অপারেশন ওভারলর্ড: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Escarbot (আলোচনা | অবদান)
wikidata interwiki
Atlantikwall.gif কে চিত্র:Atlantikwall.png দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, কারণ: file renamed, redirect linked from other project।
১০৩ নং লাইন: ১০৩ নং লাইন:


==== আটলান্টিক ওয়াল ====
==== আটলান্টিক ওয়াল ====
[[চিত্র:Atlantikwall.gif|thumb|আটলান্টিক ওয়ালের মানচিত্র।]]
[[চিত্র:Atlantikwall.png|thumb|আটলান্টিক ওয়ালের মানচিত্র।]]
১৯৪২-৪৩ সালের দিকে জার্মানরা, সঠিক অবস্থানের সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও, মিত্রবাহিনী কোন এক সময়ে পশ্চিম ইউরোপের উপকূলে প্রচণ্ড আঘাত হানবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল। সম্ভাব্য অভিযানকে রুখবার জন্য নাৎসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়। এই প্রস্তুতির বিশেষ অংশ ছিল জার্মানির তৎকালীন প্রকৌশল সংস্থা অর্গানাইজেশান টডের মাধ্যমে সংলগ্ন বন্দরগুলো সহ অন্যান্য স্থাপনাকে ঘিরে শক্ত প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করা। এছাড়া ঐসব এলাকায় সৈন্য সমাবেশও অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেমন শুধু ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদার্ল্যান্ডস ওয়ামাখ্‌টের ৫৯টি ডিভিশানকে সেসময় মোতায়েন রাখা হয়েছিল।
১৯৪২-৪৩ সালের দিকে জার্মানরা, সঠিক অবস্থানের সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও, মিত্রবাহিনী কোন এক সময়ে পশ্চিম ইউরোপের উপকূলে প্রচণ্ড আঘাত হানবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল। সম্ভাব্য অভিযানকে রুখবার জন্য নাৎসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়। এই প্রস্তুতির বিশেষ অংশ ছিল জার্মানির তৎকালীন প্রকৌশল সংস্থা অর্গানাইজেশান টডের মাধ্যমে সংলগ্ন বন্দরগুলো সহ অন্যান্য স্থাপনাকে ঘিরে শক্ত প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করা। এছাড়া ঐসব এলাকায় সৈন্য সমাবেশও অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেমন শুধু ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদার্ল্যান্ডস ওয়ামাখ্‌টের ৫৯টি ডিভিশানকে সেসময় মোতায়েন রাখা হয়েছিল।



০৭:৫৭, ২০ জুন ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

অপারেশান ওভারলর্ড
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

মিত্রবাহিনীর রসদবাহী পরিবহন হতে সৈন্যদের জন্য রসদ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির খালাস সম্পন্ন হচ্ছে।
তারিখ৬ জুন – ৩০ আগস্ট ১৯৪৪
অবস্থান
নরম্যান্ডি, ফ্রান্স
ফলাফল মিত্রবাহিনীর বিপুল বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
পশ্চিমা মিত্রবাহিনী  নাৎসি জার্মানি
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার
(মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক)
যুক্তরাজ্য আর্থার টেডার (সহ-সর্বাধিনায়ক)
যুক্তরাজ্য বার্নার্ড মন্টগোমরি (অধিনায়ক, স্থলবাহিনী)
যুক্তরাজ্য ট্রাফোর্ড লে-ম্যালরি (অধিনায়ক, বিমানবাহিনী)
যুক্তরাজ্য বারট্রাম রামসে (অধিনায়ক, নৌবাহিনী)
নাৎসি জার্মানি গার্ড ভন রানস্টেড
নাৎসি জার্মানি আরউইন রমেল
শক্তি
১,৪৫২,০০০ (২৫ জুলাই)[১]
২,০৫২,২৯৯ (২১ আগস্ট, শুধুমাত্র উত্তর ফ্রান্সে)[২]

৩৮০,০০০ (২৩ জুলাই)[৩]- ১,০০০,০০০+ (সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে)[nb ১]

২,২০০[৪] - ~২,৩০০ ট্যাঙ্ক[৫]
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি

২২৬,৩৮৬জন হতাহত[nb ২]
[৭]
৪,১০১টি বিমান[৮]

~৪,০০০ ট্যাঙ্ক[৯]

২০৯,৮৭৫[nb ৩] – ৪৫০,০০০জন হতাহত[nb ৪]
২,১২৭টি বিমান[১০]

~২,২২০টি ট্যাঙ্ক[nb ৫]
ফ্রান্স: ১৯,৮৬০ বেসামরিক নিহত[১১]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী যে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে নাৎসি জার্মানি নেতৃত্বাধীন অক্ষবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করেছিল, অপারেশান ওভারলর্ড সেই অভিযানের সামরিক নাম। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ইংলিশ চ্যানেল সংলগ্ন ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অবতরণের মাধ্যমে অপারেশান ওভারলর্ডের অধীনে মিত্রবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ শুরু হয়। প্রাথমিক ভাবে নরম্যান্ডিতে অবতরণের লক্ষ্যে ৬ জুন তারিখে মার্কিন, ব্রিটিশ ও কানাডীয় মোট ১৬০,০০০ সৈন্য ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে। পরবর্তীকালে আগস্ট মাস পর্যন্ত আরও তিরিশ লক্ষাধিক সৈন্য এই অভিযানে প্রেরণ করা হয়।

নরম্যান্ডি সহ অন্যান্য উপকূলগুলো দখলের পর তিন সপ্তাহ যাবৎ শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে, যার পরে অপর একটি সামরিক অভিযান কোবরার অধীনে নরম্যান্ডি থেকে মিত্রবাহিনী ইউরোপের গভীরে আক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করে। নরম্যান্ডিকে কেন্দ্র করে চলতে থাকা যুদ্ধের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় দু’মাস যেখানে অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্রসমূহ আকাশপথে ও নৌপথে যে যেভাবে পারে অবদান রাখছিল। অপারেশান ওভারলর্ডের ফলশ্রুতিতে ২৫ আগস্ট তারিখে প্যারিসকে নাৎসি জার্মানির দখলমুক্ত করা হয়।

ওভারলর্ডের প্রস্তুতি

মিত্রবাহিনীর অভিযান সমূহ

হিটলার বলেছিলেন, স্থানের ব্যাপ্তির কারণে পূর্বে অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে লড়াইয়ে পরাজয়ের ফলে জার্মানি বিশাল এলাকা হারাবে কিন্তু তা হয়তো জার্মানির জন্য ধ্বংসাত্মক হবে না। কিন্তু পশ্চিমের পরিস্থিতি অনুরূপ নয়। ঐদিকে শত্রুরা সফল হলে এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি অল্প সময়ের মাঝেই কার্যকর হবে।[১২]

১৯৪০ সালের জুন মাসে জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পতনকে অ্যাডলফ হিটলার ‘ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বাহিনী, পরাস্ত হলেও ডানকির্ক থেকে তিন লক্ষ সৈন্যের এক ঐতিহাসিক পশ্চাদপসরণের মাধ্যমে চূড়ান্ত ভাবে পর্যদুস্ত হওয়াকে এড়াতে পেরেছিল। এরপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল এক বিখ্যাত বিবৃতিতে জার্মানির হাত থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার জন্য ফ্রান্স অভিযান করবেন বলে জানিয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় নেতা জোসেফ স্টালিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সাথে এক যৌথ বিবৃতিতে চার্চিল ইউরোপে মিত্রবাহিনীর দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার ঘোষণা দেন। চার্চিল সোভিয়েত মন্ত্রী মলটোভকে এক অনানুষ্ঠানিক স্মারক হস্তান্তরের মাধ্যমে জানান যে সেই মুহূর্তে দ্বিতীয় ফ্রন্ট গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ হয়তোবা সম্ভব হবে না। এতদসত্ত্বেও দ্বিতীয় ফ্রন্টের ঘোষণার কিছু প্রভাব দেখা দিয়েছিল, যেমন এই ঘোষণার আসার পরপর অ্যাডলফ হিটলার ইউরোপে মিত্রবাহিনীর সম্ভাব্য আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।[১২]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কারণে ব্রিটেনে চার্চিল প্রশাসন এবার ব্যয়বহুল সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে যাবার ব্যাপারটিকে বিবেচনায় আনে। অবদান স্বরূপ ব্রিটিশরা সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল অপারেশানস এক্সিকিউটিভ (এসওই)-এর দ্বারা শত্রু এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টিকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বিবেচনা করে। পাশাপাশি তারা অক্ষশক্তির তুলনামূলক ভাবে কম শক্তিশালী ইটালির বিরুদ্ধে আগ্রাসন করার কথা বিবেচনা করে যারা মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর থেকে ভিয়েনা অভিমূখে ও জার্মানির দক্ষিণ ভাগে আঘাত হানার সুবিধা হতে পারত। ব্রিটিশরা এই পরিকল্পনার আরেকটি সুবিধা বিবেচনা করে যে এর দ্বারা ইউরোপের গভীরে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাদের সাম্রাজ্যবাদের স্বঘোষিত প্রতিপক্ষ সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের পথে সামান্য বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এসব পরিকল্পনা অনেকটা নাকচ করে দেয় কারণ তারা জার্মানিতে পৌছবার জন্য সংক্ষিপ্ততম পথের অভিযানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছিল। এই লক্ষ্যে ১৯৪২ সালে অপারেশান স্লেজহ্যামার ও ১৯৪৩ সালে অপারেশান রাউন্ডআপ নামের দুটি অভিযান প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীকালে অপারেশান রাউন্ডআপের প্রস্তাবনা গৃহীত হয় যা আরও এক বছর দেরি করে ১৯৪৪ সালে এই অপারেশান ওভারলর্ড নামে পরিচালিত হয়।[১৩]

১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা সম্মেলন ও একই বছরের শেষভাগে তেহরান সম্মেলনের পর এই অভিযান সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রথম উপস্থাপিত হয়[১৪]। উপস্থাপন করেন মিত্রবাহিনীর সেসময়ের সর্বাধিনায়ক ও ‘চিফ অফ স্টাফ অফ সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ড (COSSAC)’ ব্রিটিশ লেঃ জেনারেল স্যার ফ্রেডরিক মরগ্যান এবং তার মার্কিন সহকারী মেঃ জেনারেল রে বার্কার। এই COSSAC-এর উপাদান সমূহ পরে ১৯৪৪ সালের শুরুর দিকে মিত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান কার্য্যালয়ে স্থানান্তরিত করা হয় যেখানে সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্মভার লাভ করেন ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার[১৫]। এই নেতৃত্বের অধীনে সমস্ত স্থল কার্যক্রমের দায়িত্ম জেনারেল স্যার বার্নার্ড মন্টগোমরিকে যিনি একই সাথে পুরো অভিযানের পরিকল্পনার কাজ শুরু করেন।[১৬]

মিত্রবাহিনীর জেনারেলগণ সরাসরি কোন ফরাসি বন্দরে আক্রমণের মাধ্যমে অবতরণের পক্ষপাতী ছিলেননা। কারণ ১৯৪২ সালে অনুরূপ একটি অভিযানে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।[১৭] এদিকে আবার ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের বহুলব্যাবহৃত বিমান যেমন সুপারমেরিন স্পিটফায়ারহকার টাইফুনের কার্যকরী এলাকার সীমাবদ্ধতার কারণে নির্বাচনযোগ্য অবতরণস্থলের তালিকা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল।

মিত্রবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক নেতৃবৃন্দ নরম্যান্ডিতে অবতরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার করতে চেয়েছিলেন কারণ এখানকার বিবেচ্য অবতরণস্থলের নিকটবর্তী চারবুর্গ বন্দরটিতে নাৎসি বাহিনীর বিপুল শক্তি সঞ্চিত ছিল। এমনিতে ভৌগোলিক বিবেচনায় ব্রিটেন থেকে ইউরোপের মূলভূমির সবচেয়ে নিকটবর্তী এলাকাটি হল পাস দ্য ক্যালেইস, যেটি চারবুর্গের চেয়েও অধিক সুরক্ষিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে মিত্রবাহিনীর নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন নরম্যান্ডিই হতে পারে উপযুক্ত অবতরণস্থল।[১৮]

মূল পরিকল্পনা

COSSAC তিনটি ডিভিশানের স্থলপথে ও দুটি ব্রিগেডের বিমানযোগে অবতরণের পরিকল্পনা করে। অভিযানটিতে সর্বমোট ৪৭টি ডিভিশান মোবিলাইজ করার পরিকল্পনা হয় যার মাঝে থাকবে ব্রিটিশ কমান্ডের অধীনে ব্রিটেনের ১৯টি, কানাডার ৫টি ও পোল্যান্ডের ১টি ডিভিশান এবং সাধারণ কমান্ডের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ২১টি ডিভিশান।[১৯]

ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে ফ্রান্স উপকূলের বেশ কিছু চিত্র ধারণ করেছিল যেগুলোর মধ্যে থেকে নর্ম্যান্ডির ছবিগুলো নিয়ে মিত্রবাহিনী ঐ এলাকার একটি বিস্তারিত ভৌগোলিক মানচিত্র তৈরি করে। পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় নরম্যান্ডির উক্ত অঞ্চলে প্রধানত রয়েছে বিস্তীর্ণ জলাভূমি যেগুলো ভারি সামরিক যান চলাচলের উপযুক্ত নাও হতে পারে। প্রশিক্ষণ ও অভিযানের চর্চার উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের নরফোকে প্রায় অনুরূপ সমুদ্র সৈকতে অপারেশান ওভারলর্ডের খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে নরম্যান্ডির ভূমি আদৌ ভারি সামরিক যানচলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। এ ব্যাপারে আরও তথ্য জানার লক্ষ্যে ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বারে ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর পক্ষ থেকে অপারেশান পোস্টেজ এব্‌ল নামক একটি পৃথক সামুদ্রিক রেকনেসান্স অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে একটি এক্স ক্লাস ডুবোজাহাজ ব্যবহৃত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল নরম্যান্ডির ভূমি সম্পর্কে সঠিক ও কার্যকরী তথ্য সংগ্রহ করা।

৭ এপ্রিল ও ১৫ মে তারিখে বার্নার্ড মন্টগোমরি লন্ডনে অবস্থিত সেন্ট পল’স স্কুলে তার বিস্তারিত পরিকল্পনাটি মিত্রবাহিনীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরেন।[২০] মন্টগোমরি ৯০ দিনে ব্যাপ্তির একটি আগ্রাসন পরিকল্পনা দেন যেখানে ৯০ দিন[২১] পর ব্রিটিশ ও কানাডীয় বাহিনীর সেইনে পৌছবার কথা ও পরে কান[২২] থেকে মার্কিন বাহিনীর সাথেক পূর্ণশক্তি নিয়ে পূর্বদিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা ছিল।

প্রথম চল্লিশ দিন যাবৎ কান ও চারবুর্গ শহরে শক্ত অবস্থান তৈরি করার কথা বলা হয়। বিশেষ করে চেরবূর্গের গভীর সমুদ্র বন্দরের দখল যে কোন মূল্যে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এই শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয়। এই অবস্থানের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটানি দখল করা ও ব্রিটানি সংলগ্ন আটলান্টিকের অন্যান্য বন্দরগুলো দখলের জন্য অভিযান পরিচালনা করা।

প্রযুক্তি

ওভারলর্ড পরিচালনার সুবিধার জন্য মিত্রবাহিনীকে কিছু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল ‘মালবেরি’ যা ছিল ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ও ভারী একটি ভ্রাম্যমাণ বন্দর। কোন উপকূলে অবতরণ করার আগে একটি শত্রু বন্দর দখল করার যে বাধ্যবাধকতা থাকে মালবেরি ছিল সেই সমস্যার সমাধান।

জেনারেল পার্সি হোবার্ট যিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন ব্রিটিশ প্রকৌশলী, তিনি চার্চিলশারম্যান ট্যাংকে কিছু কারিগরি পরিবর্তন এনে বিশেষ রূপ দান করেছিলেন যেগুলো কোন সমুদ্র সৈকতে সামরিক অবতরণের জন্য সহায়ক ছিল।

শত্রুর মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি

ব্রিটেনে ওভারলর্ডে ব্যবহৃতব্য গোলাবারুদের পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ চলছে।

অপারেশান ওভারলর্ডের পূর্বের উত্তেজনাকর কূটনৈতিক সম্পর্কাবলীর বদৌলতে মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি উভয়েরই নিজনিজ ক্ষেত্রে অপরপক্ষ কর্তৃক প্রেরিত চরদের বিচরণ ছিল। মিত্রশক্তি নরম্যান্ডি অবতরণের আগে অপারেশান ওভারলর্ডের সঠিক ও যাচাইকৃত তথ্য যেন শত্রূর হাতে না পৌছে সে জন্য শত্রূকে বিভ্রান্ত করার জন্য একাধিক গোপন অভিযান বা ডিসেপশান অপারেশান পরিচালনা করে। প্রাথমিক ভাবে অপারেশান বডিগার্ড নামক একটি অভিযান পরিচালিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল মূল ওভারলর্ড অভিযানের এলাকার সংলগ্ন অধিবাসীদের মধ্যে এই বলে প্রচারণা চালানো যে প্রাথমিক অবতরণ নরম্যান্ডিতে নয় বরং পাস দ্য ক্যালেইসে হবে। আরেকটি ডিসেপশান অপারেশান ছিল অপারেশান ফর্টিচ্যুড যা বিস্তারের দিক থেকে আগেরটির চেয়ে অনেক বড় অপারেশান ছিল। এর অধীনে ইউরোপে অক্ষশক্তির সামরিক নেতৃবৃন্দের মাঝে শক্ত বিশ্বাস সৃষ্টি করা হয় যে মূল অবতরণ ও প্রকৃত মিত্র আক্রমণ আসবে উত্তরে নরওয়ের অরক্ষিত উপকূল দিয়ে। অপারেশান ফর্টিচ্যুডের সাফল্য ছিল এই যে নাৎসি জার্মানি নরওয়ের উপকূলে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করে ও সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ঐ অঞ্চলে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে, প্রকৃতপক্ষে যা একান্তই বৃথা ছিল।

বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ইউএস প্রথম আর্মি বা FUSAG নামের একটি কাল্পনিক ডিভিশানের জন্ম দেয়া হয় যার অবস্থান দক্ষিণপূর্ব ব্রিটেনে রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। শুধু প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে উক্ত অঞ্চলে নকল সামরিক ক্যাম্প, নকল ট্যাঙ্কবহর ইত্যাদি স্থাপন করা হয় যা বিমান থেকে দেখলে মনে হবে যেন একটি বিশাল সৈন্যদল সেখানে অবস্থান করছে। এই কাল্পনিক সৈন্যদলের অধিনায়ক হিসেবে জেনারেল লেসলি ম্যাকনেয়ার ও জেনারেল জর্জ প্যাটনের নাম প্রচার করা হয়। ব্রিটেনের বিমান প্রতিরক্ষা কাঠামোতে ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু ত্রুটি রাখা হয় যার ফলে জার্মানির লুফটওয়াফা সহ অন্যান্য অক্ষশক্তির বিমান সেগুলোর ছবি তুলতে সক্ষম হয়ছিল। এই সৈন্যদলের অবস্থানের সম্পর্কে ভুল ধারণা আরও বদ্ধমূল করার লক্ষ্যে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা তাদের বেতার যোগাযোগে সেই সৈন্যদলের অবস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করত যেন অক্ষশক্তির গোয়েন্দারা বেতার যোগাযোগ গোপনে শুনতে পায়। এছাড়াও উভয় দেশের দ্বৈতচরদের মাধ্যমে ঐ বিশেষ স্থানে কাল্পনিক সৈন্য অবস্থানের খবর প্রচারিত হতে থাকে এবং এর সাথে এও প্রচার করা হতে থাকে যে মূল আক্রমণ প্রকৃতপক্ষে পাস দ্য ক্যালেইস দিয়ে করাই সুবিধাজনক। শুধু গোপন অভিযানই নয়, ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর বিভিন্ন জাহাজ পাস দ্য ক্যালেইসের সংলগ্ন অঞ্চলের ব্যাপক রেকনেসান্স অভিযান শুরু করে যার ফলে শত্রুপক্ষের সামরিক নেতৃবৃন্দ, জনগণ এমনকি ব্রিটিশ জনগণসহ মিত্রশক্তির দেশগুলোর মানুষও ভাবতে শুরু করে যে আক্রমণ প্রকৃতপক্ষে পাস দ্য ক্যালেইসের পথেই ঘটবে।[১৯]

ফর্টিচ্যুডের সহায়ক হিসেবে অপারেশান স্কাই নামের আরেকটি অপারেশান চালানো হয় যার অধীনে স্কটল্যান্ড অবস্থিত রয়্যাল এয়ারফোর্স রেডিও ট্রাফিক নরওয়ে আক্রমণের বিভিন্ন ইঙ্গিত বহন করত।

বিভ্রান্তি সৃষ্টির চূড়ান্ত অভিযানটি চালায় ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (স্যাস) একটি দল ফ্রান্সের লা হ্যাভারে, যেখানে তারা ডামি প্যারাট্রুপার মোতায়েনের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের আক্রমণে ভ্রান্ত ইঙ্গিত দেয়। একই রাতে আরও দুটি রয়্যাল এয়ারফোর্স স্কোয়াড্রন আটলান্টিকের কেপ দ্য অ্যান্টিফারে বিস্তীর্ণ ধাতব ফয়েল বা স্ট্রিপ রেখে আসে যা জার্মান রাডারে শত্রুপক্ষের অগ্রসরমান জলযান হিসেবে ধরা দেয়। এর অপারেশানের মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলে আক্রমণের ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করা হয়।

বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই অভিযানগুলোতে খুব সূক্ষ্মভাবে ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের সম্ভাব্যতার ইঙ্গিত দেয়া হয়, শুধুমাত্র নরম্যান্ডি ছাড়া। এই অভিযানগুলোর দ্বারা মূল অবতরণস্থল নরম্যান্ডির উপর থেকে অক্ষশক্তির মনযোগ যৎসম্ভব সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।[২৩]

প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা

মূল অভিযানের মাশখানেক আগে থেকেই মিত্রবাহিনী ওভারলর্ডের রিহার্সাল দিতে শুরু করে করেছিল। ১৯৪৪ সালের ২৮ এপ্রিল তারখে এরূপই একটি রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ব্রিটেনের ডেভন উপকূলে যেখানে জার্মান টর্পেডো বোটের আকস্মিক আক্রমণে ৭৪৯ জন মার্কিন নৌ সেনা নিহত হয়।[২৪].

অভিযানোত্তর সময়ে ব্রিটেন থেকে ছড়িয়ে পড়া একটি খবরের কারণে অক্ষশক্তির মাঝে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্বাধীন আইরিশ রাষ্ট্র যা আজকের আয়ারল্যান্ড, সেখানে ও সেখান থেকে যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জার্মান দূতাবাসগুলো, নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বা অন্যান্য অক্ষরাষ্ট্র যেখানেই থেকে থাকুক না কেন, সম্ভাব্য মিত্রবাহিনী অভিযান সম্পর্কে এতটাই পরস্পরবিরোধী তথ্য পেয়েছিল যে মিত্রবাহিনীর নীতিনির্ধারকরা একটি পর্যায় গিয়ে নিশ্চিত হন যে এখন কোন সঠিক তথ্য পেলেও জার্মানরার তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে না বা নিশ্চিয়তা পেতে আগ্রহী হবে না।

মূল অভিযানের কয়েক সপ্তাহ আগে ব্রিটেনের ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি শব্দজট ছাপা হয় এবং গোয়েন্দারা আবিষ্কার করেন সেই শব্দজটের সমাধানের বেশ কিছু শব্দ পাওয়া যায় যা অপারেশান ওভারলর্ড পরিকল্পনায় ব্যবহৃত গোপন কিছু শব্দের অনুরূপ। যেমন শব্দজটের একটি সমাধান ছিল মালবেরি যা প্রকৃতপক্ষে ছিল ওভারলর্ডে ব্যবহৃতব্য একটি ভ্রাম্যমাণ বন্দর যা অবতরণের কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা। এই ঘটনা আবিষ্কারের পর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ শব্দজটটির নির্মাতা লন্ডনের এক স্কুলশিক্ষক লিওনার্ড ডাওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন যে ডাও প্রকৃতপক্ষে নির্দোষ ও শব্দের মিলের ঘটনাটি ছিল কাকতালীয়।

মূল অভিযানের আগে একাধিকবার তথ্যফাঁস হবার ঘটনা ঘটেছিল। আলবেনীয় নাগরিক ইলিয়েসা বাযনা যিনি জার্মানদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন, অভিযানের পূর্বে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর ও সেই সময়ে তুরস্কে জার্মান রাষ্ট্রদূত ফ্রাঞ্জ ভন প্যাপেনের হাতে ওভারলর্ড সম্পর্কে বেশ কিছু গোপন নথিপত্র হস্তান্তর করতে সক্ষম হন। নথিপত্রগুলো সরাসরি ভাবে ওভারলর্ডের সাথে সম্পর্কিত না হলেও অর্থাৎ এতে পরিকল্পনার বিশেষ তথ্য না থাকলেও এতে অপারেশান ওভারলর্ড নামে যে কোন অভিযান সত্যিই রয়েছে সেই তথ্য ছিল।[২৫]

তথ্যফাঁসের আরেকটি ঘটনা ঘটে ফরাসি জেনারেল চার্লস দ্য গলের অসাবধানী কথাবার্তার কারণে। তিনি ডি-ডের পর একটি মন্তব্যে বলেন যে নরম্যান্ডির অবতরণই হল মিত্রবাহিনীর প্রকৃত অভিযান। এই মন্তব্যের ফলে মিত্রবাহিনীর অপারেশান ফর্টিচ্যুড ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়েছিল যে অপারেশানের মাধ্যমে জার্মান নীতিনির্ধারকদের মাঝে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে মূল অভিযান হবে নরওয়ের উপকূল দিয়ে। ফর্টিচ্যুডের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে জার্মানরা নরওয়ের উপকূলে বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। পরে অবশ্য দ্য গলের মন্তব্যের তেমন বিরূপ প্রভাব পড়েনি কেননা জার্মানরা তার মন্তব্যকে তেমন একটি গ্রাহ্য করেননি ও তখনও নিশ্চিত ছিলেন নরওয়ের উপকূল দিয়ে একটি বড় আক্রমণ ঘটবে।[২৬] আদতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়কালেও নরওয়ে দিয়ে কোন অভিযান কখনও পরিচালিত হয়নি।

মিত্রশক্তির অভিযান পরিকল্পনা

ব্রিটেন নরম্যান্ডির ওর্ন নদীর সংলগ্ন এলাকায় মূল অভিযানের আগেই একটি বিমানবাহী আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ওর্ন নদীর সেতুগুলো নিয়ন্ত্রণে আনাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। এই নিয়ন্ত্রণে আনার দুটি সুবিধার কথা বিবেচনা করা হয়; এক, সেতুগুলো জার্মানরা তাদের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারবে না; দুই, সেতুগুলোকে ধ্বংস হবার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হলে এগুলোর সাহায্যে ইউরোপের আরও গভীরে প্রবেশ সম্ভব হবে।

নরম্যান্ডি অভিমূখে ডি-ডে আক্রমণের গতিপথসমূহ।

ফ্রান্সে অবতরণের সাধারণ পরিকল্পনা ছিল এই যে, মার্কিন বাহিনী তাদের এয়ারবোর্ন ডিভিশানের সাহায্যে ওমাহা সৈকত, পয়েন্ট ডু হক ও ইউটাহ সৈকত দখলমুক্ত করবে এবং কানাডীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের সাথে একত্রিত হয়ে স্যোর্ড সৈকতে আঘাত হানবে। এমনিতে কানাডীয় ও ব্রিটিশ বাহিনী নিজ নিজ দায়িত্মে যথাক্রমে গোল্ড সৈকত ও জুনো সৈকত দখলমুক্ত করবে।

অভিযানের নৌবহরটি গঠন করতে মোট আটটি নৌবাহিনীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় যুদ্ধ্বজাহাজ ও ডুবোজাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছিল। পুরো নৌবহরটিকে ইস্টার্ন টাস্ক ফোর্স ও ওয়েস্টার্ন টাস্ক ফোর্স নামের দুটি উপদলে ভাগ করা হয়ছিল যেগুলোর নেতৃত্ব ছিলেন যথাক্রমে মার্কিন রিঃ অ্যাডমিরাল অ্যালেন কির্ক ও ব্রিটিশ রিঃ অ্যাডমিরাল স্যার ফিলিপ ভিয়ান। এমনিতে পুরো নৌযাত্রাটির অধিনায়ক ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল স্যার বারট্রাম রামসে।

বিশেষ নামসমূহ

অভিযানের বিশেষ অংশ সমূহকে কিছু বিশেষ নামে অভিহিত করা হত। যেমন, আঘাত হানবার পর ইউরোপের উক্ত মহাদেশীয় অঞ্চলে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলে শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়াটিকে এককভাবে ওভারলর্ড নামে অভিহিত করা হয়েছিল। ফ্রান্সের উপকূলে অবতরণের প্রক্রিয়াটি অভিহিত ছিল নেপচুন নামে। শুধুমাত্র অবতরণ অর্থাৎ নেপচুন প্রক্রিয়াটি ডি-ডে অর্থাৎ ৬ জুনের পর চব্বিশ দিন যাবৎ চলে জুনের একদম শেষভাগে গিয়ে সম্পন্ন হয়। অপরদিকে ওবারলর্ড বা শক্ত অবস্থান রচনার প্রক্রিয়াটিকে বিবেচনা করা হয়েছিল অবতরণের পর থেকে সেইন নদী অতিক্রম করা পর্যন্ত যা ১৯ আগস্ট পর্যন্ত চলেছে।

জার্মান প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

আটলান্টিক ওয়াল

আটলান্টিক ওয়ালের মানচিত্র।

১৯৪২-৪৩ সালের দিকে জার্মানরা, সঠিক অবস্থানের সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও, মিত্রবাহিনী কোন এক সময়ে পশ্চিম ইউরোপের উপকূলে প্রচণ্ড আঘাত হানবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল। সম্ভাব্য অভিযানকে রুখবার জন্য নাৎসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়। এই প্রস্তুতির বিশেষ অংশ ছিল জার্মানির তৎকালীন প্রকৌশল সংস্থা অর্গানাইজেশান টডের মাধ্যমে সংলগ্ন বন্দরগুলো সহ অন্যান্য স্থাপনাকে ঘিরে শক্ত প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করা। এছাড়া ঐসব এলাকায় সৈন্য সমাবেশও অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেমন শুধু ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদার্ল্যান্ডস ওয়ামাখ্‌টের ৫৯টি ডিভিশানকে সেসময় মোতায়েন রাখা হয়েছিল।

১৯৪৩-এর শুরুর দিকে যখন ব্রিটেনে মিত্রবাহিনীর সৈন্যদলগুলো একত্রিত হতে থাকে, তখনই পরিস্থিতি বিচারে এনে জার্মানির পশ্চিম ফ্রন্টের অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল গার্ড ভন রানস্টেড তার অধীনে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আবেদন জানান। এরপর তার জন্য বাড়তি সৈন্য প্রেরিত হয়, পাশাপাশি তিনি ফিল্ড মার্শাল আরউইন রমেলকে তার সহকর্মী হিসেবে পান। রমেলেকে ঐখানে পাঠাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাকে দিয়ে আটলান্টিক ওয়াল নামে জার্মানদের গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা বুহ্যটি পরিদর্শন করানো। পরিদর্শনের পর রমেল অ্যাডলফ হিটলারের সাথে দেখা করে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল, বেলজিয়াম ও নেদার্ল্যান্ডসের প্রতিরক্ষার দায়িত্ম নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে ১৯৪৪ সালে জার্মানির আর্মি গ্রুপ-বি-কে আরউইন রমেলের অধীনে ঐ এলাকার প্রতিরক্ষার জন্য মোতায়েন করা হয়।

দায়িত্মলাভের পর রমেল লক্ষ্য করেন আটলান্টিক ওয়াল নামের যে ব্যাবস্থাটিকে জার্মানি এক অভেদ্য প্রতিরক্ষা বুহ্য হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করছিল, সেটি শুধু গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু বন্দরগুলো বাদে বিস্তীর্ণ সৈকতগুলো থেকে যাচ্ছিল দূর্বলভাবে রক্ষিত যেখানে চাইলেই বিশাল শত্রুবাহিনী স্বল্প বাধা অতিক্রম করে অবতরণ করতে পারে। রমেলের তত্ত্বাবধানে ঐ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলে ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাবস্থার মধ্যে ছিল ধাতব ব্যারিকেড, কংক্রিটের অত্যন্ত মজবুত বাংকার ইত্যাদি। যেহেতু ঐ পরিস্থিতিতে আকাশপথে মিত্রবাহিনীর শক্তির তুলনায় জার্মান লুফটওয়াফা যথেষ্ট দূর্বল ছিল[২৭]), তাই এয়ারবোর্ন বা বিমানবাহী আক্রমণের আশঙ্কায় রমেলের নির্দেশে ঐ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব সম্ভাব্য অবতরণযোগ্য এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে অসংখ্য গুপ্তফাঁদ স্থাপিত হয়।

কিন্তু এমন নয় যে এই সমস্ত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সুষ্ঠুরূপে বাস্তবায়িত হয়েছিল। বিশেষ করে নরম্যান্ডি অঞ্চলে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছিল কেননা ঐখানে পৌছবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় ছিল। এ কারণে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ পরিবহনের সমস্যা তো ছিলই, উপরন্তু জার্মানরা মিত্রবাহিনীর বিভ্রম সৃষ্টিকারী প্রচারণাতেই হোক আর যে কারণেই হোক, নরম্যান্ডির ব্যাপারে ততটা চিন্তিত ছিলনা এবং অনেকটা নিশ্চিত ছিল যে আঘাত নরম্যান্ডি নয় বরং পাস দ্য ক্যালেইস দিয়েই আসবে।

জার্মানরা আটলান্টিক ওয়াল কার্যক্রমের অধীনে উপকূলের সম্মুখভাগে ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছিল কারণ সাধারণ ধারণা ছিল যে অবতরণ ঘটলে তা ঘটবে জোয়ারের সময় (শুধুমাত্র জার্মানদের এই পূর্বধারণার জন্যেই মিত্রবাহিনীকে ভাটার সময়ে অবতরণ করতে হয়েছিল)। বিশেষ করে প্রতিরক্ষার নরম্যান্ডি সেক্টরটি অর্থাৎ যেখানে মূলত আঘাত হানা হয়, এখানকার দায়িত্মে ছিল মূলত চারটি ডিভিশান যার মধ্যে ৯১তম ও ৩৫২তম ডিভিশান দুটি ছিল শক্তিশালী। কিন্তু বাদবাকি সৈন্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল যে কোন কারণে ইস্টার্ন ফ্রন্টে যেতে ব্যর্থ সৈন্য যাদের বাধ্য হয়েই ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। আবার আরেকটি গোষ্ঠী ছিল ভিনদেশী ও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী যারা জার্মান বন্দীশালার তৎকালীন করুণ অবস্থায় দিনযাপনের চেয়ে কর্তৃপক্ষের কথা মত সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণে রাজি হয়ে সশস্ত্রবাহিনীতে নিযুক্ত হয়েছিল।

রমেল হিটলারের কাছে প্রস্তাব করেন যে আর্মার্ড ডিভিশানগুলো যেন উপকূলের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে মোতায়েন করা হয়। সেসময়ে ইউরোপের অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলোর প্রতিরক্ষার দায়িত্মে থাকা জেনারেল গিয়ার ভন শেপেনবার্গ এই প্রস্তাবনার ্সাথে দ্বীমত পোষণা করে হিটলারকে জানান যে অভেদ্য আর্মার্ড ডিভিশানগুলো কেন্দ্রের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো বড় শহর যেমন প্যারিস, রুয়েন ইত্যাদির নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখবে। হিটলার তার দুই অধিনায়কের প্রস্তাবনার মুখে একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রমেলকে ৩টি প্যানজার ডিভিশান ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বাকিগুলো শেপেনবার্গের অধীনেই ন্যাস্ত রাখেন।

আবহাওয়ার পূর্বাভাষ

যেহেতু অভিযান শুরু করার জন্য মিত্রবাহিনীর অবতরণবান্ধব ভাটার প্রয়োজন ছিল, তাদের মূলত পূর্নচন্দ্রের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। সর্বাধিনায়ক আইজেনহাওয়ার মোটামুটি ভাবে ৫ জুন তারিখে অভিযান শুরু করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ৪ জুনে আবহাওয়ার যথেষ্ট অবনতি ঘটে যখন মহাসাগরে প্রচণ্ড বাতাস ও নিম্নচাপ বিদ্যমান ছিল। উপকূলের আকাশেও বিদ্যমান ছিল কম উচ্চতার মেঘ যার ফলে অভিযাত্রী বিমানগুলোর দৃষ্টিক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ এটি নিশ্চিত ছিল যে আর যাই হোক ৫ তারিখে কোন আঘাত হানা সম্ভব হবে না। এই উপলব্ধি থেকে জার্মান প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা অনেকটা নিশ্চিন্ত ভাবে দায়িত্ম পালন করছিল। কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এরূপ নিশ্চয়তার কারণে দায়িত্নে উপস্থিত ছিলেন না। স্বয়ং আরউইন রমেল তার স্ত্রীর জন্মদিন অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে অনুপস্থিত ছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে আইজেনহাওয়ারের প্রধান আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ গ্রুপ ক্যাপ্টেন জেমস স্ট্যাগ তার অধীনস্থদের হতে প্রাপ্ত তথ্য দেখে নিশ্চিত হন যে শীঘ্রই সামান্য সময়ের জন্য আবহাওয়ার উন্নতি ঘটবে। ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর একটি ক্যাপ্টেন ক্লাস ফ্রিগেট এইচএমএস গ্রিনডেল যেটি ১৯৪৪-এর এপ্রিল থেকেই মধ্য আটলান্টিকে মোতায়েন অবস্থায় ছিল ও দিনরাত মিলিয়ে তিন ঘণ্টা পরপর আবহাওয়ার বার্তা পাঠাচ্ছিল, এর দায়িত্মপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট এইচ আর কারি ৪ জুন তারিখে একটি জরুরি বার্তায় জানান যে তার তথ্য অনুযায়ী সামনেই অল্প ব্যাপ্তির একটি উচ্চচাপ রয়েছে। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার মাঝে এই তথ্য সামান্য সময়ের জন্য ভালো আবহাওয়াকে নির্দেশ করছিল। এই তথ্য পাবার পর ওভারলর্ডের নীতিনির্ধারকরা জরুরি বৈঠকে বসেন যাতে সিদ্ধান্ত হয় যে ভালো আবহাওয়া সুযোগে ৬ জুন তারিখেই আঘাত হানা হবে।

অভিযান

সৈকতসমূহ

চারবুর্গ

কান

অপারেশান কোবরা

সেইনে অপসারণ

রাজনৈতিক বিবেচনা

হতাহত

নরম্যান্ডি অভিযানের ভূমিকা

মন্তব্য

Footnotes
  1. Zetterling, p. 32: "On 25 July there were 812,000 US soldiers and 640,000 British in Normandy."
  2. Zetterling, p. 341: "By 21 August, the Allies had landed 2,052,299 men in Normandy."
  3. Zetterling, p. 32: "When Operation Cobra was launched, the Germans had brought to Normandy about 410,000 men in divisions and non-divisional combat units. If this is multiplied by 1.19 we arrive at approximately 490,000 soldiers. However, until 23 July, casualties amounted to 116,863, while only 10,078 replacements had arrived."
  4. Shulman, p. 192
  5. Wilmot, p. 434
  6. Ellis, p. 493
  7. Tamelander, M, Zetterling, N (2004), Avgörandes Ögonblick: Invasionen i Normandie. Norstedts Förlag, p. 341. এখানে মিত্র বিমানবাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও যোগ করতে হবে। মিত্র বিমানবাহিনী পুরো অভিযানে মোট ৪৮০,৩১৭ উড্ডয়ন করেছে যার ফলে এর কমপক্ষে ৪,১০১টি বিমান বিদ্ধস্ত হয়েছে ও ১৬,৬৯৬ সদস্য নিহত হয়েছেন।
  8. Tamelander, M, Zetterling, N (2004), Avgörandes Ögonblick: Invasionen i Normandie. Norstedts Förlag, p. 341. To these numbers should also be added the losses of the allied airforces operating. The allied airforces made 480,317 takeoffs in direct connection to the operation with the loss of no fewer than 4,101 planes and the lives of 16,696 crewmen. Thus total Allied casualties rises to 226,386 men.
  9. Tamelander, M, Zetterling, N (2004), Avgörandes Ögonblick: Invasionen i Normandie. Norstedts Förlag, p. 342. মিত্রবাহিনীর কমপক্ষে ৪০০০ ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যার অর্ধেকই ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর।
  10. Tamelander, pp. 342–343
  11. Beevor, A (2009), D-Day: The Battle for Normandy. Historiska Media, p. 555.
  12. Ambrose, Stephen (১৯৯৫)। D-Day June 6, 1944: The Climactic Battle of World War II। Simon & Schuster। 
  13. Churchill, Winston (১৯৪৮)। The Second World War book 5, Closing the Ring। Chapter 16, paragraph 1। 
  14. Gilbert, Martin (১৯৮৯)। Second World War। New York: H. Holt। পৃষ্ঠা 397, 478। আইএসবিএন 9-78-0805017885 
  15. Gilbert, Martin (১৯৮৯)। Second World War। পৃষ্ঠা 491। 
  16. Nigel Hamilton, Montgomery, Bernard Law, Oxford Dictionary of National Biography (2004)
  17. The World At War, episode 17, Morning। ১৯৭৪। event occurs at 2:29-3:09।  অজানা প্যারামিটার |person= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  18. Ambrose, Stephen (১৯৯৫)। D-Day June 6, 1944: The Climactic Battle of World War II। Simon & Schuster। Chapter 4 Paragraph 4। 
  19. Weinberg, Gerhard (১৯৯৫)। A world at arms - A global history of World War II। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 684। 
  20. "St. Pauls School biographies of famous pupils"। পৃষ্ঠা paragraph 4। ২০০৮-০১-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-০৩ 
  21. Weinberg, Gerhard (১৯৯৫)। A world at arms - A global history of World War II। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 698। 
  22. Gilbert, Martin (১৯৮৯)। The allied D-Day objective। পৃষ্ঠা 538। The allied D-Day objective-the vital communications centre at Caen 
  23. Bickers, Richard (১৯৯৪)। Air War NormandyPen And Sword Books। পৃষ্ঠা 19–21। আইএসবিএন 0-85052-412-1 
  24. Gilbert, Martin (১৯৮৯)। The Second World War। New York: H. Holt। পৃষ্ঠা 520। আইএসবিএন 9-78-0805017885 
  25. Keegan, John. The Second World War, p 279. আইএসবিএন ০-১৪-০১১৩৪১-X
  26. " আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে ইংল্যান্ড থেকে একটি সুবিশাল সৈন্যদল বিশাল অভিযানের জন্য রওনা হয়েছে ।"."Text of De Gaulle's message on D-Day" (Press release). SHAEF. 1944-06-06. Archived from the original on 26 December 2018. http://web.archive.org/web/20181226125131/http://worldatwar.net/article/overlord/%20। সংগৃহীত হয়েছে 2007-10-09.
  27. Keegan, John (১৯৯৭)। The Second World War। London: Pimlico। পৃষ্ঠা 309। আইএসবিএন 9-780712-673488 
বর্ণনা


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "nb" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="nb"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি