকোন একটি উদয় হয়।[৫]
  • সুখ: এটি এক ধরণের সুখদায়ক অনুভূতি। ধ্যানের এই অঙ্গ ঔদ্ধত্য বা অস্থিরতা, এবং কৌকৃক্য বা অনুতাপ থেকে মনকে দূরে রক্ষে।[৫]
  • একাগ্রতা: মন যখন ধ্যেয় বিষয়ের উপরে নিশ্চল অবস্থায় অবস্থান করে, তাকেই একাগ্রতা বলা হয়। ধ্যানের সকল স্তরেই একাগ্রতা আবশ্যক। এটা মনের কামচ্ছন্দ বা কামতৃষ্ণাকে সাময়িকভাবে নিবারণ করতে সক্ষম।[৫]
  • উপেক্ষা: যে বিষয়ের উপর ধ্যান করা হচ্ছে, তার উপর নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞানকে বোঝানো হয়। [৫]

ধ্যানের স্তর

ধ্যান বা ভাবনা করার সময় ধ্যানী বিভিন্ন স্তরে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন যাকে ধ্যানের শ্রেণীও বলা হয়ে থাকে। এই স্তর বা শ্রেণী সমূহকে ১০ ভাগে বিভক্ত, যা প্রথম থেকে দশম ধ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত।[৫]

  • প্রথম ধ্যানঃ জাগতিক ভোগ বিলাস থেকে সরে এসে সাধক যখন কোন বিষয় বা নিমিত্ত বা ধ্যেয়কে অবলম্বন করে ধ্যান বা ভাবনা করে, তখন তার প্রথম ধাপে বা স্তরে পঞ্চনিবারণ (কামচ্ছন্দ/ভোগ, ব্যাপদ/ক্রোধ, স্ত্যানমিদ্ধ/আলস্য, ঔদ্বত্য/অস্থিরতা, বিচিকিচ্ছা/সন্দেহ) লোপ পায়। যার কারণে ধ্যানীর বিতর্ক, বিচার, প্রীতি, সুখ ও একাগ্রতা লাভ হয়। এটিই ধ্যানের প্রথম স্তর, যা পঞ্চাঙ্গ সংযুক্ত রূপাবচর ধ্যান।[৫]
  • দ্বিতীয় স্তরঃ ধ্যানী, ধ্যানের প্রথম স্তরের সুখে আবিষ্ট না হয়ে যখন আরও উচ্চতর ধ্যানের জন্য সাধনা করতে থাকে, তখন পঞ্চাঙ্গ সংযুক্ত রূপাবচর ধ্যান থেকে প্রথম অঙ্গ, বিতর্ক অংশটি প্রয়োজনহীন অনুভব করেন এবং সেটা ছাড়াই ধ্যান চর্চা চালিয়ে যান। এই স্তরে তার মন আরও হালকা, তৎপর ও তীক্ষ হয়ে উঠে।[৫]
  • তৃতীয় স্তরঃ ধ্যানী যখন আরও উচ্চতর ধ্যানের জন্য সাধনা করতে থাকে, তখন পঞ্চাঙ্গ সংযুক্ত রূপাবচর ধ্যান থেকে বিচার অংশটিও প্রয়োজনহীন অনুভব করেন এবং সেটা ছড়াই ধ্যান চর্চা চালিয়ে যান। এই স্তরে তার মন আরও হালকা, তৎপর ও তীক্ষ হয়ে উঠে এবং ঋদ্ধি ক্ষমতা অর্জন করেন।[৫]
  • চতুর্থ স্তরঃ ধ্যানী যখন আরও উচ্চতর ধ্যানের জন্য সাধনা করতে থাকে, তখন পঞ্চাঙ্গ সংযুক্ত রূপাবচর ধ্যান থেকে প্রীতি অংশটিও প্রয়োজনহীন অনুভব করেন এবং সেটা ছড়াই ধ্যান চর্চা চালিয়ে যান। এই স্তরে তার মন সুখ ও একাগ্রতা অনুভব করে।[৫]
  • পঞ্চম স্তরঃ ধ্যানী যখন আরও উচ্চতর ধ্যানের জন্য সাধনা করতে থাকে, তখন পঞ্চাঙ্গ সংযুক্ত রূপাবচর ধ্যান থেকে সুখ অংশটিও প্রয়োজনহীন অনুভব করেন এবং সেটা ছড়াই ধ্যান চর্চা চালিয়ে যান। এই স্তরে তার ধ্যানে চরম একাগ্রতা আসে। ধ্যানীর মনে রূপ জাতীয় কোন কিছুই আর উদয় হয়না, যার জন্য একে অরূপধ্যানও বলা হয়। অনেকে একে নির্বাণ ভেবে ভুল করে। এই স্তরও লৌকিক ধ্যান বলে গণ্য হয়।[৫]
  • ষষ্ঠ স্তরঃ এই স্তরে অসীম আকাশকে অবলম্বন করে ধ্যান করা হয়ে থাকে। তাই একে ষষ্ঠ সমাপত্তি ধ্যান ছাড়াও আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যানও বলা হয়ে থাকে।[৫]
  • সপ্তম স্তরঃ ধ্যানের সপ্তম স্তরে এসে ধ্যানী অনন্ত বিজ্ঞান আয়তনকে অবলম্বন করে ধ্যান বা ভাবনা করতে থাকেন যাকে বিজ্ঞান আয়তন ধ্যানও বলা হয়ে থাকে।[৫]
  • অষ্টম স্তরঃ আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যান ও বিজ্ঞান অনন্ত আয়তন ধ্যান করে ধ্যানী শূণ্যতা ও একাকীত্বতা উপলব্ধি করেন। একে আকিঞ্চন আয়তন ধ্যানও বলা হয়ে থাকে। [৫]
  • নবম স্তরঃ এই স্তরে, ধ্যানের মধ্যে একেবারে সুক্ষাতিসূক্ষ্ম সংজ্ঞাগুলোই বিদ্যমান থাকে। ধ্যানের এই স্তর হল লোকায়ত স্তরের সর্বশেষ স্তর।[৫]
  • দশম স্তরঃ এই স্তরের ধ্যান হল লোকত্তোর ধ্যান। এখানে চিত্তের সংজ্ঞা ছাড়া বাকি সব কিছুই (বেদনা, সঙ্গাকার ও বিজ্ঞান) প্রশমিত হয়। গৌতম বুদ্ধ এর আবিষ্কারক। এই স্তরে ধ্যানী নির্বাণ লাভ করে বলে একে নৈর্বাণিক ধ্যানও বলা হয়ে থাকে।[৫]

ধ্যানের প্রকারভেদ

বৌদ্ধ ধ্যান ২ ধরনের হয়ে থাকে, ১) বিদর্শন, ২) শমথ।

বিদর্শন ধ্যান

বৌদ্ধ ধর্মের মূল লক্ষ্য, নির্বাণ লাভের জন্য বিপশ্যনা বা বিপাসনা সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই পদ্ধতির ধ্যান অনেক পুরানো। কোন কিছুকে বিশেষভাবে দেখাকেই সংস্কৃতিতে বিপশ্যনা বলা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে বস্তু যেমন আছে, তাকে সেভাবে দেখার মধ্য দিয়ে আত্মসংশোধন করা যায়। মহাস্মৃতিপ্রস্থান সূত্রে বিদর্শন ধ্যানের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে স্মৃতিপ্রস্থানকে চারটি মূল অংশে বিভক্ত করা হয়েছে।

কায়ানুদর্শন

শরীরের অবস্থা ও তার প্রতিটি ক্রিয়াকে বিশেষভাবে দর্শনই কায়ানুদর্শন। কায়ানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:

  • শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান (আনাপানা স্মৃতি);
  • সকল প্রকারের দেহের অবস্থায় (দাঁড়ানো, হাঁটা, বসা ও উদম) মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • দৈহিক ক্রিয়াকর্মে (খাওয়া, বস্ত্র পরিধান, শৌচ কাজ করা ইত্যাদি) মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • দেহ যেসকল ধাতু (কঠিন পদার্থ, তরল পদার্থ, বায়বীয় পদার্থ, শক্তি বা ক্যালরি) নিয়ে গঠিত, সেগুলোর উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • শবাগার, তথা মৃত্যুর পর মানুষের দৈহিক পরিবর্তনের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • মানসিক পরিস্থিতির উপর (সুখ, দুঃখ ইত্যাদি) মনোনিবেশ করে ধ্যান।

বেদনানুদর্শন

বৌদ্ধ ধর্মে যেকোন প্রকারের অনুভূতিকেই বেদনা বলা হয়ে থাকে। বেদনানুদর্শন হল সুখ, দুঃখ, উপেক্ষা এই ধরণের সকল অনুভূতিকে বিশেষভাবে দর্শন। বেদনানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:

  • আনন্দদায়ক, নিরানন্দদায়ক, বা দুটির কোনটিই নয়, এমন অনুভূতির উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • মনের অনুভূতির ( লোভ, লোভহীন, হিংসা, অহিংসা, মোহাচ্ছন্ন, মোহ মুক্ত, একাগ্র চিত্ত, বিক্ষিপ্ত চিত্ত, মহৎ, অমহত্‌, উত্তর, অনুত্তর, সমাহিত, অ-সমাহিত, বদ্ধ, মুক্ত) উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান।

চিত্তানুদর্শন

মনের বিভিন্ন বৃত্তি যেমন লোভ, হিংসা সহ অন্যান্য যে সকল প্রবৃত্তির উদয় হয়, সেগুলোকে বিশেষভাবে দর্শনই চিত্তানুদর্শন। চিত্তানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:

  • কামাচ্ছন্ন বা কাম মুক্ত, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • ক্রোধাচ্ছন্ন বা ক্রোধ মুক্ত, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • স্তান-মিদ্ধে (অলস, অতিঘুম, অতিভোজন) আচ্ছন্ন বা মুক্ত, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • অহংকারী বা নিরহংকারী, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • বিচিকিৎসা(মানসিক দোটানা)-তে আচ্ছন্ন বা মুক্ত, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;

ধর্মানুদর্শন

ষড়ায়তন (দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধর্ম) এর মাধ্যমে শরীর ও মনের অবস্থার পরিবর্তনকে বিশেষভাবে দর্শনই ধর্মানুদর্শন। ধর্মানুদর্শনে যে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়:

  • পঞ্চ-উপাদান-স্কন্ধ (কোন কিছু দেখা, তার জন্য সৃষ্ট মানসিক অনুভূতি, মানসিক অনুভূতির উপলব্ধি, সেই উপলব্ধির কারণে সৃষ্ট মানসিক প্রতিক্রিয়া, সেই মানসিক প্রতিক্রিয়ার নিবারনের ইচ্ছা), তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • ছয় অভ্যন্তর ও ছয় বাহিরায়তন (দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধর্ম), তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • সপ্তবোধাঙ্গ ( স্মৃতি, ধর্মবিচয়, বীর্য, প্রীতি, প্রশদ্ধি, সমাধি, উপেক্ষা), তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান;
  • চতুরার্য সত্য, তার উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান।

শমথ ধ্যান হল মনোযোগ বা সমাধির গঠন করা যা প্রশান্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো মনকে শান্ত করা এবং একাগ্রতা স্থাপন করা। মতান্তরে এর মাধ্যমে অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতার অর্জন করা যায়। শমথ ধ্যানে চল্লিশ প্রকারের অনুশীলন রয়েছে।[৮]

শমথ ধ্যান

শমথ ধ্যান হল মনোযোগ বা সমাধির গঠন করা যা প্রশান্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়।[৮] এর মূল লক্ষ্য হলো মনকে শান্ত করা এবং একাগ্রতা স্থাপন করা।[৮] মতান্তরে এর মাধ্যমে অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতার অর্জন করা যায়। শমথ ধ্যানে চল্লিশ প্রকারের অনুশীলন রয়েছে।[৮]

দশ কসিন (কৃৎস্ন) ধ্যান

দশ প্রকারের বিষয় আছে যাকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা হয়, যাদের একত্রে দশ কসিন বলা হয়ে থাকে।[৮]

১) পৃথিবী কসিন ধ্যান: পৃথিবী তথা মাটিকে বিষয় করে যখন ভাবনা করা হয় তখন তাকে পৃথিবী কসিন ধ্যান বলা হয়ে থাকে।পৃথিবী কসিন ধ্যান আবার ২ প্রকারের হয়ে থাকে, প্রস্তুতকৃত ও প্রকৃতিগত। চারপ্রকার দোষ (লাল, নীল, সাদা ও হলুদ রঙ) বিবর্জিত, গেরুয়া রঙের মাটি নিয়ে কসিন প্রস্তুত করা হয়। মাটি থেকে ঘাস-গুল্ম, পাথর ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানিতে মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে দেড় বিঘত বনাম দেড় বিঘত ন্যাকড়া নিয়ে তাতে চার আঙ্গুল পুরু মাটির বৃত্ত প্রস্তুত করে নিতে হয়। এটা শুকিয়ে গেলে, ঐ ন্যাকড়াটি যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রস্তুত শেষে, সেই নিমিত্ত এক জায়গায় রেখে, তার থেকে আড়াই হাত দূরে এবং ষোল আঙ্গুল উঁচু স্থানে বসে, মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম ধ্যান পর্যন্ত উপনীত হওয়া যায়।[৮]

২) আপ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের নিমিত্ত হলও পুকুর, জলাশয়, হ্রদ, সমুদ্র বা পাত্রে পূর্ণ পানি। পানিতে কোন রঙ থাকা যাবে না, অর্থাৎ তাকে বর্ণহীন হতে হবে। এরপর তাকে নিমিত্ত করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান করা যায়।[৮]

৩) তেজ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয় হল আগুনের শিখা। আগুন জ্বালানোর পর তার সামনে মাদুর, মোটা কাপড, চাটাই ধরণের যেকোন কিছু চার আঙ্গুল সমান গোল করে ছিদ্র করে, তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান করা যায়। [৮]

৪) বায়ু কসিন ধ্যান: এই ধ্যানে বাতাসকে অনুভব করে ধ্যান করতে হয়। বাতাসে দুলছে এমন কিছুতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে যাওয়া যায়।[৮]

৫) নীল কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু নীল রঙের ফুল বা কাপড়। নীল ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা নীল রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

৬) পীত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু হলুদ রঙের ফুল বা কাপড়। হলুদ ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা হলুদ রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

৭) লোহিত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু লাল রঙের ফুল বা কাপড়। লাল ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা লাল রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

৮) অবদাত কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু সাদা রঙের ফুল বা কাপড়। সাদা ফুলের বাঁট দেখা না যায়, এভাবে রেখে বা সাদা রঙের মণ্ডল প্রস্তুত করে তাতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করা যায়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

৯) আলোক কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয়বস্তু হল জানালা বা দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে আসা আলোক রশ্মি। এতে মনোনিবেশ করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

১০) আকাশ কসিন ধ্যান: এই ধ্যানের বিষয় হল দৃশ্যমান আকাশ। জানালা বা দেয়ালের ছিদ্র নিয়ে দেখা যায় এমন পরিমাণ দৃশ্যকে কেন্দ্র করে ধ্যান করতে হয়। এভাবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান চালিয়ে নেওয়া যায়।[৮]

দশ অশুভ ধ্যান

মৃত্যুর পর মানব দেহে পরিবর্তন ঘটে এবং এই পরিবর্তনকে নিমিত্ত করে ধ্যানকেই দশ অশুভ ধ্যান বলা হয়। প্রথমত বর্ণ, অর্থাৎ মৃতদেহটি কোন বর্ণের, কালো, সাদা, হলুদাভ ইত্যাদি সম্পর্কে ভাবনা। দ্বিতীয়টি হল মৃতদেহটি কোন লিঙ্গের এবং বয়সের সে বিষয়কে নিমিত্ত করে ভাবনা। তৃতীয়টি হলও সংস্থান, অর্থাৎ এটা মৃতদেহের মস্তক, গ্রীবা, হাত, পা, উদর ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। চতুর্থটি হল দিশা, অর্থাৎ দেহের ডান-বাম, উপর-নীচ ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। পঞ্চমটি হল অবকাশ, অর্থাৎ এখানে হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। ষষ্ঠ হল পরিচ্ছেদ, অর্থাৎ মাথা চুল দিয়ে আচ্ছন্ন, দেহ ত্বক দিয়ে আচ্ছন্ন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। সপ্তম হল সন্ধি, অর্থাৎ দেহে আট হাজার সন্ধি (জয়েন্ট) আছে, যেমন আঙ্গুলের সন্ধি, হাতের সন্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। অষ্টম হল দেহস্থ বিবর বা ছিদ্র, যেমন কান, নাক ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। নবম হল নিম্ন, অর্থাৎ দেহে মুখ গহ্বর, গলনালী ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। দশম হল স্থল, অর্থাৎ দেহের যে জায়গাগুলো উঁচু হয়ে থাকে যেমন কপাল, নাক ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে ভাবনা। পরিশেষে সমস্ত, অর্থাৎ সমস্ত মৃতদেহকে এক ভেবে ভাবনা করা।[৮]

দশ অনুস্মৃতি ধ্যান

অনুস্মৃতি বলতে এক মনে কোন কিছু বার বার স্মরণ করা। বৌদ্ধ ধর্মে ১০ প্রকার অনুস্মৃতির বিবরণ পাওয়া যায়:

১) বুদ্ধানুস্মৃতি: গৌতম বুদ্ধের নয় গুণকে স্মরণ করে ধ্যান করাই বুদ্ধানুস্মৃতি ধ্যান, যে গুণ গুলো হলঃ অরহত, সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ, অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ সারথি, দেব-মানুষের শিক্ষক/শাস্তা, জ্ঞানী, এবং ভগবান।[৮]

২) ধর্মানুস্মৃতি: ধর্মের ছয় গুণকে স্মরণ করে ধ্যান করাই ধর্ম্নুস্মৃতি ধ্যান, যে গুণ গুলো হলঃ ধর্ম সুব্যাখ্যাত, স্বয়ং দৃষ্ট, কালাকাল হীন, "এসো ও দেখো" বলার যোগ্য, নির্বাণগামী ও বিজ্ঞব্যক্তি দ্বারা প্রত্যবেক্ষণযোগ্য।[৮]

৩) সঙ্ঘানুস্মৃতি: সঙ্ঘকে স্মরণ করে ধ্যান করাই সঙ্ঘানুস্মৃতি ধ্যান। সঙ্ঘের ৯ গুণ হলঃ সুপ্রতিপন্ন, ঋজুপ্রতিপন্ন, ন্যায়প্রতিপন্ন, আহবানযোগ্য, সতকারযোগ্য, দক্ষিণারযোগ্য, অঞ্জলিযোগ্য, অনুত্তর পূর্ণ ক্ষেত্র।[৮]

৪) শীলানুস্মৃতি: শীলের সদাচার অনুসরণ করে ধ্যানই হল শীলানুস্মৃতি। বৌদ্ধ ধর্মে পঞ্চশীল, অষ্টশীল সহ যেকোন শীলকে কেন্দ্র করেই এই ধ্যান করা যায়।[৮]

৫) ত্যাগানুস্মৃতি: ত্যাগ বা দানকে অনুসরণ করে ধ্যান বা ভাবনাকেই ত্যাগানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]

৬) দেবতানুস্মৃতি: দেবতাদের গুণানুস্মরণে করা ধ্যান বা ভাবনাকেই দেবতানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]

৭) উপশমানুস্মৃতি: নির্বাণের সুখ বা সকল দুঃখের উপশমকে চিন্তা করে যে ধ্যান করা হয় বা ভাবনা করা হয়, তাকেই উপশমানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]

৮) মরণানুস্মৃতি: মরণ বা মৃত্যুকে উপশমকে চিন্তা করে যে ধ্যান করা হয় বা ভাবনা করা হয়, তাকেই মরণানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]

৯) কায়াগতানুস্মৃতি: দেহের বত্রিশ প্রকারের অশুচি ( কেশ, লোম, নখ, দাঁত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু, অস্থি, মজ্জা, মস্তিষ্ক, হৃদয়, ক্লোম, ফুসফুস, প্লিহা, যকৃৎ, অন্ত্র, বৃহদান্ত্র, বৃক্ক, বিষ্ঠা, অশ্রু,সিকনি, থুথু, শ্লেমা, পিত্ত, মূত্র, পুঁজ, স্বেদ, মেদ, লাসিক ইত্যাদি) কেন্দ্র করে যে ধ্যান করা হয় তাকেই কায়াগতানুস্মৃতি বলা হয়।[৮]

১০) আনাপানা স্মৃতি: শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে যে ধ্যান করা হয়, তাকেই আনাপানা স্মৃতি বলা হয়।[৮]

চার অপ্রমেয় ধ্যান বা ব্রহ্মবিহার ধ্যান

চার অপ্রমেয় ধ্যান বা ব্রহ্মবিহার ধ্যান হলঃ

১) মৈত্রী ভাবনাঃ প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুত্ব ইত্যাদিকে নিমিত্ত করে ভাবনা বা ধ্যান। এর প্রতিপক্ষ হল দ্বেষ, হিংসা ও ক্রোধ। [৫]

২) করুণা ভাবনাঃ অপরের ভাল এবং সুখ কামনাকে নিমিত্ত করে ভাবনা বা ধ্যান। এর প্রতিপক্ষ হল হিংসা।[৫]

৩) মুদিতা ভাবনাঃ অন্যের সুখ, সমৃদ্ধি, সম্পদ, সৌভাগ্য, লাভ-যশ, ঐশ্বর্য ইত্যাদি দেখে আনন্দিত হওয়াকে নিমিত্ত করে যে ভাবনা বা ধ্যান। [৫]

৪) উপেক্ষা ভাবনাঃ মনের মধ্যে নিরপেক্ষ, সাম্য ও মধ্যস্থতাকে ভিত্তি করে যে ভাবনা বা ধ্যান, তাকেই উপেক্ষা ভাবনা বলা হয়। [৫]

এক সংজ্ঞা ধ্যান বা আহার প্রতিকূল সংজ্ঞা ধ্যান

খাদ্য বা পানীয় বস্তু গ্রহণ করার পর, পরিশেষ তার পরিণতি মল, মূত্র, ঘাম বা অন্য দৈহিক বর্জ্য যা ঘৃণ্য, বস্তুতে পরিণত হয়।[৫] এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাবনা করা বা ধ্যান করাকেই এক সংজ্ঞা ধ্যান বা আহার প্রতিকূল সংজ্ঞা ধ্যান বলা হয়।[৫]

এক ব্যবস্থান ধ্যান বা চতুর্ধাতু ব্যাবস্থান ধ্যান

মানুষের শরীরে কঠিন, তরল, উষ্ণ, বায়বীয়- এই চার ধাতু নিয়ে বিশেষণ করে যে ধ্যান বা ভাবনা করে হয়ে থাকে তাকে এক ব্যবস্থান ধ্যান বা চতুর্ধাতু ব্যাবস্থান ধ্যান বলা হয়।[৫]

চার অরূপ ধ্যান

সাধক রূপাবচর (পঞ্চম স্তর পর্যন্ত ধ্যান) ধ্যানে যথাযথ আয়ত্ত করতে পারলে উপলব্ধি করতে পারে যে সমস্ত দুঃখের কারণ হল এই ভৌতিক দেহ। তখন তার রূপের প্রতি বিরাগ উৎপন্ন হয় এবং অরূপ ধ্যানে মনোনিবেশ করে থাকে। এই চার অরূপ ধ্যান হলঃ

১) আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যানঃ ধ্যানী অসীম আকাশকে অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকে।[৫]

২) বিজ্ঞান আয়তন ধ্যানঃ ধ্যানী অনন্ত বিজ্ঞান আয়তনকে অবলম্বন করে ধ্যান বা ভাবনা করতে থাকে।[৫]

৩) আকিঞ্চন আয়তন ধ্যানঃ আকাশ অনন্ত আয়তন ধ্যান ও বিজ্ঞান অনন্ত আয়তন ধ্যান করে ধ্যানী শূণ্যতা ও একাকীত্বতা উপলব্ধি করেন। আকিঞ্চন আয়তন ধ্যানে ধ্যানী শূন্যতা অনুভব করে থাকে।[৫]

৪) নৈব সংজ্ঞা বা না সংজ্ঞা আয়তন ধ্যানঃ এই ধ্যানের মধ্যে একেবারে সুক্ষাতিসূক্ষ্ম সংজ্ঞাগুলোই বিদ্যমান থাকে। ধ্যানের এই স্তর হল লোকায়ত স্তরের সর্বশেষ স্তর।ধ্যানী মনে মনে "শান্ত-শান্ত" বলে আবৃতি করতে থাকেন।[৫]

থেরবাদ

সূত্রপিটক ও টীকা

ধ্যান সম্পর্কে পালি নিকায় সমূহে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। যেমন, পটিসম্ভিদামাগ্‌গ-এর আনাপানা স্মৃতি সূত্রে কিভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা যায়, তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।

বুদ্ধঘোষ

প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে বুদ্ধঘোষের বিশুদ্ধিমাগ্‌গ-কে ধ্যানের নির্দেশিকা হিসেবে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে গণ্য করা হয়। বুদ্ধঘোষ তাঁর বিশুদ্ধিমাগ্‌গ গ্রন্থে নতুন কিছু প্রবর্তন করেননি, বরং তিনি ত্রিপিটকের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন সূত্র ও টীকা বিশ্লেষণ করে এবং তৎকালীন চল অনুসারে যে সকল ধ্যান করা হত, তিনি সেগুলোর উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেন। চল্লিশ ধ্যেয় [note ১০] সম্পর্কে এই গ্রন্থে বিশদ আলোকপাত করে হয়েছে।

সমসাময়িক থেরবাদ

বৌদ্ধ ধর্মে শমথ হল, কোন কিছুকে ভিত্তি করে বা নিমিত্ত করে তাতে মনোনিবেশ করা। বর্মী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শমথ ধ্যানকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। অন্য দিকে, থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শমথ ও বিদর্শন ধ্যানকে একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বলে মনে করেন।

ব্রহ্মদেশীয় থেরবাদ

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) বিপাশনা ধ্যানের নবজাগরণ হয়। মিঙ্গুন সেয়াদো, উ নারাদা এবং মাহাসি সেয়াদো এর বিকাশ ঘটান। তাঁদের মতে, শমথ ধ্যান অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং এটি বিপাশনার সহায়ক হিসেবে অনুশীলন করা যায়। তবে শমথ ধ্যান করে নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়, এর জন্য বিদর্শন ধ্যান আবশ্যক। আরেক বর্মী ধারা আছে যা লেদি সেয়াদো, বা খিন এবং এস, এন, গোয়েঙ্কা মানুষের কাছে প্রচার করেন, যা প্রায় একই ধরণের ধ্যানের অনুশীলন। তাঁদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল, প্রথম পক্ষ আনাপানা স্মৃতি ধ্যানের মনোনিবেশ পেট ফোলা ও কমার উপর জোর দেয়, অন্য দিকে দ্বিতীয় পক্ষ নাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতিতে মনোনিবেশ করে ধ্যানে জোর দেয়।

শ্যামদেশীয় থেরবাদ

থাইল্যান্ডের, শ্যাম অরণ্য ধারাটি ভদন্ত মুন ভুরিদত্ত ধারা থেকে এসেছে, যা আঝান চ্যান মানুষের কাছে প্রচার করেন এবং তা জনপ্রিয় করে তোলেন। এই ধারা মতে, শমথ ও বিদর্শন, উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

থাইল্যান্ডে আরও একটি চল রয়েছে, যেটি হল ভদন্ত লাউং পু শোধ কান্দাসারো-র বিজ্জা ধম্মকায়া ধ্যান। এই ধারা অনুযায়ী ধর্ম ও দেহকে নিমিত্ত করে ধ্যান করা হয়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসকে কেন্দ্র করে ও সাম্য অরহম মন্ত্র জপ করে নির্বাণ সাধনা করা হয়।

সর্বস্তিবাদ

সর্বস্তিবাদ অনুযায়ী মানসিক ও জাগতিক, উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। [৯] এই মতবাদ অনুযায়ী, কোন জাগতিক বস্তুর স্বতন্ত্র ও চিত্ত নিরপেক্ষ অস্তিত্ব থাকে।[৯] এই ধারা থেকে আবার দুইটি ধারার বিকাশ ঘটে, সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক। মূলত সৌত্রান্তিকবাদী গণ সূত্র পিটকের সূত্র সমূহকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের মতবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে, অন্য দিকে বৈভাষিক গণ অভিধর্ম পিটকের টীকা ও ব্যাখ্যা সমূহের ভিত্তিতে তাঁদের মতবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে। এই ধারার ধ্যান তত্ত্ব অনুসারে পূর্ব এশিয়া ও তিব্বতে সাধনা করা হয়।। এই ধারার ধ্যানী গণ যোগাচার্য নামে পরিচিত। হিন্দু কুশ পর্বতমালার দক্ষিণাংশের ব্যাক্ট্রিয়া, কাশ্মীর ও গান্ধার অঞ্চলে এই ধারার বৌদ্ধ ভিক্ষু গণ তাঁদের মতবাদ অনুযায়ী ধ্যান সূত্র মতে যোগ আচারের বিকাশ ঘটায়।

সর্বস্তিবাদ সাধনা

কে, এল, ধাম্মাজ্যোতির মতে, সর্বস্তিবাদ ধ্যানীগণ মূলত শমথ ধ্যানে সাধনা করে থাকে। এই ধারায় চিত্ত বা মনের পঞ্চ স্থিরতার উপর কেন্দ্র করে ধ্যান করা হয়ে থাকে, যেগুলো হল[১০]:

১) রাগী চরিত্রের লোকদের জন্য অশুভ ধ্যান, [৪]

২) হিংসা চরিত্রের লোকদের জন্য চার ব্রহ্ম বিহার ধ্যান, [৫]

৩) লোভী চরিত্রের লোকদের জন্য আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান,

৪) শ্রদ্ধাশীল চরিত্রের লোকদের জন্য অনুস্মৃতি ধ্যান, [৬] এবং

৫) বিতর্ক বা সবসময় মনের মধ্যে দোটানায় ভোগে এমন চরিত্রের লোকদের জন্য আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ধ্যান।

ভারতীয় মহাযান

মহাযান অনুশীলনের মূল লক্ষ্য হল বোধিসত্ত্বের পথ অবলম্বন করে অন্তিম প্রাপ্তি, বুদ্ধত্ত্ব লাভ করা। ধ্যান বা ভাবনা হল মহাযান ধারার পারমীগুলোর একটি যা বুদ্ধত্ত্ব লাভের জন্য অপরিহার্য। ভারতীয় মহাযান ধারা বৌদ্ধিক ধারা, বৌদ্ধিক তত্ত্ব, মতবাদ ও ধ্যানের পদ্ধতির উপর কেন্দ্র করে বিকাশ হয়েছে। মহাযান ধারার এক এক উপধারার পন্থীগণ এক এক মতবাদ ধারণ করে থাকে। বিভিন্ন লিখিত উৎস থেকে দেখা যায়, সর্বাস্তিবাদ ধারার মত মহাযান ধারার পন্থীরাও উত্তর ভারত ও মধ্য এশিয়ায়, একই ধরণের ধ্যান বা ভাবনার অনুশীলন করে থাকে। এই ধারাতেও যোগাচারভূমি-শাস্ত্র গ্রন্থটির প্রভাব দেখা যায়, যেখানে ধ্যান বা ভাবনার তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। [১১]

ভারতীয় মহাযান ধ্যান ধারা

এই ধারার ধ্যানে বিপাসনা ও শমথ, দুই ধরণের ধ্যানই অনুশীলন করা হয়। ভারতীয় মহাযান ধারায় যোগাচার আসাঙ্গা-এর অভিধর্মসমুচ্চ, বসুবন্ধু-এর মধ্যন্তবিভঙ্গ-ভাষ্য, স্মৃতি, ৩৭ রকমের বোধিপক্ষীয় ধর্ম [৭] ( চার স্মৃতিপ্রস্থান, চার সাম্মাপ্পাধানা , চার ঋদ্ধিপাদ, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ বালা, নির্বানের সাতটি বিষয়, অষ্টাঙ্গিক মার্গ), এবং সমাধির উপর ভিত্তি করে এর বিকাশ ঘটেছে। মহাযান ধারায় মহারত্নকুট সূত্র, প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, অষ্টসংস্কারিক প্রজ্ঞাপারমিতা সহ বিভিন্ন সূত্র রয়েছে যার মূল বিশ্লেষণ হল ধ্যান বা ভাবনা। [১২]

মহাযান ধারার আরেক ধরণের ধ্যান অনুশীলন হল পদ্ম সূত্র, হৃদয় সূত্রের মতও বিভিন্ন সূত্র ও গাঁথা আবৃতির মাধ্যমে ধ্যান করা। এই আবৃতির এক বিশ্বাস হল, এর জপের ফলে অশুভ শক্তি দূরীভূত হয় এবং শুভ শক্তির আহরণ হয়। [১৩][১৪]

পূর্ব এশীয় মহাযান

চৈনিক বৌদ্ধ ধর্মের ভাবধারাটি মধ্য এশীয় অঞ্চল থেকে বিকাশিত হলেও তা ভারতীয় মহাযান পন্থা থেকে খুব একটা আলাদা নয়। প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক, ’’আন শিগাও’’ দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে আনাপানা স্মৃতি বা শ্বাস-প্রশ্বাসকে কেন্দ্র করে যে ভাবনা বা ধ্যান করা হয়, তার অনুবাদ করেন যা চৈনিক বৌদ্ধ ধর্ম ধারায় ধ্যানের জন্য ব্যাবহৃত হয়ে এসেছে।[১৫] আরেক প্রখ্যাত চৈনিক অনুবাদক এবং শিক্ষাবিদ, ’’কুমারাজিভা’’ চতুর্থ শতাব্দীর দিকে ধ্যান সংক্রান্তিয় বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করেন এবং তা ’’বসে থেকে সমাধি অনুশীলনের সূত্রবলী’’ নামে গ্রন্থিত হয়, যা সর্বাস্তিবাদদের ধ্যানধারার সরাসরি প্রতিফলন। তাঁরা এই সকল সূত্রাবলীকে ধ্যান সূত্র বলে থাকে।[১৬] এই ধারায় সর্বাস্তিবাদের সৌত্রান্তিক ধারা এবং মহাযান ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।[১৭]

পূর্ব এশিয়ার যোগাচার পদ্ধতি

পূর্ব এশিয়ায় যোগাচার ধারা বা ওয়েইশি ঝং চৈনিক বৌদ্ধ ধারার মাধ্যমে প্রভাবিত, যা জাপানে হাস্‌সো ধারা বলে পরিচিত। এই ধারায় বেশ কয়েক ধরণের ধ্যান বা ভাবনার অনুশীলন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ধারার ধ্যানীগণ এক শ্রেণীর চিত্র মনস্থ করে ধ্যান অনুশীলন করে থাকে, যার মধ্যে মৈত্রেয় বুদ্ধের বোধিসত্ত্বকে কেন্দ্র করে চর্চা করা হয়। যোগাচার সিদ্ধ, ঝুয়াংজ্যাং, এই ধরণের ধ্যানের কথা তাঁর জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই ধারার ধ্যানের মূল উদ্দ্যেশ্য হল পুনর্জন্ম লাভ করে মৈত্রেয় বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করা এবং তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করা।

চৈনিক ধ্যান ধারার আরেকটি রূপ হল '’বিজ্ঞাপ্তি মন্ত্র'’ জপের মাধ্যমে অনুশীলন করা, যা ঝুয়াংজ্যাং এর শিষ্য কুইজি প্রচলন ঘটান এবং এর প্রসার করেন। যোগাচার ধারার মধ্যে এর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারায় পাঁচটি স্তর রয়েছে:[১৮]

১) মিথ্যার অবদমন এবং সত্যের উন্মোচন,

২) পাপের মোচন এবং পুণ্যের সঞ্চয়,

৩) মূল উৎসে ফিরে যাওয়া,

৪) অধীনতা থেকে মুক্তি, এবং

৫) সকল কিছুর বাস্তব রূপ উপলব্ধি করা।


তিয়ানতাই সমথ-বিপাসনা

চায়নাতে নিয়মতান্ত্রিক ও বোধগম্য ধ্যান, তিয়ানতাই'’ ধারাতে দেখা যায়। ভারতীয় বৌদ্ধ ধ্যান সংক্রান্তিয় নির্দেশিকা পুস্তক ছাড়াও এই ধারায় তাঁদের নিজেদের প্রবর্তিত কিছু ধ্যান অনুশীলন দেখা যায়, যা শমথ ও বিদর্শন ধ্যানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ঝিয়ি-এর সামাথাবিপাসানা, ঝিগুয়াং-এর মাহাসামাথাবিপাসানা, এবং ছয় সূক্ষ্ম ধর্ম দ্বার গ্রন্থ সমূহ, এই ধারার ধ্যানের জন্য বিশদভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে। ঝিয়ি তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, "শমথ ও বিদর্শন অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বান অর্জন করা সম্ভব। সকল বন্ধন একত্রিত করার প্রথম ধাপ হল শমথ, এবং বিদর্শন জাগতিক ভ্রান্তি দূর করার জন্য অপরিহার্য। শমথ ধ্যান মনের খোরাক মেটায়, এবং বিদর্শন আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। শমথ ধ্যানের মাধ্যমে অনুপম সমাধির উৎপন্ন হয়, এবং বিদর্শন প্রজ্ঞা আনে।"

তিয়ানতাই ধারার ধ্যানে আনাপানা স্মৃতির প্রাধান্য দেখা যায়। ঝিয়ি শ্বাসকে চার ভাবে ভাগ : হাঁপানো, সাধারণ শ্বাস, নিঃশব্দের গভীর শ্বাস, এবং স্থবিরতা/বিশ্রাম। ঝিয়ির মতে, প্রথম তিন প্রকারের শ্বাস শুদ্ধ নয়, শুধুমাত্র চতুর্থ প্রকারের শ্বাসই শুদ্ধ। ঝিয়ি, চার রকমের সমাধি এবং দশ ধরণের বিদর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।


জাপানি তেন্দাই

এন্‌নিন (জিকাকু দাইশি), জাপানই তেন্দাই ধারায় মিক্‌ক্যো বা নিদর্শন ধারার প্রচলন আনেন, যা পরবর্তীতে তামিৎসু বলে পরিচিতি লাভ করে। তেন্দাই তামিৎসু মতবাদ অনুযায়ী পদ্ম সূত্রের পাশাপাশি বিদর্শন ধ্যানও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে, মন্ত্র জপ করে, নির্দিষ্ট মুদ্রাতে(ধ্যান আসন), বিদর্শন ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বান লাভ করা সম্ভব। তিমিৎসু ধারার উৎপত্তি চীন থেকে, এবং কুকাই ধারা থেকে এর ব্যপ্তি ঘটে।[১৯]


হুয়াইয়ান ধ্যান তত্ত্ব

শুদ্ধ ভূমি বুদ্ধবাদ

চেন

বজ্রযান

ত্রিপিটকে ধ্যান সংক্রান্তীয় উল্লেখযোগ্য সূত্র

টীকা

  1. কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার দেহে ক্ষয় তথা পচন ধরে। মানবদেহের এই দৈহিক অবক্ষয়ের বিভিন্ন দশা বা অবস্থাকে নিমিত্ত করে বা তার উপর মনোনিবেশ করে যে ধ্যান করা হয়, তাই হল অশুভ ভাবনা। এই ধরণের ধ্যানে গুরুর তত্ত্বাবধান আবশ্যক।
  2. প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দটি পালি ভাষা থেকে এসেছে। তিনটি শব্দের সংযুক্তিতে এর গঠন। পালি পটিচ্চ অর্থ মূল কারণ, সং (সম) অর্থ যথার্থ এবং, উপাদ্দ অর্থ ফক উৎপ্নন । অর্থাৎ প্রতীত্যসমুৎপাদ অর্থ দাঁড়ায় "ফল উৎপত্তির কারণ" বা হেতু । দ্বাদশ সংযোগ প্রতীত্যসমুৎপাদগুলো হলঃ অবিদ্যার (অজ্ঞানতার) কারণে সংস্কার (কর্ম) উৎপত্তি হয়, সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান (প্রতিসন্ধি বিজ্ঞান) উৎপন্ন হয়, বিজ্ঞানের কারণে নাম-রূপ উৎপন্ন হয়, নাম-রূপের কারণে ষড়ায়তন উৎপন্ন হয় , ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ (পরস্পর সংস্পর্শের প্রতিক্রিয়া) উৎপন্ন হয়, স্পর্শের কারণে বেদনা (অনুভূতি) উৎপন্ন হয়, বেদনার কারণে তৃষ্ণা উৎপন্ন হয়, তৃষ্ণার কারণে উপাদান (দৃঢ় আসক্তি) উৎপন্ন হয়, উপাদানের কারণে কর্মভব উৎপন্ন হয়, কর্মের কারণে জন্ম উৎপন্ন হয়, জন্মের কারণে জরা, মরণ উৎপন্ন হয়, জরা-মরণের কারণে শোক, পরিদেবন কায়িক দুঃখ, মানসিক দুঃখ, উপায়াস কেবল দুঃখের কারঙুলি অবিচ্ছিন্নভাবে উৎপন্ন হয়।
  3. অনুস্মৃতি বলতে এক মনে কোন কিছু বার বার স্মরণ করা। বৌদ্ধ ধর্মে ১০ প্রকার অনুস্মৃতির বিবরণ পাওয়া যায়: বুদ্ধানুস্মৃতি, ধর্মানুস্মৃতি, সঙ্ঘানুস্মৃতি, শীলানুস্মৃতি, ত্যাগানুস্মৃতি, দেবতানুস্মৃতি, উপশমানুস্মৃতি, মরণানুস্মৃতি, কায়াগতানুস্মৃতি এবং আনাপানা স্মৃতি। দেখুন, জিতেন্দ্র (২০১৩), পৃ ৪২-৪৯ ।
  4. আনাপানা স্মৃতি মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ করে ভাবনা করা বা ধ্যান করাকে বুঝায়। এর বিস্তারিত বিবরণ আনাপানস্মৃতি সূত্রে রয়েছে।
  5. চারি ব্রহ্ম-বিহার বলতে বুঝায় মৈত্রী করুণা মুদিতা উপেক্ষা সহগত চিত্ত নিয়ে অবস্থান করা। মৈত্রী- পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী সুখী হোক। করুণা- সকল প্রাণী দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক। মূদিতা -সমস্ত প্রাণী স্ত্রী-পুত্র ধন-জন নিয়ে সুখে বাস করুক; আপন সঞ্চিত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হোক। উপেক্ষা -কর্মই সমস্ত প্রাণীর স্বকীয়। চারি ব্রহ্ম-বিহারের ইহাই সংক্ষেপার্থ। দেখুন, জিতেন্দ্র (২০২০), পৃ ৬৬ ।
  6. পঞ্চশীল হলঃ প্রাণি হত্যা না করা, যা দেওয়া হয়নি এমন বস্তু নেওয়া বা চুরি থেকে বিরত থাকা, অবৈধ কামাচার ও ব্যভিচার তথা যৌন কর্ম থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা কথা বা কাউকে আঘাত করে এমন কথা না বলা, এবং কোন প্রকার নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন বা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
  7. মানব দেহে ৩২ প্রকারের অশুচি হলঃ কেশ, লোম, নখ, দাঁত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু, অস্থি, মজ্জা, মস্তিষ্ক, হৃদয়, ক্লোম, ফুসফুস, প্লিহা, যকৃৎ, অন্ত্র, বৃহদান্ত্র, বৃক্ক, বিষ্ঠা, অশ্রু,সিকনি, থুথু, শ্লেমা, পিত্ত, মূত্র, পুঁজ, স্বেদ, মেদ, লাসিক ইত্যাদি।
  8. চার প্রকারের ব্রহ্ম বিহার হলঃমৈত্রী, করুণা, মুদিতা/তুষ্টি, এবং উপেক্ষা।
  9. ৬ প্রকার অনুস্মৃতি হল- ১) বুদ্ধানুস্মৃতিঃ বুদ্ধের ৯ গুণ, অরহং,সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ, অনুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ সারথী, সকলের শাস্তা/শিক্ষক, জ্ঞানী ও ভগবান; ২) ধর্মানুস্মৃতিঃ ধর্মের ৬ গুণ, ধর্ম সুব্যাখ্যাত, স্বয়ং দৃষ্ট, কালাকাল হীন, "এসো ও দেখো" বলার যোগ্য, নির্বাণগামী ও বিজ্ঞব্যক্তি দ্বারা প্রত্যবেক্ষণযোগ্য; ৩) সঙ্ঘানুস্মৃতিঃ সঙ্ঘের ৯ গুণ, সুপ্রতিপন্ন, ঋজুপ্রতিপন্ন, ন্যায়প্রতিপন্ন, আহবানযোগ্য, সতকারযোগ্য, দক্ষিণারযোগ্য, অঞ্জলিযোগ্য, অনুত্তর পূর্ণ ক্ষেত্র; ৪) শীলানুস্মৃতিঃ শীলের সদাচার অনুসরণ করে ধ্যান; ৫) ত্যাগানুস্মৃতিঃ ত্যাগ বা দানকে অনুসরণ করে ধ্যান, ৬) দেবতানুস্মৃতিঃ দেবতাদের গুণানুস্মরণে করা ধ্যান।
  10. ৪০ ধ্যেয় হলঃ দশ কসিন ( কৃৎস্ন) ধ্যান (পৃথিবী কসিন, পানি/আপ কসিন, আগুন/তেজ কসিন, বায়ু কসিন, নীল কসিন, হলুদ কসিন, লাল কসিন, সাদা কসিন, আলো কসিন, আকাশ কসিন), দশ অশুভ ধ্যান (উদ্ধমিতক, বিনীলক, বিপূষক, বিছিদ্দক, বিখায়িত, বিক্ষিপ্ত, কর্তিত বিক্ষিপ্ত, লোহিতক, পুলবক, অটঠিক), দশ অনুস্মৃতি ধ্যান (বুদ্ধানুস্মৃতি, ধর্মানুস্মৃতি, সঙ্ঘানুস্মৃতি, ত্যাগানুস্মৃতি, দেবতানুস্মৃতি, উপশমানুস্মৃতি, মরণানুস্মৃতি, কায়াগতানুস্মৃতি, আনাপানা স্মৃতি), চার ব্রহ্মবিহার ( মৈত্রী ভাবনা, করুণা ভাবনা, মুদিতা ভাবনা, উপেক্ষা ভাবনা), চার অরূপ ধ্যান (আকাশানন্তায়ন ধ্যান, বিজ্ঞানায়তন ধ্যান, আকিঞ্চায়তন ধ্যান, নৈব সংজ্ঞা না সংগায়তন ধ্যান), ইত্যাদি। দেখুন, বুদ্ধঘোষ, বিশুদ্ধিমাগ্‌গ
  11. আবাস অনুকূলতা হল যে স্থাপনায় (বিল্ডিং, বাসা ইত্যাদি) ধ্যান করা হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে সেই স্থানই হল আবাস। সেখানে এমন কোন কক্ষ, যা আলো-বাতাস পূর্ণ, নির্বাচন করে একনাগাড়ে ৩ দিন থেকে দেখতে হবে যে ধ্যান তাড়াতাড়ি উথপন্ন হয় কিনা।[৭]
  12. গোচর অনুকূলতা হল কোন জায়গায় (প্রান্তর, বৃক্ষ, গুহা ইত্যাদি) গিয়ে ধ্যান করেলে, সেই স্থান যেন চলাচলের ও খাবার সংগ্রহ করার জন্য সুবিধাজনক হয়।[৭]
  13. ভাষ্য অনুকূলতা হল অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বর্জন করতে হবে। প্রয়োজনীয় কথা বা কুশল বিনিময় হলেও তা যেন সংক্ষিপ্ত হয়।[৭]
  14. সবসময় ঠাট্টা তামাশা, বিদ্রূপ করে কথা বলা, কর্কশ কথা বলা, ভোজনবিলাসী ও শারীরিক আরামপ্রিয় ব্যক্তি, ধ্যানে অনুৎসাহী, এই সকল আচারের ব্যক্তি বর্জন করে মিতভাষী, জ্ঞানী, মিষ্টভাষী, পরিমিত আহারকারী, অল্পতে সন্তুষ্ট, কষ্টসহিষ্ণু, শীলবান ব্যক্তির সান্নিধ্যকেই পূদগল অনুকূলতা বলে।[৭]
  15. ঋতু অনুকূলতা হল এক এক জনের এক এক ঋতুতে দেহে ও মনে মৈত্রী ও প্রীতিভাব উৎপন্ন হয়, এবং সেই ঋতুতে ধ্যান করলে সফলতা লাভের পথ সহজ হয়।[৭]
  16. মানুষের চারটি স্বাভাবিক অবস্থা, হাঁটা, দাঁড়ানো, বসা ও শুয়ে থাকা। এই চার অবস্থানের কোনটিতে অনুকূল হচ্ছে (যেমন হেঁটে চংক্রামন ধ্যান) তা তিন দিন করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এবং যেটি সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে বা যে অবস্থায় ধ্যানে উন্নতি হচ্ছে, সেই অবস্থাটিতে ধ্যান করলে ধ্যানে সফলতা প্রাপ্তি সুগম হয়।[৭]
  17. খাবারে কারো মিষ্টি, কারো টক, কারো ঝালে রুচি থাকে। এই অবস্থায়, স্বাদে আসক্ত না হয়ে, প্রত্যবেক্ষণ চিত্তে নিজ নিজ রুচি অনুসারে মিতাহারকেই ভোজন অনুকূল বলে।[৭]
  18. দৈহিক বিভিন্ন বিষয়, যেমন চুল, লোম, নখ ইত্যাদি দীর্ঘ হলে, ঘামে দেহ ময়লা ও দূর্গন্ধময় হলে ধ্যানে প্রতিবন্ধকতা হয়। চুল-নখ ছোট রাখা, দেহ-বস্ত্র পরিষ্কার রাখাই বস্তু বিশোধন।[৭]
  19. ইন্দ্রিয় সমতা বিধান হল পঞ্চ চৈতসিক: শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা, এদের মধ্যে সমতা রাখতে হবে, যেন একটি আরেকটির চেয়ে সবল বা দূর্বল না হয়।[৭]
  20. নিমিত্ত কুশলতা হল বিদর্শন ধ্যান বা শমথ ধ্যান, উভয় ক্ষেত্রেই যে বিষয়ে মনোসংযোগ দিয়ে ধ্যান করা হচ্ছে, তাকে নিমিত্ত কুশলতা বলা হয়। সেই নিমিত্তকে বৃদ্ধি করে এবং সংরক্ষণ, অপর্ণা সমাধি স্তরে যেতে সাহায্য করে।[৭]
  21. চিত্ত প্রগ্রহের প্রগ্রহ অর্থ এখানে, শক্ত বা দৃঢ়ভাবে ধরাকে বোঝানো হয়েছে। যখন, সাধকের মনোবল দূর্বল হয়, তখন সপ্ত বোধ্যঙ্গের- প্রশ্রদ্ধি, সমাধি ও উপেক্ষা-এই তিন ধরণের ধ্যান এর বদলে ধর্মবিচয়, বীর্য ও প্রীতি -এই তিন বিষয়ে ধ্যান করা উচিত।[৭]
  22. চিত্ত প্রগ্রহের সাত প্রকারের বীর্য হলঃ ১) প্রশ্ন-উত্তর, ২) বস্তু বিশোধন, ৩) ইন্দ্রিয়ে সমতা, ৪) জ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসা, ৫) অজ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্য ত্যাগ, ৬) গভীর জ্ঞানচর্চা প্রত্যবেক্ষণ, ৭) তদধি মুক্তি তথা সমাধির প্রতি নতভাব আনয়ন।[৭]
  23. চিত্ত প্রগ্রহের যে এগার প্রকারের বীর্য উৎপন্ন করা যায় তা হলঃ ১) অপায় বা নরক দুঃখ প্রত্যবেক্ষণ, ২) লৌকিক ও লোকোত্তর সুফল প্রত্যবেক্ষণ, জ্ঞানী ব্যক্তিদের পথ অনুসরণের ইচ্ছা, ৪) গৌতম বুদ্ধের মহত্ত্ব পর্যবেক্ষণ, ৫) শীলবান, ধ্যানী ও অপ্রমত্ত ব্যক্তিদের দান করে, ৬) লোকোত্তর মার্গ জ্ঞান উপলব্ধি করা, ৭) চিত্ত বা মনের একাগ্রতা সাধন ও ইর্যাপথ পরিবর্তন (নড়াচড়া) পরিহার, ৮) অলস ব্যক্তির সান্নিধ্যতা বর্জন, ৯) তেজী, উদ্যোগী, স্থির-চিত্ত ও বীর্যবান ব্যক্তির সান্নিধ্যে থাকা, ১০) কোন বিষয়ের মূল কারণ (সম্যক প্রধান) প্রত্যবেক্ষণ, ১১) তদধি মুক্তি তথা সমাধির প্রতি নতভাব আনয়ন।[৭] }
  24. চিত্ত প্রগ্রহের যে এগার প্রকারের প্রীতি উৎপন্ন করা যায়, তা হলঃ ১) বুদ্ধানুস্মৃতি (বুদ্ধ অনুস্মৃতি), ২) ধর্মানুস্মৃতি, ৩) সংঘানুস্মৃতি, ৪) শীলানুস্মৃতি, ৫) ত্যাগানুস্মৃতি, ৬) দেবতানুস্মৃতি, ৭) উপশমানুস্মৃতি, ৮) রুক্ষ, বদমেজাজি ও অপছন্দের ব্যক্তি বর্জন, ৯) স্নিগ্ধ, মধুর ও প্রিয়ভাষী ব্যক্তির সাহচার্য, ১০) প্রীতি উৎপাদক গাঁথা বা গীতি আবৃতি, ১১) তদধি মুক্তি তথা সমাধির প্রতি নতভাব আনয়ন।[৫]
  25. বীর্য বা দৃড়তার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলে মন ঊদ্ধত বা দাম্ভিক হয়ে ওঠে যা, অন্তর্দৃষ্টি উৎপত্তিতে বিঘ্ন ঘটায়। এই অবস্থায় সপ্ত বোধ্যঙ্গ ধ্যানের, ধর্মবিচয়, বীর্য ও প্রীতি পরিবর্তে প্রশ্রদ্ধি, সমাধি ও উপেক্ষা ভাবনা বা ধ্যান করাই অনুকূল হয়।[৫]
  26. মনকে শান্ত করার জন্য সাত প্রকার প্রশ্রদ্ধি উৎপন্ন করা যায়, যেগুলোঃ ১) পরিমিত খাবার, ২) ঋতু সুখ, ৩) ইর্যাপথ সুখ অনুভব, ৪) মধ্যস্থভাব প্রযোগ, ৫) চঞ্চল, তেজস্বী ও বীর্যবান ব্যক্তি বর্জন, ৬) শান্ত, গতিসম্পন্ন ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসা, ৭) তদধিমুক্ততা অর্থাৎ সমাধির প্রতি নতভাব।[৫]
  27. মনকে শান্ত করার জন্য এগার প্রকার সমাধি উৎপন্ন করা যায়, যেগুলোঃ ১) বস্তু বিশোধন, ২) নিমিত্ত কুশলতা, ৩) ইন্দ্রিয় সমতা, ৪) চিত্তকে নিগ্রহ (মনকে সংযম/শান্ত করা), ৫) চিত্তকে প্রগ্রহ/প্রগ্রাহ (মনকে লাগাম দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ), ৬) নিরাসবাদ চিত্তে স্মপ্রহর্ষণতা উৎপাদন, ৭) যথাযথ স্মৃতি অনুশীলন্রত চিত্তকে জাগ্রত সম্যক গতিতে পরিচালন, ৮) অসমাধিস্থ ব্যক্তি বর্জন, ৯) সমাধিস্থ ব্যাক্তির সান্নিধ্য, ১০) লব্ধধ্যান প্রত্যবেক্ষণ, ১১) তদবিমুক্ততা বা সমাধির প্রতি নতভাব।[৫]
  28. মনকে শান্ত করার জন্য পাঁচ প্রকার উপেক্ষা উৎপন্ন করা যায়, যেগুলোঃ ১) স্বত্ব-মধ্যস্থতা (নিজের কর্মফলকে নিজেই ভোগ করতে হবে), ২) সংস্কার মধ্যস্থতা (সকল সংস্কার/বস্তু অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম) , ৩) সত্ব, সংস্কার, ক্লেশ, পুদ্গল ইত্যাদি বর্জন, ৪) সত্ব্য, সংস্কার, মধ্যস্থ পুদ্গলের সাহচার্য দ্বারা, ৫) তদধিমুক্ততা।[৫]
  29. ধ্যানে মনোযোগ বসাতে না পারলে বা ধ্যান করলে যে সুখ হয়, তা উৎপন্ন করতে না পারলে মনে নিরস্বাদ বোধ বা বিরক্তির সৃষ্টি হতে পারে। এই সময় অষ্টমহাসংবেগ বস্তু, যা হল জন্ম, জরা, ব্যধি, মরণ, চার অপায় দুঃখ [তীর্যক (পশু-পাখি কুল), প্রেতলোক (প্রেত-পেতী), অসুর (অনাচারী দেবক‚ল), নরক (নিরয়)], অতীত ও ভবিষ্যতে আবর্তনজনিত দুঃখ, বর্তমানে আহার ও দেহ পরিচর্যাজনিত দুঃখ অথবা ত্রিরন্তের (বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ) গুণসমূহ স্মরণ করে মন বা চিত্তে আনন্দ বা সম্প্রহর্ষ আনে।[৫]
  30. ধ্যানে ঠিকমতো মনোযোগ রাখতে পারলে চিত্তের প্রগ্রহ, নিগ্রহ বা সম্প্রহর্ষণের দরকার হয়না। সামান্য চেষ্টাতেই ধ্যানের সমাধি বাড়ানো যায়। এটাই অধ্যুপেক্ষাকৃত্য [৫]
  31. অসমাধিস্থ ব্যক্তি হল নির্বাণ লাভের কোন ইচ্ছা নেই, পঞ্চকামগুণের (রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ) প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত ব্যক্তি, মন ধিরস্থির নয় এমন ব্যক্তি, ধ্যনে উদাসীন, এমন ব্যক্তি।[৫]
  32. নির্বাণ কাম্য করেন, পঞ্চকামগুণে (রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ) আসক্ত নয় এমন ব্যক্তি, মন স্থির, ধ্যানে উদ্যমী, এমন ব্যক্তি।[৫]
  33. সমাধি যতটুকু ইচ্ছা বৃদ্ধি করা, সমাধির প্রতি ভক্তি, সমাধির প্রতি নত হওয়া, সমাধির প্রতি মনের এই অনুগত ভাবই তদধিমুক্ততা।[৫]


তথ্যসূত্র

  1. জিনবোধি (২০০৩).
  2. Rupert Gethin (1998), The Foundation of Buddhism, Oxford University Press, নিউয়র্ক, ISBN 978-0-19-289223-2
  3. রেবতপ্রিয় বড়ুয়া (১৯৯৩), বিশুদ্ধিমার্গে বৌদ্ধতত্ত্ব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
  4. Philip Kapleau Roshi (1969), The Three Pillars of Zen: Teaching, Practice, and Enlightenmen, Anchor, ISBN 9780385260930
  5. ড় ঢ় য় কক কখ কগ কঘ কঙ কচ কছ কজ কঝ কঞ কট কঠ কড কঢ কণ কত কথ কদ কধ কন কপ কফ কব কভ কম কয কর কল কশ কষ কস কহ কড় কঢ় কয় কৎ খক খখ খগ বড়ুয়া (২০১৪).
  6. জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু (অনুবাদক)(২০১৩), পা-অক সেয়াদ, জানা ও দেখা, কল্পতরু, রাঙ্গামাটি
  7. বড়ুয়া (২০১৩).
  8. বুদ্ধঘোষ (৫ম শতাব্দী).
  9. বসু (২০১৭).
  10. অভিধর্ম মহাবিভাষা শাস্ত্র
  11. Drewes, David (২০১০)। "Early Indian Mahayana Buddhism I: Recent Scholarship"। Religion Compass4 (2): 55–65। ডিওআই:10.1111/j.1749-8171.2009.00195.x 
  12. Delenau, Florin, Buddhist Meditation in the Bodhisattvabhumi, 2013
  13. Skilton, Andrew. A Concise History of Buddhism. 1997. p. 104
  14. Drewes, David (২০১০)। "Early Indian Mahayana Buddhism II: New Perspectives"। Religion Compass4 (2): 66–74। ডিওআই:10.1111/j.1749-8171.2009.00193.x 
  15. Bhante Dhammadipa, KUMĀRAJĪVA’S MEDITATIVE LEGACY IN CHINA, ২০১৫
  16. Deleanu, Florin (১৯৯২); Mindfulness of Breathing in the Dhyāna Sūtras. Transactions of the International Conference of Orientalists in Japan (TICOJ) ৩৭, ৪২-৫৭
  17. Thich Hang Dat, A REAPPRAISAL OF KUMĀRAJĪVA’S ROLE IN MEDIEVAL CHINESE BUDDHISM: AN EXAMINATION OF KUMĀRAJĪVA’S TRANSLATION TEXT ON “THE ESSENTIAL EXPLANATION OF THE METHOD OF DHYANA”
  18. Gregory, Peter N. (সম্পাদক), Traditions of Meditation in Chinese Buddhism, ইঊনিভার্সিটি অফ হাওয়াই প্রেস, ১৯৮৬, পৃ. ৩২-৩৪.
  19. Ryūichi Abe (২০১৩), The Weaving of Mantra: Kūkai and the Construction of Esoteric Buddhist Discourse, কলাম্বিয়া ইঊনিভার্সিটি প্রেস, পৃ. ৪৫


  • ভিক্ষু, ড. জিনবোধি (২০০৩), তথাগত বুদ্ধের বোধি বিধি, বুডিস্ট রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশন সেন্টার 
  • বড়ুয়া, জিতেন্দ্র লাল (২০১৩), বিদর্শন ধ্যান, অন্যধারা 
  • বড়ুয়া, জিতেন্দ্র লাল (২০১৪), ধ্যানঃ সুখী জীবনের চাবিকাঠি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা 
  • বুদ্ধঘোষ, বিশুদ্ধিমাগ্‌গ, ৫ম শতাব্দী।
  • বসু, রণদীপম (২০১৭), চর্বাকেতর: ভারতীয় দর্শন [প্রথম খণ্ড] জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন, রোদেলা